Sunday, February 6, 2022

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | চতুর্থ পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”

১৪

আবার আমি কয়েক দিনের জন্য লস এঞ্জেলসে ফিরে গেলাম এডিটিংয়ের কাজে। দ্বিতীয় দিনে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আলো নিভিয়ে দিতেই একটা প্রচণ্ড ভয় আমায় চেপে ধরল, এই বুঝি মাঝরাতে ফোন বেজে উঠবে। আর ঠিক সেটাই ঘটল। ফোনের অপর প্রান্তে ভায়ের গলা শুনতে পেলাম, সচেতনভাবে শান্ত থাকার চেষ্টা রয়েছে সেই স্বরে।

-হ্যালো, বাবার খুব জ্বর। ডাক্তার বলছেন তোমার এখুনি ফিরে আসাই ভালো।

ফোন রেখে ফোনেই পরের দিন ভোরের একটা টিকিট বুক করলাম। তারপর সেই অন্ধকারের মধ্যে সারারাত জেগে শুয়ে আছি। বুকের মধ্যে এক প্রবল কষ্টের অনুভূতি, ভায়ের জন্য, মায়ের জন্য এবং নিজের জন্যও। আমরা মানে আমি আর আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, মেহিকো আর স্পেনে বড় হয়ে উঠছি আর বাবা-মা দুজনের পরিবারের অন্যান্য সবাই থাকতেন কলোম্বিয়ায়, তখন আমরা যেন ছিলাম একটা ছোট্ট দল, একটা ক্লাবের মতো। সেই ক্লাবের প্রথম সদস্য এখন চলে যাওয়ার পথে। সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না।

পরের দিন প্লেনের মধ্যে বসে মুহূর্তের জন্য আমি মনে করতে পারছিলাম না আমি ঠিক কোথায় যাচ্ছি, মেহিকোর দিকে যাচ্ছি নাকি মেহিকো থেকে ফিরছি। এমনই ছিল শেষের সেই দিনগুলোর বিভ্রান্তি। বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশনের কাজ ও মালপত্র সংগ্রহের মধ্যে এক ফাঁকে ভাইকে ফোন করলাম।

-আমাদের হাতে আর ২৪ ঘণ্টা সময়ও নেই, সে বলল।

“আর মাস দুয়েক” থেকে “বড় জোর কয়েক সপ্তাহ”, সেখান থেকে “মাত্র ২৪ ঘণ্টা”-য় কিভাবে চলে এলাম আমরা? অসংখ্য নার্স, শল্যচিকিৎসক, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, ফুসফুস বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের প্রধান ও বার্ধক্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অগণিত কথোপকথনের পর, যাঁরা এতদিন কোনও কিছুই লুকিয়ে যাননি, তাঁদের এই নতুন ঘোষণার দৃঢ়তা যে কী নিষ্ঠুর! বাবার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অবশ্য সমস্ত কিছু নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করে দিয়েছিলেন, কি কি করা সম্ভব আর সম্ভাবনাই বা কী। এবার আমরা একটা নিশ্চিত জায়গায় এসে পৌঁছলাম। তবুও, যে নিশ্চয়তার সঙ্গে তাঁরা বলছেন যে আর একটা মাত্র দিন মাত্র বাকি, তা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও হিসাবও তো সামনে নেই। দুটো কিডনিই কাজ করছে না, রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, তা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া একসময় বন্ধ করে দেবে। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাপ্তি যেভাবে ঘটেছে, বাবা তাদেরই অনুসরণ করছেন। এই যে জীবন, সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বয়ে চলেছে, আজও তা একই রকমভাবে অনিশ্চিত রয়ে গেছে। শুধু মৃত্যু যখন শিয়রে এসে দাঁড়ায়, সে কাউকে নিরাশ করে না। 

মালপত্রের বেল্টের দিকে যেতে যেতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, নিজেকে মনে হল ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা ও ১০৯ কেজি ওজনের স্কুলে পড়া ছোট্ট একটি লাজুক বালক। 

১৫

দিনের বেলার নার্সকে বললাম, বাবার মধ্যে সামান্যতম কোনও পরিবর্তন বা সেরকম কোনও লক্ষণ দেখলে, যা শেষের সেই ক্ষণের ইঙ্গিত বলে মনে হবে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাকে ডাকেন। তার সঙ্গে অবশ্য এও বললাম যে এটা কোনও নির্দেশ নয়, যদি কিছু লক্ষ্য করেন, তাহলে আমাকে জানালে আমি বাধিত হব। আমার ভায়ের স্ত্রী ও তার ছেলেমেয়েরা প্যারিস থেকে রওনা দিয়েছে আর আমার স্ত্রী ও মেয়েরা পরের দিন সকালের প্লেনে আসবে।

সেদিন দুপুরে, মা খাবার খেয়ে একটু ঘুমচ্ছেন, আমি বাবার পড়ার ঘরে বসে খুটখাট কাজ করছিলাম, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, মনে হল সব কিছু কী অদ্ভুত শান্ত! বাগানে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। অবাক হয়ে দেখলাম এই বাড়িরই উপরের একটা ঘরে একজন মানুষের জীবন নিভে আসছে, কিন্তু তার জন্য কোথাও বিন্দুমাত্র কোনও বিচলন নেই।

এই বাড়িটি যে লোকালয়ে অবস্থিত তা তৈরি করেছিলেন স্থপতি লুইস বারাগান, চার-পাঁচের দশকে। প্রাথমিকভাবে বাড়িগুলো ছিল মর্ডানিস্ট স্টাইলের, কিন্তু পরবর্তীতে, সাত-আটের দশকে, যে বিরাট বড় বড় বাড়ি তৈরি হয় তার স্থাপত্যশৈলীর যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাবা কোনোদিনই এই জায়গাটার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু একটা বাড়ি খুঁজে পেলেন, ব্যতিক্রমী স্থপতি মানুয়েল পাররার তৈরি। তিনি নিজস্ব একটা স্টাইল উদ্ভাবন করেছিলেন: ঔপনিবেশিক মেহিকো, স্পেনীয় এবং মূর স্টাইলের একটি সংমিশ্রণ। পুরোন বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে দরজা, জানলার ফ্রেম ও পাথরের কাজ সংগ্রহ করে নতুন বাড়ির অঙ্গীভূত করতেন। ফলে অন্যান্য যা উপাদানই ব্যবহার করা হোক না কেন বাড়ির একটা নিজস্বতা তৈরি হত, তাতে সঞ্চারিত হত মানবিক উত্তাপ। বাবা সবসময় তাঁর প্রশংসা করতেন এবং প্রতিবেশী আধুনিকমনস্ক বুদ্ধিজীবী ও শ্বেত পাথরের বিরাট বিরাট সব প্রাসাদের মাঝখানে এই বাড়িতে বাস করাটা বেশ উপভোগ করতেন।

মনে আছে ছোটবেলায় বাগানে ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতাম। এই বাগানটাকে তখন কী ভালোই না লাগত! (এমনকি সেই বয়সেও বুঝতে পারতাম যে বাচ্চাদের ভালো লাগার জায়গাগুলো সবসময় যে বাস্তবে খুব আকর্ষণীয় হবে এমনটা নয়।) এই জায়গাটা থেকে সন্ধ্যা নেমে আসা দেখার অনুভূতিটা ছিল অসাধারণ। মেহিকোর রাজধানীতে যাঁরা বাস করেন তাঁরা জানেন যে প্রায়শই এখানে অভূতপূর্ব সন্ধ্যা নামে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কখনো কখনো, বৃষ্টির পর, বাতাস হয়ে ওঠে সজীবস্বচ্ছ আর তাতে থাকে অপূর্ব এক সুবাস। দূরে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আহুস্কো আগ্নেয়গিরি আর হঠাৎই গোটা শহরের উপর নেমে আসে শান্তির আস্তরণ। তখন আর মনে হবে না যে একটা দূষণে ভরা, হট্টগোলে আকীর্ণ এক বৃহৎ নগরে আমরা বাস করছি, বরং অনেক আগে যেমন ছিল, সেই মায়াময় এক সুন্দরী উপত্যকায় থাকার অনুভূতি ঘন হয়ে আসবে মনে এবং মুহূর্তের জন্য নস্টালজিয়ার পাশাপাশি এক গভীর আশার সঞ্চার ঘটবে। আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল এই বাগানে, এক সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে। অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টা খানেক পরে প্রচণ্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আছড়ে পড়ে। কিন্তু আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস, সেটা ছিল শুভ লক্ষণ। এটাও ঠিক যে ওরা তিরিশ বছর ধরে সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করে আসছে।

এই বাগানেই বাবার ৭০ বছরের জন্মদিনের উৎসব হয়েছিল। তিনি ঠিক করেছিলেন শুধু তাঁর সমবয়সী মানুষদের নিমন্ত্রণ করবেন। তাঁর চেয়ে ছোট কিছু বন্ধু-বান্ধব খুবই ক্ষুব্ধ হন এতে, সেকথা তাঁর গোচরেও আনেন। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন; তাঁর মতে এই দীর্ঘ জীবনের সমস্ত পরিচিত বা কাছের মানুষদের এই বাড়িতে ধরানো সম্ভব নয়, তাই শুধুমাত্র তাঁর বয়সী মানুষদেরই ডাকা হবে। তবে মনে মনে দুঃখ পেয়েছিলেন, অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য।

বাড়ির একতলাতে ছিলাম আমি। দুপুরের খাওয়ার পর রান্নাঘর পরিষ্কার করলাম। বসার ঘরটা ঠিক যেমন ছিল তেমনই আছে। তবে একেবারে নিশ্চিত করে সেকথা বলা যায় না, কারণ ঘরের আসবাবপত্র, সংগৃহীত প্রতিটি শিল্পকর্ম ও অগণিত ছোটখাটো জিনিষ সেখানে জড়ো হয়েছে দশকের পর দশক ধরে আর সেগুলো একসঙ্গে মিলে তৈরি করেছে এক অনির্দিষ্ট নতুনত্ব, আবার তার সঙ্গে রয়েছে প্রাচীনত্বের আভাসও। ওদের মধ্যে কিছু জিনিষ কবে যে আনা হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব। বেশ পুরোন ছোট্ট একটা পাথরের তৈরি জিনিষ আছে, অনেকটা ফুলের মতো দেখতে, যার পাপড়িগুলো ছুরির মতো ধারালো। এটা আছে আটের দশকের গোড়া থেকে। রাফায়েল আলবের্তির হাতে লেখা একটা কবিতা আছে সাতের দশক থেকে - ৪০ বছর নির্বাসনে থাকার পর যখন তিনি মাদ্রিদে ফিরে যান তার পর। আরও আছে আলেখান্দ্রো ওব্রেগোনের একটি আত্মপ্রতিকৃতি, যার মধ্যে গুলির গর্ত হয়ে আছে (এক রাতে মদ্যপ অবস্থায় প্রচণ্ড রেগে গিয়ে শিল্পী রিভলভার দিয়ে নিজের ছবির চোখে গুলি করেন, কারণ তাঁর পরিণত বয়স্ক ছেলেরা ওই ছবির দখলদারি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছিল) এবং লার্তিগের একটি ফটোগ্রাফির বই, যেটা সেই বারো বছর বয়স থেকে দেখে আসছি।

প্রায় ২৫ বছর যাবত বাড়িতে একটা টিয়াপাখি ছিল। বিকেলবেলায়, যখন কোনও একটা দরজা বন্ধ করা হত বা টেলিফোন বাজত, কখনো কখনো সে অদৃশ্য এক সুন্দরী তরুণীর উদ্দেশ্যে শিস দিত। তারপর, এই কাজটা করতে গিয়ে এত পরিশ্রম হয়ে যেত যে বাকি দিনটা নিঃশব্দে বিশ্রাম করত। আমরা সবাই যে তার প্রতি খুব মনোযোগী ছিলাম, এমনটা নয়; কিন্তু তার মৃত্যুর পর সকলেই খুব কাতর হয়ে পড়েছিলাম।

১৬

সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাবার ঘরের কাছে গেলাম। ভেতরে দেখলাম দিনের বেলার নার্সটি কিছু লিখছেন আর তাঁর সাহায্যকারিণী একটা পত্রিকা পড়ছেন। বাবা একদম শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন, দেখে মনে হবে বুঝি ঘুমচ্ছেন। কিন্তু বাড়ির মধ্যে এই ঘরটাকে মনে হচ্ছে যেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আশপাশের সবকিছু ধীর, অচঞ্চল হলেও সময় সেখানে ঘোড়ায় জিন দিয়ে ছুটে চলেছে, এই মুহূর্ত থেকে পরের মুহূর্তে পৌঁছতে তার সে কী ভীষণ ব্যস্ততা! সে যেন আর নিয়মের অধীন নয়।

খাটের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছিলাম। কী চেহারা হয়ে গেছে! মনে হল আমি শুধু তাঁর ছেলে নই, সেই ছোট্ট খোকাটি শুধু নই আর, একই সঙ্গে তাঁর পিতাও। বেশ ভালো করেই জানি যে তাঁর দীর্ঘ সাতাশি বছরের বিস্তৃত জীবনের কথা আমি বলছি। তার সূচনা, মধ্যগতি এবং সমাপ্তি – এখন আমার সামনে এবং তা থেকে বাচ্চাদের অ্যাকর্ডিয়ান বইয়ের মতো একটার পর একটা পাতা খুলে যাচ্ছে।

একজন মানুষের অন্তিম পরিণতি জেনে গেলে উৎকণ্ঠায় ভরে ওঠে মন। আমার জন্মের আগের যেসব কাহিনী, তা অবশ্যই ছিল বাবা, মা, কাকাদের বলা গল্প বা আত্মীয়, বন্ধু, সাংবাদিক, জীবনীকারদের পুনরাবৃত্তির এক মিশ্রণ এবং আমার কল্পনাশক্তি তাকে আরও নানা রঙে রঙিন করে তুলেছিল। বাবার বয়স যখন মেরেকেটে ছয়, একটা ফুটবল দলে গোলরক্ষক হিসেবে খেলতেন। তাঁর ধারণা ছিল যে তিনি বেশ ভালোই খেলতেন, সাধারণের চেয়েও ভালো এবং খুব গর্ববোধ করতেন তাই নিয়ে। এর দু’-এক বছর পরে উপযুক্ত চশমা ছাড়া সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন বলে তাঁর বাঁ চোখের মাঝখানের দৃষ্টি চলে যায়। একদিন তাঁর দাদুর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কয়েকজন মানুষ একটা লোকের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর ওই মৃত ব্যক্তির স্ত্রী পেছন পেছন হাঁটছে, সে একহাতে একটা বাচ্চাকে ধরে আছে ও অন্য হাতে মৃত স্বামীর ঝুলে থাকা মাথাটা। তিনি নিজের ভাগের জেলির মধ্যে থুতু ফেলে এবং জুতোর মধ্যে কলাভাজা রেখে খেতেন যাতে ছোট ছোট অসংখ্য ভাইবোন তাঁর সেই খাবার কেড়ে খেতে না পারে। কৈশোরকালে মাগদালেনা নদী দিয়ে যাওয়ার সময় একবার প্রবল একাকীত্ব অনুভব করেছিলেন। প্যারিসে থাকার সময় একদিন দুপুরে এক মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং কথা বলতে বলতে অকারণ দেরি করতে থাকেন যাতে ওই মহিলা তাঁকে খেয়ে যেতে বলেন, কারণ ওনার কাছে তখন একটা পয়সাও ছিল না আর কয়েকদিন ধরে খেতে পাননি কিছুই। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সেখান থেকে বেরিয়ে ওই মহিলার বাড়িরই রাখা জঞ্জাল ঘেঁটে যা পেয়েছিলেন, তাই খেয়েছিলেন। (আমার যখন পনের বছর বয়স বাবা এই গল্পটা আমার সামনেই অন্যদের বলছিলেন আর কী লজ্জা যে করছিল আমার।) প্যারিসে সেই সময় ছিলেন চিলের এক নিঃসঙ্গ তরুণী বিয়োলেতা পাররা। সেখানে থাকা দেশছাড়া লাতিন আমেরিকার মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই তাঁর সঙ্গে দেখা হত বাবার। তিনি লেখালেখি করতেন এবং অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী গান গাইতেন। অনেক বছর পরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ১৯৬৬ সালের এক বিকেলে, মেহিকোর এই রাজধানী শহরে, বাড়ির দোতলায় উঠে মা যেখানে খাটের উপর শুয়ে ছিলেন, সেখানে গিয়ে বললেন, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুর কথা লেখা শেষ হল।

-কর্নেলকে মেরে ফেললাম, তিনি বললেন, তিনি তখন সান্ত্বনার অতীত।

মা বুঝতেন বাবার কাছে এর অর্থ কতখানি। দুজনে দীর্ঘক্ষণ, একসঙ্গে, নিঃশব্দে বসে রইলেন।

একথা ঠিক যে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সাহিত্যিক জনপ্রিয়তার শিখরে অবস্থান করেছিলেন, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সামাজিক প্রতিপত্তিও অর্জন করেছিলেন যথেষ্ট, কিন্তু তারই পাশাপাশি কিছু দিন গেছে বড় বেদনার। একদিকে যেমন ৪৬ বছর বয়সে আলবারো সেপেদার মৃত্যু, ড্রাগ-মাফিয়াদের দ্বারা ৬১ বছরের সাংবাদিক গিয়েরমো কানোর হত্যা ও তাঁর সবচেয়ে ছোট দুই ভাইয়ের মৃত্যু, অন্যদিকে তেমন খ্যাতির একাকীত্ব, স্মৃতিভ্রংশ ও তার ফলে লিখতে না পারা। একেবারে শেষের দিকে, তাঁর নিজের লেখা বই প্রকাশিত হওয়ার পর সেই প্রথম পড়তে শুরু করলেন এবং যেন প্রথমবার গল্পটা পড়ছেন এমনভাবে আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন চুলো থেকে এসব বেরিয়েছে?” বইগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে গেলেন, এক একবার মনে হচ্ছিল প্রচ্ছদটা যেন তাঁর চেনা, কিন্তু বিষয়বস্তু বিশেষ বুঝতে পারছিলেন না। কখনো কখনো বইটা বন্ধ করার পর পিছনের পাতায় নিজের ছবি দেখে এমন চমকে উঠতেন যে আবার বইটা ফিরে পড়ার চেষ্টা করতেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল যে ডিমেন্সিয়া সত্ত্বেও (এবং সম্ভবত মরফিনের প্রভাব সত্ত্বেও) এখনো পর্যন্ত তাঁর মস্তিষ্ক ঠিক তেমনই সৃজনশীলতায় পরিপূর্ণ, যেমনটা ছিল সারাজীবন। হয়তো খানিক ক্ষত তৈরি হয়েছে, তাই পুরোন চিন্তাভাবনায় ফিরতে পারছেন না বা যুক্তির শৃঙ্খলা বজায় থাকছে না, কিন্তু এখনো সক্রিয় আছে। সর্বদাই তাঁর কল্পনাশক্তিতে ছিল প্রতিভার অভূতপূর্ব স্ফুরণ। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ছয় প্রজন্ম নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’। অবশ্য আরও দুই প্রজন্মের সমস্ত উপাদান তাঁর কাছে সঞ্চিত ছিল। কিন্তু উপন্যাসটি অনেক বেশি বড় ও ক্লান্তিকর হয়ে যাবে এই ভয়ে তা বাদ দেন। বাবা মনে করতেন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা হল একটি উপন্যাস লেখার প্রধান স্তম্ভগুলির একটি, বিশেষ করে গল্পের কাঠামো ও তার সীমানা প্রস্তুত করার জন্য। যাঁরা মনে করতেন যে উপন্যাসের গঠনশৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশি স্বাধীনতা পাওয়া যায় এবং সেই কারণে সিনেমার চিত্রনাট্য বা একটি গল্প লেখার থেকে উপন্যাস লেখা অনেক বেশি সহজ, তিনি তাঁদের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি বলতেন যে একজন ঔপন্যাসিককে অবশ্যই তার যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করে নিতে হবে, যাতে ‘উপন্যাসের চোরাবালিতে’ হারিয়ে না যান।

১৯২৭ সালে আরাকাতাকা থেকে ২০১৪ সালে মেহিকো শহরে আজকের এই দিন – এক দীর্ঘ ও ব্যতিক্রমী যাত্রা, সমাধি প্রস্তরের উপর শুধু ওই তারিখদুটো দিয়ে যাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা নিতান্তই বৃথা। আমার মতে, লাতিন আমেরিকার প্রায় কোনও মানুষই এরকম বিশেষত্ব ও সৌভাগ্যপূর্ণ জীবন যাপন করেননি। যাঁরা একথা মেনে নিতে পারেন বলে আমার মনে হয়, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে যিনি থাকতেন, তিনি আমার বাবা। 


আগের পর্ব


গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | তৃতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment