Tuesday, September 5, 2023

অধরা গালিব ও তাঁর গজল | মহিউদ্দিন সাইফ

উর্দু শায়েরি আর গালিব যেন সমার্থক। গালিবের মনন, চিন্তন আর কল্পনা বিশ্বসাহিত্যে বিস্ময়কর। বড় কবিদের শায়েরির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল 'মানি আফ্রিনিশি' অর্থাৎ নতুন নতুন অর্থের জন্ম দেওয়া। গালিবের শায়েরি হল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমি চিরকালই গালিবের কবিতার ন্যাওটা। আর আমার উর্দু কাব্যচর্চাও শুরু হয় তাঁকে দিয়েই। যেমন ফারসি শুরু হয় মওলা রুমিকে দিয়ে। গালিবের কবিতা আমার নিজের কাব্যবোধ ও কাব্যভুবন গড়ে তুলতে এক অতুলন ভূমিকা রেখেছে। গালিব অনুবাদের কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না প্রথমে। কারণ অনুবাদে গালিব আনা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। কিন্তু তাঁর শের বা গজলের বাংলা অনুবাদ দেখে আমার আক্ষেপ হয়েছে বারবার। তখন থেকে স্বপ্ন দেখেছি যোগ্যতা অর্জন করলে, বুকের পাটা তৈরি হলে আমি নিশ্চয় একদিন গালিব অনুবাদে হাত দেব। বেশ কয়েকদিন ধরে গালিবের অনুবাদ বিষয়ে বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিপ্লবদার (কবি বিপ্লব চৌধুরী) ফোন থেকে একদিন কল এল। অরুণাভদার সঙ্গে আলাপ হতেই তিনি গালিবের অনুবাদের কথা তুললেন। আমি যেন মনে আরেকটু জোর পেলাম। তারই ফলস্বরূপ কাজে নেমে পড়া।

আমি আগেই বলেছি অনুবাদে গালিব নামানো পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। এটা জেনেই আমি তাতে হাত দিয়েছি। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করেছি মূলের ভাবটিকে অবিকৃত রাখার। চেষ্টা করেছি 'মানি আফ্রিনিশি'র আশ্চর্য বৈশিষ্টকে ঠিক রাখার। মূল গজলের ভঙ্গি মোতাবেক বাংলা অনুবাদে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহার করতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রচেষ্টা কতটুকু কৃতকার্য হয়েছে সেকথা রসিকজন ঠিক বলতে পারবেন। ত্রুটি দেখে করুণাবশে ক্ষমাও করবেন জানি। এখন তাহলে গালিব পড়ি!

১. 

(নক্শ ফরিয়াদি হ্যা কিস্ কি)


চিত্রগরীর খেয়ালিপনার অভিযোগ করে ছবি যে কার!

সামান্য এক কাগজ-লেবাস পরানো রয়েছে গায়ে সবার।


শুধিও না একাকীত্বের কথা, জীবনের এই দুর্বিপাক,

সন্ধে পেরিয়ে সকালকে আনা, গিরি কেটে আনা শীরের ধার।


বে-কাবু এই প্রেমের আবেগ বেড়ে গেছে দেখো এইভাবে,

তলোয়ার থেকে তীক্ষ্ণতা তার বেরিয়ে এসেছে বে-কারার।


যেভাবে পারুক বিছাক চেতনা শ্রবণের জাল, বুঝতে চাক,

আমার বাচনভঙ্গি পুরাণপাখির তুল্য, এই তো সার।


বন্দিত্বেও পায়ের তলায় আগুন রেখেই রই 'গালিব',

অগ্নিদগ্ধ লোমরাজিই তো শিকলের কড়া হল আমার।


২.

(শওক হর রঙ্গ্)


বাসনা শত্রু হল প্রতিপলে বাঁচবার উপায় গুলির,

ছবির পর্দা, তবু দেখা যায় মজনুর নগ্ন শরীর।


ক্ষতও তো বুঝল না হৃদয়ের ব্যাকুলতা, মর্ম গভীর

যখ্মি হৃদয় থেকে ডানা মেলে উড়ে গেল বেদনার তীর।


দীপের ধোঁয়াটি আর ফুলের সুবাস আর কান্না বুকের

তোমার আসর থেকে যে-ই বেরোল, হয়ে ব্যাকুল অধীর।


বাসনাদগ্ধ এই মন আমার বেদনার থালা সুস্বাদু,

বন্ধুরা তুলে নিল, যে যেমন নিতে পারে বেদনার ক্ষীর।


বাসনার পথে জেনো নিজেকে ত্যাজ্য করা কঠিন মোকাম

তাও পার হওয়া গেল, বাকি থাকে বল আর কোন কোন তীর?


হৃদয়ে আবার এক কান্নার হাহাকার উঠল 'গালিব'

বৃষ্টি হল না বলে ঝড় হয়ে বেরল যে তারই নজির।


৩.

(দহর মেঁ নক্শে-ওয়াফা)


অনুরক্তির ছবি এ জগতে প্রবোধের হল না কারণ,

নিজের অর্থে লাজ পেল না পেল না এই শব্দ এমন।


মৃত্যু কামনা করি ছাড়া পেতে অনুরক্তির গ্লানি হতে,

কিন্তু সে অবকাশটুকুও তো দিল না সে নিদয় এমন।


হৃদয় পথিক হয়ে থেকে যাক মদিরা ও পেয়ালার পথে,

খোদাভক্তির পথে প্রাণ আমার কিছুতেই গেল না যখন।


মিলনের কথা তুমি দাওনিকো, তবু রাজি হয়ে আছি আমি

সুসম্ভাষণ চেয়ে হল না এ কান আমার আতুর যেমন।


ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে আছি, কার কাছে করি অভিযোগ?

চাইছি মরণ হোক, হায়! তবু কিছুতেই আসে না মরণ।


মরে যাই ক্ষীণতনু গালিবের এমন নাজুক হাল দেখে,

জীবন ফিরিয়ে আনা ঈশার ও ফুঁ-টুকুও হল না সহন!


৪.

(ইশ্ক মুঝকো নহি)


প্রেম নয় এ উন্মাদনা, উন্মাদনাই হল

আমার উন্মাদনা তোমার খ্যাতির উপায় হল।


সম্পর্ক ছিন্ন তুমি কোরো না এইভাবে

কিছু না থাক না-হয় এবার শত্রুতাটাই রইল।


সঙ্গে আমি থাকলে তোমার কিসের অপমান?

লোকসমাজের ভয় থাকে তো নির্জনতায় চল।


আমি তোমার শত্রু তো নই, দ্বিধা কেন হায়!

না-হয় তোমার পরের সাথে ভালবাসাই হল।


যেটুক আছ, আছ নিজের অস্তিত্বের জোরে

চেতনা যদি না থাকে তো অচেতনাই হল।


প্রেমের থেকে বাফার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম হাত

প্রেমে থাকা না থাকে তো দুঃখে থাকাই হল।


অবিচারের আকাশ তুমি কিছু তো দাও হাতে

বিদায়বেলার তোফা না-হয় হা-হুতাশই হল।


আমিও সব মেনে নেওয়ার স্বভাব করে নেব

তোমার নাহয় স্বভাব হয়ে উপেক্ষাটাই রইল।


বঁধুর সাথে নেহার বাঁধন কেটে গেলে 'আসাদ'

মিলন তো আর থাকে না, তাই আকাঙ্ক্ষাটাই রইল।


(ভণিতায় কোথাও তিনি 'গালিব' কোথাও বা 'আসাদ' ব্যবহার করেছেন)


৫.

(সাতাঈশগর হ্যা যাহিদ)


আল্লার ভক্ত যে-স্বর্গের বাগিচার গুণগানে চুর হয়ে আছে,

অমন ফুলের তোড়া আমাদের বেখুদের ভুলে যাওয়া তাকে পড়ে আছে।


ফুরসত দেয় যদি সামান্য এ-জগত তবে আমি দেখাব জরুর,

হৃদয়ের দাগগুলি ঝাড়বাতি-প্রদীপের একেকটি বীজ হয়ে আছে।


তোমার রূপের বিভা এ আরশিনগরের কী হালত করে গেছে দেখো,

প্রতিদিন বাগানের শিশিরের ভুবনের রৌদ্র যে-হাল করে গেছে।


সৃষ্টিরই খাঁজে খাঁজে লুকায়িত আছে জেনো ধ্বংসের সমূহ কারণ,

ফসলবিনাশী বাজে যে তত্ত্ব আছে তা কৃষাণের ক্রোধেও তো আছে।


লাখে লাখ বাসনা সে নিহত লুকানো আছে এ নীরবতার অন্তরে,

অস্তি আমার যেন পথিকের কবরের নিভু নিভু দীপ হয়ে আছে।


এখন কেবল সেই প্রেমাষ্পদের স্মৃতি আর তার ছবিটি সহায়

বিধুর হৃদয় যেন ইসুফের কারাগারে কুঠুরি নিজন হয়ে আছে।


আমি তো দেখছি শুধু 'ফানা'র পথটি আছে দৃষ্টিতে আমার 'গালিব'

এ সেই সূত্র যাতে অস্তির কণাগুলি মালার মতন গাঁথা আছে।

No comments:

Post a Comment