‘সাদা নেগেটিভ’
যখন একটা কিছু বলার আগেই, শুরু হয়ে যায় গড়াগড়ি পেড়ে হাসি, তখনই বোঝা যায় যে আলোচনার বিষয়টা কী। গল্পের আভাসে জনা দুই হাসে, আর বাকিরা অবাক হয়ে দেখে। গল্পটা আর বলাই হয় না। বাড়ি, বা ইস্কুল বন্ধু, বা পাড়ার বন্ধুদের আড্ডা মানেই তাই। একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বড় হওয়া মানেই, সময়ের সিন্দুকে জমে থাকা হাসির রসদ। আমাদের দু-বোনের চাল চলনে মিলের থেকে অমিলটাই বেশি। কিন্তু এই এক ব্যাপারে দুজনেই সেই “ঘাড় কেন কাত?/ আরে, আমরা যে এক জাত!” এখানেই অব্যর্থ দুজনের সেই দুষ্টুমি ভরা চাহনি, যা আজ এই বাষট্টি এবং পঁয়ষট্টি পার করেও একেবারে এক এবং অবিকল।
এ বয়সে তো বেশিরভাগ জমায়েত মানেই শ্রাদ্ধ বা স্মরণ সভা; আর না হয়তো বা দিন পনের, কী মাস খানেক কাটিয়ে ছেলে মেয়েরা বিদেশে ফিরে যাবার আগে, একবার গণ দেখা করে নেওয়া। ফলে মন খারাপের ভাগটাই উপচে থাকে। সেখানেও দেখলাম প্রৌঢ়ত্ব পার করে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেও দু-বোনের সেই ফক্কড়িও হেসে কুটিপাটি হওয়ায় কোনও ব্যতিক্রম হল না। কেউ হয়তো গমগমে গলায় গান ধরে, গেয়েই চলেছে; থামার নামটি নেই, বোন ওমনি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে, টুক করে ভ্রূ নাচিয়ে দেবে, আর আমিও কুল কুল করে হাসতে শুরু করব। এই যে মস্করা চাহনি এর যেন শেষ নেই। সেটা যে কোন চরমে যেতে পারে তা সেদিন বুঝলাম। মাস দুয়েক আগে আমার একটা সার্জারি হয়েছে, আর বোন ছাড়া পেয়েছে সদ্য। আমার হাঁটু এবং ওর পেট সব নড়ে চড়ে গেছে; কাছের মানুষদের আতুপুতু এবং তয় তপ্পনের শেষ নেই। তার মধ্যে শুরু হল চমকদার ঈশারা এবং গড়াগড়ি পেড়ে হাসি। ভারি বয়স, ভারি শরীর সঙ্গে নানা রকমের মনভার; কোথায় কী! হেসেই চলেছি। আমাদের ছেলে মেয়েদুটোরও এ সব প্রসঙ্গ শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ; ওদের তেমন হাসিও তাই পায় না। কিন্তু আমরা দুর্নিবার গতিতে এমন হাসছি, যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েই চলেছে।
আর এও তো আশ্চর্য যে, সেই এক ঘনত্বের হাসি এবং একইরকম ইশারা। সেদিন খুবই গুরুগম্ভীর এক স্মরণ সভায় দুজনে গিয়েছি। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। সকলেরই মন ভার এবং বিশিষ্ট সঙ্গে সকলেই মার্জিত আচরণে বদ্ধপরিকর। তো একজন দেরিতে ঢোকায়, দরজা খুলতেই তাঁকে দেখা গেল, পূর্ণ আলোয়। আপাদমস্তক সাদা পোশাক এবং কলপহীন সাদায় মুখ মুন্ডল ঘেরায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, পরচুল মাথায় বিশেষ কোনও নাটকের চরিত্র যেন। ছায়াছন্ন অন্ধকারেও, পাশে বসে থাকা বোনের ঈশারাটি যেন কান দিয়েই দেখতে পালাম। দেখতে পেলাম, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তার হাসি চাপার চেষ্টা। সেই সংক্রমণে আমিও তখন ফুলে, ফেঁপে, দুলে একশা। ওই মানুষটিকে দেখে যত না হাসি পেয়েছিল, তার থেকে ঢের গুণ হাসি এল বোনের চোখ আর ভ্রূর ইশারায়; পাশাপাশি বসায়; কনুইয়ের গুঁতোগুঁতিতে। আমার কপট শাসন ওকে যেন আরও হাসাচ্ছে। এই যে দুজনের চাহনির ক্রশ কানেকশন– আসলে আমার কপট শাসন যেন ওর অন্তহীন মস্করার প্রশ্রয়, এর কোনও ব্যখ্যা আছে! গপ্পোও কিছু নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে দেখা মানুষটা আজ যখন হাসি উস্কে দিলেন, তখন তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা তাতে হাসি, তাঁকে আগেও যতবার দেখেছি তাতে হাসি; তাঁর এতদিনকার চলন, বলন, সাজ, গড়ন সব মুছে গিয়ে, ততক্ষনাৎ ফিস্ফিসিয়ে তাঁর নতুন নামকরণ হল– ‘এতো পুরো উল্টো নেগেটিভ রে– কালোর বদলে সবটাই সাদা’।
বুড়ো বয়সে অনেক কিছুর মতোই আর যা যা চেপে রাখা যায় না– তা হল চাহনি এবং কুলকুল করে বন্যার মতো হাসি।
আগের পর্ব
No comments:
Post a Comment