Wednesday, November 10, 2021

সিলভিয়া এউখেনিয়া কাস্তিয়েরোর কবিতা | সেই সামান্য বিরহে

মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ | জয়া চৌধুরী


পঞ্চম বসবাস: মোহভঙ্গ 

প্রতিবার যখন ভুট্টার কাণ্ড আরও লাল হতে থাকে

ভুট্টা গাছের পাতা থেকে ঝোলে একটা ফারের পুতুল

বালিকারা লুকোচুরি খেলে

এবং কাকতাড়ুয়াদের অনাবৃত করে ফেলতে থাকে।

সে রয়ে যায় মুখহীন, পরে এক চোখ কানাও,

কান দুটো ওকে হিঁচড়ে টানতে থাকে যতক্ষণে না সে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।

ফুটো ফুটো জালিকায় ভরা আমার বাবাকে ওরা 

যখন অপহরণ করেছিল ঠিক তেমনটি। 

সেই সমতল বিকেলে 

মনে হচ্ছিল ভুট্টার শীষ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্ত;

পুতুলের তখন আর নাক নেই, দেখতে পায় না গন্ধও নয়,

চিৎকার করতেও পারে না, বহু মানুষের মাঝখানে ও মারা গিয়েছে,

যেখানে সব শবদেহ রয়েছে বালিকারা সেখানে ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল

তখন সবে ওরা ক’জন ভদ্রলোককে বড় বড় পিস্তল দিয়ে গুলি করে উঠেছিল।


বাহুল্যবর্জিত শূন্য

বিকেলের তীব্র আবেগ

সেই কালিমা যা আমার পিছনে ধেয়ে আসে

সেই শুভ্রতা যা আমার স্কার্টকে রঙিন করে তোলে

পৃথিবীর এই খণ্ডে এ হল গোধূলি

আমাকে দংশায় আগুন

ফুলে ওঠে পেট

মুখ জ্বলতে থাকে

মনে হয় বুক থেকে বের হয়ে আসছে পা দুটো

এ হল ভয় যা কর্কশ আওয়াজে আমার শিরদাঁড়া খায়

সমস্ত ভুট্টা ক্ষেত পুড়তে থাকে

জ্বলতে থাকে সমগ্র জনপদ

বাহুল্যবর্জিত শূন্যরা

দুলতে থাকা বৃক্ষদের দিকে

আমার লাল স্কার্ট ছড়িয়ে পড়ে

বিদ্ধকারী সাঁড়াশিদের মতো

ভাঙা জানলারা পড়ে যায়

আমার পোড়া হাতদুটো জল খোঁজে

এক শ্বাসরোধী আগুন খড়ের উপর চিৎকার করে

ডুবে যাওয়া আমার সে চিৎকার, একটা কাঁপুনি

আগুনে গোটা পাহাড় দুমড়ে যায় 

তোমার ভেদকারী চোখেরা আমাকে পলকহীন রেখে দেয়

শস্যাগারে বাড়তে থাকে আগুন

পাশে পাহাড়ে তখন কেবল বাহুল্যবর্জিত শূন্য।


একটি ক্রিসেন্থিমাম পরিধান করি

এবং চুলের উপর সাদা মুকুট;

মা পরেন সাদা জুঁইফুল

এবং গোলাপের মুকুট, কাঁটাগুলি একটি আঙুলে ফোটে।

কাঠের ড্রয়ারে 

ও তার খুলির ভিতরকার বিরাট গর্তে

বাবার গভীর চাহনিতে মা কেঁদে ওঠেন।

ঠাকুমা বাবাকে গুছিয়ে দিয়েছিল যাতে ওরা তাঁকে দেখতে না পায়

কিন্তু আমার মনে তো ওঁরা থাকবেনই। 

মা জানু ঢাকা মোজা পরেছেন, কুঁজো হয়ে হাঁটেন,

চোখে পাথুরে চাহনি, ওঁর আঙুলের রক্ত

বাবার মুখের ওপরে পড়ে টপ টপ, সঙ্গী থাকা কুমারী 

মেরীর ছবিটিতেও। বাবা হাসতে থাকেন,

হয়ত তখনও পালিয়ে না গিয়ে মেঘের ভিতরে থাকেন,

বাবা ভুট্টাক্ষেত বুনতেন এবং মিথ্যে বলতেন,

তারপর লুকিয়ে পড়তেন 

যতক্ষণ না ফের বেরিয়ে পড়েন এবং পাহাড়ে হারিয়ে যান,

ওঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় ওরা পায়, কথা বলছিলেন না, কেবল মিথ্যে বলছেন।

ক্রিসেনথিমাম ফুলেদের পাপড়ি ঝরে পড়ে,

মৃত্যু গন্ধ ছড়িয়ে ঢলে পড়তে থাকে জুঁই, তবে ঠাম্মার

গ্লাডিওলাসের শাখারা ঢের বেশি সিরিয়াস, সুগন্ধ ছড়ায় না, কাঁটাও ফোটায় না।

তারা দুঃখী হয় না কক্ষনও।


যেদিন থেকে বহুবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া শরীর পড়েছে

ঝোপঝাড় দেখলে মনে হয় কাকতাড়ুয়াদের জন্ম দেবার পক্ষে ওরা যথেষ্ট উর্বর 

এবং বিছানার চাদরের মত ওরা ঝুলতে থাকে

দেখায় যেন তীর বিঁধে আছে কাণ্ডে,

আকাশ অন্ধকার করে দিয়ে পাখিরা চিৎকার করতে থাকে

এবং পালায়।

এককোণে ভীষণ লালচুলো এক ডাইনির উদয় হয়

তার মুখে ঘাস আটকে রয়েছে।

নিরলঙ্কার যন্ত্রণার ভেতরে স্তব্ধ, এ এক গর্ভপাত হওয়া চিৎকার।

ডাইনিটা বেগনি। ট্রেন থেকে ছেঁচড়ে নামিয়ে আনার আগে

ওকে নিশ্চয় ওদের শ্বাসরোধ করে রাখতে হয়েছিল। দুলছিল

ঝড়ের সামনে দোল খাচ্ছে বলে, পাশে থাকা ভুট্টার পাতাদের

দেখে মনে হয় দুর্ভাগ্য দেখে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।

চোখ খুবলে নিতে পাতিকাকেরা এগিয়ে আসে,

দুটি গভীর গর্তের

ভেতরকার গোলকধাঁধা দেখতে রেখে যায়;

পরে শকুনেরা তা খেয়ে ফেলে

ভাঙা হাড়গোড়গুলো ফেলে যায়।

সে নারী প্রতিরাতে লাঙল হাতে

গ্রামবাসীর জানলায় উঁকি দেয়।


আগ্নেয়গিরির মতো, কলঙ্কময় সূর্যের আলোয়

ভরাভর্তি চারমাথার মোড়ে ছোটরা দৌড়াদৌড়ি করে;

দেয়ালে বিষুবরৈখিক স্বরভঙ্গি,

কুটিরশিল্প, ইন্ডিয়ান জনজাতির মানুষ, মদ;

ধীরস্থির বুড়োদের জাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট 

এবং মেঝে ঢেকে দেয়া পাতারা।

তিনজন পুরুষ কাছে এগিয়ে আসে, হাঁটার সময় তারা একেবেঁকে চলে,

দেখলে মনে হয় চোখ নেই, চারমাথার মোড়ের আধখানা গিয়ে

পালানোর পথ খোঁজে, একটা ডাকের জন্য অপেক্ষা করে, নগ্ন আকাশে

লুকোতে চাইবার এক চিহ্ন,

চারমাথার উপরে ছুরি দিয়ে ফালাফালা করার মতো একটা শতপদী কেঁচো 

পবিত্র নৈবেদ্য-গিঁট,

গলা, হৃৎপিণ্ড। এবং ওরা শুকিয়ে যায়।


আধঘুমন্ত মানুষ।

দ্রুত হাতদা-র ধার দিয়ে স্তন দুটো ছোঁয়।

ট্রেনের ছাদে

মুরগিপালকেরা তাদের হ্যাচারি বয়।

ডানা ক্ষইতে থাকা মোটাসোটা মুরগিরা 

নড়াচড়া করতে পারে না।

পাতা জুড়ে একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে,

ঘাড়ের প্রধান শিরা প্রতি মুহূর্তে আরও পুরু হয়ে চলে--

এটা ভয়-- ছুরি ও ছেদ চওড়া হতে থাকে,

বাড়তে থাকে-- রক্ত বুদবুদ করে ফুটতে থাকে

বাতাসের সংস্পর্শে কালো হয়ে যায়। 

মাথা চোখ বোজাতে সে অস্বীকার করে

যেন তাদের খুঁজছে।

ভেতর থেকে থকথকে কাদার গন্ধ ফুটতে থাকে।


যেদিন অপহরণ ঘটেছিল

আমার পুতুলটা লাল পুকুরে পড়ে গিয়েছিল,

মাথায় ফুটো ছিল ওটার 

আমরা তখন দৌড়চ্ছিলাম আর মা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

আমার পুতুলটা ভাঙা চোখে আকাশের দিকে 

মুখ করে পড়েছিল 

এবং একটা গর্তের ভেতরে

প্লাস্টিকের মতো দুটো গুলি আটকে ছিল।

আমার ত্বকে ঠাণ্ডা লাগছে 

নখেরা আমায় চিরে ফেলতে আসছে,

আঙুল দিয়ে কেটেও ফেলল।

আমার ক্ষতি করল ওরা। 

শূন্য থেকে নীল চোখে আমার পুতুল

আমার দিকে চেয়ে রইল,

নোংরা রক্তটাকে আমি দেখেই যাচ্ছি।



---------------------------------------------------------

কবি সিলভিয়া এউখেনিয়া কাস্তিয়েরো মানসানো (Silvia Eugenia Castillero Manzano) জন্মেছেন মেক্সিকো শহরে। গুয়াদালাখারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা ‘লুভিনা’ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ২০১২ সালে বাইসেন্টিনিয়াল লেটার্স পুরষ্কার পেয়েছেন। সপরিবারে কলকাতায় এসেছিলেন ২০১৯ সালে। আইসিসিআরে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি।

No comments:

Post a Comment