Showing posts with label গদ্য. Show all posts
Showing posts with label গদ্য. Show all posts

Saturday, November 2, 2024

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য | সৌজন্যের উত্থান | সুমন গুণ

আমাদের ভাষায় যাঁরা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, খেয়াল করে দেখলে পরিষ্কার টের পাওয়া যাবে যে, তাঁদের মধ্যে তাঁরাই টিঁকে যাচ্ছেন যাঁদের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই  ভাষার রকমফের থাকতে পারে, আলোছায়ার তর-তম থাকতে পারে, কিন্তু যিনি লিখছেন, তাঁর অব্যবহিত ব্যবহারটুকু ধরা থাকছে কিনা তাঁর লেখায়, সেটাই বড়ো কথা।  জীবনানন্দ অথবা কমলকুমার, সন্দীপন কিংবা দেবেশ রায়, সমরেশ বসু বা শীর্ষেন্দু --- সবাইকেই সময় মেপে নিচ্ছে তাঁদের গদ্যভাষার সৌজন্যে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এই গদ্যভঙ্গিমার জোর নিয়ে আলাদাভাবে কিছু আপাতত বলছি না। তাঁর সম্প্রতি ছাপা একটি উপন্যাসে আমাদের জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার কীভাবে সব ধনধৌলতসহ উথলে উঠেছে, তার কথাই একটু বলব, প্রসঙ্গক্রমে শীর্ষেন্দুর চিত্ররূপময় গদ্যবিন্যাসের কথাও উঠবে। 

‘সতীদেহ’ উপন্যাসে অনেকগুলো সমান্তরাল ঘটনার পাশাপাশি অবস্থান আছে। সমান্তরাল বললাম বটে, কিন্তু প্রতিটি ঘটনাই পারস্পরিক টানাপোড়েনে যুক্ত। আমি শুধু একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরছি। রুনু আর সতী। এই গোটা উপাখ্যানটির ছত্রে ছত্রে নশ্বর ভালোবাসার অলৌকিক মায়া জড়ানো। জীবন যে তার নিজস্ব গরিমাতে সম্পূর্ণ, জীবনকে মৃত্যুর সরল অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া যে অপরাধ, সেটা শান্ত আর অপ্রতিরোধ্য ভাষায় বলা হয়েছে এখানে। রুনু সতীকে ভালোবাসতো। কিন্তু নন্দনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়  সতীর। বিয়ের  রাতেই আত্মহত্যা করে সতী। আর, শোকে আত্মঘাতী হতে চায় রুনুও। পারে না। অন্যরকম হয়ে জীবনে লেগে থাকে। এইটুকুই ঘটনা। কিন্তু এর নির্যাস গল্পটা পড়তে পড়তে মনে বেজে ওঠে। সতীর আত্মহত্যার কথা রুনুকে এভাবে জানায় মহিম ডাক্তার :


‘মরবার কী দরকার ছিল বল তো! কোনও মানে হয়? একটা জন্মের পিছনে কত প্রস্তুতি, কত অপেক্ষা, তিল তিল করে গড়ে ওঠা শরীর কি এভাবে নষ্ট করতে হয়?’  

এটাই এই উপন্যাসের দর্শন। মৃত্যুর বিপক্ষে অপরাজেয় ভঙ্গিতে কথা বলেছেন এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু। কখনো মহিম ডাক্তারের মুখে, কখনো শিশুর মুখের গন্ধ ঘাস রোদ মাছরাঙা নক্ষত্র আকাশের আলছায়াভরা জীবনের টুকরো টুকরো কাহিনি শুনিয়ে। মহিম ডাক্তারের সঙ্গে রুনুর একটা কথোপকথন তুলছি :


ঘুমের চটকা ভেঙে উঠে বসলেন মহিম সরকার, “কী হল রে?”

“কাকা, একটা কথা রাখতে হবে”।

“কী কথা রে?”

“একটা ডেথ সার্টিফিকেট। সতীর”।

“তুই কী পাগল?”

“দয়া করুন কাকা”।

 “পরিষ্কার  অ্যানন্যাচারাল ডেথ। অনেকে জেনে গেছে’। 

“এটুকু আপনি পারবেন কাকা”।

মাথা নেড়ে বললেন, “না পারি না। ধরা পড়লে আমার চাকরি যাবে। বুড়ো বয়সে পেনশন পাব না, তুই কি আমাকে মারতে চাস?”

“সতীকে বাঁচিয়ে দিন কাকা”।

“মরা মানুষকে বাঁচাতে পারি এমন এলেম আমার নেই”।

“শরীরটা বাঁচবে না জানি। কিন্তু সম্মানটা বাঁচবে”।

“কিসের সম্মান? যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’।

“ও কথা বলবেন না। দুনিয়ায় অনেক দুর্বলচিত্ত মানুষও আছে”।

“ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ, নিশ্চয়ই কোনও ছেলেছোকরার সঙ্গে লটঘট পাকিয়ে রেখেছিল”।

“আমার মুখ চেয়ে এটুকু করে দিন কাকা”।

মহিম সরকার আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, “সে কি তুই? সত্যি করে বল তো রুনু, তোর জন্য?”

“ছেড়ে দিন কাকা। ওসব অতীত”।

“তাহলে একটা কথা দে”।

“কী কথা?”

তোর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই একটা কিছু পাকাচ্ছিস। আমি মড়াকাটা ডাক্তার বটে, লোকে আমাকে পোঁছেও না। তবু যাকে মরণ ডাকে তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি। কথা দে, মেয়েটার শোকে তুই কিছু করে বসবি না?”

“কথা দিলাম কাকা”।

“মনে রাখিস”।

চাকরি যাওয়ার ভয় ছিল, চৌপাট হতে পারত পেনশন, বদনাম হতে পারত, অনেক ঝুঁকি নিয়েও মহিমকাকা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ডেথ... ডিউ টু কনভালশন”।  

কেন? এত ঝুঁকি নিলেন কেন মহিম ডাক্তার? নিলেন, কারণ, রুনুকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পেরেছিলেন। রুনু তাঁকে কথা দিয়েছিল বলেই অবধারিত মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে ফিরে এসেছিল বন্ধুর, অথচ সমারোহময় জীবনের পথে। 

মহিম ডাক্তার সতীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন : ‘যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’। জীবন নষ্ট করা যে পাপ, এই দর্শন শীর্ষেন্দুর অন্য আরও অনেক উপন্যাসের মতো ‘সতীদেহ’তেও নানাভাবে বলা আছে। কখনো একটি বালিকার সঙ্গে নিষ্পাপ আহ্লাদে, কখনও মূর্ছনার সঙ্গে মধুর সম্পর্কের অন্ত্যমিলে। বালিকা রিচার সঙ্গে রুনুর কথোপকথনের একটি অংশ উদ্ধার করছি, যেখানে ধরা পড়েছে এই জীবন তার সব গোপন রহস্য আর সম্ভাবনা  নিয়ে কীভাবে ছড়িয়ে আমাদের চারপাশে, আর রুনু সেই জীবনকে ছুঁতে পারছে কি প্রশান্ত নিরাসক্তি সহ : 


গুটি গুটি রিচা এসে আমার পাশটিতে বসল। রোগা একখানা হাত রাখল আমার হাঁটুতে। 

অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি একদিন একটা রাস্তার কুকুরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলে?”

আমি লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বললাম, “এমা, তোমাকে কে বলল?”

“শম্ভুদা দেখেছে, ঝাড়ুদার গুপ্লু দেখেছে, পরমাদিদি দেখেছে। বলো না, করেছিলে?”

“সে কথা আর বোলোনা। রাস্তার ধারে কুকুরটা সামনের দুটো পা এমনভাবে উঁচু করে বসেছিল যে, আমার মনে হল একটু ভাব করতে চায়। তাই ওর ডান পা ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলেছিলাম, গুড মর্নিং। দেখলাম বেশ খুশি হল’’।

“হিঃ হিঃ! আর শম্ভুদা বলে তুমি সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাকদের রুটি খাওয়াও তখন নাকি কাকদের সঙ্গেও কথা বলো”!

“হুঁ। কাকেরাও বলে। যেদিন বাংলা বনধ ছিল সেদিন সকালে কাকেরা কিন্তু আমাকে দেখেই সবাই মিলে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, হরতাল! হরতাল!”

“হিঃ হিঃ! সত্যি”!

“হ্যাঁ তো”।

“আরও বলো”।

“বলব? তোমার কিন্তু বিশ্বাস হবে না। একদিন আমার ঘরের ফ্রিজটা আমাকে বকুনি দিয়েছিল তা জানো? ফ্রিজ থেকে দুধের প্যাকেট বের করে পিছু ফিরেছি, পিছন থেকে কে যেন ধমকে বলল, অ্যাই! খুব চমকে উঠে ঘুরে দেখি, দরজাটা ঠিকমতো বন্ধ করিনি, একটু ফাঁক হয়ে আছে। ‘সরি’ বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিতেই ফ্রিজটা বলল, থ্যাংক ইউ”।

যে-রুনু জীবনের কিনার থেকে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল  মৃত্যুর দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে, তাকে জীবনের এমন চিত্ররূপময় বৈচিত্র্যের দিকে ফিরিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল লেখকের।  সেই লক্ষ্যে তিনি নিঃশব্দে সফল হয়েছেন তাঁর অনুদ্যত ভাষার জোরে। 

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ভাষার নিজস্ব ওজনেই একজন লেখক বেঁচে থাকেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতায়  জীবনানন্দ টের পেয়েছিলেন :


‘বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!

মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!’

 

মনের এই পার্থিব চঞ্চলতার নানা বিভঙ্গ ‘সতীদেহ’ উপন্যাসে উঠলে উঠেছে।

Saturday, November 25, 2023

চাহনি | পর্ব ১০ | দৃষ্টি বিনিময় | মন্দার মুখোপাধ্যায়

তিনতলায় বাবার স্টুডিও ঘর। বিশাল ঘরের উত্তর দিকের সদর দরজাটা আজ হাট করে খোলা। দক্ষিণের বড় জানলাটার কয়েকটা শিকও খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে জ্যেঠামণির দিক থেকেও সহজে ঢুকে আসা যায়। খোলা রয়েছে ঘর থেকে বার হয়ে পুবের বারান্দায় যাবার বাহারি কাচের দু’টো দরজা এবং তার মাঝখানের জানলাটাও। খোলা ওই ঘরের পশ্চিম দেওয়ালের গঙ্গা আঁকা খান ছয়েক জানলাও। চারিদিকে আত্মীয় স্বজনের নীরব কান্না। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে বাবা চলে যাচ্ছেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে। ডাক্তার কিষাণ কাকা ইনজেকশন দিতে এসে, কোনও হাতেই ভেইন পাচ্ছেন না। বিকেল তিনটে। ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে সূর্যাস্তের মরা আলো আর জোয়ার-বহা গঙ্গার বাতাস। কার্তিকের শেষ। হিম আর শিশির দু’ইই পড়ছে রাতে আর দিনে। তবু শীত বস্ত্র রাখছেন না গায়ে। পরিষ্কার স্বরে বললেন, আমি আর কুড়ি মিনিট; কাটাছেঁড়া আর নাই বা করলে!

বাবার ছাপান্ন বছরের লম্বা শরীরের মাঝামাঝি বসে আছেন আমাদের মা; মাথা নিচু করে। তাঁর ওই ঊনচল্লিশ বছরেই, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘনিয়ে আসবে বৈধব্য। নতুনদিদা এসে তাঁর বাঁ হাত থেকে খুলে নেবেন এয়োতীর লোহা। একে একে আমাদের দু’বোনকে দিয়ে চামচে করে তাঁর গালে দেওয়ানো হল শেষ জলটুকু। বাবা তাকালেন না। তাঁর ঠোঁট দু’টি ভিজে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে এল অশ্রু। ঠাকুমা আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছিয়ে দিতেই, এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে; বা হয়তো চোখের দিকে। ঘর ভর্তি গুরুজনদের উপস্থিতি ভুলে, মা-ও তো  অপলক। দু’জনের গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণ পথ কেটে হেঁটে এল মৃত্যু। বিকেল ঠিক তিনটে কুড়িতেই চোখ বুজলেন বাবা। থেমে গেল দৃষ্টি বিনিময়। স্থাণুবৎ মা, স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তাঁদের যৌথ জীবনের লোপাট হয়ে যাওয়া অস্তিত্বের দিকে। 

মৃত্যুকে মাঝখানে রেখে দু’জনের এমন চাহনি বিনিময় আর কি দেখেছি!

Saturday, November 11, 2023

চাহনি | পর্ব ৯ | নাচের গুরুজি | মন্দার মুখোপাধ্যায়

খুব আনন্দ হয়েছিল, গুরু গোবিন্দন কুট্টি আমাকে যখন নাচ শেখাতে রাজি হয়েছিলেন। অল্প বয়সে, নাচের পরীক্ষক হিসেবে আমার নাচ দেখে দু’একবার উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য। সে সময় সম্ভব হয়নি; কারণ তখন আমার বেশি মন ছিল চাকরি ও সংসারের দিকে। বছর চল্লিশ পার করে হঠাৎই মনে হল। এখন একবার তাঁর কাছে গেলে কেমন হয়! কারণ আমি নাচ ছাড়লেও, নাচ তো আমাকে ছাড়েনি। ওজনই বা কত আর বেড়েছে! এখন তো দক্ষিণেই থাকি। কতটুকুই বা দূর ওই ডোভার লেন! ডায়াল করে ‘হ্যালো’ শুনেই বুঝলাম যে পুরনো নম্বরই আছে। আমার ওজন এবং নাচ দেখে সাগ্রহে রাজি হলেন। শুরু হল সপ্তাহে দু’দিন করে ঈশ্বর-দর্শন। শরীরে সে এক নতুন উৎসব। নাচের বোল, মুদ্রা আর অভিনয়ে, প্রতিটি ক্লাসেই গুরুজি যেন সুন্দরের বীজ বুনে চলেছেন। 

পঁচাত্তর পার করে তাঁর মাথার সব চুল গরদের মতই মখমল এবং গঙ্গাজল রঙের। হালকা ছিপছিপে শরীর; ট্রাউজারের ওপর ঢিলে পাঞ্জাবি এবং কাঁধে একটা লম্বা ঝোলা। তাঁর হেঁটে আসার ছন্দেও যেন কাঁসার সেই ভারি ঘুঙু্ট-জোড়ার নিক্বণ। ক্লাসে পৌঁছতে এক মিনিট দেরি হলেই রাগ; আবার দু’মিনিট আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখলেও অসন্তুষ্ট। কী জ্বালা রে বাবা! তাঁর ডোভার লেনের বাড়ি থেকে ভেতর দিয়ে হেঁটে আসেন, ডোভার রোডের বাড়িটায়। একতলাটা ভাড়া নিয়েছেন স্পেশাল ক্লাস করাবার জন্যেই। কোলাপসিবলের চাবি খুলে, বারান্দায় রাখা ফুলের টবে জল দিয়ে নিজের চেয়ারে যখন বসবেন ঠিক তখনই ঢুকতে হবে। প্রতিদিনই আমার যেন মঞ্চে প্রবেশ। ব্যাগটা মাটিতে রেখে, ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে আমি দাঁড়াব। একটা ছোট্ট লাঠি পকেট থেকে বের করে নিজের চেয়ারের পাশে রাখা টুলটায় নামিয়ে উনি বলবেন, শুরু কর। তাঁর পা ছুঁয়ে শুরু হবে আমার মারদাঙ্গা অনুশীলন।

ক্লাসটা হাসি হাসি মুখে প্রণাম দিয়ে আরম্ভ হলেও, কিছু পরেই দেখা দেবে তাঁর রুদ্রমূর্তি। নাচের  সময় গলা ও থুতুনির অবস্থানে হাফ ইঞ্চি ফারাকের হেরফের হলেই রে রে করে তাড়া। তালে ভুল হলেই লাঠিটা ছুঁড়বেন হাঁটু তাক করে। আমি যখন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যাব,  টুল থেকে উঠে এসে নিজেই আবার কুড়িয়ে নেবেন। বার বার করে শেখাবেন, দু’মাত্রা থেকে দশমাত্রার জোড়া তাল এবং তারই মাঝে মাঝে বেজোড় তালে পাঁচ এবং সাত মাত্রা। প্রথম দিকের সেই হিমসিম অবস্থাটাই কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই এক খেলা হয়ে গেল। নাচের ঠিকাদারি নিয়ে স্থপতি ডি সি পালের মতোই আমার শরীরটাও বুঝতে শিখল যে কোন জমি ঠিক কেমন বাড়ি চায়! 

তাল  কিছুটা আয়ত্তে এলে শুরু হল গানের সঙ্গে অনুশীলন। সে এক কঠিন প্যাঁচ, না জানি তামিল ভাষা, না বুঝি তার সুরের চলন। কোনও একদিন শেখাচ্ছেন দময়ন্তীর বর্ণনায় নলের বাগানের শোভা এবং তা দেখে দময়ন্তীর প্রেমিকা-ভাব। গুরুজিকেই দেখছি। এ কি শেখা যায়?  যতোই যা করি না কেন, তালের ফাঁকে ফাঁকে ধরতাইয়ের মজাগুলো কেবলই ফসকাচ্ছে। হাত-পা-চোখ-ভ্রু –- সবই বেসামাল; বকুনির ভয়ে শিউরে উঠছে। হঠাৎই একটুও না বকে, শান্ত হয়ে বললেন।

‘আমাকেই দেখ ………আআআমাকেই’ – 

সাহস করে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে কী নিবিড় দৃষ্টিতে আমার মধ্যে তিনি হাতড়ে চলেছেন নাচ এবং আগ্রহ। ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেললাম। মনে হল, উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট কত পুরুষই তো আমাকে দেখেছে! হয় আসক্তি, নয় মুগ্ধতায়। কেউ তো এমন অপার হয়ে বলেনি যে ‘আমাকেই দেখ’! এই প্রথম দেখলাম পৌরুষ নয়, শুধুমাত্র সৌন্দর্য-বোধের আধিপত্য। গুরুজি নিজে এমন রূপ, গুণ আর শক্তির আধার হয়েও তিনি আমাকে টেনে নিতে চাইছেন আমারই মর্মস্থলে! সে চাহনিতে কোনও মুগ্ধতা নেই আমার দেহসৌষ্ঠব বা রূপে। উল্টে সে সব থেকে মুক্ত করে আমাকে করে তুলতে চাইছেন এমন এক বোধ ও অনুভবের আধার যেখানে নাচও যেন আভরণের মতোই খসে যায় শরীর থেকে।

গুরুজির ওই দৃষ্টিপাতে এ জীবনে সেই একবারই ঈশ্বর-দর্শন হয়েছিল। 

বার বার মনে পড়েছিল সেই দু’কলি--

‘মেঘের মাঝে মৃদং তোমার বাজিয়ে দিলে কী ও

সেই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিও দিও’।।

Thursday, November 2, 2023

আমার মা | শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

 

মায়ের কথা বলতে গেলেই যেন আমার ভিতরে একটা বাঁধভাঙার মতো অবস্হা হয়। কত কথা যে মনে আসতে থাকে, যেন কথা আর ফুরোবেই না। মায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল মহামায়া। দাদামশাই মাকে সারদেশ্বরী আশ্রমে পাঠিয়ে দেন মানুষ হওয়ার জন্য। সারদেশ্বরী আশ্রমে স্বয়ং গৌরীমার তত্ত্বাবধানে আমার মা বড় হয়েছেন। মায়ের মাথায় একঢল মেঘের মতো ঘণ, কোঁকড়া চুল ছিল, আর তাই আশ্রমে মায়ের নামই হয়ে গিয়েছিল চুলওয়ালা মহামায়া। আশ্রমবাসের ফলে আমার মায়ের আধ্যাত্মিক ভাব ছিল গভীর, আর তেমনি দয়ামায়া। জীবনে মাকে কখনও কারও সঙ্গে গলা তুলে ঝগড়া করতে শুনিনি। রাগ হলে বকাঝকা করতেন বটে, বিশেষ করে আমাকে, তবে তাতে তেমন ঝাঁঝ থাকত না। আমার মা যেমন শান্তপ্রকৃতি ছিলেন তেমনি আমি ছিলাম বেজায় দুষ্টু আর বাঁদর। আমাকে সামলাতে মাকে হিমসিম খেতে হত। আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ এত দুষ্টু ছিল না। আর তাই আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তাও ছিল বেশি। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাড়িতে কোনও ভিখিরিকে খালিহাতে ফেরানো হয় না। যুদ্ধের সময়ে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে তখনও মা এই নিয়মের ব্যাত্যয় করেননি। মাঝেমাঝে ক্ষুধার্ত ভিখিরিকে বাইরে বসিয়ে গরম ভাত ডাল তরকারি খাওয়াতেন। বাসিপচা জিনিষ কখনও খাওয়াতেন না। অথচ আমাদের অবস্হা যে খুব সচ্ছল ছিল তা নয়। আমার সৎপ্রকৃতির বাবা রেলে চাকরি করতেন বটে, কিন্ত ঘুঁষ খেতেন না বলে আমাদের চিরকালই টানাটানির সংসার। ওই সামান্য হিসেব করা পয়সা থেকেই অল্পস্বল্প বাঁচিয়ে মা তাঁর সামান্য দানধ্যান করতেন। যখন আমার তিন কি চার বছর বয়স তখন প্রতি দুপুরে খাওয়ার পর মা আমাকে নিয়ে মাদুর পেতে মেঝেয় শুতেন আর দুষ্টু ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য রবি ঠাকুরের কবিতা শোনাতেন। সেই মোহময় কবিতা আমার ভিতরে এক সম্মোহন তৈরি করে দিত, তাই আজও আমি কবিতার পরম অনুরাগী। তখন আমার মা ছিলেন আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মা ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না। কিন্ত বাবার বদলির চাকরি, দেশভাগ ইত্যাদির ফলে আমাকে হস্টেলে চলে যেতে হয়। তাতে মায়ের ওপর টান আরও বেড়েছিল, আর মাও আমার জন্য বড্ড ব্যাকুল থাকতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে কি যে আদর হত আমার! আজ কত বছর হয়ে গেল মা নেই, তবু আজও মায়ের অভাবে যেন মাঝেমাঝে বুক টনটন করে। একটা মজার কথা বলি। হস্টেল থেকে বাড়ি গেলে আমি সারাক্ষণ মায়ের কাছেকাছে থাকতাম। মা রান্না করতেন আর আমি কাছটিতে বসে গল্প করতাম। আর এইভাবেই মায়ের তোলা উনুনে রান্না করা দেখেদেখেই আমি নিজের অজান্তে পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছি। আমার রান্না খেয়ে অনেকেই আজও প্রশংসা করে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন | অমর মিত্র

 


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পড়ছি সেই  স্কুলের শেষ আর কলেজের আরম্ভ থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুনপোকা ঠিক কবে বেরিয়েছিল এখন মনে নেই, তবে ঘুনপোকার আগে পড়েছি উজান, এরপর আরো পরে পারাপার, মানব জমিন, যাও পাখি ইত্যাদি। মাঝে ঘুনপোকা। তারপর তো পড়েই চলেছি। ছোটদের বড়দের নানা গল্প উপন্যাস। বড় হয়েও তাঁর ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস না পড়া মানে শৈশবকে ভুলে মারা। গন্ধটা খুব সন্দেহ জনক, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাইবাগানের ভূত…, তিনি এখনো আমাকে আমার শৈশব ফিরিয়ে দেন। কত যে পড়েছি সব আনন্দমেলায়। সঙ্গে সেই সব গল্প যা আমাকে  এখনো ঘুরে ঘুরে পড়ার কথা ভাবায়,  সেই গঞ্জের মানুষ, ট্যাঙ্কি সাফ থেকে উত্তরের ব্যালকনি, প্রতীক্ষার ঘর..., কত গল্প।  তিনি তাঁর গল্প নিয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর প্রবেশ করেন। তিনি আমাদের জীবনের নানা বিহ্বলতার কথা মনে করান। শীর্ষেন্দু অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন। জীবন এখানে নির্ভার মগ্নতার,  জীবন এখানে  অজ্ঞাত এক আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি  দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস তাঁর গল্পের দুঃখী মানুষের ভিতর সঞ্চারিত হয়।  উত্তরের ব্যালকনিতে বা গঞ্জের মানুষ কেন তাঁর অনেক গল্পেই আমি তা দেখেছি। দেখেছি উপন্যাসে। উজান- উপন্যাসে এ এক ভিখিরির সামান্য খুদকুড়ো ছড়িয়ে দিল বালক, তার কী অসম্ভব গর্জন। বালক মাটিতে ছড়ান খুদ খুঁটে খুঁটে তুলে দিতে থাকে ভিখিরির বাটিতে।  শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে অনুভব করতে হয়। অনুভব করতে চেয়েছি। তিনি অনুভব করাতে পারেন। তাঁর গল্প আমার ভিতরে অপরাহ্ণের আলো আর বিমর্ষতা নিয়ে আসে। উত্তরের ব্যালকনি এক প্রেমের গল্প। দুঃখীর গল্প। ব্যালকনিটি উত্তরে। সংসারটি তুষার আর কল্যানীর। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে লোকটিকে দেখা যায়। সে বসে থাকে বকুল গাছটির নিচে। এবার গাছে ফুল এসেছে খুব। তলাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সেইখানে নিবিড় ধুলোমাখা ফুলের মাঝখানে লোকটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘন নীল জামা, খাকি ফুল প্যান্ট, লজ্জাস্থানগুলিতে ছেঁড়া তা। মাথার চুলে জটা, গালে অনেক দাড়ি, গায়ে চিট ময়লা, কনুইয়ে ঘা। সে অরুণ। সে পাগল।  ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তুষার লোকটাকে দ্যাখে। এখনো চেনা যায় অরুণকে। না আগের চেহারাটা তেমন মনে পড়ে না। এখনকার অরুণকে সে চিনতে পারে। কেন না সে পাঁচ বছর সে ওই গাছতলায় বসে আছে। অফিসে বেরোনর আগে পানের পিক ফেলতে ব্যালকনিতে এসে তুষার দ্যাখে ওকে। পাগলও একবার মুখ তুলে তাকায় যেন। আগে ওই চোখে ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধের ছায়া দেখত তুষার। এখন কিছুই না। তুষার টের পায় কেবল অবিন্যস্ত চিন্তারাশি বয়ে যায় ওর মাথার ভিতর দিয়ে।  শুধুই শূন্যতা। আর কল্যানী? তুষার চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তুষারের ভেজা ধুতি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে মেলে দিতে দিতে দ্যাখে আকীর্ণ ধুলো মাখা ফুলের ভিতর বসে আছে অরুণ। পাগল। তার একদা প্রেমিক। অরুণ তাকিয়ে আছে। কল্যানী স্পষ্ট দেখতে পায় ফাঁক হয়ে থাকা মুখের ভিতর নোংরা হলুদ দাঁত, পুরু ছ্যাতলা পড়েছে। ওই ঠোঁট জোড়া ছ-সাত বছর আগে  জোর করে কল্যানীকে চুমু খেয়েছিল একবার। ভাবলে এখন ঘেন্না করে। কল্যানী প্রতিদিন শেষবেলায় ঠিকে কাজের লোককে দিয়ে ভাত পাঠায় ওকে। অরুণকে সে কখনো ভালবাসে নি,সে ভালবেসেছিল তুষারকে। কিন্তু পাগল হয়ে অরুণ যখন ওই গাছতলায় আশ্রয় নিল, ঘরের মধ্যে তারা দুজন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। যদি পাগল ঘরে এসে ওঠে ? কী মায়াময় ভালবাসার গল্প এই উত্তরের ব্যালকনি। একতরফা ভালবাসায় ব্যর্থ অরুণের ছিল পৃথিবী হারানোর দুঃখ। সেই দুঃখ তার দুবর্ল  মাথা সহ্য করতে পারে নি। তাই এসে বসেছিল কল্যানীদের সংসারের দোরগোড়ায়। আগে সে চিৎকার করত, অব্যক্ত আর্তনাদ করত, এখন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তুষার সমস্তদিন ধরে কাজের চাপে বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। অরুণের প্রতি তার মায়া আছে। আবার সংসার করতে করতে ক্লান্ত তুষার অন্য নারীর কাছে গিয়েও ভালবাসাহীন হয়েই ফেরে। এই গল্প জটিল নাগরিক জীবনের। এই গল্প হৃদয়ের অতি অন্তঃস্থলের। কল্যানীর ভয় আছে, তুষারের নেই। কল্যানী চলে যেতে চেয়েছিল এই জায়গা থেকে। তুষার বলেছিল, গিয়ে লাভ নেই, ও খুঁজে খুঁজে ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। তুষারের খুব মায়া। ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা তার। এই গল্পে অনেক মাত্রা। মদ খেয়ে ফেরে তুষার। তার গায়ে মেয়েমানুষের গন্ধ, শার্টে তার লিপস্টিকের দাগ। কল্যানী কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ফুরোয়। বাইরে বকু্লগাছের তলায় পাগল অনেক অনেক ফুল নখে ছিঁড়ে স্তুপ করেছে। উগ্র চোখে সে ব্যালকনির দিকে তাকায়। ক্ষুধার্ত হয়েছে সে। তুষার নিজে গিয়ে তাকে ভাত খাইয়ে আসে। ডাল তরকারীতে মাখা কাগজ ছিঁড়ে গেছে। পথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তাই খুঁটে খাচ্ছে। ক্লান্ত তুষারের বুকের ভিতরে বহু উঁচু থেকে ক্রেন-হ্যামার যেন ধম করে নেমে আসে। এই দৃশ্য সে দেখেছিল একদিন অফিস ফেরতা। সে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে আছে। এই জীবন থেকে বেরোতে হবে। মুক্তি, মুক্তি চাই যেন তার। পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে হয় এই শহর ছেড়ে। একদিন রাতে ভাত দিতে গিয়ে সে অরুণকে জিজ্ঞেস করে, কল্যানীকে তার দেখতে ইচ্ছে করে কি? জবাব দেয় না পাগল। একদিন তুষার  হাত ধরে অরুণকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। কী অসামান্য সেই নিয়ে আসা। কল্যানী ভয় পায়। আর্তনাদ করে ওঠে। তুষার তাকে অভয় দেয়। পাগলের হাত ধরে সমস্ত ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখায়। নিজের সমস্ত সুখের চিহ্ন দেখায়। পাগল দেখেই যায়। তারপর ডাইনিং টেবিলে বসে পেট ভরে খায়। তাকে থাকতে বলে। কিন্তু সে কিছুই না বলে নিজে নিজে নেমে চলে যায় বকুল বিছানো ধুলোয়। কল্যানী দেখেছে পাগলকে। তার চোখে শুধুই বিস্মৃতি। ভালবাসায় পাগল হওয়া অরুণের হৃদয় জুড়িয়ে গেছে বকুলতলায় বকুলছায়ায় বসে। সে কল্যানীকে চেনে না আর, ভাতের জন্য বসে থাকে। তুষারের এত ক্লান্তি কাজে, কল্যানীর এত প্রত্যাখ্যান নিয়ে বাঁচা, এর ভিতরে যেন আবছায়া এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। আধা আলো আধা অন্ধকার, স্মৃতিময় স্রোত বয়ে যায় অবিরল। পাগলের কোনো ক্লান্তি নেই। সে বসে থাকে। পাঠক এই গল্প আর শোনাতে পারছি না আমি। বিকেলের নিভে আসা আলোয় পাগলকে দেখছি বকুল ঝরানো ছায়ায়। নদীর পাড়ে। সব কিছু থেকে মুক্তি পেয়েছে এই দুঃখী। নতজানু হই লেখকের কাছে। 

Saturday, October 14, 2023

চাহনি | পর্ব ৮ | মন্দার মুখোপাধ্যায়


প্রস্তাব

ইশকুল বয়স। মনে হয় চোদ্দ। ক্লাস এইট। ইশকুলের পাঁচিল আর তাদের বাড়ির মধ্যে একটাই সরু পিচ রাস্তা। বাড়িটাও এই রাস্তার ওপরেই। দোতলায়, কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলো খুব বড় বড়। খড়খড়ি টেনে, তার ফাঁক দিয়ে এখান থেকেই যে সে রোজ আমাকে দেখে, তা আমি বেশ অনুমান  করতে পারি। কী করে বুঝি! তা জানি না। বয়সে আমার থেকে বছর কয়েকের বড় বলেই আন্দাজ হয়। কিন্তু সে অনুপাতে চালচলনে একটু বেশিরকমই আত্মবিশ্বাসী। মাঝে মাঝে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, নিজেকে চেনাতে। চিনিয়েছে, মোড়ের আড্ডায় দাঁড়িয়েও চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে। এসবে আমল না দিলেও সামান্য কেঁপে, মাথা নিচু করে নিজের রাস্তায় চলে গিয়েছি বার বার। তাই তার দিক থেকে এগিয়ে এসে কথা বলা বা আলাপ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাকে আমি এভাবেই চিহ্নিত করেছিলাম তার ওই চকিত দেখায়। সুঠাম এবং রূপবান চেহারা। একমুখ নরম দাড়ি, কোঁকড়া চুল আর দৃপ্ত চোখ।

শনি রবিবারও ওই স্কুলে যেতাম, ছবি আঁকা শিখতে। সেদিন ক্লাস শেষ হলে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে, বাউন্ডারি পাঁচিলের কোনায় গিয়ে সেই গাছটার নীচে এসে দাড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু কমলা ফুল কুড়িয়ে নেব, যদি দু’একটা পাই! গাছটার নাম জানতাম না। ফুলগুলো এত সুন্দর যে মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে এনে পাত্রে সাজিয়ে স্টিল লাইফ আঁকতাম। কখনও স্কার্ট বা ফ্রকের ঘেরে ফেব্রিক পেইন্ট করলেও ওই ফুল। তখন আমার প্রিয় বই বা ডায়েরির ভাঁজেও পাওয়া যেত ওই শুকনো ফুল আর তার পাতা। পাতাগুলিও অন্যরকম সবুজ। গাঢ় নয়, হালকা। 

সেদিন নাগালের মধ্যেই ছোট ছোট স্তবক দেখে, মাথা তুলে হাত বাড়াতেই ওদের জানলাটায় চোখ পড়েছিল। সেদিন আর খড়খড়ির আড়াল থেকে নয়। জানলাটা হাট খুলে, দু'হাতে দু'টো লোহার রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক অকপট মুগ্ধতায় স্নান করে। গায়ে ছিল সাদা পায়জামা আর গেঞ্জি। কোঁকড়া চুলগুলো ভিজে পাট পাট। তার সর্বাঙ্গে রবিবারের আরাম। জানলাটা মানুষের থেকেও লম্বা বলে তার পুরো শরীরটাই সেদিনও দেখা গিয়ছিল।

ফুলের ফাঁক দিয়ে তার চোখে আমার চোখ পড়তেই সে হাসল নিভৃতে। তার সেই নিজস্ব চাহনিতে কোনও সংকোচ নেই। আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। চোখ নামিয়ে ফুল-সমেত ডালটা ছেড়ে, মাথা নামিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিলাম দ্রুত। মায়ের ডিজাইনে বানানো কমলা রঙের আমব্রেলা কাটের  সুতির ফ্রক  পরা, আমার সেই টিংটিঙে শরীরে সে কী ভাললাগা! আর তার ওই চাহনিতে যেন বড় হয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি।

সে কি বুঝেছিল, হাসি ফিরিয়ে না দিলেও কতখানি সম্মতি ছিল আমার! অচেনা শিহরণে কত হাসি ঝরেছিল মনের গভীরে!

আজও জানি না যে কী ফুলের গাছ ছিল সেটা! রাস্তায় বা বাগানে ওই কমলা ফুলের গাছ দেখলেই এখনও তো কেঁপে উঠি। মনে পড়ে তার সেই নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা; অভ্যর্থনার উষ্ণ প্রকাশ; সপ্রতিভ হাসি। 

আমার মন থেকে কোনওদিন কি মুছে যাবে তার সেই নির্ণিমেষ চাহনি…… প্রেমের প্রস্তাব!

Saturday, September 23, 2023

চাহনি | পর্ব ৭ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

চক্ষুদান

চক্ষুদান কথাটার অর্থ আজকাল আমূল বদলে গেছে। সদ্যমৃতের সজীব চোখ আই ব্যাঙ্কে রেখে জীবিতকে চক্ষুষ্মান করা। এতে একজন দাতা এবং অন্যজন গ্রহীতা। আর পুরো কাজটি করেন চিকিৎসকেরা। এ এক মহতী সেবা। অন্ধ বা প্রায়ান্ধদের চোখে আলো ফোটে। আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে চক্ষুদান বলতে একমাত্র যা বোঝাতো তা হল, বিগ্রহের চোখ ফোটানো। এ কাজটি প্রথমে করতেন প্রতিমা শিল্পীরা। পরে পুজোপাঠের মধ্যে দিয়ে, সেই বিগ্রহে প্রাণ সঞ্চার করে তাকে সজল করে তুলতেন পুরোহিত। এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সকলের মনে হবে-– মা যেন চেয়ে আছেন।

বাড়ির খুব কাছেই ভটচায্যি বাড়িতে দুর্গা পুজা হতো। রথেরদিন খুঁটি পুজো করে ঘট বসত। এরপর কবে যেন মাটির ঢিবি রাখা হতো চণ্ডীমণ্ডপে; আর শুরু হয়ে যেত প্রতিমা গড়ার কাজ। একটা বাঁশের চালচিত্রে ছেলেপিলে বাহন-সহ মাদুগ্গার সংসার। প্রতিদিন ইস্কুলের পরে, বিকেলের খেলা বাদ দিয়ে আর ছুটির দিনগুলো দুপুর থেকে সেখানেই পড়ে থাকতাম। হাঁ করে দেখতাম সেই ঠাকুর গড়া। মাস খানেক ধরে সে পব্বো শেষ হলে, শুরু হতো মায়ের চক্ষুদান। তখন কিন্তু নির্জন মণ্ডপে একা সেই বুড়ো মানুষটি যিনি চোখ আঁকবেন। ভোর থেকে সবাই দেখতে পাবে মায়ের চোখ কেমন চেয়ে আছে। আমি অবশ্য অসুর এবং সিংহের চোখজোড়াও দেখতাম। সিংহের হুঙ্কার আর অসুরের ভয় দুটোই প্রকাশ পেত ওই আঁকা মণিতে। আর মায়ের চোখে যেন উৎসব। আমাদের নতুন জামা-জুতো পাওয়ার আনন্দ । মজা লাগত গণেশের কুতকুতে চোখ দেখেও। কী একটা আকর্ষণ থাকতো তাতেও। তবে কার্ত্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী-– এই তিনজনের চোখ প্রায় এক রকম। মিষ্টি মিষ্টি সেজে তাকিয়ে থাকা। 

প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে কত না প্রতিমা আর তার কী বিচিত্র সব অভিব্যক্তি! তেজ, শক্তি, প্রসন্নতা-– একেক শিল্পীর একেক রকম প্রকাশ। কিন্তু যে একটা ব্যাপারে সমতা ছিল, তা হল সবই কিন্তু প্রতিমার চোখ। এ চাহনি মানুষের দৃষ্টিতে পাইনি। এমনকি অভিনয় বা নাচেও তাঁদের প্রতিমার মতো মনে হয়; কিন্তু প্রতিমা মনে হয় না। এ চাহনি দেবীর। মনে হয় একমাত্র মূর্তিতেই ফুটে ওঠে কারণ তা স্থির। এ চোখের পলক পড়ে না।

প্রতি বছর একবার কুমোরটুলি যাই। যাই কালীঘাটের পোটো পাড়াতেও। তা ছাড়াও এ শহরের নানান আনাচ কানাচে কুমোরদের কিছু সাবেক ঘর এখনও নয় নয় করেও আছে। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা গড়ার কাজ। ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাখা মস্ত মস্ত প্রতিমা। মাটির কাজ শেষ হয়ে এবার রং এবং চক্ষুদান হবে। বেশিরভাগই বারোয়ারি পুজোর অর্ডারি ঠাকুর। শিল্পীদের জিজ্ঞাসা করি কেমন লাগে ওই চক্ষুদান পর্ব! সকলেরই প্রায় এক উত্তর– মা এসে আঁকিয়ে নেন। এই অনুভুতিটাই বোধহয় চক্ষুদানের আসল চাবি কাঠি। এবারেও যখন গেলাম, মনে হল ওই এ কোণা ও কোণা থেকেও মা যেন দেখছেন। বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তো পুতুলের, কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই তা যেন শক্তি! উৎসব।

হয়তো এ জন্যই মানুষের চেয়ে থাকায় যা চাহনি, দেবী মূর্তির ওই চেয়ে থাকা হল–- পূর্ণদৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে পলক পড়ে না। তবুও তা সতেজ এবং বাঙ্ময়।

Thursday, June 1, 2023

চাহনি | পর্ব ৫ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

‘সাদা নেগেটিভ’

যখন একটা কিছু বলার আগেই, শুরু হয়ে যায় গড়াগড়ি পেড়ে হাসি, তখনই বোঝা যায় যে আলোচনার বিষয়টা কী। গল্পের আভাসে জনা দুই হাসে, আর বাকিরা অবাক হয়ে দেখে। গল্পটা আর বলাই হয় না। বাড়ি, বা ইস্কুল বন্ধু, বা পাড়ার বন্ধুদের আড্ডা মানেই তাই। একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বড় হওয়া মানেই, সময়ের সিন্দুকে জমে থাকা হাসির রসদ। আমাদের দু-বোনের চাল চলনে মিলের থেকে অমিলটাই বেশি। কিন্তু এই এক ব্যাপারে দুজনেই সেই “ঘাড় কেন কাত?/ আরে, আমরা যে এক জাত!” এখানেই অব্যর্থ দুজনের সেই দুষ্টুমি ভরা চাহনি, যা আজ এই বাষট্টি এবং পঁয়ষট্টি পার করেও একেবারে এক এবং অবিকল। 

এ বয়সে তো বেশিরভাগ জমায়েত মানেই শ্রাদ্ধ বা স্মরণ সভা; আর না হয়তো  বা দিন পনের, কী মাস খানেক কাটিয়ে ছেলে মেয়েরা বিদেশে ফিরে যাবার আগে, একবার গণ দেখা করে নেওয়া। ফলে মন খারাপের ভাগটাই উপচে থাকে। সেখানেও দেখলাম প্রৌঢ়ত্ব পার করে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেও দু-বোনের সেই ফক্কড়িও হেসে কুটিপাটি হওয়ায় কোনও ব্যতিক্রম হল না। কেউ হয়তো গমগমে গলায় গান ধরে, গেয়েই চলেছে; থামার নামটি নেই, বোন ওমনি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে, টুক করে ভ্রূ নাচিয়ে দেবে, আর আমিও কুল কুল করে হাসতে শুরু করব। এই যে মস্করা চাহনি এর যেন শেষ নেই। সেটা যে কোন চরমে যেতে পারে তা সেদিন বুঝলাম। মাস দুয়েক আগে আমার একটা সার্জারি হয়েছে, আর বোন ছাড়া পেয়েছে সদ্য। আমার হাঁটু এবং ওর পেট সব নড়ে চড়ে গেছে; কাছের মানুষদের আতুপুতু এবং তয় তপ্পনের শেষ নেই। তার মধ্যে শুরু হল চমকদার ঈশারা এবং গড়াগড়ি পেড়ে হাসি। ভারি বয়স, ভারি শরীর সঙ্গে নানা রকমের মনভার; কোথায় কী! হেসেই চলেছি। আমাদের ছেলে মেয়েদুটোরও এ সব প্রসঙ্গ শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ; ওদের তেমন হাসিও তাই পায় না। কিন্তু আমরা দুর্নিবার গতিতে এমন হাসছি, যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েই চলেছে। 

আর এও তো আশ্চর্য যে, সেই এক ঘনত্বের হাসি এবং একইরকম ইশারা। সেদিন খুবই গুরুগম্ভীর এক স্মরণ সভায় দুজনে গিয়েছি। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। সকলেরই মন ভার এবং বিশিষ্ট সঙ্গে সকলেই মার্জিত আচরণে বদ্ধপরিকর। তো একজন দেরিতে ঢোকায়, দরজা খুলতেই তাঁকে দেখা গেল, পূর্ণ আলোয়। আপাদমস্তক সাদা পোশাক এবং কলপহীন সাদায় মুখ মুন্ডল ঘেরায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, পরচুল মাথায় বিশেষ কোনও নাটকের চরিত্র যেন। ছায়াছন্ন অন্ধকারেও, পাশে বসে থাকা বোনের ঈশারাটি যেন কান দিয়েই দেখতে পালাম। দেখতে পেলাম, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তার হাসি চাপার চেষ্টা। সেই সংক্রমণে আমিও তখন ফুলে, ফেঁপে, দুলে একশা। ওই মানুষটিকে দেখে যত না হাসি পেয়েছিল, তার থেকে ঢের গুণ হাসি এল বোনের চোখ আর ভ্রূর ইশারায়; পাশাপাশি বসায়; কনুইয়ের গুঁতোগুঁতিতে। আমার কপট শাসন ওকে যেন আরও হাসাচ্ছে। এই যে দুজনের চাহনির ক্রশ কানেকশন– আসলে আমার কপট  শাসন যেন ওর অন্তহীন মস্করার প্রশ্রয়, এর কোনও ব্যখ্যা আছে! গপ্পোও কিছু নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে দেখা মানুষটা আজ যখন হাসি উস্কে দিলেন, তখন  তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা তাতে হাসি, তাঁকে আগেও যতবার দেখেছি তাতে হাসি; তাঁর এতদিনকার চলন, বলন, সাজ, গড়ন সব মুছে গিয়ে, ততক্ষনাৎ ফিস্ফিসিয়ে তাঁর  নতুন নামকরণ  হল– ‘এতো পুরো উল্টো নেগেটিভ রে– কালোর বদলে সবটাই সাদা’।

বুড়ো বয়সে অনেক কিছুর মতোই আর যা যা চেপে রাখা যায় না– তা হল চাহনি এবং কুলকুল করে বন্যার মতো হাসি।




আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৪ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

Saturday, May 20, 2023

চাহনি | পর্ব ৪ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

উৎসার

শুধু যে শান্তিনিকেতন তাই নয়, কয়েক প্রজন্ম জুড়ে কোনও না কোনও ভাবে এঁরা সকলেই, বিশ্বভারতীতেই পড়াশোনা করেছেন বা চাকরি করেছেন। তাতেও অবশ্য সবাইকে যে খুব মনে ধরে তা নয়। কিন্তু এই পরিবারটি বড় অদ্ভুত রকমের স্বাধীন, আবার একই সঙ্গে, সর্বত ভাবেই রবীন্দ্রনাথেই স্থিত; কিন্তু সে তাঁদের নিজস্ব অভিধান ও নিয়মে; ফলে এ বাড়ির দুই বোনের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব তাড়াতাড়িই নিকট হয়ে গেলাম। ষাটের দশকে দেখা শান্তিনিকেতন যেন ফিরে এল নব্বইয়ের সীমানায়। ইতিমধ্যে বসন্ত উৎসবে এসে, অনুষ্ঠানের পর দুম করে আলাপ হল, এ বাড়ির বড় ছেলে, মানে ওই দুই বোনের দাদার সঙ্গে। মস্ত এক জোড়া গোঁফের সঙ্গে মানান সই পরিশিলীত ইংরেজি, হিন্দি এবং বাংলা উচ্চারণ ও শব্দ চয়ন। দোহারা দীর্ঘ চেহারায় যে নিপুণতায় ধুতি পাঞ্জাবি, সেই একই রকম অনায়াস স্বাচ্ছন্দে শর্ট স্লিভ ট্রাউজার, ফেডেড জিন্স এবং ঝকঝকে পালিশের বুট। স্মার্টনেসটা এতোটাই আটপৌরে! বেশি কথা বলেন না। তীক্ষ্ণ চোখে একভাবে চেয়ে থাকেন। আমার থেকে প্রায় পনের বছরের বড়, কিন্তু দৃষ্টিপাতে না কোনও কপট স্নেহ, না সঙ্কোচ। অথচ মানুষটি জড়সড়ো; কুন্ঠিত। স্ত্রী ধমক দিলেই শুধু মাথা নয়, গলা শুদ্ধু নিজের  মাথাখানি  নিজের বুকের কাছে ঝুলিয়ে, অপরাধী বালকের মতো বকুনি খান। সেই উজ্জ্বল হাসি মুহূর্তে বদলে যায় বিষাদে। তাঁর স্ত্রীও বিশ্বভারতী থেকেই পাশ দেওয়া এবং সুকন্ঠি। স্ত্রীর পছন্দেরই একের পর এক গান শোনাচ্ছেন দুজনে; কিন্তু আমার কানে কী যেন কম বাজছে। আগের সন্ধেতে যখন উনি একা কিছু গান শুনিয়েছিলেন, সেই গলার বলিষ্ঠ মাদকতা, যেন ওই দুজনে গাওয়া গানে নেই। আমি তো গান গাইতে জানি না, ফলে কারণটা ধরতে পারলাম না। কিন্তু মানুষটির অপরাধী ভঙ্গি আমার মনে কেন জানিনা গাঁথা হয়ে গেল। আসলে সংশয়ের একটা কাঁটা যেন বিঁধে রইল কোথাও; কোথায় বেমানান ইনি?

কলকাতায় ফিরে হঠাৎই একদিন দেখি, আমার সামনে থেমে যাওয়া গাড়ির কাচ নামিয়ে, উনি আমাকে জলদি উঠে পড়তে বলছেন। ওঁর পাশের সিটে চড়ে বসতেই, সিগন্যাল ছেড়ে দিল। আর রাসবিহারী ক্রশিং, যেখানে আমার নেমে যাওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছনোর আগেই শুরু হয়ে গেল ঝম ঝম বৃষ্টি। কোনও অনুরোধ ছাড়াই দুম করে শুরু করে দিলেন, ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা...’। আমার হাতে ভাগ্যিস স্টিয়ারিং নেই; কী যে থানা পুলিশ হয়ে যেত কে জানে! মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন গেল নেমে যাওয়ার চেনা পথ। 

নেশাগ্রস্তের মতো চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি, তার সপ্তকে গান ধরে, প্রবল আনন্দে মুগ্ধ তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে; চোখের ওপর যেন আর কালো পিচ রাস্তা ও কংক্রিট জঙ্গলে ঘেরা শহর কলকাতা নয়; শান্তিনিকেতনের মাঠঘাট, গাছপালা আর রাঙামাটির পথ; বৃষ্টি আর তুফান দেখছেন। দেখছেন গানের সেই অবাধ মুক্তি, সঙ্গতে যখন নিজের গলায় মন্দ্র সপ্তকে বাজ আর বিদ্যুৎ। তাঁর ওই চেয়ে থাকায় দেখেছিলাম, গান; দেখেছিলাম মুক্তি। বুঝেছিলাম যে এই তাঁর নিজের স্কেল, দ্বৈত গানে যা সমঝোতা করে বামন হয়ে যায়। আজ তা নিজের গহন থেকে উৎসারিত এবং অবাধ।

তাঁর ওই দৃষ্টিতে তাই বৃষ্টির অবিশ্রাম ঝরে পড়া আর তীব্র আনন্দ। এক আকাশ থেকে আর আকাশে ছুটে বেড়ানো; এবং আমার সংশয়ের অবসানে অসামান্য উপহার ওই মুক্ত কন্ঠের গান।

দেখলাম, শূন্যে দৃষ্টি বিছিয়েও মানুষ কেমন উৎসারিত হয়ে আসে তার স্বমহিমায়।

ওই দৃষ্টির অর্থ কি তবে, 

‘যায় নিয়ে যায়, আমায় নিয়ে যায় আপন গানের টানে…ঘর ছাড়া কোন পথের পানে’।



আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৩ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

Saturday, April 22, 2023

চাহনি | পর্ব ৩ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

 

সতর্ক

সাদার্ন আভেন্যুয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই রেলিং ঘেরা লেক। বিকেল পাঁচটা; এখনও তবু গণগণে রোদ্দুর; সঙ্গে দুর্জয় গরম। চৈত্র শেষ হতে চলেছে যে! লায়ন সাফারি পার্কের গেট দিয়ে ঢুকলে, হাঁটার স্ট্রেচটা বেশ ফাঁকাই থাকে। হকারদের ঝামেলাও নেই। উপরন্তু, ব্যাটারি চালিত একটা সাদা বেঁটে চারচাকায় পুলিশের ধীর টহলদারি। এরই মধ্যে, বড় গেট পেরিয়ে ঢুকেই যে রেলিং ঘেরি, সেটা বেশ নিরিবিলি। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু উঁচু বসার জায়গা; কোনওটা সোজা বেঞ্চি;  কোনওটা আবার অর্ধেক গোল। নিচেটা যদিও ঝাঁট দেওয়া সাফ সুতরো, তা হলেও বেঞ্চিগুলোয় পাখিদের সাদা এবং ধুসর হাগুর টাটকা বা বাসি ছোপ থাকবেই। যারা নিয়মিত আসে, তারা বেশ খবরের কাগজ বা টুকরো পিচবোর্ড নিয়েই আসে। অনেকে গামছা পেতে সটান লম্বা হয়ে, নাক ডাকিয়ে, বেঞ্চি জুড়ে ঘুমোয়। ভাল পোশাকের ডেলিভারি বয়রা হাত পা ছড়িয়ে টিফিন খায়; বাকিরা আসে জোড়ায় জোড়ায়, আদরে জুড়তে। হন্টন বিলাসীরাও এদিকে আসে না; আসেনা টহলদার পুলিশ; এ বেশ মাধবীকুঞ্জের মনোরম আবেশ। তবে, আমার মতো ঠায় বসে কোকিলের ডাক শুনতে, বা গাছের ওপর ধীরে ধীরে আলোর বদল দেখতে, কিম্বা পাখিদের স্নান দেখে মজা পেতে-- আর কেউ আসে বলে মনে হয় না। সকলেই আসে কিছু কিছু না কিছু কাজ সারতে; ঘুম, খাওয়া বা আদরের উদ্দেশে। এমন কি পাখিরাও তাই, কাজে আসে। আমিই বোধহয় একমাত্র সেই হঠকারি আলসে, যে শুধু বসতে আসে দু দণ্ড।

প্রথমদিকে, গাছের নিচে যুগলদের অবস্থান দেখে একটু অস্বস্তি যে হতো না তা নয়। পরে মনে হতো, একাই বসে আছি; কারণ সকলেরই তো সেই একই পোষ মানা আচরণ আর নিঃশব্দে টুক করে বেঞ্চি খালি করে চলে যাওয়া। আর এও আশ্চর্য যে আমার পছন্দের বেঞ্চিটা সব সময় খালি পাই, কারণ সেটি খুবই প্রকাশ্য। আজ ঢুকেই দেখি দুধ সাদা জলের ফোয়ারা ছুটছে; সঙ্গে ওয়াটার লাইটের বাহারি জ্বলা নেভা। ফলে পাখিরা সব পালিয়েছে, এমনকি কাকও। সেই আওয়াজে বাতাস বা পাতার শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। আর আমার বসার জায়গায় একজন পুরুষ জমকালো লুঙ্গি ও কালো গেঞ্জি পরে, নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে; রাস্তার বাঁদিকে খালি না পেয়ে ডান দিকে বসে দেখি, মাথার ওপর পাতার ছায়া আর ফাঁক ফোকর গলে, চড়া রোদের ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ঝিলিমিল। ফোয়ারার শোভায় পাখিদের হারিয়ে, এদিক ওদিক তাকাতেই ডানদিকে অল্প দূরেই দেখি, মিষ্টি মিষ্টি চেহারার মেয়েটি নিশিন্তে নিজেকে সঁপে দিয়েছে একজন তুলনায় বয়স্ক ছেলের হাতে। ছেলেটি একেবারেই প্রেমিকোচিত নয়। মনে হচ্ছে বাজারের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে, মেয়েটাকে আদর নামক প্রবোধ দিয়ে, আবার বাজার করে বাড়ি ফিরে বউকে বলবে, ‘তোমার হাতের সেই লেবু চা’! মেয়েটাকে দেখে কী যে ভাল লাগছিল; কী সরল, আর কী নির্ভরতা! অনভিজ্ঞতার আরাম আর আনন্দ ওর সবটুকু জুড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার ওদিকে চোখ বোলাতেই দেখি, মেয়েটিকে বেঞ্চিতে বসিয়ে, দুষ্টু কাকু গোছের ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়াল, মুখোমুখি। লগ্ন মেয়েটি তাতেও মুখ গুঁজে, নিশিন্তে তাকে জড়িয়ে; আর ছেলেটি যেন স্নেহের স্পর্শ বোলাতেই এসেছে, অভিভাবক সুলভ এমন ভঙ্গিতে, মেয়েটির মাথা থেকে কাঁধ বেয়ে হাত নামাতে নামাতে, বাহুর নিচে স্পর্শ করেই, সন্তর্পণে আমার দিকে ঘুরে দেখতে লাগল। আমিও  স্থির দৃষ্টিতে দেখলাম যে, নিজের নাকে সে কখন যেন চশমা এঁটে নিয়েছে; মেয়েটার কোনও আড়ষ্টতা নেই; অথচ লোকটা (ছেলে নয় তো!) বাহু বন্ধনে মেয়েটিকে ধরে রেখেও, অপরাধীর চোখে আমাকেও দেখছে। ভাগ্যিস চোখ সরাইনি; না হলে তো দেখতেই পেতাম না, প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে মোবাইল বের করে, সঙ্গোপনে তার সময় দেখা; হায় রে! উঠে দাঁড়ানো, নাকে চশমা আঁটা এবং মোবাইলে সময় দেখা-– এসবই হল মেয়েটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেড়ে যাবার ছল। ধূর্তের অভিজ্ঞ প্রস্তুতি!

কোথায় ভাবছি ,

প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস…

তা না, অতি লোলুপের, আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে, অতি সতর্ক চাহনি!



আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ২ | দোলনচাঁপা | মন্দার মুখোপাধ্যায়

Tuesday, April 4, 2023

চাহনি | পর্ব ২ | দোলনচাঁপা | মন্দার মুখোপাধ্যায়

বছর আঠারো বয়েস। ইস্কুলের শেষ ক্লাস। পুজোর ছুটিতে মায়ের সঙ্গে এবার মধুপুর। বাবার বন্ধু সুরম্য জেঠুর বাড়ি। জেঠু জেঠিমা ছাড়াও বাড়ি ভর্তি লোক। সাত ভাইবোন সমেত, বড় দাদার এক বউ এবং দুটি ছানা। বাবা চলে যাবার পর, বহু মাস পরে, মাকে আবার হাসতে দেখল মিলি। সকাল সন্ধে জমিয়ে আড্ডা, গান, কবিতা আর দফায় দফায় চা। তিনখানি ঘরের একটা আটপৌরে, একতলা বাড়ি। রান্নাঘর লাগোয়া উঠোনের ওপারে, পাঁচিলের গায়ের নিচে যেটুকু মাটি, সেখানেই সাদা রঙের রাশি রাশি দোলন চাঁপা ফুটে আছে। নরম পাপড়ির মাঝখানে যেন লুকোনো সুগন্ধির ঝাঁপি। ভেতর উঠোন তাই সৌরভে ম ম করে। কুঁড়িগুলো সরু সরু লম্বা। এই ফুল ও সুগন্ধ মিলির কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। জেঠু বললেন, এর নাম দোলনচাঁপা।

ষষ্ঠীর সকাল। মায়ের কেনা সেই ফলসা রঙা তাঁতের ডুরে শাড়িটা পরে, কী মনে হল, একগুচ্ছ দোলনচাঁপা তুলে, নিজের একবেণীর বাঁ পাশে, যত্ন করে, ক্লিপ দিয়ে লাগাল মিলি। বাকি সকলে, এখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে, বারান্দায় দাঁড়াল মিলি। এখান থেকে গেট অবধি জমি; অনেকখানি এমনিই পড়ে আছে। ঘাস ভর্তি প্রজাপতি আর শালিখের ওড়াউড়ি। থামের গায়ে হেলান দিয়ে মিলি দেখছে, ঘাসের ওপর তার লম্বাটে ছায়া। সেই ছায়ার কাছে আরও একটি ছায়ার আভাস দেখা যেতেই, মিলি চোখ তুলে তাকাল। ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে এলে, জুতোর শব্দ হয় না; তাই সে টের পাইনি।

মিলি দেখল, একজন আত্মবিশ্বাসী যুবক তাকে দেখছে, অপার মুগ্ধতায়। আনত চোখে মিলি হাত ছোঁয়াল তার বেণিতে লাগানো, সেই দোলনচাঁপা গুচ্ছে। তার মনে হল, এটাই যেন দৃষ্টি টানছে ওই যুবকের। স্মার্ট বললেও কম বলা হয়। বলিষ্ঠ শরীরে যেন বিদেশ বাসের ছাপ। পায়ে ভারি জুতো। চোখে চোখ রেখে সে জানতে চাইল, ‘তুমি কে’? মিলি বলল, ‘বেড়াতে এসেছি; এটা আমার জেঠুর বাড়ি’। দু-পায়ে সবল দাঁড়িয়ে মিলিকে সে শুধু দেখছে তো দেখেছই। সেই সম্মোহনে মিলি স্থাণুবৎ। ভেতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে, সহর্ষে ভেতরে ডেকে নিল তাকে। মিলি জানল যে, যুবকটি এ বাড়ির বউদির ভাই। আগের রাতেই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে। ওখানকার পড়া শেষ করে, এবার সে এখানে চাকরি করবে।

সন্ধেবেলা আবার সে এলো। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির ওপর, গলায় একটা প্রিন্টেড সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে। মিলিকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যামেলিয়া লাগাওনি’? 

মিলি বলল, ‘দোলনচাঁপা’।

সদ্য বড় হয়ে ওঠা, সবে শাড়ি ধরা মিলি বুঝল যে, এ দেখাকেই বলে নিমেষ; বলে সম্মোহন। 

Friday, February 17, 2023

চাহনি | পর্ব ১ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

মুহূর্ত মানেই কি পলকে দেখা! চোখের পাতা পড়লেই অন্য সময়ে ঢুকে পড়া! গড়িয়ে যেতে যেতে আবার অপেক্ষা- আরও এক নতুন মুহূর্তের জন্য, যখন আবার পলক পড়বে না; স্থির হয়ে দেখিয়ে দেবে হৃদয় কী চায়! মূক  বা বাকরহিতও তো চোখে কথা বলে। স্বচ্ছ দীঘির মধ্যে কালো ছিপ-নৌকার মতো দুরন্ত ঘুরে বেড়ায় সেই  চোখের মণি; হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেই তৈরি হয় এক  বিশেষ উচ্ছ্বাস। কিছুটা আচেনা; হয়তো অজানাও। মনও তখন আঁকড়ে ধরে সেই দৃষ্টিটুকুই। ধরে রাখতে চায় সেই গোপন সঙ্কেত, না হারানো বিশ্বাসের মতোই। রোজকার কথা, হাঁটাচলা, মানুষে মানুষে যাতায়াত, গাছে জল দেওয়া, খাবার বানানো, বার চারেক তা খাওয়া, নিয়ম করে স্নান-– সব ভুলে যাই ক্রমে। ঘুমিয়ে থাকা কিছু অপলক দৃষ্টি, কত কী যে মনে করিয়ে দেয়! সব যেন থরে থরে সাজানোই থাকে। কোনওটা সাধারণ তাকে, কোনওটা বা মোহর জ্ঞানে নিভৃত লকারে। 

কমলা, এমনই চকিতে দেখেছিল, তার দ্বিতীয় বরের সেই দৃষ্টি। প্রথম বিয়ে ভেঙে দ্বিতীয়তেও সুখী হয়নি কমলা; আবার সে পা বাড়িয়েছিল, নতুন প্রেমিকের রোশনাই ইশারায়। আধিপত্যের জেরে কানাই তা আন্দাজ করতেই, জোর লড়ালড়ি। গালাগালির অল্প পরেই মার-– লাথি ও চুলের মুঠি ধরে দুরমুশ। বিয়ে ছেড়ে, ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল কমলা; তবু সে ভুলতে পারে না, সেই এক ছবি। বেদম মারের পর কানাইয়ের হাত দুখানা নিজের হাতে জড়ো করে সে বলছে,

-চলো খেয়ে নেবে; তোমার পছন্দের রুটি তড়কাই বানিয়েছি।

মিথ্যে চুম্বনের আশ্বাস জাগিয়ে বলছে,

- এমন মার কেউ মারে!

রাগ ভুলে কানাইও চেয়ে আছে অপলক, কমলার চোখে। জানে, যে কমলার চোখে যা কিছু, সবটুকু মিথ্যে আর ছল; বরের মার থেকে নিজেকে বাঁচাবার পথটুকু সে শুধু করুণা বিছিয়ে দিয়েছে; তবু নরম হয়ে আসে কানাইয়ের রাগ আর ক্ষোভ; কমলা অবাক তাকায়-– এত স্বচ্ছ! এত নরম! এত নির্ভরতা! লজ্জায় নিভে আসে দুর্বল কমলা।

চুম্বন বা সঙ্গম নয়; আজও তার মনে পড়ে, কানাইয়ের সেই দৃষ্টিটুকু।

বৃষ্টি শেষে ভেজা মাঠের মতো, ঝকঝকে সবুজ।

Saturday, December 25, 2021

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | তৃতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি প্রতিদিন দুপুরবেলায় বাবা-মা ঘুমতেন। প্রায় কখনোই তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মাঝে মধ্যে বাবা আমাদের বলতেন যদি সময় মতো ঘুম না ভাঙে তাহলে তাঁকে ডেকে দিতে। কিন্তু আমি আর আমার ভাই দুজনে সেই ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম যে কাজটা খুবই ঝুঁকির। জাগানোর সময় যদি কেউ তাঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকত বা তাঁর গায়ে হাত দিয়ে ডাকত, সঙ্গে সঙ্গে এমন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন আর এমনভাবে হাত নাড়াতেন যেন কারুর থেকে বা কোনও কিছুর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছেন। তখন খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাসও নিতেন। জাগ্রত বিশ্বে নিজেকে খুঁজে নিতে তাঁর কয়েক লহমা সময় লাগত। তাই আমরা একটা কৌশল আবিষ্কার করেছিলাম: শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খুব আস্তে আস্তে নরম স্বরে তাঁর নাম ধরে একটানা ডেকে যেতাম। তা সত্ত্বেও কখনও কখনও লাফ দিয়ে জেগে উঠতেন, তবে সাধারণত তা করতেন না। আর যেই তিনি ভয় পেয়ে জেগে উঠতেন আমরা এক ছুটে বারান্দায় পালিয়ে যেতাম।

তারপর ভালো করে ঘুম কেটে গেলে এমন করে দু’হাত মুখে বোলাতেন যেন মনে হত ধীরে ধীরে মুখ ধুচ্ছেন। তারপর তাঁর সেই প্রিয় নাম ধরে আমাদের ডাকতেন: ‘পেররো বুররো’১। হাতছানি দিয়ে আমাদের কাছে ডাকতেন ও তাঁকে চুমু খেতে বলতেন। জিজ্ঞাসা করতেন: “নতুন কি খবর আছে? কেমন চলছে সব?” রাতেও প্রায়শই শুনতে পেতাম ঘুমের মধ্যে গোঁ গোঁ শব্দ করছেন আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। মা তখন কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বাবাকে ডেকে তুলতেন। একদিন ওইরকম অশান্ত ভাবে সিয়েস্তা২ থেকে ওঠার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন।

-একটা খুব সুন্দর দিন আর আমি একটা ছোট ডিঙি নৌকায় বসে আছি, কিন্তু সঙ্গে কোনও দাঁড় নেই। একটা তিরতিরে শান্ত নদীর উপর দিয়ে নিঃশব্দে, খুব ধীরে ধীরে ভেসে চলেছি।

-এখানে দুঃস্বপ্নটা কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম।

-আমি জানি না।

কিন্তু আমার ধারণা যে তিনি জানতেন। কারণ তাঁর লেখায় সাংকেতিক কিছু আছে এ কথা তিনি সমানে অস্বীকার করলেও এবং কেতাবি ও বিদ্বজ্জনের সব তত্ত্ব যা তার গল্পের মধ্যে রূপকের সন্ধান করে তার থেকে সব সময় নিজেকে দূরে রাখলেও তিনি জানতেন যে আর সকলের মতো তিনিও অজ্ঞান মনের দাস। জানতেন যে একটা জিনিষ অন্য জিনিষের ভাবার্থ বহন করতে পারে। এবং অন্য অনেক লেখকের মতোই ধ্বংস এবং তার সর্বোচ্চ প্রকাশ মৃত্যু সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মৃত্যু– শৃঙ্খলাপূর্ণ ও শৃঙ্খলাহীন, যৌক্তিক ও যুক্তিহীন, অবধারিত ও অগ্রহণীয়।   

বাবার বয়স যখন সবে সত্তরের কোঠায়, বেশ কয়েকবার কেমোথেরাপির সময়ে এবং পরে, তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন কয়েক খণ্ডে তা প্রকাশ করবেন। প্রথম খণ্ড শুরু হয়েছিল বহু পুরনো স্মৃতির হাত ধরে আর শেষ হল তাঁর সাতাশ বছর বয়সে, যখন সাংবাদিক হিসাবে প্যারিসে গিয়েছেন। কিন্তু তারপর আর কিছু লিখলেন না, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সাফল্যের সময়গুলোর কথাই শুধু লিখলে আর সব বিখ্যাত আত্মজীবনীর মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে যাপনের মহিমা কীর্তন করা হবে। যেমন, অমুক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক রাত কি তমুক চিত্রকরের চিত্রশালা দর্শন বা রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র কি এক প্রতিভাধর বিপ্লবীর সঙ্গে জলযোগ।

-আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটাই আমার ভালো লাগে, বাবা বলেছিলেন, কারণ ওর মধ্যেই আছে আমার লেখক হয়ে ওঠার সময়টার কথা।

একবার একটা অন্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন:

-আট বছর বয়সের পর আর আমার জীবনে আকর্ষণীয় কিছু ঘটেনি।

ওই বয়সেই তিনি দাদু-দিদিমার বাড়ি ছেড়ে, আরাকাতাকা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। ছেড়ে এসেছিলেন সেই জগৎ যা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তাঁর প্রথম দিকের সৃষ্টিকে। তিনি স্বীকারও করেছিলেন যে প্রথম জীবনের লেখাগুলোই ছিল ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’-র জন্য হাত পাকানোর আসর।

স্মৃতিকথা লেখার জন্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাবা তাঁর প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই সেই শৈশবের পর আর দেখা হয়নি বা কোনোরকম কোনও যোগাযোগ ছিল না। কয়েকজনের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন, কারণ বন্ধুটি মারা গিয়েছিলেন। জীবনের এই দীর্ঘ পথ পারি দিতে গিয়ে যে কিছু বন্ধুকে ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছেন, এ আশঙ্কা তাঁর ছিল। কিন্তু কয়েকজনের ক্ষেত্রে যখন শুনলেন যে কিছু সময় মাত্র আগে তাঁরা মারা গেছেন তখন খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। তাঁরা সফল জীবন যাপন করেছেন, মোটামুটি সুখী ও সৃষ্টিশীল জীবন ছিল তাঁদের এবং সত্তরের কোঠায় পৌঁছে মারা গিয়েছেন, যা ছিল মৃত্যুর গড় বয়স। তাই ওই সব বন্ধুদের মৃত্যু কোনও ট্র্যাজিক ঘটনা নয়, বরং জীবনচক্রের স্বাভাবিক পরিণতিই বলা যায়। এই সময়টার পর তিনি বলতে থাকেন ‘আগে মারা যাননি এরকম অনেক মানুষ এখন মারা যাচ্ছেন’ এবং নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতেন।

১০

যদিও স্বভাবগতভাবে তিনি মিশুকে ছিলেন এবং আপাতভাবে মনে হত যে বাইরের জগতের সঙ্গে তিনি ভালোই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন, কিন্তু আমার বাবা আসলে খুবই মুখচোরা মানুষ, তাঁকে অন্তর্মুখী বললেও ভুল বলা হবে না। তাই বলে খ্যাতি উপভোগ করতে পারতেন না, তা নয় বা দীর্ঘ সময় ধরে খ্যাতির শীর্ষে থাকার ফলে নার্সিসিজম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন, এমনটাও বলা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমস্ত সময় খ্যাতি ও সাহিত্যিক সাফল্যকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। আমাদেরকে (এবং নিজেকেও) বারবার মনে করিয়ে দিতেন যে তলস্তয়, প্রুস্ত আর বোর্হেস নোবেল পাননি। যেমন পাননি তাঁর প্রিয় লেখক ভার্জিনিয়া উলফ, হুয়ান রুলফো ও গ্রাহাম গ্রিন। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত যে এই সাফল্য তিনি অর্জন করেননি, তাঁর জীবনে ঘটে গেছে মাত্র। কখনও নিজের প্রকাশিত বই ফিরে পড়তেন না (অবশ্য শেষ বয়সে যখন তাঁর স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল তখন এই কাজটা অনেকবার করেছেন)এই ভয়ে যে অসম্পূর্ণতা খুঁজে পেতে পারেন আর সেটা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে ব্যহত করবে।

১১

দু’দিনের জন্য আমাকে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরতে হল। সেখানে একটা চলচ্চিত্রের এডিটিংয়ের কাজ করছিলাম। গল্পটা হল বাবা আর ছেলের। যে দৃশ্যটা নিয়ে তখন কাজ করছিলাম, একটা দীর্ঘ ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্য, সেখানে একটার পর একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাবা ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে এবং তার জন্য সম্ভবত ছেলেটিও খানিকটা দায়ী। দৃশ্যটি খুবই করুণ, একটা দুর্ঘটনার পর সংঘর্ষ হল, তারপর মৃতদেহ বহন করে আনা হল, তাকে ধোয়া হল, তারপর শেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মৃতদেহটি ধ্বংস হয়ে গেল আর এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে গেল বাবা। যখন নিজের বাবার জীবনের শেষ কয়েকটা মাত্র দিন কি কয়েকটা সপ্তাহ বাকি, তখন এরকম একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে যে ভয়ংকর অনুভূতির সম্মুখীন হতে হবে তা কারুর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবুও ঈশ্বরের পরিহাস হিসাবেই তাকে মেনে নিলাম। কিন্তু সময় যত এগোতে থাকল এই দৃশ্যগুলো নিয়ে আর অনায়াসে কাজ করে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আমি শ্রান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম। এই রকম একটা গল্প লেখার জন্য তখন নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তখন প্রচুর চকোলেট খেতাম আর ভাবতাম যে গল্প আমাদের হাসায় সেটা লেখাই বোধহয় সবথেকে ভালো। আমি নিশ্চিত, পরের বার তাই-ই করব। অথবা হয়তো তা করব না।  

চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে কাজ শুরু করার প্রথম দিকে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন কোন কোন শিল্পীর কাজ আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। আমি বেশ সতর্কতার সঙ্গে নামের একটা তালিকা বলতাম। মোটামুটি একটা নিজস্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করতাম, তবে অনেক নামই ছিল অবধারিত। কিন্তু একটা পর্যায়ে পৌঁছে বুঝতে পারলাম যে আসলে আমি সত্যকথন থেকে বিরত থেকেছি। কোনও পরিচালক, লেখক, কবি, এমনকি কোনও ছবি বা গান আমাকে যা প্রভাবিত করেছে তার থেকে ঢের ঢের বেশি প্রভাবিত হয়েছি আমার বাবা-মায়ের দ্বারা, আমার ভাই, আমার স্ত্রী আর আমার মেয়েদের দ্বারা। জীবনের সমস্ত মূল্যবান শিক্ষা মানুষ মূলত বাড়ি থেকেই  শেখে।

১২

এক সপ্তাহের একটু বেশি হল বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছেন, কিন্তু মেহিকো থেকে ফিরে আসার পর মাকে এর মধ্যেই খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার কি মনে হয় যে সত্যি সত্যিই আরও কয়েকটা মাস বাকি। এমনভাবে প্রশ্নটা করলেন যে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই সময়কে ধারণ করার ক্ষমতা তাঁর নেই। বাবার জন্য বাড়িতে অত্যন্ত সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁকে রাখা হয়েছিল প্রধান শোবার ঘরগুলোর থেকে একটু দূরে, দিনে-রাতে সর্বক্ষণ দেখাশোনার লোক ছিল এবং সর্বোপরি তিনি বেশ শান্তই ছিলেন। বাড়ির বাকি অংশে মনেও হত না যে সেখানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে চলেছে। কিন্তু আমার মায়ের কাছে বাবার ওই ঘরটার ঘড়ির টিকটিক শব্দটাকেও মনে হত বড় দীর্ঘ আর গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো উচ্চকিত।

মাকে বললাম, অত দিন বোধহয় পাব না। তবে সেকথা বলেছিলাম শুধুমাত্র মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। পরের দিন সকালে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাবাকে পরীক্ষা করার পর মত বদলালেন: মনে হয় না আরও কয়েক মাস, বড় জোর আর কয়েক সপ্তাহ। মা চুপচাপ কথাটা শুনলেন সিগারেট খেতে খেতে, সম্ভবত একই সঙ্গে স্বস্তি ও বেদনার বোধ তাঁকে ঘিরে ধরল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বছর চল্লিশের একজন বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ এসে মাকে বোঝাতে লাগলেন শেষের সেই সময়ে কিভাবে যত্ন নিতে হবে। তখনও পর্যন্ত যতজন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তাঁদের মধ্যে ইনিই সর্বকনিষ্ঠ। ব্যাপারটা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল, কেননা এরকম একজন যুবক বার্ধক্যের সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবেন তা আর কে আশা করে। মা তো তাঁকে প্রায় জেরা করলেন, যেমন সবাইকে করেন। চিকিৎসক আমাদেরকে বললেন যে বাবার একটা লিম্ফ নোড ক্যান্সার হয়েছে যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তখন তাঁকে একেবারে অন্যরকম মনে হল, যেন খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন। তাঁর নিজের থেকে বয়সে অনেক বড় রোগীর মুমূর্ষু অবস্থার সামনে তিনি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে পড়েছেন। বললেন যে সেই মুহূর্তটি যখন আসবে, আমরা চাইলে স্যালাইন খুলে দিয়ে সময়কে ত্বরান্বিত করতে পারি। আমাদের ব্যাখ্যা করে বললেন যে কিছু দেশের নিয়ম অনুযায়ী কোনও অবস্থাতেই রোগীর স্যালাইন খুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না, যেহেতু সেখানে জলের প্রয়োজনকে মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে গণ্য করা হয়। কিন্তু মেহিকোর আইন ভিন্ন আর তাই মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে পরিবারের লোকজন স্যালাইন খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয় আর এটা খুব একটা বিরল ঘটনা নয়। তাছাড়া রোগী তখন ওষুধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, ফলে কষ্ট পায় না। নিঃশব্দে তাঁর সমস্ত কথা শুনলাম, যেন কোনও একটি লেখার এক অদ্ভুত স্বগতোক্তি আমরা শুনছি। কথাগুলো নির্দয় এবং অদ্ভুত। বাস্তববাদী, সহানুভূতিপূর্ণ, হননোদ্যত।

১৩

মা আর আমি একসঙ্গে বসে টিভিতে খবর দেখছি, হঠাৎ আমাকে বললেন: “আমাদের তৈরি থাকতে হবে কেননা একটা সার্কাস হতে চলেছে।” বাবার মৃত্যুর মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যম, পাঠক ও বন্ধুদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হবে মা তার কথাই বলছিলেন। বাবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই অসংখ্য মানুষ ফোন করতে ও চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন। তারপর কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ঘোষণা করল যে তিনি বাড়ি ফিরে গিয়েছেন, জীবনের অন্তিম সময়টুকু যাপনের জন্য। তাঁর ৮৭ বছর বয়স, সুতরাং যে কোনও সময়ে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।

ভায়ের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলাম বাবা মারা যাওয়ার পরেই কয়েকজন সাংবাদিক, যাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে, তাঁদের ফোন করতে হবে। তবে সেটা খুব বেশি নয়: কলোম্বিয়ার দুজন, একজন সে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের আর অন্যজন, বছর কুড়ি বয়সে বাবা যে সংবাদপত্রে প্রথম কাজ শুরু করেন, সেখানকার। আর মেহিকোতে দেশের প্রধান সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম এক মহিলা সাংবাদিক, যিনি রেডিও ও টিভির সংবাদের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া কয়েকজন নিকট বন্ধুদের জানাতে হবে, যাঁরা তাঁদের সুবিধামতো খবরটি প্রচার করবেন। এঁদের মধ্যে অবশ্যই ছিলেন বাবার এজেন্ট ও বান্ধবী, বার্সেলোনার এক দম্পতি এবং এক ভাই, যিনি কলোম্বিয়ায় তাঁর পরিবারের অন্যতম মূল স্তম্ভ। যদিও এঁরা সকলেই এই অন্তিম পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন।

টীকা:

১। পেররো বুররো: পেররো অর্থাৎ কুকুর আর বুররো অর্থাৎ গাধা।

২। সিয়েস্তা: ভাতঘুম


আগের পর্ব

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | দ্বিতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

Wednesday, December 16, 2020

কালীঘাটের মেয়ে পরিণীতা

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়: তখনও বেশি রাত হয়নি। দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে ফিরছি। আমরা জনা চারেক। একটা ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম। এখানে বেশ ভিড়। তবে বাইরে খোলা আকাশের নীচে চেয়ার-টেবিল পেতে বেশ গুছিয়ে রেখেছে ধাবা মালিক। চারটে চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা গল্পগুজব করছি। আমাদের লাগোয়া টেবিলে এক দম্পতি বসে। সঙ্গে আট-দশ বছরের একটি কন্যা। সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষ করি কন্যাটির মা আমার দিকে তাকাচ্ছে– যেন কিছু বলতে চায়! আমারও চোখটা ক্ষণে ক্ষণেই সেই মহিলার দিকে অজান্তে চলে যাচ্ছে। বলতে গেলে একটু অস্বস্তিই হচ্ছে। এইভাবে চলে কিছুকাল। তারপর ওই ভদ্রলোক ধাবার ভিতরে ঢোকে, হয়তো কিছু নতুন অর্ডার করতে, তখন হঠাৎই সেই মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বোঝার আগেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, ‘স্যার ভালো আছেন?’ আমি তো যাকে বলে হতভম্ব! কে এই মেয়ে, কীভাবেই বা আমি তার স্যার হলাম তা কোনও অনুমানেই বুঝতে পারছি না। কোনও ভাবেই মেলাতে পারছি না। একবার মনে হল, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের ছাত্রী ছিল কিনা। তা-ও হতে পারে না। কেননা গত দশ বছর যে সব ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি তাদের প্রত্যেকের মনে আছে– যাদের আমি নামে চিনি। এখনও আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হইনি। তবে কে এই ছাত্রী?

এরপর আমার অবস্থা মালুম পেয়ে মেয়েটি বলে, ‘চিনতে পারছেন না স্যার? আমার নাম নীতা। আপনি আমাকে পরিণীতা বলে ডাকতেন– কালীঘাট। এই ‘কালীঘাট’ শব্দটির সঙ্গে যেন কয়েক কোটি ক্যালেন্ডারের পাতা আমার চোখের সামনে ঝরে পড়ল। আমি যেন ফিরে গেলাম সাতাশ-আঠাশ বছর পিছনে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার উপান্তে। বস্তি সংগঠনের এক নেতা সেই সময় আমাকে পটিয়ে ফেলেন যে, সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, যারা সমাজে পিছিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাদের জন্য কাজ করার লোক নেই। তো কী সেই কাজ? ঠিক হল কালীঘাটের নিষিদ্ধ পল্লিতে যে শিশু-কিশোররা আছে তাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এদের মধ্যে কিছু ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় বটে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। এদের উৎসাহিত করতে হবে। আমার সেই বয়সে এমন ধরনের কাজে নিযুক্ত হওয়াকে বেশ গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। সপ্তাহে দুদিন পড়াতে হবে। ফলে তেমন কোনও চাপ নেই ভেবে শুরু করে দিলাম।

চাপ কি আর ছিল না? টালিনালার ধারে যাকে বলা যায় আদি গঙ্গা, তার দূষিত জলে, পচা গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে, একটা চালাঘরের মাটির দাওয়ায় প্রাথমিক ভাবে প্রায় জনা আটেক বাচ্চাকে নিয়ে আমার ক্লাস শুরু হল। চারদিকে মাছি ভন ভন করছে। দুর্গন্ধে প্রথম প্রথম বমি পেত। চারদিকের আবহ যাকে বলে মদোমাতাল আর কাঁচা খিস্তির বন্যায় রচিত হয়েছে। এখানে কেউ সোজা বা যাকে বলে সাধারণ ভাষায় কথা বলে না। সবাই উদমার্গের খিস্তি সম্বলিত ভাষাতেই অভ্যস্ত। এমনকী বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে সেই একই ভাষায় কথা বলছে বড়োরা। প্রথম দিকে মনে হত এসব বন্ধ করতে হবে। মাথা গরম হয়ে যেত। কিন্তু ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যাই। সেই দাদা নেতাটি আমায় বুঝিয়েছিলেন, ‘আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার তাবৎ পরিবেশ পালটানো তোমার কাজ নয়। আর তা পারবেও না। আমরা যদি এই বাচ্চাগুলোকে একটু লেখাপড়া শেখতে পারি তো জানবে বিরাট কাজ করা গেল।’ কথাটার যৌক্তিকতা আমার মনে ধরেছিল। ফলে বছর খানেক টানা টালিনালার পাশে এইসব বাচ্চাকাচ্চাদের পড়িয়ে গেছি। এদের লোক না হয়েও। কোথাও পুলিশ ঝামেলা করছে, কোনও খদ্দের মদ খেয়ে এসে হুজ্জুতি করছে, কার পালিয়ে যাওয়া বর এসে হুজ্জুতি করছে তার গতর খাটিয়ে বউ-এর কাছে, কে কাকে মারল ধরল, সব কিছুর মধ্যে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকলাম। কিন্তু আমার মূল কাজ ছিল সপ্তাহে দুদিন এই তথাকথিত বাপহারা ছেলে মেয়েদের পড়ানো। ‘বাপহারা’ কথাটা লিখলাম এই কারণে যে, প্রায় প্রত্যেকটি ছেলে মেয়ে জানে না বা তাদের জানানো হয় না যে কে তার বাবা, কী তার নাম। কখনও কখনও মায়েরা মিথ্যে নাম বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে যখন এরা স্কুলে ভরতি হতে গেছে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব সময়েই বাপের নামটাই প্রধানত গ্রাহ্য করা হয়, ফলে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। আর তখন তো আইন-কানুনও এখনকার মতো হয়নি।

এখানে এইসব শিশুকিশোরদের পড়াতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, বিশেষ করে এই স্কুলে ভরতি করার সময়। আজকে প্রচুর না হলেও অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকলেও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এদের জন্য লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে। সে-সময় এই ধরনের কিছু সংগঠন থাকলেও তা যে খুব উচ্চকিত ছিল তা নয়। হয়তো সম্ভবও ছিল না। সে যাই হোক, এই ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার মধ্যে ধরে রাখাই ছিল একটা বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ। কেননা মায়ের খদ্দের এলে তার মদটা, সিগারেটটা, খাবার-দারারটা নিয়ে এলেই কাঁচা পয়সা পাওয়া যায়। আর ওদের পড়াশোনা করার সময় ছিল সন্ধেবেলা। সে সময় তো এই অঞ্চল গমগম করছে।তখন কি আর পড়াশোনায় মন বসে! এদের মধ্যে অনেকেই ছিল লেখাপড়ায় বেশ ভালো, চটপট বুঝতে পারতো। কেউ কেউ একটু পিছিয়ে থাকা। তার করণটাও সহজেই বুঝে ফেলি। যে অবহেলায় ও মানসিক নিপীড়নের মধ্যে এরা জন্মায়, বড়ো হয়ে ওঠে– তাতে এই ধরণের সমস্যা খুব স্বাভাবিক। যেমন, আগেই বলেছি যে, একমাত্র মা-ই এদের ভরসা। তথাপি সেই মা যে তার ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য খুব একটা কিছু করতে পারে তা নয়। নিদেন দুবেলা খাওয়াও অনেকের জোটে না। তারপর আছে রোগভোগ। আপাতত ফিরে যাই সেই কালীঘাট থেকে উঠে আসা নীতার সঙ্গে দেখা হওয়া প্রসঙ্গে।

কালীঘাট শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার পর যথারীতি আমি নীতাকে চিনতে পারি। বলি, ‘কেমন আছিস মা?’ বেশ গর্বের সঙ্গে সে বলে, ‘খুব ভালো আছি স্যার।’ মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ‘এই আমার মেয়ে, আর ওই উনি হলেন আমার স্বামী।’ ইতিমধ্যে নীতার স্বামী ধাবা থেকে বেরিয়ে আসে। নীতা বলে, ‘ইনি, সেই স্যার, আমাদের কালীঘাটে পাড়াতেন।’ বুঝলাম, ছেলেটি আমার নাম পর্যন্ত জানে। স্বামী হাত মুখ ধুতে গেলে নীতাকে জিজ্ঞেস করি, ‘হ্যাঁ রে, পড়াশোনা কতটা করতে পড়েছিলি?’ নীতা এক গাল হেসে বলে ‘হায়ার সেকেন্ডারি অব্দি কিন্তু তারপর আর হল না। সংসার, মেয়ে সব সামলে আর পড়া হয়নি।’ ক্রমে সে চাপা গলায় শুরু করল তার জীবনবৃন্তান্ত। এই ছেলেটি নাকি ছিল তার মায়ের খদ্দের, প্রায়ই আসত। বয়সে প্রায় পনের বছরের বড়। সে-ই নাকি তার মাকে বুঝিয়ে নীতাকে বিয়ে করে। পাইপের ব্যবসা করে। আজ তার ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে; বোঝা গেল সঙ্গের গাড়িটা দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর মা-র খবর কী?’ নীতা ছলছলে চোখে জানায়,’কঠিন ব্যাধিতে মারা গেছে।’ শেষ বয়সে আমার কাছেই থাকত। আর কটা দিন আগে মাকে নিজের কাছে নিয়ে এলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম।’ এ তো প্রায় হিন্দি ছবির মিলানন্তক কাহিনি। তা হোক, আমায় কেন জানি একটা তৃপ্তির হাওয়া ছুঁয়ে গেল। ওরা পয়সা মিটিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি খনিকক্ষণ স্মৃতির মেঘের মধ্যে যেন ডুবে গেলাম। এই রকম তো আরও ছাত্রছাত্রীরা ছিল। তাদের কী হল? তাদের সঙ্গে কখনও কি দেখা হয়ে যাবে! আজও তার অপেক্ষায়ই আছি।

Monday, November 23, 2020

নির্মল হালদারের গদ্য


পানিপাথর

ওষুধত লাগবেকেই--

পকা লাগে। ওষুধ দিতেই হবেক।


পীযুষের কথা শুনে চেয়ে আছি লকলকে বাঁধা কপি ফুল কপির দিকে।

পালং শাকের জমিতে ফড়িং

উড়ছে। 

আকাশেও মেঘ। এই হেমন্ত দিনে বৃষ্টি হলে পাকা ধানের ক্ষতি। 

প্রকৃতির সঙ্গে কে কবে আর পেরে উঠেছে! বৃষ্টি এলে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মানব জগতের নেই।


পীযূষরা প্রকৃতির সঙ্গে থেকেও প্রকৃতিকে সব সময় বুঝে উঠতে পারে না। মাটিকেও বোঝে না। যে মাটিতে লাগিয়েছিল বেগুন

দেখা গেল গাছগুলো বেড়ে উঠতে উঠতে মরে যাচ্ছে। কি কারণ?

পরীক্ষা করাতে হবে মাটি। প্রভাস জানালো আমাদের।

ব্লকে কৃষি বিভাগের একটি শাখা আছে। সেইখানে মাটি নিয়ে গেলে, পরীক্ষা করে দেবে। তারপর বলেও দেবে,

এই মাটিতে কি হবে কি হবে না।


মুশকিল হল, এই তথ্য অনেক চাষি জানে না। অনেক সময় তো তাই, চাষ করে ও নষ্ট হয় বীজ। শ্রম ও টাকা জলে চলে যায়।


আমি এসেছি। চাষী ঘরে এসেছি। আমি যদিও এখানে খুব বেমানান পোশাকে আশাকে। কথাবার্তায়। আচরণে। তবুও এসেছি। কেননা, এইসব চাষীদের ঘরে

প্রাণের সম্ভার। সতেজ সজীব

প্রাণ।

কি পরিশ্রমটা করে এরা, না দেখলে না জানলে বোঝা যাবে না।

পীযূষ বিএসসি পাশ করে চাকরির পড়াশোনার ফাঁকে

বাপ ঠাকুরদার চাষবাসেও 

তার মন।


সাধারণত আজকাল দেখা যাচ্ছে, মাহাতদের অনেক তরুণ পড়াশোনা করে চাষের দিকে আর যায় না। ফলে, বাপ ঠাকুদ্দার চিন্তা হয়, তাদের অবর্তমানে চাষবাস আর হবেনা। আকাল দেখা যাবে।

ক্রমশ সংখ্যাটা বাড়লে, ভবিষ্যতে চাষবাস আর হবেই না, এই উদ্বেগ কাজ করে।


পীযূষ চাকরির পরীক্ষার জন্য অংক যেমন জানে তেমনি পালং পাতায় পোকা লাগলে 

দেখতে পায়। প্রতিকার করেও থাকে।


আমাকে ঘরের শাকসবজি দেবে বলে, নিয়ে এলো হাঁসুয়া।

একটার পর একটা ফুলকপি

বাঁধা কপি কাটতে থাকে।


আমার চোখে পড়ে টমেটো ক্ষেত। নীল লাল রঙে নিজেদের সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


কাছে যাবার সাহস মানে, জোর করে কাছে যাবো। কিন্তু গেলাম না। পীযূষকেই বললাম, কয়েকটা টমেটো দিস।


আমাদের ঘরে টমেটো পোড়ানা হয়ে থাকে। সঙ্গে নুন

কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ। ভাতের সঙ্গে খুব সুস্বাদু।


রাঁধনাশাল থেকে মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। তুষারের ন মাসের গর্ভবতী বউ ভাজছে।

 মাছ ভাজার গন্ধে খিদে চাগিয়ে উঠলেও মনে মনে স্থির করেছি, খাব না। ভাত খেয়ে আবার যাওয়া, বেশ ক্লান্তিকর। অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে।


তুষার ও পীযূষ এবং তাদের বাবাকে বললাম, খাওয়াটা বড় কথা নয়। এই যে আমি এসেছি, সবাই কথা বলছি। এইতো ঢের।


সকলের আন্তরিকতা টের পাচ্ছি ভেতরে ভেতরে, এই কথা বললাম না আর। শুধু বলবো, গ্রামের নাম পানিপাথর পরাবাস্তব পরাবাস্তব লাগলেও  পানিপাথর খুবই বাস্তব। খুব জ্যান্ত।


এই জ্যান্তর পাশেই আমিও

জ্যান্ত থাকতে চাই। আসতে চাই সময়ে অসময়ে।


আমার বন্ধু প্রভাস মাহাতর শ্বশুরবাড়ি হলেও আমার আত্মীয় বাড়ি তো বটেই। যেখানে আমি শুনতে পেয়েছি, ন'মাসের গর্ভ থেকে

এক সন্তান আমাকে বলছে,

আবার আসবে-- আসবে।


৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

২১-১১-২০২০


রচনা করেছি শয্যা


আমি বরাবর মেঝেতে শুই। মেঝেতেই আমার লম্বা-চওড়া বিছানা। এবং আমি বিছানার একধারে শুয়ে থাকি।

          বিছানাতে গড়াগড়ি খাওয়া আমার অভ্যেস নেই। আমার বালিশ থেকে অনেকটা তফাতে আরেকটা বালিশ। কোনো মানে নেই। অথচ মানে আছে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে যদি দেখি, কেউ শুয়ে আছে।

           আমার মনের বুনন এ রকমই। শুয়ে থাকবে যে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে নিয়ে চলে যাব ছাদে। উপর থেকেই তো উপরে ওঠা যায়। কি পূর্ণিমা কি অমাবস্যা

চাঁদ আমাকে ডাকে। 

           চাঁদ না বলে বলা ভালো চাঁদের বুড়ি।অনন্তকালের সম্পর্ক। চাঁদের বুড়ি চরকা চালায়। তার সুতো এত সূক্ষ্ম ও সুন্দর কোনোদিন ছিঁড়বে না।

            সম্পর্ক ছিঁড়বে না।

            কে আসবে বিছানায়? মাঝ রাতে তাকে ডেকে তুলবো? যে কেউ এলে চলবে না। বিশেষ বিশেষ মানুষ আছে আমার তালিকায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এলে, রাতভর বৃষ্টি। বৃষ্টির রঙ কি হবে? এও চিন্তার বিষয়। নীল হলে কেমন হয়? মেরুন রঙটা কেমন লাগে? রঙের দিকে না গিয়ে প্রেমের দিকে যেতে চাই।

প্রেমের গভীরতা মাপামাপি না করে, শুধু দেখবো প্রেমের আকর্ষণ কতদূর। 

             শুধু প্রেমে আমার বিশ্বাস নেই। কুল গাছে উঠবো আর পায়ে কাঁটা বিঁধবে না, তাহলে কুল আর পাড়লাম কই? রক্তাক্ত হতেই হবে।

             যখন কেউ আটা মাখছে তখন তার আঙ্গুলে ভেজা আটা লাগবেই। তবেই তো রুটি হবে সুস্বাদু। গরম গরম।

             না, আমার বিছানায় উষ্ণতা নেই। খড়ের বিছানায় শুতে পারলে উষ্ণতা পেতাম। একা শুলেও উষ্ণতা। কেন না, খড়ের অন্তর্নিহিত অর্থ , মায়ের ফেলে যাওয়া একটা অংশ। কেউ কেউ চুল বলে থাকে। তাই, খড় থেকে মায়ের ওম পাওয়া যায়।

             আমি কোনো ভাবেই চওড়া কপাল করে আসিনি। আমাকে বিছানা পাততেই হয়। বিছানা তুলতে হয়। সকাল হলেই যখন তুলছি তখন লক্ষ্য করি, কারোর কিছু পড়ে আছে নাকি। এই ভাবনা যে কত অবান্তর, নিজের কাছেই নিজে হেসে ফেলি। নীরব।

            বিছানা একাকীর নয়। অথবা বিছানা একাকীর। নিঃশব্দ। অনেকেই আছেন বিশেষ করে গ্রামের দিকে একা একা শুয়েও পাশে রাখেন একটা লাঠি। চোর তাড়ানোর জন্য। আমারও যে চোরের ভয় নেই এমনটা নয়। কিন্তু লাঠি রাখার কথা কোনোদিন ভাবি নাই। ঘুমের ঘোরে লাঠিতে পা পড়লে, যদি ভয় পাই? চেঁচিয়ে উঠি? হেসে উঠবে লাঠিও। মেনে নিতেই হয়েছে, নিজেরই দোষে একা একা বিছানায় আঁকিবুকি করবো।

              আমার লম্বা-চওড়া বিছানা দেখে কেউ কেউ জানতে চেয়েছে, এত বড় বিছানায় আর কে শোয়?আমি নিজেই যে ১ থেকে ১০০ হয়ে যাই, ক'জনকে আর বলবো। কিংবা আমি যে ১ থেকে শূন্য হয়ে যাই, বলতে চাই না কাউকে।

             সন্ধে হয়ে গেছে। আমি প্রতিদিনের মতো বিছানা পেতেছি। চারপাশে অসংখ্য চরিত্র আমার সঙ্গে কথা বলছে। সারাদিন পর ক্লান্ত লাগছে আমার। কিন্তু ক্লান্তিকে গ্রাহ্য করলে কিছুই যে করা যাবে না। আমার অনেক কাজ। অনেক কাজ বাকি আছে এখনো।


৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

২২-১১-২০২০

আলোকচিত্র: সন্দীপ কুমার