অরুণাভ রাহারায়ের কবিতা লেখার শুরু অল্প বয়স থেকেই। প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০১০-এ 'সবুজ পাতার মেঘ'। পরে 'দিনান্তের ভাষা' (২০১৫), 'খামখেয়ালি পাশবালিশ' (২০১৮)। এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে 'স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়'।
নাম থেকেই বোঝা যায় বইটির কবিতায় আছে প্রণয়প্রসঙ্গ, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন ইত্যাদির অনুষঙ্গ। একুশ শতকের নতুন কালের ভাষায় একটু অন্যরকম ভাবে সহজ ভাষায় মনের গভীরে ডুব দেওয়া, আবার ভেসে ওঠা। স্নিজার সঙ্গে থাকাটা একটা উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু আসল কথাটা বলার চেষ্টা, নিজের কবিসত্তার এক অভিনব উন্মোচন!
আমরা 'আধুনিক' কবিতা আর বলি না। আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন প্রয়াসে এবং প্রশ্রয়ে তিরিশের দশকে (বিশ শতক) যে কবিকুলের একটু অন্যরকম কবিতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে, তাদের মধ্যে আপাত বিচারে ভাষার দিক থেকে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী কিছুটা সহজ ভাষার পথিক। আবার ভাষার জটিলতায় চিহ্নিত বিষ্ণু দে (পরে অবশ্য সহজপন্থী), কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর রাজকীয় মহিমায় থেকে গেলেন, তৎসম শব্দের খাঁচায় তৈরি কবিতার রহস্যময় প্রাসাদে। সেই যুগের আধুনিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল বিরোধ-ঐক্যের। তবে একুশ শতকের কবিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ আছেন দূরে, নিজস্ব মহিমায়।
এখন আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিরোধ নয়, ঐক্যও নয়, তাঁকে অস্বীকারও নয়, বরং কিছুটা উদাসীনতা, আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনেকের আগ্রহ প্রতিফলিত অক্ষরবিন্যাসে। এক সময় বাংলা কবিতায় প্রেম ও রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কয়েকজন কবি। সমর সেন 'জন্মদিনে' কবিতায় লেখেন: 'রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়'। তবু কাল থেকে কালান্তর রোমান্টিকতা নতুন পোশাকে ফিরে আসে পৃথিবীতে। ব্রায়ান প্যাটেন (জন্ম ১৯৪৬) ইংরেজ কবি, তিনি সচেতনভাবে কবিতায় আবার রোমান্টিকতাকে ফিরিয়ে আনতে চান। 'কবিতা ব্যক্তিগত বিষয়'-- এই তাঁর ধারণা। রোমান্টিকতা বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়-- 'আশাতীতের নিরন্তর প্রত্যাশা'। সেই জন্যই কি এ কালের এক কবি জোড়াসাঁকোয়?
অরুণাভ রাহারায়ের নতুন কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবি একটু অন্যরকম ভাবে ভাষা ও শব্দের তৎসম ও জটিল বিন্যাস পরিহার করেছেন। কবিতার মধ্যে ছন্দকেও ব্যবহার করেছেন খুব সহজ স্বচ্ছ কথ্য ভাষায়। মাঝে মাঝে মনে হবে আপনমনের কথাবলা, স্নিজার সঙ্গে নানা পরিবেশ, পরিস্থিতিতে দেখা হওয়া, তার শরীরী বা অ-শরীরী ভাবগত অস্তিত্বকে অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে যেন নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। আপাত সহজ সারল্যের ভেতর দিয়ে কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও শান্তিনিকেতন, কখনও জোড়াসাঁকো, কখনও প্রেম আবার কখনও-বা ছায়াময় দার্শনিক রহস্যময়তায় প্রস্থান। প্রচ্ছন্ন নাটকীয়তা কোনও কোনও কবিতাকে ছুঁয়ে আছে।
'ডানা' কবিতায় ছ'টি লাইন। শেষ দুটির মিল:
'চাঁদের শরীরে শুধু গান ভেসে, ভেসে চলে সুর
যেভাবে ছাদের তারে মেলে দাও কবিতা প্রচুর...'
কবিতার মধ্যে আসে গানের কথা। 'গানে গানে স্বরলিপি'-র আরম্ভ: 'তোমার পিসির গান আমার দিদির খুব প্রিয়', শেষে আছে 'অথচ তোমার গান আমাকে ছুঁয়েছে'। 'স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়' কবিতাটি রোমান্টিকতার মধ্যেও বাস্তবতার ছোঁয়া এনে দেয়। 'শ্রাবণে আঘাত আসে আমেরিকা থেকে
বরং তোমার সঙ্গে মনে মনে জোড়াসাঁকো ঘুরি...'
পরের কবিতাটির নাম 'ধন্যবাদ স্নিজা দাশগুপ্ত'। 'ঋণ' কুড়ি লাইনের কবিতা:
'আমরা থেকে যাব কাব্যে কবিতায়
আমার বেড়ে যাবে অনেক ঋণ'
পরের কবিতা 'বোধি'-তে লেখা হয় 'বোধিজন্ম লাভ হয় জলের কোলাজে'। ঘুরে ফিরে আসে স্নিজার সঙ্গে কবিতায় কথাবলা। নিজের সঙ্গে সংগোপনে কবিতায় নানা কথাবলা। যেখানে 'বিস্ময়' কবিতায় কবির কথা: 'এতটা প্রেমিকা তুমি। কবিতা এতটা'। কবিতাগুলোয় সর্বত্র স্নিজা নেই, তবু থেকে যায় একটু অদ্ভুত রহস্যময়তার অনুভূতি। তাই সে 'নিঃশব্দ প্রেমিকা'। 'বেড়াল', 'দাশগুপ্ত সন্ধ্যা', 'সাংবাদিকা', 'অ্যাসাইনমেন্ট', 'স্বরলিপি কাব্য', 'হৃদকমলে রাখব', 'বিদুষীবালা', 'একজন্মেই জাতিস্মর', 'বইমেলা' পরপর নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি, কিন্তু হঠাৎ অন্যরকম 'টাইম-স্পেসের জার্নাল', 'দুই বাংলা'।
একেবারেই অন্যরকম একটি কবিতা 'কোকোরো কবিতাসন্ধ্যা' শুরু হয় 'শান্তিনিকেতনের ভেতর একটা আশ্চর্য জাপান আছে। সেই জাপানের নাম কোকোরো'। নিছক গদ্যে লেখা একটি আশ্চর্য ছবি, আসলে একটা বাড়ি, যা কবিতা-ছবি-অনুভূতি মিলে তৈরি হয় কবিতার মতন এক বাড়ি।
খুব সাধারণ ভাষায়, খুব সহজ ছন্দের পয়ার ধাঁচে কবিতা কখন যেন আমাদের নিয়ে যায় চৈতন্যের গভীরে, চেতন থেকে অবচেতনায়, চিত্রকল্পের রহস্যলোকে, বর্তমান থেকে অতীতে। শুনতে পাই কবিতা:
'অরণ্যে দাঁড়িয়ে আছে গাছের শিরদাঁড়া' (গন্তব্য)
'ঝুমুর তালের মতো দুলে
দুলে গালগুলো ফিরে এল' (ভোর)
'আমাদের মধ্যখানে ঢুকে গেছে দু'জন মানুষ
আশ্চর্য চাঁদের রাতে অবান্তর তারা' (চিত্রকর)
শেষ কবিতায় থেমে যায় কথোপকথন। এতক্ষণ যা ছিল অনেকটা আত্মকথন, সেখানে পাঠক ছিল নিছক পাঠক ও শ্রোতা। 'আঁচ' কবিতায় শেষ কথা:
'তোমার দাঁড়ানো দেখে ভয় পাই খুব
হৃদয়ে প্রচুর কথা তবু থাকি চুপ'।
অনেক দিন পরে আন্তরিক কিছু রোমান্টিক প্রেমের কবিতা পড়ে আবার মনে হয়েছে:
'এভাবে ধাক্কা দিলে কত কি যে হয়
ছায়ারা আগুনে নেভে, কবিতার জয়'
পেপারব্যাক বইটির ছাপা খুব ভাল। প্রচ্ছদ করেছেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন। প্রচ্ছদের ভেতরেও কবিতার সংকেতভাষণ।
---------------------------------------------------------
স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়/ অরুণাভ রাহারায়/ ভাষালিপি/ প্রচ্ছদ: শুভাপ্রসন্ন/ ৮০ টাকা
No comments:
Post a Comment