প্রস্তাব
ইশকুল বয়স। মনে হয় চোদ্দ। ক্লাস এইট। ইশকুলের পাঁচিল আর তাদের বাড়ির মধ্যে একটাই সরু পিচ রাস্তা। বাড়িটাও এই রাস্তার ওপরেই। দোতলায়, কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলো খুব বড় বড়। খড়খড়ি টেনে, তার ফাঁক দিয়ে এখান থেকেই যে সে রোজ আমাকে দেখে, তা আমি বেশ অনুমান করতে পারি। কী করে বুঝি! তা জানি না। বয়সে আমার থেকে বছর কয়েকের বড় বলেই আন্দাজ হয়। কিন্তু সে অনুপাতে চালচলনে একটু বেশিরকমই আত্মবিশ্বাসী। মাঝে মাঝে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, নিজেকে চেনাতে। চিনিয়েছে, মোড়ের আড্ডায় দাঁড়িয়েও চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে। এসবে আমল না দিলেও সামান্য কেঁপে, মাথা নিচু করে নিজের রাস্তায় চলে গিয়েছি বার বার। তাই তার দিক থেকে এগিয়ে এসে কথা বলা বা আলাপ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাকে আমি এভাবেই চিহ্নিত করেছিলাম তার ওই চকিত দেখায়। সুঠাম এবং রূপবান চেহারা। একমুখ নরম দাড়ি, কোঁকড়া চুল আর দৃপ্ত চোখ।
শনি রবিবারও ওই স্কুলে যেতাম, ছবি আঁকা শিখতে। সেদিন ক্লাস শেষ হলে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে, বাউন্ডারি পাঁচিলের কোনায় গিয়ে সেই গাছটার নীচে এসে দাড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু কমলা ফুল কুড়িয়ে নেব, যদি দু’একটা পাই! গাছটার নাম জানতাম না। ফুলগুলো এত সুন্দর যে মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে এনে পাত্রে সাজিয়ে স্টিল লাইফ আঁকতাম। কখনও স্কার্ট বা ফ্রকের ঘেরে ফেব্রিক পেইন্ট করলেও ওই ফুল। তখন আমার প্রিয় বই বা ডায়েরির ভাঁজেও পাওয়া যেত ওই শুকনো ফুল আর তার পাতা। পাতাগুলিও অন্যরকম সবুজ। গাঢ় নয়, হালকা।
সেদিন নাগালের মধ্যেই ছোট ছোট স্তবক দেখে, মাথা তুলে হাত বাড়াতেই ওদের জানলাটায় চোখ পড়েছিল। সেদিন আর খড়খড়ির আড়াল থেকে নয়। জানলাটা হাট খুলে, দু'হাতে দু'টো লোহার রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক অকপট মুগ্ধতায় স্নান করে। গায়ে ছিল সাদা পায়জামা আর গেঞ্জি। কোঁকড়া চুলগুলো ভিজে পাট পাট। তার সর্বাঙ্গে রবিবারের আরাম। জানলাটা মানুষের থেকেও লম্বা বলে তার পুরো শরীরটাই সেদিনও দেখা গিয়ছিল।
ফুলের ফাঁক দিয়ে তার চোখে আমার চোখ পড়তেই সে হাসল নিভৃতে। তার সেই নিজস্ব চাহনিতে কোনও সংকোচ নেই। আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। চোখ নামিয়ে ফুল-সমেত ডালটা ছেড়ে, মাথা নামিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিলাম দ্রুত। মায়ের ডিজাইনে বানানো কমলা রঙের আমব্রেলা কাটের সুতির ফ্রক পরা, আমার সেই টিংটিঙে শরীরে সে কী ভাললাগা! আর তার ওই চাহনিতে যেন বড় হয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি।
সে কি বুঝেছিল, হাসি ফিরিয়ে না দিলেও কতখানি সম্মতি ছিল আমার! অচেনা শিহরণে কত হাসি ঝরেছিল মনের গভীরে!
আজও জানি না যে কী ফুলের গাছ ছিল সেটা! রাস্তায় বা বাগানে ওই কমলা ফুলের গাছ দেখলেই এখনও তো কেঁপে উঠি। মনে পড়ে তার সেই নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা; অভ্যর্থনার উষ্ণ প্রকাশ; সপ্রতিভ হাসি।
আমার মন থেকে কোনওদিন কি মুছে যাবে তার সেই নির্ণিমেষ চাহনি…… প্রেমের প্রস্তাব!
The label is incorrect. This is not "godyo" . More like premer kabyo
ReplyDeleteখুব মূল্যবান আপনার এই মতামত।। এভাবে কমই পাঠকই অনুভব করেন। গল্পটা মুখ্য হয়ে ওঠে। আপনি নির্মাণ নিয়ে ভেবেছেন। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
Delete