Monday, November 15, 2021

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | দ্বিতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”


একান্ত আপনজনের মৃত্যু সম্বন্ধে লিখতে গেলে একটা দূরত্বের প্রয়োজন, সময়ের দূরত্ব। ঘটনাটা যেন অনেক পুরোনো হয়, লেখনি নিজে যতটা প্রাচীন, ততটা। তাই এ লেখার কাজে হাত দিতেই গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল। বিষয়গুলো এক এক করে নির্দিষ্ট করে নেওয়ার কথা ভাবতেই আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম, তারপর সেগুলো লিখতে গিয়ে ভীষণ বিব্রত বোধ করছিলাম আর তাদের ফিরে পড়তে গিয়ে একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। আসলে, আমার বাবার খ্যাতিই এই লেখার ক্ষেত্রে মানসিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করছিল। লেখার প্রয়োজনীয়তার চেয়েও তখন বড় হয়ে দাঁড়াল আমার দ্বিধা। মনের মধ্যে বারবার সন্দেহ হচ্ছিল, আজকের মধ্যমেধার বাজারে নিজের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি না তো। তার চেয়ে বোধহয় খ্যাতির অন্তরালে থেকে না লেখাই ভালো ছিল। আসলে তো আমি আড়ালে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। কিন্তু লেখনির ক্ষেত্রে যা ঘটে, লেখক বিষয়কে নয় বরং বিষয় লেখককে বেছে নেয় আর তখন সমস্ত বাধাই অকৃতকার্য হয়ে যায়।

মাস কয়েক আগে এক বান্ধবী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে আমার বাবা কেমন আছেন? তাকে বললাম, তিনি শুধুমাত্র বর্তমান সময়ে বেঁচে আছেন, অতীতের বোঝা নেই, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাও নেই। অতীতের অভিজ্ঞতার উপর ভর করে বা গল্পের অন্যতম উৎসের মতো পূর্ব অভিজ্ঞতার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যে ভবিষ্যতের দর্শন, তাঁর জীবনে তার আর কোনও ভূমিকা নেই। 

-তাহলে তিনি বুঝতে পারছেন না যে মারা যাবেন, বান্ধবীটি বলল, কি সৌভাগ্যবান!

বান্ধবীকে যা বলেছিলাম তা প্রকৃত বাস্তবের একটি সরলিকৃত অংশ মাত্র। বাবার চৈতন্যে তখনও পর্যন্ত অতীতের ছাপ রয়ে গিয়েছিল। যেমন ভাবে আগে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতেন, একটার পর একটা প্রশ্ন করে, ‘কেমন আছো?’ ‘এখন কোথায় থাকো?’, ‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’, সেই অভ্যাসের প্রতিধ্বনির মতো তিনি কথা বলে যেতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে আরেকটু বেশি কিছু বলতে যেতেন, আর তখনই খেই হারিয়ে ফেলতেন মাঝপথে। ভুলে যেতেন কি নিয়ে কথা বলছিলেন আর চুপ করে যেতেন। তখন তাঁর সেই বিভ্রান্ত অবস্থা (সিগারেটের ধোঁয়ার ক্ষণিক উপস্থিতির মতোই তাঁর মুখে লজ্জার অরুণাভা মুহূর্তের জন্য খেলা করে যেত) দেখে বোঝা যেত এরকমভাবে কথা বলে যাওয়াটা একসময় তাঁর কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ছিল। রসিকতা, আনন্দ, স্মৃতিমেদুরতা আর উত্তেজনায় ভরপুর সেই সব কথোপকথন। তাঁর সব বর্ষীয়ান বন্ধুরা বলতেন যে তিনি লেখায় যেমন আলাপেও তেমন সমান প্রতিভাধর। ভবিষ্যতের ভাবনাও যে পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন এমনটা নয়। সন্ধ্যে হলে মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আজ রাতে আমরা কোথায় যাব? বেশ আনন্দ হয় তেমন একটা জায়গায় যাওয়া যাক। চলো নাচতে যাই। কেন? কেন নয়?’ প্রসঙ্গটা একটু পালটে দিলেই ভুলে যেতেন কি বলছিলেন এতক্ষণ।  

বাবা মাকে চিনতে পারতেন আর কত নামে যে তাঁকে ডাকতেন: মেচে, মেরসেদেস, জননী, লা মাদ্রে সান্তা। কিন্তু কিছু দিন আগে কয়েক মাসের জন্য পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়েছিল। তখন সারা জীবনের সঙ্গিনী নিজের স্ত্রীর কথা মনে করতে পারলেও সামনে যে মহিলাটি রয়েছেন, তিনি-ই যে তাঁর স্ত্রী, সেকথা হাজারবার বললেও বিশ্বাস করতে পারতেন না। 

-এই মেয়েটি আমার কেউ নয়, তবে কেন সে এখানে রয়েছে আর বাড়ির সব কাজ দেখাশোনা করছে?

মা তখন রেগে উঠতেন। 

-‘কি হয়েছে ওর?’ অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করতেন। 

-বাবা এটা করছে না মা, করছে ওঁর ডিমেন্সিয়া।

মা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি তাঁকে ভুল বোঝাচ্ছি। আশ্চর্যজনকভাবে এই পর্যায়টা কেটে গেল এবং বাবার স্মৃতিতে মা আবার তাঁর নিজের জায়গা ফিরে পেলেন, তাঁর সেই আজীবনের সহচরী। সেটাই ছিল তাঁদের শেষ বন্ধন। তাঁর সেক্রেটারি, গাড়ির চালক, রাঁধুনি-- যাঁরা দীর্ঘদিন এ বাড়িতে কাজ করেছেন তাঁদের সবাইকে চিনতে পারতেন। তাঁরা সবাই ছিলেন কাছের মানুষ, পছন্দের মানুষ, যাঁরা তাঁকে আগলে রাখবেন। কিন্তু কারুর নাম মনে রাখতে পারতেন না। আমি আর আমার ভাই যখন তাঁকে দেখতে যেতাম খুব সতর্কভাবে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের দেখতেন, যেন একটা প্রবল কৌতূহলের ব্যাপার। আমাদের মুখ দেখে বহুদিন আগের কিছু একটা মনে পড়ত হয়তো, কিন্তু আর আমাদের চিনতে পারতেন না। 

-পাশের ঘরে ওরা কারা? কর্মচারীদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন।

-আপনার ছেলেরা।

-সত্যি? ওই লোকগুলো? ধুর ছাই, বিশ্বাসই করা যায় না। 

বছর দুয়েক আগে একটা ভয়ংকর দুঃসময় এসেছিল আমাদের জীবনে। বাবা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন যে ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এই কথাটা বার বার বলতেন আর সমানে আমাদের সাহায্য চাইতেন। একটা মানুষকে ওই চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে দেখা এবং একই কথার বারংবার পুনরাবৃত্তি সহ্য করা যে কি ভয়ানক! বাবা বলতেন, ‘আমার কাজই হল স্মৃতিকে নিয়ে। স্মৃতি হচ্ছে আমার কাজ করার যন্ত্র ও প্রাথমিক উপাদান। সেই স্মৃতি ছাড়া আমি কাজ করতে পারব না, তোমরা আমায় দয়া করে সাহায্য করো।’ তারপর এই কথাটাই বিভিন্ন ভাবে বলে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। খুবই বিধ্বস্ত হয়ে পড়তেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পর্যায়টা চলে গেল। খানিকটা শান্ত হয়েছিলেন আর মাঝে মাঝে বলতেন:

-আমার স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে, কিন্তু তা যে হারিয়ে ফেলছি সৌভাগ্যক্রমে সেটাই আমি ভুলে যাচ্ছি।

অথবা,

-সবাই এমন করে যেন আমি একটা বাচ্চা ছেলে। তবে সেটা আমার মন্দ লাগে না।  

বাবার সেক্রেটারি আমাকে বলেছিলেন, একদিন বিকেলে তাঁকে দেখতে পান বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ বহু দূরে, গভীর কোনও ভাবনায় যেন ডুবে আছেন। 

-এখানে কি করছেন, দোন গাব্রিয়েল?

-কাঁদছি।

-কাঁদছেন? কই না তো?

-হ্যাঁ কাঁদছি, তবে চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। বুঝতে পারছ না যে আমার মাথায় আর কিছুই নেই?  

 আরেকদিন সেক্রেটারিকে বললেন:

-এটা আমার বাড়ি নয়। আমি আমার বাড়ি যাব। আমার বাবার বাড়িতে। সেখানে বাবার খাটের পাশেই আমার খাট আছে। 

 আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে উনি বাবার কথা নয়, বলছিলেন দাদামশাই কর্নেলের কথা (কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরিত্র যাঁর আদলে গঠিত)। আট বছর বয়স পর্যন্ত তিনি দাদুর সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর খাটের পাশে একটা ছোট্ট তোষকের উপর আমার বাবা ঘুমোতেন। ১৯৩৫ সালের পরে আর তাঁদের দেখা হয়নি।

-এরকমই অবস্থা হয়েছিল আপনার বাবার, তাঁর সহকারী আমায় বলেছিলেন, কি সুন্দরভাবে সব কিছু বলতেন, এমনকি ভয়ংকর ব্যাপারও। 

একদিন সকালে চিকিৎসা সঙ্ক্রান্ত জিনিষপত্র ভাড়া দেয় এমন একটি কোম্পানির এক মহিলা কর্মচারী এসে একটা খাট দিয়ে গেলেন। বাবার সেক্রেটারির নির্দেশ অনুসারে তিনি সেটাকে গেস্টরুমে রাখলেন। কিছুক্ষণ পরে, রাতের খবরে সেই মহিলা দেখলেন যে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন তিনি বুঝতে পারলেন কার জন্য ওই খাট তিনি এনেছিলেন। পরের দিন তাঁর মালিকের নাম করে একটি চিঠিতে তিনি আমাদের লেখেন, বাবার জন্য খাটটি দিতে পারায় তাঁরা গর্বিত এবং তার জন্য অবশ্যই কোনও টাকা দিতে হবে না। আমার মা প্রথমে এটা মেনে নিতে চাননি, কারণ তিনি মনে করতেন যে সমস্ত খরচ নিজেদের পকেট থেকেই করা উচিত। তবে পরে তাঁকে আমরা বোঝালাম যে এক্ষেত্রে বিরোধীতা না করাই শ্রেয়।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর বাবার ডিসচার্জ সার্টিফিকেট একটি ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত হল। সম্ভবত আমার ভায়ের হাত থেকে সার্টিফিকেটটা পড়ে গিয়েছিল এবং হাসপাতালে দেখা করতে আসা কোনও এক মহিলা সেটা কুড়িয়ে পান। তিনি সেটা দেন তাঁর মেয়েকে, যার তখন একটা অপারেশন হয়েছিল এবং সে বাবার লেখার খুব ভক্ত ছিল। কিন্তু সেখান থেকে কিভাবে যে কাগজটা খবরের কাগজের অফিস অবধি পৌঁছে গিয়েছিল সেটা এখনও একটা রহস্যই রয়ে গেছে।

যে মুহূর্ত থেকে রটে গেল যে আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গণমাধ্যমের লোকজন এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা একে একে বাড়ির বাইরে জড়ো হতে শুরু করলেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার দিন প্রায় শ’খানেক লোকের ভিড় ছিল বাড়ির সামনে। এমনকি সরকার থেকে পুলিশ পোস্টিং করা হল যাতে বাড়ির মূল ফটকের সামনের নির্দিষ্ট একটা অংশ পর্যন্ত কেউ না আসতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সটাকে গ্যারেজের মধ্যে উলটো দিকে মুখ করে ঢোকানো হল। কিন্তু সেটা এত বড় যে দরজা খোলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার ভাই, বাড়ির একজন কর্মচারী ও বাবার সেক্রেটারি একটা চাদরকে পর্দার মতো উপরে তুলে ধরলেন যাতে কেউ ছবি তুলতে না পারে আর তখনই বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সের পেছন দিক দিয়ে বের করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর যখন দেখলাম যে আমাদের সামান্য ব্যক্তিগত পরিসরটুকু রক্ষা করতে আমার ভাই যে চাদর ঝুলিয়ে রেখেছিল সেই ছবিটাও প্রকাশিত হয়ে গেছে, তখন আমি সত্যি সত্যিই রেগে উঠেছিলাম। কিন্তু তারপর নিজেকে বললাম, শান্ত হও, কারণ দরজার বাইরে এই যে এত মানুষ জড়ো হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বাবার ভক্ত পাঠককুল এবং বাকিরা কোনও ছোটখাটো পত্রিকার নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমের সব প্রতিনিধি। 

বন্ধু-বান্ধব বা চিকিৎসক যাঁরাই বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন বা বেরোচ্ছেন সাংবাদিকেরা তাঁদেরকে সঙ্গে সঙ্গে ছেঁকে ধরছেন নতুন খবর জানার জন্য। এঁদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তখন আমরা অন্য একটা গ্যারেজ ব্যবহার করতাম এবং গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিতাম। বাবার সেক্রেটারি আমায় একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। সেই সপ্তাহে একদিন আমার মা বাইরে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু ফেরার সময় গ্যারেজের দরজা খুলতে পারেননি। তখন কয়েক পা এগিয়ে মূল দরজা দিয়ে ঢোকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু যেই তিনি গাড়ি থেকে নামলেন স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা ও আবেগে সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাস্তাটা নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি মাথাটা একটু হেলিয়ে, যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন এমনভাবে সেই পথটুকু পার হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁকে খুব একটা উত্তেজিত বলে মনে হল না, এমনকি চারপাশের সবাই যে চুপ করে গেল সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ উদাসীন, যেন মনে হচ্ছিল নিজের শোবার ঘর থেকে বাথরুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। আমার বাবা প্রায়ই বলতেন মায়ের মতো এমন আশ্চর্য মানুষ তিনি আর কখনও দেখেননি।

বাবাকে আমরা তাঁদের শোবার ঘরে রাখলাম না, কেননা তাতে মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। তাঁকে রাখলাম বারান্দার প্রান্তের একটা ঘরে যেটা গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহৃত হত, আবার মাঝে মাঝে প্রোজেক্টর লাগিয়ে সিনেমাও দেখা হত। কয়েক দশক আগে ওখানে একটা বড় ছাদ ছিল আর কলেজের সব ছেলেমেয়েরা এসে সিগারেট খেত। তবে পরে জায়গাটাকে ঘিরে দেওয়া হয়।

হাসপাতালের মতো খাটে শুইয়ে দেওয়ার পর বাবার প্রথম কথা, ‘বাড়ি যাব’। বেশ বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে প্রায় অবোধ্য স্বরে বললেন। মা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি বাড়িতেই আছেন। কিন্তু অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে চারপাশে তাকালেন, মনে হল না যে কিছু চিনতে পারছেন। তিনি ডান হাতটা তুললেন, বেশ কাঁপছে, তারপর তাকে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে একটা ভঙ্গী করলেন যা একেবারেই তাঁর নিজস্ব। হাতটা প্রথমে কপালে রাখলেন, তারপর চোখের উপর ধীরে ধীরে বুলিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলেন। এরপর ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটদুটো টিপে বন্ধ করলেন। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, বা গভীর মনোযোগ দিতেন কিংবা কিছু শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতেন, তখন এই ভঙ্গীটা করতেন। সাধারণত কারুর কোনও কষ্টের কথা শুনেও এরকম করতেন। পরের কয়েক দিন এই ভঙ্গীটা ঘনঘন করতে লাগলেন।

বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য সাধারণত দুজন লোক ছিলেন। তার সঙ্গে দু’জন নার্স দিনে ও রাতে পালা করে তাঁর কাছে থাকতেন। দিনের বেলার নার্সটি ছিলেন সত্যিই অসাধারণ। হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার সময় ওখান থেকেই তাঁকে সুপারিশ করেছিল। তাঁর বয়স তখন তিরিশের কোঠার শেষের দিকে। বিবাহিতা তবে অপুত্রক, খুবই ভদ্র ও শান্ত, আত্মবিশ্বাসী এবং খুব হাসিখুশি। তিনি সমস্ত কিছু নিখুঁতভাবে, পরিষ্কার হাতের লেখায় লিখে রাখতেন। ওষুধ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ নির্ভুলভাবে গুছিয়ে রাখতেন আর ঘরের পর্দাগুলো এমনভাবে খোলা-বন্ধ করতেন যাতে সারা দিন ঘরের মধ্যে একটা শান্ত, স্তিমিত আলো খেলা করে। তাঁর কাজের দক্ষতা ও সুমধুর ব্যক্তিত্ব তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। সর্বোপরি রোগীর প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ ভালোবাসা। বাবাকে ডাকতেন ‘ডার্লিং’ বা ‘ছোট্ট সোনা’ বলে। শুধু একবারই তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখেছিলাম। চিকিৎসকের শেষ নির্দেশগুলো দেখতে গিয়ে একটা অসঙ্গতি তাঁর চোখে ধরা পড়ল। বাবার নির্দেশ ছিল সেই রকম সময় উপস্থিত হলে তাঁকে যেন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা নাহয়। নার্সটির মনে হয়েছিল চিকিৎসকের নির্দেশ যেন বাবার ইচ্ছার সঙ্গে মিলছে না। অন্য সমস্ত কাজ পাশে সরিয়ে রেখে টানা আধ ঘন্টা ধরে সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন ও ফোনে বিভিন্ন মেসেজ পাঠালেন। শেষ পর্যন্ত কার্ডিয়োলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে তবে নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর মা যখন তাঁর শেষ স্বাক্ষরটা করলেন এবং আমি বললাম যে সব কিছু আমাদের ইচ্ছানুযায়ী হয়েছে, তবেই তিনি আশ্বস্ত হলেন এবং নিজের কাজে ফিরে গেলেন।

কখনও কখনও বাবা জেগে উঠতেন আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে আলোড়ন পড়ে যেত। পরিবারের লোকজন, যাঁরা তাঁর দেখাশোনা করতেন এবং অনেক সময়েই একজন গৃহ চিকিৎসক সবাই সানন্দে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম। তাঁকে কত কি জিজ্ঞাসা করতাম, মন দিয়ে শুনতাম উত্তরে কি বলেন আর এভাবেই জমে উঠত আমাদের গল্প-গুজব। বাবা জাগ্রত অবস্থায় থাকলে আমাদের যে কি আনন্দ হত! আর চিকিৎসক ও নার্সরা এরকম একজন কিংবদন্তিতুল্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলায় এতই আনন্দ হত যে আমরা ভুলে যেতাম এই মানুষটা গত কয়েক বছর ধরে স্মৃতিভ্রংশের শিকার। যে মানুষটার সঙ্গে কথা বলছি তিনি আসলে হারিয়ে গেছেন, তিনি আদৌ কিছু বুঝতে পারছেন না। আসলে এই মানুষটা সেই মানুষটাই নয়। 

দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার বিছানায় তাঁর শুয়ে থাকার ভঙ্গি বদল করা হত। গায়ে মালিশ ও অঙ্গসঞ্চালন করে দেওয়া হত। তিনি জেগে থাকলে দেখতে পেতাম আরামে তাঁর চোখ বুজে আসছে। এক যুবক চিকিৎসক, যিনি হাসপাতালের প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের প্রধান এবং তাঁর বাবা ছিলেন কলোম্বিয়ার মানুষ, একদিন বিকেলে বাবাকে দেখতে এলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন। বাবা উত্তর দিলেন, ‘খোদিদো’১। তখন যে নার্সটি ছিলেন তিনি তাঁর দীর্ঘ বিবৃতির শেষে বললেন যে বাবার যৌনাঙ্গের ত্বকে সমস্যা আছে আর সেখানে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে ফেললেন আর তাতেই বোঝা গেল যে তিনি মজা করছেন। তারপর ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করার জন্য বললেনঃ ‘ও আসলে আমার বিচির কথা বলতে চেয়েছে।’ সবাই তখন হো হো করে হাসছে। মনে হত তাঁর রসবোধ তাঁর স্মৃতিভ্রংশতাকেও জয় করতে পেরেছিল। সেটা ছিল তাঁর সত্ত্বারই অংশ। নিজের শরীরের ব্যাপারে বাবা বেশ সতর্ক ছিলেন, প্রায় লাজুকই বলা চলে। তবে যেভাবে সবাই তাঁর সেবা করেছিলেন তাতে কখনই তাঁর সম্ভ্রম এতটুকু ব্যাহত হয়নি। যে সহৃদয় সেবা তিনি পেয়েছিলেন তাতে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন। 

দু’জন নার্স, দু’জন সহকারী এবং ঘরের কাজের একজন বা দুজন মেয়ে তাঁদের পালা বদল করার সময় কয়েক মিনিটের জন্য নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিতেন। বাবার সেক্রেটারি বিছানার চাদর বদল করার সময় একবার বলেছিলেন যে তিনি শুনেছিলেন বাবার পা নাকি খুব সুন্দর ছিল। অন্য মহিলারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে তাকান এবং সায় দেন। আমি জানিনা কোন চুলো থেকে এইসব কথা তাঁরা আমদানি করতেন। তবে এসব ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন না করাই শ্রেয়। 

কখনও কখনও মহিলাদের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে তিনি জেগে উঠতেন। চোখ খুলতেন আর যেই ওই মহিলারা তাঁর দিকে ফিরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করতেন সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠত। এরকমই একটি সময়ে আমি তাঁর পাশের ঘরে ছিলাম। শুনতে পেলাম যে মেয়েগুলো খুব হাসছে। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। তাঁরা আমাকে বললেন যে বাবা চোখ খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁদের দেখেছেন এবং তারপর শান্ত স্বরে বলেছেন:

-তোমাদের সবার সঙ্গে একসঙ্গে পারব না। 

একটু পরে, মা ঘরে ঢুকতেই, তাঁর গলার স্বর ও উপস্থিতি সবাইকে সম্মোহিত করে চুপ করিয়ে দিল।  


টীকাঃ

খোদিদো– ইংরাজি ভাষায় এর অর্থ ‘fucked’


আগের পর্ব: 

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায়

No comments:

Post a Comment