Tuesday, May 31, 2022

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | ৫ম পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”

১৭

মঙ্গলবারের রাত কাটল এক অস্থির ঘুমের মধ্যে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল এই বুঝি দরজায় কেউ টোকা দেবে আর বলবে বাবা চলে গেছেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙতেই তাঁর ঘরে গেলাম। নার্স বললেন যে বাবা সারা রাত একবারও নড়াচড়া করেননি। কাল শেষবার তাঁকে যেভাবে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, এখনও ঠিক সেভাবেই শুয়ে আছেন আর এত ধীরে শ্বাস নিচ্ছেন যে বোঝাই যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবলাম, নার্সেরা কি এখনও পর্যন্ত ওঁর হাত-পা সঞ্চালন করিয়ে দেন, বেড সোর এড়াতে এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে শোয়ান, না কি এখন এসবের অনেক উর্দ্ধে চলে গেছেন। স্নান ক’রে, পোশাক প’রে আবার তাঁর ঘরে গেলাম। ঘরের ভেতরে, ভোরের আলোয়, শুয়ে আছে যেন এক অন্য মানুষ, যেন তাঁর এক যমজ ভাই, যে অতি সাধারণ, কৃশ, গায়ের চামরা স্বচ্ছ, যাকে আমি ভালো করে চিনিনা পর্যন্ত। এই মানুষটার সঙ্গে যেন আমার অন্য কিছু সম্পর্ক, অনেক দূরের কেউ একজন। হতে পারে এটাই পরিবর্তনের ইশারা, এভাবেই বিচ্ছেদকে সহজ করে দেওয়া, ঠিক যেমনভাবে সদ্যজাত শিশুর দিকে একবার তাকালেই মুহূর্তের মধ্যে অন্তর স্নেহের সিঞ্চনে ভরে ওঠে।

রান্নাঘরে গিয়ে টেবিলে একা বসলাম। সেখানে ছিলেন আমাদের রাঁধুনি, বহু দিন ধরে মাঝে মাঝেই তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর দৃঢ় চরিত্রের জন্য বাবার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁকেও খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল। একবার আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাবাকে দেখতে গেলেন, যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, ‘দেখি, যদি কিছু দরকার লাগে।’

জলখাবার খাওয়ার পর শুনতে পেলাম বাবার ঘর থেকে ভেসে আসা বাইয়েনাতোর[১] সুর। এটি তাঁর সবচেয়ে পছন্দের সঙ্গীত। চেম্বার মিউসিক বা ল্যাটিন ব্যালাডের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কিছু সময় কাটালেও শেষ পর্যন্ত এই বাইয়েনাতোর কাছেই ফিরে ফিরে আসতেন। তাঁর স্মৃতিভ্রংশতা বেড়ে যাওয়ার পরেও স্পেনের স্বর্ণযুগের কোনো কবিতার প্রথম লাইনটা কেউ বলে দিলে বাকিটা আবৃত্তি করতে পারতেন। পরে যখন সেই ক্ষমতা চলে গেল, তখনও তাঁর প্রিয় গানগুলো গাইতে পারতেন। যেখানে তিনি জন্মেছিলেন সেখানকার একান্ত নিজস্ব সঙ্গীত এই বাইয়েনাতো। তাই, জীবনের একেবারে শেষের কয়েকটা মাসে, যখন নিতান্ত প্রয়োজনের জিনিষটাও আর মনে করতে পারতেন না, অ্যাকর্ডিয়ানের সুর শুনলেই আবেগে তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তাঁর সেক্রেটারি অনেকগুলো বাইয়েনাতোর সংকলন চালিয়ে দিতেন আর তিনি পড়ার ঘরে বসে মনের আনন্দে নিজেকে আবদ্ধ করে নিতেন সময়ের একটা সুরঙ্গের মধ্যে। তাই শেষ দু’দিন ধরে তাঁর ঘরের সমস্ত জানলা হাট করে খুলে দিয়ে নার্সরা খুব জোরে বাইয়েনাতো চালিয়ে রেখেছিলেন। সেই সুরে ভেসে যাচ্ছিল সারা বাড়ি। তার মধ্যে কয়েকটা বাইয়েনাতোর গীতিকার ও সুরকার তাঁর কোম্পাদ্রে[২] রাফায়েল এস্কালোনা। এই সময়ে ওই গানগুলো আমার স্মৃতিকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। এই সঙ্গীত ছাড়া আর কোনো কিছুই আমাকে এতখানি স্মৃতিতাড়িত করতে পারত না। আমাকে বাবার জীবনের অতীতে নিয়ে যাচ্ছে, সেই জীবনের পথ বেয়ে আমি ভ্রমণ করছি আর তারপর ফিরে আসছি বর্তমানে, যেখানে বেজে চলেছে সর্বশেষ ঘুম পাড়ানি গান।

সঙ্গীত রচয়িতাদের বাবা যেমন শ্রদ্ধা করতেন, তেমন ঈর্ষাও করতেন; কত কম কথায় কত সুন্দর করে অনেক কথা বলার জন্য। ‘কলেরার সময়ে প্রেম’ উপন্যাস লেখার সময় তিনি নিয়ম করে একটানা শুনে যেতেন ব্যর্থ ও অনুচ্চারিত প্রেম নিয়ে স্প্যানিশ ভাষায় গীত পপ সঙ্গীত। আমাকে বলেছিলেন, উপন্যাসটি কোনোভাবেই ওই গানগুলোর মতো মেলোড্রামাটিক হবে না, কিন্তু হৃদয়ানুভূতি প্রকাশের কৌশলের ক্ষেত্রে তাদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শৈল্পিক পছন্দের ক্ষেত্রে তিনি কখনো ভান করেননি এবং তাঁর ভালোলাগার পরিধি বেলা বার্তোক থেকে রিচার্ড ক্লেডারম্যান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একদিন আমি টিভিতে এলটন জনের একটা প্রোগ্রাম দেখছি, শুধুমাত্র পিয়ানো সহযোগে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ গানগুলো গাইছিলেন। বাবা তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই গায়ক সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু সেই সুর তাঁর পথ রুদ্ধ করে দিল, তিনি বসে পড়লেন এবং পুরো অনুষ্ঠানটা শুনলেন। তারপর মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আরিব্বাস, এ তো একজন অসাধারণ বোলেরো গায়ক।’ সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুকে নিজের সংস্কৃতি দিয়ে বোঝানোটা ছিল তাঁর নিজস্ব ধরণ। কক্ষনো ইউরোপীয় উদাহরণ টেনে আনতেন না, যদিও সর্বত্র সেটাই ছিল সাধারণ রীতি। তিনি জানতেন যে প্রকৃত শিল্প সুদূর কিয়োটোর একটা ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে মিসিসিপির একটা অখ্যাত গ্রাম সব জায়গাতেই রচিত হতে পারে আর গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে লাতিন আমেরিকা বা ক্যারিবীয় উপকূলের যে কোনো প্রান্তিক, অবক্ষয়িত জায়গাও মানব-অভিজ্ঞতার শক্তিশালী প্রতিভূ হয়ে উঠতে পারে।

বাবা সবকিছু গোগ্রাসে পাঠ করতেন – ‘ওলা’ পত্রিকা থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখা, মহম্মদ আলির স্মৃতিকথা বা ফ্রেডরিক ফরসিথের থ্রিলার - যাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে তিনি একদম পছন্দ করতেন না। খুব বেশি বিখ্যাত নয়, কিন্তু তাঁর খুব পছন্দের এমন বইয়ের মধ্যে ছিল থ্রনটন ওয়াইল্ডারের ‘The Ides of March’। আমার অর্ধেক জীবন জুড়ে বইটি তাঁর টেবিলে পড়ে থাকতে দেখেছি। আরো ছিল বিভিন্ন অভিধান ও নানা ভাষার রেফারেন্স বই, যা সারাক্ষণ তাঁর কাজে লাগত। কোনো স্প্যানিশ শব্দের অর্থ তিনি জানেন না, এমনটা কখনো দেখিনি। এমনকি প্রয়োজনে প্রতিটা শব্দের বুৎপত্তি বলে দিতে পারতেন। একবার একটা শব্দ মনে করার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। শব্দটার অর্থ একটি লেখার পূর্ণ সমালোচনা বা ব্যখ্যা। মুহূর্তের জন্য তিনি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। হাতের সমস্ত কাজ সরিয়ে রেখে পাগলের মতো শব্দটকে খুঁজছেন। তারপর যখন তা স্মরণে এল, চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ ‘এক্সেহেসিস’। তখন তাঁর আনন্দ দেখার মতো। শব্দটা যে অব্যবহৃত এমনটা নয়, কিন্তু তাঁর জগতের থেকে দূরে তার অবস্থান। তাঁর মতে, সেটি পন্ডিতদের ও বুদ্ধিজীবিদের শব্দ, যাঁদেরকে তিনি প্রখর সন্দেহের চোখে দেখতেন।

১৮

সেদিনই সকালে, বেশ কিছুক্ষণ পরে, বাড়ির মধ্যে একটা মরা পাখি দেখতে পাওয়া গেল। বাড়িতে বসা বা খাওয়ার জন্য বাগানের দিকে মুখ করে যে একটা খোলা জায়গা ছিল কয়েকবছর আগে সেখানটা ছাদ দিয়ে ঘিরে নেওয়া হয়। তার দেওয়ালগুলো ছিল কাচের, তাই বোধহয় পাখিটা উড়তে উড়তে এসে, দিগভ্রান্ত হয়ে, কাচের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মরে পড়েছিল সোফার উপর, ঠিক যেখানটায় বাবা বসতেন। তাঁর সেক্রেটারি আমায় বললেন যে, বাড়ির কর্মচারীরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেছেনঃ একদল মনে করছেন এটা একটা অশুভ লক্ষণ, তাই পাখিটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হোক; কিন্তু আরেক দলের মতে এটা শুভ, তাই ফুলের বাগানে কবর দেওয়া হোক। যাঁরা ফেলে দেওয়ার পক্ষে তাঁরাই এগিয়ে আছেন, পাখিটা ইতিমধ্যে রান্নাঘরের বাইরে একটা মাটির পাত্রে রেখে দিয়েছেন। তারপর, আরো অনেক তর্ক-বিতর্কের পর, পাখিটাকে বাগানের এক কোনে রেখে দেওয়া হল যতক্ষণ না তার সম্বন্ধে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল উঠোনে টিয়াপাখির পাশে তাকে কবর দেওয়া হবে। সেখানে একটা বাচ্চা কুকুরও শায়িত ছিল। পোষ্যদের এই কবরগুলোর কথা বাবাকে কখনো বলা হত না, যাতে তিনি অযথা আতঙ্কিত না হন।

১৯

দুপুরবেলা মা, ভাই ও ভায়ের পরিবার - যাঁরা ফ্রান্স থেকে আগের রাতে এসে পৌঁচেছেন, আমরা সবাই একসঙ্গে বসলাম। তাছাড়াও বোগোতা থেকে এসে পৌঁচেছে মায়ের তরফের এক তুতো বোন। তার ছোটবেলা কেটেছে আমাদের সঙ্গে, আমাদেরই বাড়িতে। বাবার কন্যাসম ছিল সে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সবাই মানসিকভাবে বেশ হালকাই ছিলাম। হতে পারে, জীবিত মানুষের জন্য কেউ শোকপালন করে না, তাই। তাছাড়া, অনেকদিন বাদে আমরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছি আর আমাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই বয়স অল্প, সে কারণেও হতে পারে।

এই সময় কাচের দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম বাবার সেক্রেটারি তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে দ্রুত আমাদের দিকে আসছেন। আমাকে চেঁচিয়ে বললেন যে নার্স আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আর কাউকে কিছু না জানানোর চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু সবাই বুঝে গেল যে কিছু একটা হয়েছে। যতটা সম্ভব শান্তভাবে ঘর থেকে বেরোলাম, কিন্তু সহসা ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছি, তখন দিনের বেলার নার্সটিও ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছেন। আমাকে দেখে শঙ্কিতভাবে বললেন, ‘ওনার নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।’ ঘরে ঢুকে বাবাকে দেখে প্রথমে মনে হল দশ মিনিট আগে যেমন দেখেছিলাম এখনো তো ঠিক তেমনই আছেন। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলাম আমার ভুল। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন তাঁকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে – একটা ট্রেন বা একটা বাস কিংবা একটা বজ্রাঘাত – একটা কিছু যা শুধুমাত্র তাঁর জীবন প্রদীপটাকে নিভিয়ে দিয়ে গেছে। আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে একটা খারাপ কথা বেরিয়ে গেল, তবে চাপা স্বরে। ওদিকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে নার্স সমানে তাঁর নাড়ি খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন। তারপর ডাক্তারকে ফোন করলেন। বলে রাখা সত্ত্বেও আমাকে আগে না ডাকার জন্য মুহূর্তের জন্য তাঁর উপর খুব রাগ হল, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না, তখন আর সে নিয়ে ভাবার অবসর নেই।

বাবার কার্ডিয়োলজিস্টকে ফোনে পাওয়া গেল। তাঁকে নার্স বললেন যে প্রায় তিন মিনিট হয়ে গেল নাড়ি পাচ্ছেন না। ডাক্তার আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। প্রথমে আমাকে সমবেদনা জানালেন ও বাড়িতে আসতে চাইলেন। কিন্তু আমি জানি যে এটা একটা উৎসবের দিন। জানি যে বাবা চলে গেছেন অনেক, অনেক দূরে। তাই ডাক্তারকে বললাম, আর আসার প্রয়োজন নেই। আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল যে অন্তিম মুহূর্ত যখন উপস্থিত হবে তিনিই হাসপাতালের ডাক্তারকে জানাবেন যাতে বাড়ি এসে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো করতে পারেন। একতলায় ফোন করলাম। মা ফোন ধরলেন। তাঁকে বললাম, ‘সব শেষ হয়ে গেছে।’ কথাটা বেশ কষ্ট করে বললাম, চেষ্টা করলাম যাতে স্বর অবিকৃত থাকে, কিন্তু মা পুরোটা শোনার আগেই ফোন রেখে দিলেন। আবার বাবার কাছে ফিরে এলাম। তাঁর মাথাটা একপাশে হেলে গেছে, মুখ ঈষৎ উন্মুক্ত আর তাঁকে এত দূর্বল লাগছে, যেন এর চেয়ে বেশি দূর্বল কেউ হতে পারে না। তাঁকে এইরকম ভাবে দেখা, একজন মানুষের এই পরিণতি দেখা, একইসঙ্গে ভয়ংকর আবার নিশ্চিন্তও করে।  

দেখলাম মা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন। পিছনে আমার ভাই ও তার পরিবার। সাধারণত মা-ই সবার চেয়ে ধীরে, সবার পেছনে হাঁটেন। এখন সবাই জায়গা ছেড়ে দিয়েছে যাতে মা সবার আগে যেতে পারেন। শেষ দিনগুলোয় মা সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমার আর ভায়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি ঘরে ঢুকলেন ও বাবাকে দেখলেন, আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, দশকের পর দশক দীর্ঘায়িত ওঁদের যুথবদ্ধ জীবন কেমনভাবে তাঁকে এই মুহূর্তটির সম্মুখীন হওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দান করেছে। এই দুজন মানুষ যে অতীতে কখনো কখনো একে অন্যকে বুঝতে পারেননি, তা ভাবতেও অবাক লাগে। মা ছিলেন বাবার প্রতিবেশী, এভাবেই তাঁদের চেনাজানা। বাবার যখন ১৪ বছর বয়স আর মায়ের ১০, বাবা মাকে মজা করে বলেছিলেন যে তাঁকে বিয়ে করবেন আর মা তাই শুনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। ওঁদের বিয়ের দিনে, এই মুহূর্ত থেকে ৫৭ বছর ২৮ দিন আগে, কিন্তু ঠিক একই সময়ে, যতক্ষণ না মা জানতে পেরেছেন যে বাবা গীর্জার বাইরে এসে পৌঁচেছেন ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ের পোশাক পরেননি, যাতে গীর্জার মধ্যে তাঁকে কনে বউয়ের সাজে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে।

দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই মা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। নার্স এবং তাঁর সহকারিণী তখন মুখটা বন্ধ করার জন্য বাবার মাথাটা তুলে সযত্নে একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা থেকে থুতনির নিচ দিয়ে ঘুরিয়ে বেঁধে দিচ্ছিলেন। খাটের দিকে যেতে যেতে মা বেশ উঁচু স্বরে বললেন, ‘আরো জোরে বাঁধুন।’ তারপর বাবাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নির্বিকারভাবে জরিপ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, এইবার ঠিক আছে’, যেন বাবা তাঁর একজন রুগী মাত্র। চাদরটা বুক অবধি টেনে হাত দিয়ে সমান করে দিলেন। তারপর বাবার হাতের উপর রাখলেন নিজের একটা হাত। ভালো করে দেখলেন মুখটা, হাত বুলিয়ে দিলেন কপালে। একটা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর একবার কেঁপে উঠলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়লেন, ‘বেচারা, সত্যি সত্যি ও চলে গেছে?’ নিজের অন্তরে বেদনা উপলব্ধিরও আগে তিনি বাবার জন্য প্রগাঢ় করুণা অনুভব করলেন। আমার সারা জীবনে মাকে তিনবার মাত্র কাঁদতে দেখেছি। শেষবারের এই কান্নাটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু সেই ক্রন্দনের ক্ষমতা ছিল একটা মেশিনগানের সমান।

পরের মুহূর্তগুলো ছিল একটু বিভ্রান্তিকর। মা ঘরের বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসলেন এবং বেশ কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম সত্যিকারের সিগারেট ধরালেন, ইলেকট্রনিক সিগারেট নয়। নার্সকে অনুরোধ করলেন চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়ার আগে বাবাকে নকল দাঁত পরিয়ে দিতে। বাবার মুখটা অনেক ভালো দেখতে লাগছে। আমার ভাই ও তার পরিবার বাবাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর খুব কাঁদছে। স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার আগে ওর ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে বাবার খুব ভাব ছিল, ওরা তখন খুব ছোট। তারাও খুব কাঁদছে। খবরটা ইতিমধ্যে বাড়িময় ছড়িয়ে পড়েছে আর একে একে, কার পরে কে এখন আর মনে নেই, তবে বাড়ির সব কর্মচারীরা দরজার ধারে বা বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন আর অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলেন। অন্যরা সামনে রয়েছে বলে তখন আর কেউ গ্রাহ্য করছে্ন না, যে যার মতো শোকপ্রকাশ করছেন। আর কোনো বাধা নেই যেন। প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই মৃত্যুর সামনে নিজেকে উন্মোচিত করে দিচ্ছেন, যেন বা এ মৃত্যু তাঁদের সকলের সম্মিলিত শোক। মৃত্যু তো অপরিহার্য, কেউই তাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু শুধু কারুর অনুপস্থিতি নয়, মৃত্যু যেন তার চেয়ে অনেক বেশি শূণ্যতা সৃষ্টি করে। এমনকি ওই ঘরে থাকা নার্সদেরও এই মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে। তাঁরা কাজ করে চলেছেন ঠিকই, কিন্তু কেমন যেন আত্মনিমগ্ন, মুখে দুঃখের স্পষ্ট ছাপ। আসলে মৃত্যু এমন একটা ঘটনা, যাতে কেউই অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে না।

টীকা:

১। বাইয়েনা: কলোম্বিয়ার একটি লোক-সঙ্গীত। এটি বিশেষ করে ক্যারিবীয় অঞ্চলের গান। বাইয়েনাতো শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘উপত্যকায় জাত’। এক্ষেত্রে সান্তা মার্তার সিয়েররা নেভাদা ও উত্তর-পূর্ব কলোম্বিয়ার সেররানিয়া দে পেরিখা পর্বতমালার উপত্যকার কথা বলা হচ্ছে। আবার যে অঞ্চলে এই গানের উৎপত্তি, সেই ‘বাইয়েদুপুর’ নামেরও প্রভাব রয়েছে।

২। কোম্পাদ্রে: খ্রীষ্টধর্মের নিয়ম অনুযায়ী একটি শিশুর ওই ধর্মে দীক্ষাদানের সময়ে বাবা-মায়ের আত্মীয় বা পরিচিত কোনো ব্যক্তি সেই কাজটি করেন। তখন ওই ব্যক্তিটি শিশুটির বাবার ‘কোম্পাদ্রে’ হন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্থেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। 


আগের পর্ব

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | চতুর্থ পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য


No comments:

Post a Comment