Saturday, November 25, 2023

চাহনি | পর্ব ১০ | দৃষ্টি বিনিময় | মন্দার মুখোপাধ্যায়

তিনতলায় বাবার স্টুডিও ঘর। বিশাল ঘরের উত্তর দিকের সদর দরজাটা আজ হাট করে খোলা। দক্ষিণের বড় জানলাটার কয়েকটা শিকও খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে জ্যেঠামণির দিক থেকেও সহজে ঢুকে আসা যায়। খোলা রয়েছে ঘর থেকে বার হয়ে পুবের বারান্দায় যাবার বাহারি কাচের দু’টো দরজা এবং তার মাঝখানের জানলাটাও। খোলা ওই ঘরের পশ্চিম দেওয়ালের গঙ্গা আঁকা খান ছয়েক জানলাও। চারিদিকে আত্মীয় স্বজনের নীরব কান্না। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে বাবা চলে যাচ্ছেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে। ডাক্তার কিষাণ কাকা ইনজেকশন দিতে এসে, কোনও হাতেই ভেইন পাচ্ছেন না। বিকেল তিনটে। ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে সূর্যাস্তের মরা আলো আর জোয়ার-বহা গঙ্গার বাতাস। কার্তিকের শেষ। হিম আর শিশির দু’ইই পড়ছে রাতে আর দিনে। তবু শীত বস্ত্র রাখছেন না গায়ে। পরিষ্কার স্বরে বললেন, আমি আর কুড়ি মিনিট; কাটাছেঁড়া আর নাই বা করলে!

বাবার ছাপান্ন বছরের লম্বা শরীরের মাঝামাঝি বসে আছেন আমাদের মা; মাথা নিচু করে। তাঁর ওই ঊনচল্লিশ বছরেই, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘনিয়ে আসবে বৈধব্য। নতুনদিদা এসে তাঁর বাঁ হাত থেকে খুলে নেবেন এয়োতীর লোহা। একে একে আমাদের দু’বোনকে দিয়ে চামচে করে তাঁর গালে দেওয়ানো হল শেষ জলটুকু। বাবা তাকালেন না। তাঁর ঠোঁট দু’টি ভিজে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে এল অশ্রু। ঠাকুমা আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছিয়ে দিতেই, এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে; বা হয়তো চোখের দিকে। ঘর ভর্তি গুরুজনদের উপস্থিতি ভুলে, মা-ও তো  অপলক। দু’জনের গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণ পথ কেটে হেঁটে এল মৃত্যু। বিকেল ঠিক তিনটে কুড়িতেই চোখ বুজলেন বাবা। থেমে গেল দৃষ্টি বিনিময়। স্থাণুবৎ মা, স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তাঁদের যৌথ জীবনের লোপাট হয়ে যাওয়া অস্তিত্বের দিকে। 

মৃত্যুকে মাঝখানে রেখে দু’জনের এমন চাহনি বিনিময় আর কি দেখেছি!

3 comments: