আমাদের ভাষায় যাঁরা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, খেয়াল করে দেখলে পরিষ্কার টের পাওয়া যাবে যে, তাঁদের মধ্যে তাঁরাই টিঁকে যাচ্ছেন যাঁদের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষার রকমফের থাকতে পারে, আলোছায়ার তর-তম থাকতে পারে, কিন্তু যিনি লিখছেন, তাঁর অব্যবহিত ব্যবহারটুকু ধরা থাকছে কিনা তাঁর লেখায়, সেটাই বড়ো কথা। জীবনানন্দ অথবা কমলকুমার, সন্দীপন কিংবা দেবেশ রায়, সমরেশ বসু বা শীর্ষেন্দু --- সবাইকেই সময় মেপে নিচ্ছে তাঁদের গদ্যভাষার সৌজন্যে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এই গদ্যভঙ্গিমার জোর নিয়ে আলাদাভাবে কিছু আপাতত বলছি না। তাঁর সম্প্রতি ছাপা একটি উপন্যাসে আমাদের জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার কীভাবে সব ধনধৌলতসহ উথলে উঠেছে, তার কথাই একটু বলব, প্রসঙ্গক্রমে শীর্ষেন্দুর চিত্ররূপময় গদ্যবিন্যাসের কথাও উঠবে।
‘সতীদেহ’ উপন্যাসে অনেকগুলো সমান্তরাল ঘটনার পাশাপাশি অবস্থান আছে। সমান্তরাল বললাম বটে, কিন্তু প্রতিটি ঘটনাই পারস্পরিক টানাপোড়েনে যুক্ত। আমি শুধু একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরছি। রুনু আর সতী। এই গোটা উপাখ্যানটির ছত্রে ছত্রে নশ্বর ভালোবাসার অলৌকিক মায়া জড়ানো। জীবন যে তার নিজস্ব গরিমাতে সম্পূর্ণ, জীবনকে মৃত্যুর সরল অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া যে অপরাধ, সেটা শান্ত আর অপ্রতিরোধ্য ভাষায় বলা হয়েছে এখানে। রুনু সতীকে ভালোবাসতো। কিন্তু নন্দনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় সতীর। বিয়ের রাতেই আত্মহত্যা করে সতী। আর, শোকে আত্মঘাতী হতে চায় রুনুও। পারে না। অন্যরকম হয়ে জীবনে লেগে থাকে। এইটুকুই ঘটনা। কিন্তু এর নির্যাস গল্পটা পড়তে পড়তে মনে বেজে ওঠে। সতীর আত্মহত্যার কথা রুনুকে এভাবে জানায় মহিম ডাক্তার :
‘মরবার কী দরকার ছিল বল তো! কোনও মানে হয়? একটা জন্মের পিছনে কত প্রস্তুতি, কত অপেক্ষা, তিল তিল করে গড়ে ওঠা শরীর কি এভাবে নষ্ট করতে হয়?’
এটাই এই উপন্যাসের দর্শন। মৃত্যুর বিপক্ষে অপরাজেয় ভঙ্গিতে কথা বলেছেন এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু। কখনো মহিম ডাক্তারের মুখে, কখনো শিশুর মুখের গন্ধ ঘাস রোদ মাছরাঙা নক্ষত্র আকাশের আলছায়াভরা জীবনের টুকরো টুকরো কাহিনি শুনিয়ে। মহিম ডাক্তারের সঙ্গে রুনুর একটা কথোপকথন তুলছি :
ঘুমের চটকা ভেঙে উঠে বসলেন মহিম সরকার, “কী হল রে?”
“কাকা, একটা কথা রাখতে হবে”।
“কী কথা রে?”
“একটা ডেথ সার্টিফিকেট। সতীর”।
“তুই কী পাগল?”
“দয়া করুন কাকা”।
“পরিষ্কার অ্যানন্যাচারাল ডেথ। অনেকে জেনে গেছে’।
“এটুকু আপনি পারবেন কাকা”।
মাথা নেড়ে বললেন, “না পারি না। ধরা পড়লে আমার চাকরি যাবে। বুড়ো বয়সে পেনশন পাব না, তুই কি আমাকে মারতে চাস?”
“সতীকে বাঁচিয়ে দিন কাকা”।
“মরা মানুষকে বাঁচাতে পারি এমন এলেম আমার নেই”।
“শরীরটা বাঁচবে না জানি। কিন্তু সম্মানটা বাঁচবে”।
“কিসের সম্মান? যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’।
“ও কথা বলবেন না। দুনিয়ায় অনেক দুর্বলচিত্ত মানুষও আছে”।
“ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ, নিশ্চয়ই কোনও ছেলেছোকরার সঙ্গে লটঘট পাকিয়ে রেখেছিল”।
“আমার মুখ চেয়ে এটুকু করে দিন কাকা”।
মহিম সরকার আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, “সে কি তুই? সত্যি করে বল তো রুনু, তোর জন্য?”
“ছেড়ে দিন কাকা। ওসব অতীত”।
“তাহলে একটা কথা দে”।
“কী কথা?”
তোর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই একটা কিছু পাকাচ্ছিস। আমি মড়াকাটা ডাক্তার বটে, লোকে আমাকে পোঁছেও না। তবু যাকে মরণ ডাকে তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি। কথা দে, মেয়েটার শোকে তুই কিছু করে বসবি না?”
“কথা দিলাম কাকা”।
“মনে রাখিস”।
চাকরি যাওয়ার ভয় ছিল, চৌপাট হতে পারত পেনশন, বদনাম হতে পারত, অনেক ঝুঁকি নিয়েও মহিমকাকা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ডেথ... ডিউ টু কনভালশন”।
কেন? এত ঝুঁকি নিলেন কেন মহিম ডাক্তার? নিলেন, কারণ, রুনুকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পেরেছিলেন। রুনু তাঁকে কথা দিয়েছিল বলেই অবধারিত মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে ফিরে এসেছিল বন্ধুর, অথচ সমারোহময় জীবনের পথে।
মহিম ডাক্তার সতীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন : ‘যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’। জীবন নষ্ট করা যে পাপ, এই দর্শন শীর্ষেন্দুর অন্য আরও অনেক উপন্যাসের মতো ‘সতীদেহ’তেও নানাভাবে বলা আছে। কখনো একটি বালিকার সঙ্গে নিষ্পাপ আহ্লাদে, কখনও মূর্ছনার সঙ্গে মধুর সম্পর্কের অন্ত্যমিলে। বালিকা রিচার সঙ্গে রুনুর কথোপকথনের একটি অংশ উদ্ধার করছি, যেখানে ধরা পড়েছে এই জীবন তার সব গোপন রহস্য আর সম্ভাবনা নিয়ে কীভাবে ছড়িয়ে আমাদের চারপাশে, আর রুনু সেই জীবনকে ছুঁতে পারছে কি প্রশান্ত নিরাসক্তি সহ :
গুটি গুটি রিচা এসে আমার পাশটিতে বসল। রোগা একখানা হাত রাখল আমার হাঁটুতে।
অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি একদিন একটা রাস্তার কুকুরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলে?”
আমি লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বললাম, “এমা, তোমাকে কে বলল?”
“শম্ভুদা দেখেছে, ঝাড়ুদার গুপ্লু দেখেছে, পরমাদিদি দেখেছে। বলো না, করেছিলে?”
“সে কথা আর বোলোনা। রাস্তার ধারে কুকুরটা সামনের দুটো পা এমনভাবে উঁচু করে বসেছিল যে, আমার মনে হল একটু ভাব করতে চায়। তাই ওর ডান পা ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলেছিলাম, গুড মর্নিং। দেখলাম বেশ খুশি হল’’।
“হিঃ হিঃ! আর শম্ভুদা বলে তুমি সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাকদের রুটি খাওয়াও তখন নাকি কাকদের সঙ্গেও কথা বলো”!
“হুঁ। কাকেরাও বলে। যেদিন বাংলা বনধ ছিল সেদিন সকালে কাকেরা কিন্তু আমাকে দেখেই সবাই মিলে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, হরতাল! হরতাল!”
“হিঃ হিঃ! সত্যি”!
“হ্যাঁ তো”।
“আরও বলো”।
“বলব? তোমার কিন্তু বিশ্বাস হবে না। একদিন আমার ঘরের ফ্রিজটা আমাকে বকুনি দিয়েছিল তা জানো? ফ্রিজ থেকে দুধের প্যাকেট বের করে পিছু ফিরেছি, পিছন থেকে কে যেন ধমকে বলল, অ্যাই! খুব চমকে উঠে ঘুরে দেখি, দরজাটা ঠিকমতো বন্ধ করিনি, একটু ফাঁক হয়ে আছে। ‘সরি’ বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিতেই ফ্রিজটা বলল, থ্যাংক ইউ”।
যে-রুনু জীবনের কিনার থেকে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল মৃত্যুর দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে, তাকে জীবনের এমন চিত্ররূপময় বৈচিত্র্যের দিকে ফিরিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল লেখকের। সেই লক্ষ্যে তিনি নিঃশব্দে সফল হয়েছেন তাঁর অনুদ্যত ভাষার জোরে।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ভাষার নিজস্ব ওজনেই একজন লেখক বেঁচে থাকেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতায় জীবনানন্দ টের পেয়েছিলেন :
‘বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!’
মনের এই পার্থিব চঞ্চলতার নানা বিভঙ্গ ‘সতীদেহ’ উপন্যাসে উঠলে উঠেছে।