চোখে চোখ
চেনা মানুষকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু আহামরি কি! বিশেষত তাঁর সঙ্গে যদি প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ হয়; কারণ নিয়মিত কথা বলা ও সহাবস্থানের একটা নিজস্ব মেমরি বক্স থাকেই। যোগাযোগে থাকা মানুষ, ভিড়ের মধ্যেও তাই চট করে চোখে পড়ে যায়; মুখ না দেখেও, পিঠ ফিরিয়ে থাকা তার দেহ রেখাতেও চিনতে তাই ভুল হয় না। কিন্তু যে মানুষটির সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়েছে একবার বা বড় জোর দুবার, তাও প্রায় বছর দশেক আগে এবং তা আরও অনেকের মধ্যে, সেখানে নিকট বোধ গড়ে ওঠা বিস্ময়কর বৈকি। তা ছাড়াও মানুষটি এতোই বিশিষ্ট এবং আকাঙ্ক্ষিত যে, ওরকম গুচ্ছগুচ্ছ গুণগ্রাহী এবং রূপমুগ্ধদের সঙ্গে তাঁর প্রতিদিনই আলাপ পরিচয় হয়; ফলে আমাকে চেনা এবং মনে রাখা একেবারেই অসম্ভব; তা ছাড়াও তাঁর কোনও বৃত্ত মানে, কাজ বা পরিচিত গণ্ডি, কোথাওই আমি পড়ি না। ফলে আমার সেই চমকে ওঠার বিস্ময় ও বুক ধুক পুক আনন্দ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই আজও মন জুড়ে রাজত্ব করছে।
একটি স্মরণ সভার আমন্ত্রণ পেয়ে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় দেখি তাঁর নাম; লকডাউনের সময় ফেসবুক সক্রিয়তায় তাঁর সঙ্গে এক নিবিড় যোগাযোগ ঘটে। কবে বা কেন যে আমিও তার ‘ফ্রেন্ডস ওনলি’ বন্ধু গ্রুপে ধরা আছি, তা খেয়াল করিনি তেমন; কিন্তু লকডাউনে প্রতিদিন নিয়ম করে কবিতা পাঠ শুরু করলেন তিনি; একই সঙ্গে বাংলা কবিতা এবং তার ইংরেজি তর্জমা; আবার কখনও ইংরেজি তর্জমা সমেত অন্য ভাষার কবিতাও; তাঁর সেই জ্ঞান, প্রস্তুতি, নিষ্ঠা অনেকের সঙ্গে মুগ্ধ করেছে আমাকেও। লকডাউন শেষে সে সব পর্ব মিলিয়ে গেলেও, প্রায় বছর খানেক ধরে, ফেসবুকে প্রতিদিন দেখা হওয়ায় কেমন এক নিকট সান্নিধ্য গড়ে উঠেছিল; মনে হয়েছিল আলাপ পরিচয়ের মধ্যে কোনও দূরত্ব বা চ্ছেদ নেই যেন; দেখা হলেই কথা হবে, যেন বা এতটাই চেনা; কিন্তু সে তো আমার মনের ভাব; তাঁর মতো প্রথিতযশা মানুষটিরও যে এমনই মনে হবে, তা ভাবা বাতুলতা বৈকি! কিন্তু সেদিন তো তাইই ঘটল!
পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ, এবং প্রায়ান্ধকার; তাঁর আসবার অপেক্ষায় আমারা সকলে, কারণ তিনিই তো উদ্বোধক; সময়ের মিনিট তিনেক দেরিতে ঢুকতেই প্রবেশ দ্বারের আলো এসে পড়ল সামনের কয়েকটি সারিতে; আর হতবাক করে দিয়ে, তাঁর চশমা ঢাকা চোখেও উচ্ছ্বাস জাগিয়ে হাত নাড়লেন তিনি, দ্বিতীয় সারিতে বসা আমার দিকে সহজ তাকিয়ে! আমার দুপাশে বসা অতিথিরা আমাকে নজর করার আগেই লজ্জায় বা আনন্দে মাথা নামিয়ে নিলাম; ওই হাত নাড়া যেন আমার দিকে নয়; পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তাঁর চেনা মানুষের কী অভাব ঘটেছে! এটা বিশ্বাস করতে আমারও বেশ আরাম লাগল; কিন্তু মঞ্চে উঠে, নিজের চেয়ারে বসে এবার তিনি আরও ভাল করে মিলিয়ে নিলেন আমাকে; কোনও এক সময় ফেসবুকেই জানতে চেয়েছিলেন, আমার লেখা একটি বই সম্পর্কে; মানে কী ভাবে কোথায় পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি; ফলে, মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে ওই বইটি আমি সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, নিজে না পারলেও, কারও হাত দিয়ে ওইদিন ওঁর হাতে ঠিকই পৌঁছে দিতে পারব। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব সেরে, তিনি আবার যখন মঞ্চে এসে বসলেন, একজনকে অনুরোধ করামাত্র তিনি বইটি তাঁর হাতে দিয়ে এলেন। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের আগে চা পানের বিরতি হয়ে, আলো নিভলেই, চুপি সাড়ে বেরিয়ে এলাম, প্রেক্ষাগৃহ থেকে; পরদিন সকালে মোবাইল অন করতেই দেখি, ফেসবুকেই আমাকে লিখেছেন, ‘বই পেলাম, কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে প্রেক্ষাগৃহে ফিরে এসে, পরে আর তোমাকে দেখলাম না; তোমার সিটটা ফাঁকা…।’
তাঁর সেদিনের সেই চাহনি একথাই বুঝিয়ে দিল, আলো বা অন্ধকার যাই থাক না কেন– প্রাণে সাড়া জাগলে, সে তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে; আর বুঝিয়েও দেবে যে – এই তো, ঠিক দেখতে পেয়েছি! চাহনির এই সম্মোহনে শুধু চোখ নয়, দৃষ্টি নয় মনও কাজ করে; কাজ করে অন্তরঙ্গ যাপনের এক নিবিড় মাধুর্য; হয়তো সামান্য কিছু শূন্যতা বোধও। আর এই জন্যেই তা ভোলা যায় না; চিরকালের সম্পদ হয়ে রয়ে যায় মনের গভীরে।
আগের পর্ব
No comments:
Post a Comment