Saturday, November 2, 2024

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য | সৌজন্যের উত্থান | সুমন গুণ

আমাদের ভাষায় যাঁরা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, খেয়াল করে দেখলে পরিষ্কার টের পাওয়া যাবে যে, তাঁদের মধ্যে তাঁরাই টিঁকে যাচ্ছেন যাঁদের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই  ভাষার রকমফের থাকতে পারে, আলোছায়ার তর-তম থাকতে পারে, কিন্তু যিনি লিখছেন, তাঁর অব্যবহিত ব্যবহারটুকু ধরা থাকছে কিনা তাঁর লেখায়, সেটাই বড়ো কথা।  জীবনানন্দ অথবা কমলকুমার, সন্দীপন কিংবা দেবেশ রায়, সমরেশ বসু বা শীর্ষেন্দু --- সবাইকেই সময় মেপে নিচ্ছে তাঁদের গদ্যভাষার সৌজন্যে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এই গদ্যভঙ্গিমার জোর নিয়ে আলাদাভাবে কিছু আপাতত বলছি না। তাঁর সম্প্রতি ছাপা একটি উপন্যাসে আমাদের জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার কীভাবে সব ধনধৌলতসহ উথলে উঠেছে, তার কথাই একটু বলব, প্রসঙ্গক্রমে শীর্ষেন্দুর চিত্ররূপময় গদ্যবিন্যাসের কথাও উঠবে। 

‘সতীদেহ’ উপন্যাসে অনেকগুলো সমান্তরাল ঘটনার পাশাপাশি অবস্থান আছে। সমান্তরাল বললাম বটে, কিন্তু প্রতিটি ঘটনাই পারস্পরিক টানাপোড়েনে যুক্ত। আমি শুধু একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরছি। রুনু আর সতী। এই গোটা উপাখ্যানটির ছত্রে ছত্রে নশ্বর ভালোবাসার অলৌকিক মায়া জড়ানো। জীবন যে তার নিজস্ব গরিমাতে সম্পূর্ণ, জীবনকে মৃত্যুর সরল অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া যে অপরাধ, সেটা শান্ত আর অপ্রতিরোধ্য ভাষায় বলা হয়েছে এখানে। রুনু সতীকে ভালোবাসতো। কিন্তু নন্দনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়  সতীর। বিয়ের  রাতেই আত্মহত্যা করে সতী। আর, শোকে আত্মঘাতী হতে চায় রুনুও। পারে না। অন্যরকম হয়ে জীবনে লেগে থাকে। এইটুকুই ঘটনা। কিন্তু এর নির্যাস গল্পটা পড়তে পড়তে মনে বেজে ওঠে। সতীর আত্মহত্যার কথা রুনুকে এভাবে জানায় মহিম ডাক্তার :


‘মরবার কী দরকার ছিল বল তো! কোনও মানে হয়? একটা জন্মের পিছনে কত প্রস্তুতি, কত অপেক্ষা, তিল তিল করে গড়ে ওঠা শরীর কি এভাবে নষ্ট করতে হয়?’  

এটাই এই উপন্যাসের দর্শন। মৃত্যুর বিপক্ষে অপরাজেয় ভঙ্গিতে কথা বলেছেন এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু। কখনো মহিম ডাক্তারের মুখে, কখনো শিশুর মুখের গন্ধ ঘাস রোদ মাছরাঙা নক্ষত্র আকাশের আলছায়াভরা জীবনের টুকরো টুকরো কাহিনি শুনিয়ে। মহিম ডাক্তারের সঙ্গে রুনুর একটা কথোপকথন তুলছি :


ঘুমের চটকা ভেঙে উঠে বসলেন মহিম সরকার, “কী হল রে?”

“কাকা, একটা কথা রাখতে হবে”।

“কী কথা রে?”

“একটা ডেথ সার্টিফিকেট। সতীর”।

“তুই কী পাগল?”

“দয়া করুন কাকা”।

 “পরিষ্কার  অ্যানন্যাচারাল ডেথ। অনেকে জেনে গেছে’। 

“এটুকু আপনি পারবেন কাকা”।

মাথা নেড়ে বললেন, “না পারি না। ধরা পড়লে আমার চাকরি যাবে। বুড়ো বয়সে পেনশন পাব না, তুই কি আমাকে মারতে চাস?”

“সতীকে বাঁচিয়ে দিন কাকা”।

“মরা মানুষকে বাঁচাতে পারি এমন এলেম আমার নেই”।

“শরীরটা বাঁচবে না জানি। কিন্তু সম্মানটা বাঁচবে”।

“কিসের সম্মান? যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’।

“ও কথা বলবেন না। দুনিয়ায় অনেক দুর্বলচিত্ত মানুষও আছে”।

“ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ, নিশ্চয়ই কোনও ছেলেছোকরার সঙ্গে লটঘট পাকিয়ে রেখেছিল”।

“আমার মুখ চেয়ে এটুকু করে দিন কাকা”।

মহিম সরকার আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, “সে কি তুই? সত্যি করে বল তো রুনু, তোর জন্য?”

“ছেড়ে দিন কাকা। ওসব অতীত”।

“তাহলে একটা কথা দে”।

“কী কথা?”

তোর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই একটা কিছু পাকাচ্ছিস। আমি মড়াকাটা ডাক্তার বটে, লোকে আমাকে পোঁছেও না। তবু যাকে মরণ ডাকে তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি। কথা দে, মেয়েটার শোকে তুই কিছু করে বসবি না?”

“কথা দিলাম কাকা”।

“মনে রাখিস”।

চাকরি যাওয়ার ভয় ছিল, চৌপাট হতে পারত পেনশন, বদনাম হতে পারত, অনেক ঝুঁকি নিয়েও মহিমকাকা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ডেথ... ডিউ টু কনভালশন”।  

কেন? এত ঝুঁকি নিলেন কেন মহিম ডাক্তার? নিলেন, কারণ, রুনুকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পেরেছিলেন। রুনু তাঁকে কথা দিয়েছিল বলেই অবধারিত মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে ফিরে এসেছিল বন্ধুর, অথচ সমারোহময় জীবনের পথে। 

মহিম ডাক্তার সতীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন : ‘যে ওভাবে নিজেকে নষ্ট করে সে পাপী’। জীবন নষ্ট করা যে পাপ, এই দর্শন শীর্ষেন্দুর অন্য আরও অনেক উপন্যাসের মতো ‘সতীদেহ’তেও নানাভাবে বলা আছে। কখনো একটি বালিকার সঙ্গে নিষ্পাপ আহ্লাদে, কখনও মূর্ছনার সঙ্গে মধুর সম্পর্কের অন্ত্যমিলে। বালিকা রিচার সঙ্গে রুনুর কথোপকথনের একটি অংশ উদ্ধার করছি, যেখানে ধরা পড়েছে এই জীবন তার সব গোপন রহস্য আর সম্ভাবনা  নিয়ে কীভাবে ছড়িয়ে আমাদের চারপাশে, আর রুনু সেই জীবনকে ছুঁতে পারছে কি প্রশান্ত নিরাসক্তি সহ : 


গুটি গুটি রিচা এসে আমার পাশটিতে বসল। রোগা একখানা হাত রাখল আমার হাঁটুতে। 

অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি একদিন একটা রাস্তার কুকুরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলে?”

আমি লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বললাম, “এমা, তোমাকে কে বলল?”

“শম্ভুদা দেখেছে, ঝাড়ুদার গুপ্লু দেখেছে, পরমাদিদি দেখেছে। বলো না, করেছিলে?”

“সে কথা আর বোলোনা। রাস্তার ধারে কুকুরটা সামনের দুটো পা এমনভাবে উঁচু করে বসেছিল যে, আমার মনে হল একটু ভাব করতে চায়। তাই ওর ডান পা ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলেছিলাম, গুড মর্নিং। দেখলাম বেশ খুশি হল’’।

“হিঃ হিঃ! আর শম্ভুদা বলে তুমি সকালে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাকদের রুটি খাওয়াও তখন নাকি কাকদের সঙ্গেও কথা বলো”!

“হুঁ। কাকেরাও বলে। যেদিন বাংলা বনধ ছিল সেদিন সকালে কাকেরা কিন্তু আমাকে দেখেই সবাই মিলে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, হরতাল! হরতাল!”

“হিঃ হিঃ! সত্যি”!

“হ্যাঁ তো”।

“আরও বলো”।

“বলব? তোমার কিন্তু বিশ্বাস হবে না। একদিন আমার ঘরের ফ্রিজটা আমাকে বকুনি দিয়েছিল তা জানো? ফ্রিজ থেকে দুধের প্যাকেট বের করে পিছু ফিরেছি, পিছন থেকে কে যেন ধমকে বলল, অ্যাই! খুব চমকে উঠে ঘুরে দেখি, দরজাটা ঠিকমতো বন্ধ করিনি, একটু ফাঁক হয়ে আছে। ‘সরি’ বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিতেই ফ্রিজটা বলল, থ্যাংক ইউ”।

যে-রুনু জীবনের কিনার থেকে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল  মৃত্যুর দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে, তাকে জীবনের এমন চিত্ররূপময় বৈচিত্র্যের দিকে ফিরিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল লেখকের।  সেই লক্ষ্যে তিনি নিঃশব্দে সফল হয়েছেন তাঁর অনুদ্যত ভাষার জোরে। 

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ভাষার নিজস্ব ওজনেই একজন লেখক বেঁচে থাকেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতায়  জীবনানন্দ টের পেয়েছিলেন :


‘বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!

মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!’

 

মনের এই পার্থিব চঞ্চলতার নানা বিভঙ্গ ‘সতীদেহ’ উপন্যাসে উঠলে উঠেছে।

Sunday, January 28, 2024

কৃষ্ণমোহন ঝা-র কবিতা | অনুবাদ: দেবলীনা চক্রবর্তী

কৃষ্ণমোহন ঝা-র জন্ম ১৯৬৮ সালে বিহারের মধুপুরায়। হিন্দি এবং মৈথিলী ভাষায় কবিতা লেখেন। তাঁর হিন্দি কবিতা সংগ্রহ 'সময় কো চিরকর' ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এবং মৈথিলী ভাষায় 'একটা হেরায়েল দুনিয়া' ২০০৮ প্রকাশিত হয়। বিদ্যাপতির পদের একটি সংকলন 'ভনই বিদ্যাপতি'র সম্পাদনা করেন তিনি এবং হিন্দি কবিতার ইংরেজি সংকলন 'হোম ফ্রম এ ডিসটেন্স'-এর একজন সহযোগী সম্পাদক কৃষ্ণমোহন ঝা। এছাড়া বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতা ইংরেজি, অসমিয়া, বাংলা, মারাঠি, তেলেগু, উর্দু এবং নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে তিনি 'কানাইহা স্মৃতি সম্মান' এবং 'হেমন্ত স্মৃতি কবিতা পুরস্কার' পান। ২০০৩ সালে এবং ২০১৩ সালে 'কীর্তি নারায়ণ মিশ্র সাহিত্য' পুরস্কার পান। বর্তমানে অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। 

মূল হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ দেবলীনা চক্রবর্তী


মৃৎ পাত্র

(শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মরণে)


আবার আসবো ফিরে এমন কথা বলব না

কারণ আমি যে কোথাও যাব না


কুয়াশার ওই পারে

হয়ত ভাষার কোনও জীবন হতেও পারে 

তবু আমার উচ্চারিত শব্দ

এইখানেই 

কার্তিকের ভোরে

ধানের শীষ থেকে ঝরে পড়বে

টুপটাপ 


আমার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা

আমার ঝরে যাওয়া অশ্রু ও স্বেদজলের সঙ্গে 

এই বেদনা তটের উপরে ভাপ হয়ে উঠবে

আর যেখানে আমার জন্ম 

সেই বিদগ্ধ আকাশে মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াবে


আমার আত্মা ও মজ্জাস্থিত সমস্ত দৃশ্যপট

এই ধুলোমাটি, এই ক্ষেতখামার 

এই ঘরদুয়ারে আপন সত্তা খুঁজতে 

বারবার আসবে 

এখানে ছাড়া আমার আমিকে

আর কোথায় পাবে খুঁজে 

আদৌ কোথায় যাবে!


আর যদি একান্তই যেতে হয়

স্বপ্ন-দৃষ্টি ও বাসনা ছাড়া 

কী করে আর কতটুকু বাঁচা সম্ভব 

তাহলে তাকে কি বলা যায় 'চলে যাওয়া'?


এসেছি যখন থাকব এখানেই....


আষাঢ়ের ঘনঘোর বৃষ্টিতে

ধরণীর উচ্ছ্বসিত অবিরাম গন্ধ বিধুরতায়


সোঁদা মাটির অন্ধকার ঘরে

প্রতিদিন দুপুর ছেয়ে থাকা

সূর্য কিরণে


চিড় ধরা আয়নার গায়ে 

বারেবারে নিশ্চুপে ছুঁয়ে যাওয়া

ধুলোর এক একটি কণা'তে 


এসেছি যখন, এখানেই রয়ে যাব 

আমি যাব না কোথাও


---------------------------------------------------------


জীবনানন্দ দ্বিতীয়


আমি ছাড়া আর কেই বা জানে

যে তোমার ভাগ্যে 

না তো কার্তিকের ভোরে শিশির নিমজ্জিত 

বৈজয়ন্তী ফুলের মতো দুর্লভ প্রেমী এসেছে

না অখণ্ড লালিমায় গড়া কাব্য সৌন্দর্য্য নিয়ে প্রেম এসেছে 


আর তুমি ছাড়া আর কে বা জানে

যে আমার ভাগ্যে 

না তো বিদ্যুৎ লতার মতো ঝলমলে রাত এসেছে

না তো এই মৃৎ পাত্র পেয়েছে 

গাঢ় অমৃতের ও শিউলি ফুলের মতো আশ্রয়


আমি জানি যে

তুমি নাটরের বাসিন্দা নও

না আমার জন্ম বরিশালে


মাঝরাস্তায় 

ট্রামের ঘড়ঘড় শব্দ দেখে শুনে 

কাছে যাওয়া তো দূরের কথা

রূপসী বাংলার সজল ভূমি স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি এখনও 


কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায়

আমার বুকের ওপর ভয়ঙ্করভাবে 

পিষে দিয়ে যায় কিছু 

সে ট্রাম নয় তো আর কি!

Saturday, November 25, 2023

চাহনি | পর্ব ১০ | দৃষ্টি বিনিময় | মন্দার মুখোপাধ্যায়

তিনতলায় বাবার স্টুডিও ঘর। বিশাল ঘরের উত্তর দিকের সদর দরজাটা আজ হাট করে খোলা। দক্ষিণের বড় জানলাটার কয়েকটা শিকও খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে জ্যেঠামণির দিক থেকেও সহজে ঢুকে আসা যায়। খোলা রয়েছে ঘর থেকে বার হয়ে পুবের বারান্দায় যাবার বাহারি কাচের দু’টো দরজা এবং তার মাঝখানের জানলাটাও। খোলা ওই ঘরের পশ্চিম দেওয়ালের গঙ্গা আঁকা খান ছয়েক জানলাও। চারিদিকে আত্মীয় স্বজনের নীরব কান্না। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে বাবা চলে যাচ্ছেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে। ডাক্তার কিষাণ কাকা ইনজেকশন দিতে এসে, কোনও হাতেই ভেইন পাচ্ছেন না। বিকেল তিনটে। ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে সূর্যাস্তের মরা আলো আর জোয়ার-বহা গঙ্গার বাতাস। কার্তিকের শেষ। হিম আর শিশির দু’ইই পড়ছে রাতে আর দিনে। তবু শীত বস্ত্র রাখছেন না গায়ে। পরিষ্কার স্বরে বললেন, আমি আর কুড়ি মিনিট; কাটাছেঁড়া আর নাই বা করলে!

বাবার ছাপান্ন বছরের লম্বা শরীরের মাঝামাঝি বসে আছেন আমাদের মা; মাথা নিচু করে। তাঁর ওই ঊনচল্লিশ বছরেই, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘনিয়ে আসবে বৈধব্য। নতুনদিদা এসে তাঁর বাঁ হাত থেকে খুলে নেবেন এয়োতীর লোহা। একে একে আমাদের দু’বোনকে দিয়ে চামচে করে তাঁর গালে দেওয়ানো হল শেষ জলটুকু। বাবা তাকালেন না। তাঁর ঠোঁট দু’টি ভিজে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে এল অশ্রু। ঠাকুমা আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছিয়ে দিতেই, এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে; বা হয়তো চোখের দিকে। ঘর ভর্তি গুরুজনদের উপস্থিতি ভুলে, মা-ও তো  অপলক। দু’জনের গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণ পথ কেটে হেঁটে এল মৃত্যু। বিকেল ঠিক তিনটে কুড়িতেই চোখ বুজলেন বাবা। থেমে গেল দৃষ্টি বিনিময়। স্থাণুবৎ মা, স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তাঁদের যৌথ জীবনের লোপাট হয়ে যাওয়া অস্তিত্বের দিকে। 

মৃত্যুকে মাঝখানে রেখে দু’জনের এমন চাহনি বিনিময় আর কি দেখেছি!

Saturday, November 11, 2023

চাহনি | পর্ব ৯ | নাচের গুরুজি | মন্দার মুখোপাধ্যায়

খুব আনন্দ হয়েছিল, গুরু গোবিন্দন কুট্টি আমাকে যখন নাচ শেখাতে রাজি হয়েছিলেন। অল্প বয়সে, নাচের পরীক্ষক হিসেবে আমার নাচ দেখে দু’একবার উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য। সে সময় সম্ভব হয়নি; কারণ তখন আমার বেশি মন ছিল চাকরি ও সংসারের দিকে। বছর চল্লিশ পার করে হঠাৎই মনে হল। এখন একবার তাঁর কাছে গেলে কেমন হয়! কারণ আমি নাচ ছাড়লেও, নাচ তো আমাকে ছাড়েনি। ওজনই বা কত আর বেড়েছে! এখন তো দক্ষিণেই থাকি। কতটুকুই বা দূর ওই ডোভার লেন! ডায়াল করে ‘হ্যালো’ শুনেই বুঝলাম যে পুরনো নম্বরই আছে। আমার ওজন এবং নাচ দেখে সাগ্রহে রাজি হলেন। শুরু হল সপ্তাহে দু’দিন করে ঈশ্বর-দর্শন। শরীরে সে এক নতুন উৎসব। নাচের বোল, মুদ্রা আর অভিনয়ে, প্রতিটি ক্লাসেই গুরুজি যেন সুন্দরের বীজ বুনে চলেছেন। 

পঁচাত্তর পার করে তাঁর মাথার সব চুল গরদের মতই মখমল এবং গঙ্গাজল রঙের। হালকা ছিপছিপে শরীর; ট্রাউজারের ওপর ঢিলে পাঞ্জাবি এবং কাঁধে একটা লম্বা ঝোলা। তাঁর হেঁটে আসার ছন্দেও যেন কাঁসার সেই ভারি ঘুঙু্ট-জোড়ার নিক্বণ। ক্লাসে পৌঁছতে এক মিনিট দেরি হলেই রাগ; আবার দু’মিনিট আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখলেও অসন্তুষ্ট। কী জ্বালা রে বাবা! তাঁর ডোভার লেনের বাড়ি থেকে ভেতর দিয়ে হেঁটে আসেন, ডোভার রোডের বাড়িটায়। একতলাটা ভাড়া নিয়েছেন স্পেশাল ক্লাস করাবার জন্যেই। কোলাপসিবলের চাবি খুলে, বারান্দায় রাখা ফুলের টবে জল দিয়ে নিজের চেয়ারে যখন বসবেন ঠিক তখনই ঢুকতে হবে। প্রতিদিনই আমার যেন মঞ্চে প্রবেশ। ব্যাগটা মাটিতে রেখে, ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে আমি দাঁড়াব। একটা ছোট্ট লাঠি পকেট থেকে বের করে নিজের চেয়ারের পাশে রাখা টুলটায় নামিয়ে উনি বলবেন, শুরু কর। তাঁর পা ছুঁয়ে শুরু হবে আমার মারদাঙ্গা অনুশীলন।

ক্লাসটা হাসি হাসি মুখে প্রণাম দিয়ে আরম্ভ হলেও, কিছু পরেই দেখা দেবে তাঁর রুদ্রমূর্তি। নাচের  সময় গলা ও থুতুনির অবস্থানে হাফ ইঞ্চি ফারাকের হেরফের হলেই রে রে করে তাড়া। তালে ভুল হলেই লাঠিটা ছুঁড়বেন হাঁটু তাক করে। আমি যখন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যাব,  টুল থেকে উঠে এসে নিজেই আবার কুড়িয়ে নেবেন। বার বার করে শেখাবেন, দু’মাত্রা থেকে দশমাত্রার জোড়া তাল এবং তারই মাঝে মাঝে বেজোড় তালে পাঁচ এবং সাত মাত্রা। প্রথম দিকের সেই হিমসিম অবস্থাটাই কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই এক খেলা হয়ে গেল। নাচের ঠিকাদারি নিয়ে স্থপতি ডি সি পালের মতোই আমার শরীরটাও বুঝতে শিখল যে কোন জমি ঠিক কেমন বাড়ি চায়! 

তাল  কিছুটা আয়ত্তে এলে শুরু হল গানের সঙ্গে অনুশীলন। সে এক কঠিন প্যাঁচ, না জানি তামিল ভাষা, না বুঝি তার সুরের চলন। কোনও একদিন শেখাচ্ছেন দময়ন্তীর বর্ণনায় নলের বাগানের শোভা এবং তা দেখে দময়ন্তীর প্রেমিকা-ভাব। গুরুজিকেই দেখছি। এ কি শেখা যায়?  যতোই যা করি না কেন, তালের ফাঁকে ফাঁকে ধরতাইয়ের মজাগুলো কেবলই ফসকাচ্ছে। হাত-পা-চোখ-ভ্রু –- সবই বেসামাল; বকুনির ভয়ে শিউরে উঠছে। হঠাৎই একটুও না বকে, শান্ত হয়ে বললেন।

‘আমাকেই দেখ ………আআআমাকেই’ – 

সাহস করে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে কী নিবিড় দৃষ্টিতে আমার মধ্যে তিনি হাতড়ে চলেছেন নাচ এবং আগ্রহ। ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেললাম। মনে হল, উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট কত পুরুষই তো আমাকে দেখেছে! হয় আসক্তি, নয় মুগ্ধতায়। কেউ তো এমন অপার হয়ে বলেনি যে ‘আমাকেই দেখ’! এই প্রথম দেখলাম পৌরুষ নয়, শুধুমাত্র সৌন্দর্য-বোধের আধিপত্য। গুরুজি নিজে এমন রূপ, গুণ আর শক্তির আধার হয়েও তিনি আমাকে টেনে নিতে চাইছেন আমারই মর্মস্থলে! সে চাহনিতে কোনও মুগ্ধতা নেই আমার দেহসৌষ্ঠব বা রূপে। উল্টে সে সব থেকে মুক্ত করে আমাকে করে তুলতে চাইছেন এমন এক বোধ ও অনুভবের আধার যেখানে নাচও যেন আভরণের মতোই খসে যায় শরীর থেকে।

গুরুজির ওই দৃষ্টিপাতে এ জীবনে সেই একবারই ঈশ্বর-দর্শন হয়েছিল। 

বার বার মনে পড়েছিল সেই দু’কলি--

‘মেঘের মাঝে মৃদং তোমার বাজিয়ে দিলে কী ও

সেই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিও দিও’।।

Thursday, November 2, 2023

আমার মা | শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

 

মায়ের কথা বলতে গেলেই যেন আমার ভিতরে একটা বাঁধভাঙার মতো অবস্হা হয়। কত কথা যে মনে আসতে থাকে, যেন কথা আর ফুরোবেই না। মায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল মহামায়া। দাদামশাই মাকে সারদেশ্বরী আশ্রমে পাঠিয়ে দেন মানুষ হওয়ার জন্য। সারদেশ্বরী আশ্রমে স্বয়ং গৌরীমার তত্ত্বাবধানে আমার মা বড় হয়েছেন। মায়ের মাথায় একঢল মেঘের মতো ঘণ, কোঁকড়া চুল ছিল, আর তাই আশ্রমে মায়ের নামই হয়ে গিয়েছিল চুলওয়ালা মহামায়া। আশ্রমবাসের ফলে আমার মায়ের আধ্যাত্মিক ভাব ছিল গভীর, আর তেমনি দয়ামায়া। জীবনে মাকে কখনও কারও সঙ্গে গলা তুলে ঝগড়া করতে শুনিনি। রাগ হলে বকাঝকা করতেন বটে, বিশেষ করে আমাকে, তবে তাতে তেমন ঝাঁঝ থাকত না। আমার মা যেমন শান্তপ্রকৃতি ছিলেন তেমনি আমি ছিলাম বেজায় দুষ্টু আর বাঁদর। আমাকে সামলাতে মাকে হিমসিম খেতে হত। আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ এত দুষ্টু ছিল না। আর তাই আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তাও ছিল বেশি। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাড়িতে কোনও ভিখিরিকে খালিহাতে ফেরানো হয় না। যুদ্ধের সময়ে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে তখনও মা এই নিয়মের ব্যাত্যয় করেননি। মাঝেমাঝে ক্ষুধার্ত ভিখিরিকে বাইরে বসিয়ে গরম ভাত ডাল তরকারি খাওয়াতেন। বাসিপচা জিনিষ কখনও খাওয়াতেন না। অথচ আমাদের অবস্হা যে খুব সচ্ছল ছিল তা নয়। আমার সৎপ্রকৃতির বাবা রেলে চাকরি করতেন বটে, কিন্ত ঘুঁষ খেতেন না বলে আমাদের চিরকালই টানাটানির সংসার। ওই সামান্য হিসেব করা পয়সা থেকেই অল্পস্বল্প বাঁচিয়ে মা তাঁর সামান্য দানধ্যান করতেন। যখন আমার তিন কি চার বছর বয়স তখন প্রতি দুপুরে খাওয়ার পর মা আমাকে নিয়ে মাদুর পেতে মেঝেয় শুতেন আর দুষ্টু ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য রবি ঠাকুরের কবিতা শোনাতেন। সেই মোহময় কবিতা আমার ভিতরে এক সম্মোহন তৈরি করে দিত, তাই আজও আমি কবিতার পরম অনুরাগী। তখন আমার মা ছিলেন আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মা ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না। কিন্ত বাবার বদলির চাকরি, দেশভাগ ইত্যাদির ফলে আমাকে হস্টেলে চলে যেতে হয়। তাতে মায়ের ওপর টান আরও বেড়েছিল, আর মাও আমার জন্য বড্ড ব্যাকুল থাকতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে কি যে আদর হত আমার! আজ কত বছর হয়ে গেল মা নেই, তবু আজও মায়ের অভাবে যেন মাঝেমাঝে বুক টনটন করে। একটা মজার কথা বলি। হস্টেল থেকে বাড়ি গেলে আমি সারাক্ষণ মায়ের কাছেকাছে থাকতাম। মা রান্না করতেন আর আমি কাছটিতে বসে গল্প করতাম। আর এইভাবেই মায়ের তোলা উনুনে রান্না করা দেখেদেখেই আমি নিজের অজান্তে পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছি। আমার রান্না খেয়ে অনেকেই আজও প্রশংসা করে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন | অমর মিত্র

 


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পড়ছি সেই  স্কুলের শেষ আর কলেজের আরম্ভ থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুনপোকা ঠিক কবে বেরিয়েছিল এখন মনে নেই, তবে ঘুনপোকার আগে পড়েছি উজান, এরপর আরো পরে পারাপার, মানব জমিন, যাও পাখি ইত্যাদি। মাঝে ঘুনপোকা। তারপর তো পড়েই চলেছি। ছোটদের বড়দের নানা গল্প উপন্যাস। বড় হয়েও তাঁর ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস না পড়া মানে শৈশবকে ভুলে মারা। গন্ধটা খুব সন্দেহ জনক, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাইবাগানের ভূত…, তিনি এখনো আমাকে আমার শৈশব ফিরিয়ে দেন। কত যে পড়েছি সব আনন্দমেলায়। সঙ্গে সেই সব গল্প যা আমাকে  এখনো ঘুরে ঘুরে পড়ার কথা ভাবায়,  সেই গঞ্জের মানুষ, ট্যাঙ্কি সাফ থেকে উত্তরের ব্যালকনি, প্রতীক্ষার ঘর..., কত গল্প।  তিনি তাঁর গল্প নিয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর প্রবেশ করেন। তিনি আমাদের জীবনের নানা বিহ্বলতার কথা মনে করান। শীর্ষেন্দু অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন। জীবন এখানে নির্ভার মগ্নতার,  জীবন এখানে  অজ্ঞাত এক আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি  দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস তাঁর গল্পের দুঃখী মানুষের ভিতর সঞ্চারিত হয়।  উত্তরের ব্যালকনিতে বা গঞ্জের মানুষ কেন তাঁর অনেক গল্পেই আমি তা দেখেছি। দেখেছি উপন্যাসে। উজান- উপন্যাসে এ এক ভিখিরির সামান্য খুদকুড়ো ছড়িয়ে দিল বালক, তার কী অসম্ভব গর্জন। বালক মাটিতে ছড়ান খুদ খুঁটে খুঁটে তুলে দিতে থাকে ভিখিরির বাটিতে।  শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে অনুভব করতে হয়। অনুভব করতে চেয়েছি। তিনি অনুভব করাতে পারেন। তাঁর গল্প আমার ভিতরে অপরাহ্ণের আলো আর বিমর্ষতা নিয়ে আসে। উত্তরের ব্যালকনি এক প্রেমের গল্প। দুঃখীর গল্প। ব্যালকনিটি উত্তরে। সংসারটি তুষার আর কল্যানীর। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে লোকটিকে দেখা যায়। সে বসে থাকে বকুল গাছটির নিচে। এবার গাছে ফুল এসেছে খুব। তলাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সেইখানে নিবিড় ধুলোমাখা ফুলের মাঝখানে লোকটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘন নীল জামা, খাকি ফুল প্যান্ট, লজ্জাস্থানগুলিতে ছেঁড়া তা। মাথার চুলে জটা, গালে অনেক দাড়ি, গায়ে চিট ময়লা, কনুইয়ে ঘা। সে অরুণ। সে পাগল।  ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তুষার লোকটাকে দ্যাখে। এখনো চেনা যায় অরুণকে। না আগের চেহারাটা তেমন মনে পড়ে না। এখনকার অরুণকে সে চিনতে পারে। কেন না সে পাঁচ বছর সে ওই গাছতলায় বসে আছে। অফিসে বেরোনর আগে পানের পিক ফেলতে ব্যালকনিতে এসে তুষার দ্যাখে ওকে। পাগলও একবার মুখ তুলে তাকায় যেন। আগে ওই চোখে ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধের ছায়া দেখত তুষার। এখন কিছুই না। তুষার টের পায় কেবল অবিন্যস্ত চিন্তারাশি বয়ে যায় ওর মাথার ভিতর দিয়ে।  শুধুই শূন্যতা। আর কল্যানী? তুষার চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তুষারের ভেজা ধুতি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে মেলে দিতে দিতে দ্যাখে আকীর্ণ ধুলো মাখা ফুলের ভিতর বসে আছে অরুণ। পাগল। তার একদা প্রেমিক। অরুণ তাকিয়ে আছে। কল্যানী স্পষ্ট দেখতে পায় ফাঁক হয়ে থাকা মুখের ভিতর নোংরা হলুদ দাঁত, পুরু ছ্যাতলা পড়েছে। ওই ঠোঁট জোড়া ছ-সাত বছর আগে  জোর করে কল্যানীকে চুমু খেয়েছিল একবার। ভাবলে এখন ঘেন্না করে। কল্যানী প্রতিদিন শেষবেলায় ঠিকে কাজের লোককে দিয়ে ভাত পাঠায় ওকে। অরুণকে সে কখনো ভালবাসে নি,সে ভালবেসেছিল তুষারকে। কিন্তু পাগল হয়ে অরুণ যখন ওই গাছতলায় আশ্রয় নিল, ঘরের মধ্যে তারা দুজন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। যদি পাগল ঘরে এসে ওঠে ? কী মায়াময় ভালবাসার গল্প এই উত্তরের ব্যালকনি। একতরফা ভালবাসায় ব্যর্থ অরুণের ছিল পৃথিবী হারানোর দুঃখ। সেই দুঃখ তার দুবর্ল  মাথা সহ্য করতে পারে নি। তাই এসে বসেছিল কল্যানীদের সংসারের দোরগোড়ায়। আগে সে চিৎকার করত, অব্যক্ত আর্তনাদ করত, এখন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তুষার সমস্তদিন ধরে কাজের চাপে বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। অরুণের প্রতি তার মায়া আছে। আবার সংসার করতে করতে ক্লান্ত তুষার অন্য নারীর কাছে গিয়েও ভালবাসাহীন হয়েই ফেরে। এই গল্প জটিল নাগরিক জীবনের। এই গল্প হৃদয়ের অতি অন্তঃস্থলের। কল্যানীর ভয় আছে, তুষারের নেই। কল্যানী চলে যেতে চেয়েছিল এই জায়গা থেকে। তুষার বলেছিল, গিয়ে লাভ নেই, ও খুঁজে খুঁজে ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। তুষারের খুব মায়া। ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা তার। এই গল্পে অনেক মাত্রা। মদ খেয়ে ফেরে তুষার। তার গায়ে মেয়েমানুষের গন্ধ, শার্টে তার লিপস্টিকের দাগ। কল্যানী কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ফুরোয়। বাইরে বকু্লগাছের তলায় পাগল অনেক অনেক ফুল নখে ছিঁড়ে স্তুপ করেছে। উগ্র চোখে সে ব্যালকনির দিকে তাকায়। ক্ষুধার্ত হয়েছে সে। তুষার নিজে গিয়ে তাকে ভাত খাইয়ে আসে। ডাল তরকারীতে মাখা কাগজ ছিঁড়ে গেছে। পথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তাই খুঁটে খাচ্ছে। ক্লান্ত তুষারের বুকের ভিতরে বহু উঁচু থেকে ক্রেন-হ্যামার যেন ধম করে নেমে আসে। এই দৃশ্য সে দেখেছিল একদিন অফিস ফেরতা। সে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে আছে। এই জীবন থেকে বেরোতে হবে। মুক্তি, মুক্তি চাই যেন তার। পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে হয় এই শহর ছেড়ে। একদিন রাতে ভাত দিতে গিয়ে সে অরুণকে জিজ্ঞেস করে, কল্যানীকে তার দেখতে ইচ্ছে করে কি? জবাব দেয় না পাগল। একদিন তুষার  হাত ধরে অরুণকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। কী অসামান্য সেই নিয়ে আসা। কল্যানী ভয় পায়। আর্তনাদ করে ওঠে। তুষার তাকে অভয় দেয়। পাগলের হাত ধরে সমস্ত ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখায়। নিজের সমস্ত সুখের চিহ্ন দেখায়। পাগল দেখেই যায়। তারপর ডাইনিং টেবিলে বসে পেট ভরে খায়। তাকে থাকতে বলে। কিন্তু সে কিছুই না বলে নিজে নিজে নেমে চলে যায় বকুল বিছানো ধুলোয়। কল্যানী দেখেছে পাগলকে। তার চোখে শুধুই বিস্মৃতি। ভালবাসায় পাগল হওয়া অরুণের হৃদয় জুড়িয়ে গেছে বকুলতলায় বকুলছায়ায় বসে। সে কল্যানীকে চেনে না আর, ভাতের জন্য বসে থাকে। তুষারের এত ক্লান্তি কাজে, কল্যানীর এত প্রত্যাখ্যান নিয়ে বাঁচা, এর ভিতরে যেন আবছায়া এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। আধা আলো আধা অন্ধকার, স্মৃতিময় স্রোত বয়ে যায় অবিরল। পাগলের কোনো ক্লান্তি নেই। সে বসে থাকে। পাঠক এই গল্প আর শোনাতে পারছি না আমি। বিকেলের নিভে আসা আলোয় পাগলকে দেখছি বকুল ঝরানো ছায়ায়। নদীর পাড়ে। সব কিছু থেকে মুক্তি পেয়েছে এই দুঃখী। নতজানু হই লেখকের কাছে। 

Saturday, October 14, 2023

চাহনি | পর্ব ৮ | মন্দার মুখোপাধ্যায়


প্রস্তাব

ইশকুল বয়স। মনে হয় চোদ্দ। ক্লাস এইট। ইশকুলের পাঁচিল আর তাদের বাড়ির মধ্যে একটাই সরু পিচ রাস্তা। বাড়িটাও এই রাস্তার ওপরেই। দোতলায়, কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলো খুব বড় বড়। খড়খড়ি টেনে, তার ফাঁক দিয়ে এখান থেকেই যে সে রোজ আমাকে দেখে, তা আমি বেশ অনুমান  করতে পারি। কী করে বুঝি! তা জানি না। বয়সে আমার থেকে বছর কয়েকের বড় বলেই আন্দাজ হয়। কিন্তু সে অনুপাতে চালচলনে একটু বেশিরকমই আত্মবিশ্বাসী। মাঝে মাঝে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, নিজেকে চেনাতে। চিনিয়েছে, মোড়ের আড্ডায় দাঁড়িয়েও চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে। এসবে আমল না দিলেও সামান্য কেঁপে, মাথা নিচু করে নিজের রাস্তায় চলে গিয়েছি বার বার। তাই তার দিক থেকে এগিয়ে এসে কথা বলা বা আলাপ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাকে আমি এভাবেই চিহ্নিত করেছিলাম তার ওই চকিত দেখায়। সুঠাম এবং রূপবান চেহারা। একমুখ নরম দাড়ি, কোঁকড়া চুল আর দৃপ্ত চোখ।

শনি রবিবারও ওই স্কুলে যেতাম, ছবি আঁকা শিখতে। সেদিন ক্লাস শেষ হলে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে, বাউন্ডারি পাঁচিলের কোনায় গিয়ে সেই গাছটার নীচে এসে দাড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু কমলা ফুল কুড়িয়ে নেব, যদি দু’একটা পাই! গাছটার নাম জানতাম না। ফুলগুলো এত সুন্দর যে মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে এনে পাত্রে সাজিয়ে স্টিল লাইফ আঁকতাম। কখনও স্কার্ট বা ফ্রকের ঘেরে ফেব্রিক পেইন্ট করলেও ওই ফুল। তখন আমার প্রিয় বই বা ডায়েরির ভাঁজেও পাওয়া যেত ওই শুকনো ফুল আর তার পাতা। পাতাগুলিও অন্যরকম সবুজ। গাঢ় নয়, হালকা। 

সেদিন নাগালের মধ্যেই ছোট ছোট স্তবক দেখে, মাথা তুলে হাত বাড়াতেই ওদের জানলাটায় চোখ পড়েছিল। সেদিন আর খড়খড়ির আড়াল থেকে নয়। জানলাটা হাট খুলে, দু'হাতে দু'টো লোহার রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক অকপট মুগ্ধতায় স্নান করে। গায়ে ছিল সাদা পায়জামা আর গেঞ্জি। কোঁকড়া চুলগুলো ভিজে পাট পাট। তার সর্বাঙ্গে রবিবারের আরাম। জানলাটা মানুষের থেকেও লম্বা বলে তার পুরো শরীরটাই সেদিনও দেখা গিয়ছিল।

ফুলের ফাঁক দিয়ে তার চোখে আমার চোখ পড়তেই সে হাসল নিভৃতে। তার সেই নিজস্ব চাহনিতে কোনও সংকোচ নেই। আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। চোখ নামিয়ে ফুল-সমেত ডালটা ছেড়ে, মাথা নামিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিলাম দ্রুত। মায়ের ডিজাইনে বানানো কমলা রঙের আমব্রেলা কাটের  সুতির ফ্রক  পরা, আমার সেই টিংটিঙে শরীরে সে কী ভাললাগা! আর তার ওই চাহনিতে যেন বড় হয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি।

সে কি বুঝেছিল, হাসি ফিরিয়ে না দিলেও কতখানি সম্মতি ছিল আমার! অচেনা শিহরণে কত হাসি ঝরেছিল মনের গভীরে!

আজও জানি না যে কী ফুলের গাছ ছিল সেটা! রাস্তায় বা বাগানে ওই কমলা ফুলের গাছ দেখলেই এখনও তো কেঁপে উঠি। মনে পড়ে তার সেই নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা; অভ্যর্থনার উষ্ণ প্রকাশ; সপ্রতিভ হাসি। 

আমার মন থেকে কোনওদিন কি মুছে যাবে তার সেই নির্ণিমেষ চাহনি…… প্রেমের প্রস্তাব!

Tuesday, October 10, 2023

উত্তর শিলালিপি | কমলেশ রাহারায় স্মরণ সংখ্যা | শরৎ ১৪৩০


স্বাগতকথন

কবি কমলেশ রাহারায়ের (১৯৪৬-২০২১) পারলৌকিক কাজে এসেছিলেন তাঁর বন্ধু-স্বজন। সেদিনের অনুষ্ঠানে একটি ডায়রিতে তাঁরা লিখে দিয়েছিলেন এইসব স্মৃতিকথন। পরেও অনেকে এসে নানা সময় ভরিয়ে তুলেছেন সেই ডায়রির পৃষ্ঠা। কবির স্বপ্নের পত্রিকা 'উত্তর শিলালিপি' এবার সেইসব লেখাকে একসঙ্গে প্রকাশ করল। সেই সঙ্গে শুরুতেই রইল তাঁর একটি কবিতা এবং অনুবাদ। পাশাপাশি থাকল আমাকে লেখা কমলেশ রাহারায় সম্পর্কিত পাঁচটি চিঠি। সবশেষে কবির তিন পর্বের ভিডিও সাক্ষাৎকার।

অরুণাভ রাহারায়

সম্পাদক, উত্তর শিলালিপি

---------------------------------------------------------

ক্রম

কমলেশ রাহারায়ের কবিতা ও জগন্নাথ বিশ্বাসের অনুবাদ

ই-চিঠি: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সিতাংশু যশশ্চন্দ্র, হান্স হার্ডার, অশ্বিনী কুমার, উদয়ন বাজপেয়ী

স্মরণলিপি: অর্ণব সেন, পবিত্রভূষণ সরকার, নিখিলেশ রায়, রামেশ্বর রায়, মধুমিতা চক্রবর্তী, সঞ্চিতা দাশ, উত্তম চৌধুরী, শান্তনু দত্ত, কল্যাণ হোড়, প্রশান্ত দেবনাথ, আমিনুর রাহমান, উত্তমকুমার মোদক, সঞ্জয় সাহা, অম্বরীশ ঘোষ, গৌরব চক্রবর্তী, ব্রহ্মজিৎ সরকার, দেবায়ন চৌধুরী

কমলেশ রাহারায়ের ভিডিও সাক্ষাৎকার

---------------------------------------------------------

কণ্ঠস্বর

কমলেশ রাহারায় 

আজকাল শৃঙ্গহরিণ নিয়ে পুননির্মাণে মেতে উঠি

এই ছায়ারোদে সে একাই যেন উৎসবমুখর

তুরুপের তাস ভেবে তাকেই ছিঁটিয়ে দিচ্ছি তৃষ্ণাজল 

তবু কেন বলে সে, হৃদয়ে রেখেছ পোড়াকাঠ


আমার কণ্ঠস্বর সুদীপ্ত হাওয়ায় ভাসে 

তুমি কি শুনতে পাও এই বেলা অবেলায় 

সাগর দিঘির জলে কতখানি শীতল সহিষ্ণু হয় 


আমি অর্জুন নই শব্দমোহর ক্রমান্বয়ে রেখেছি পাতায় 

এইসব নৈবেদ্য সাজাতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে বৃক্ষমঙ্গল হই

তুমি অনুভবে হঠাৎ বৃষ্টিদিনে-- রম্য চাঁদ দিলে না কখনও


তবু অকুলবিহারী গন্ধ, সারারাত দিগ্বিদিক

তোমাকে সঙ্গে নিয়ে মুগ্ধতায় হেঁটে যাব বাকি পথ


Voice

Kamalesh Raha Roy

Translated by Jagannath Biswas


Now I devote in reconstructing horned deer,

In this shady sun he seems festive alone

Assuming a trump-card I throw to him his thirst-water

Yet, why he says, burnt wood is kept in heart.


My voice floats in luminous air 

can you hear

how much cold is tolerable

in lake and sea


I am no Arjun, I keep coinages in leaves,

For this oblation I become the plant-god moment by moment 

Your feelings never on a rainy day 

Gave a bright moon


Yet a redolence everywhere, the entire night

I will walk with you enchanted the rest of the path.

---------------------------------------------------------

ই-চিঠি

অরুণাভ,

পিতৃবিয়োগ বড়ই বেদনাদায়ক। ঠাকুর তোমাকে এ শোক সহ্য করার শক্তি দিন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

---------------------------------------------------------

Dear Arunava, 

in this time of sheer grief and pain, we are with you as much as we can. The image that you have sent,  of your father, poet Kamalesh Raha Roy, at his writing desk early in the morning, enables me to feel your closeness with him. And the absence. "From the hollow of the tree", as your poem says, "a musical melody" is heard. In his poems you would be able to be with him, and in your poems too.... We keep in touch through WhatsApp and email for now. 

Warm personal regards, 

Sitanshu Yashaschandra

বি দ্র: গুজরাটি সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি ও লেখক। সাহিত্য আকদেমি ও পদ্মশ্রী প্রাপক।

---------------------------------------------------------

Priyo Arunabha,

apnar babar mrityusombad peye khub kharap laglo. baba-chheler somporkota amader jibone birat boro ekta bhumika rakhe. tar opor dekhchhi sahityer madhyome apnader dujoner ei prakritik jogajoger baireo ekta jogsutro chhilo.

babara kintu chole geleo onekdin amader songe theke jan bole amar obhiggota.

asha kori apni babake haranor duhkho samle nite parben. amar antorik somobedona neben.

Hans Harder

বি দ্র: হান্স হার্ডার, জার্মান অধ্যাপক ও বাঙালির পরম আত্মীয়।

---------------------------------------------------------

Dear Arunava, 

Sad to hear this- passing away of your dad, a poet too. Very tough to over come grief , yet I am sure you will memorialize him in your works and he will live  in "folklores from oyster shell!"....the best life is to stay etched in the memories and in folklores that is what you father has gifted to you.   Hope, you and your family stay well cherish his memories and his poems...

Ashwani Kumar

বি দ্র: কবি ও মুম্বয়ের টাটা ইনিস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সাইন্সের প্রফেসর।

---------------------------------------------------------

Dear Arunava, 

Both of Kamalesh ji 's are really nice.  I loved reading them.  If I may use a mathematical expression,  I will say: in poems there sadness 'under root' vast expense.

Udayan Vajpeyi

বি দ্র: হিন্দি ভাষার সুপরিচিত কবি। ভোপালবাসী।

---------------------------------------------------------

স্মরণলিপি

তাঁর পরিচিতি ছিল ব্যাপক

অর্ণব সেন

কমলেশ রাহারায়কে আমি কলেজে ছাত্র হিসাবে পেয়েছিলাম। সত্তর-আশির দশকে। বিশ শতকে, তাঁর পরিচিতি ছিল ব্যাপক। তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘উত্তরের কবিতা’ সংকলনের প্রবীণতম কবি গণেশ রায়, নবীনতম কবি একমাত্র কমলেশ রাহারায়। তবে, জলপাই-ডুয়ার্সে তাঁকে সম্ভাবনাময় কবি হিসাবে আবিষ্কার করেছিলেন কবি বঙ্কিম মাহাতো, কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র হিসাবে। বঙ্কিম অবশ্য রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে চলে যান। 

কমলেশ রাহারায়ের দু’টি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘বিপরীত বসন্ত’ এবং ‘লিনোকাটে তাপ নিচ্ছি’-– আসলে কবি হিসাবে যত ব্যাপক পরিচিতি তাঁর, সেই তুলনায় কবিতার বই করা হয়নি। স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত কবি বলেই তাঁকে চিনেছি। তবে শুধু কবি নয়, গায়ক হিসাবেও তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল মঞ্চে, ঘরেবাইরে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অনেকের সঙ্গে কমলেশ ডুরুঙ্গামারি গিয়েছিল সাহায্য দিতে। তাঁর গানে বিপুল সাড়া তুলেছিল সমবেত জনতার মধ্যে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য!

---------------------------------------------------------

কমলেশ সত্যিই আমার গুণমুগ্ধ ছিল

পবিত্রভূষণ সরকার

ছেলেবেলার বন্ধু কমলেশের প্রয়াণ আমার কাছে খুবই বেদনার। দীর্ঘদিন নানা বিষয়ে তাঁর সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। সাহিত্য জগৎ কিংবা কবিতায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাকে মুগ্ধ করত। আমার পত্রিকা (মাটিরছোঁয়া ও উৎস) এবং বিকল্প স্মারক পত্রিকায় তাঁর কবিতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছি। কমলেশ সত্যিই আমার গুণমুগ্ধ ছিল। সাহিত্যের অঙ্গনে কমলেশের সাহচর্য ও সহযোগিতা চির অম্লান। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

---------------------------------------------------------

আলিপুরদুয়ার শহরে কমলেশদা ছিলেন একটা বড় আশ্রয়

নিখিলেশ রায়

কমলেশদা (রাহারায়) থাকবেন না, আর তাঁর সম্পর্কে এইরকম একটা খাতায় আমাকে কিছু লিখতে হবে-- তা কোনওদিন ভাবিনি। আমার ছাত্রজীবনে লেখালিখি শুরুর দিকটায় আলিপুরদুয়ার শহরে কমলেশদা ছিলেন একটা বড় আশ্রয়। এত ভালোবাসা, ওই দিনগুলোতে, গ্রাম থেকে প্রথম প্রথম শহরে আসা এই ছেলেটি আর কারও কাছে পায়নি। সর্বক্ষণ উৎসাহ দিতেন। তাঁর নতুন লেখা শোনাতেন, নতুন লেখা শুনতে চাইতেন। তাঁর সঙ্গে কাটানো বহু স্মৃতি! অসম্ভব ইতিবাচক একটা বড় মনের অধিকারী কমলেশদা আজ নেই -এই শূন্যতা বহুদিন ভরাট হওয়ার নয়। তাঁকে আমার প্রণাম! 

---------------------------------------------------------

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

রামেশ্বর রায়

প্রিয় কবি, কমলেশদা, চলে যাবার পর আমরা আলিপুরদুয়ারবাসী, শিল্প-সাহিত্য সকলে গভীরভাবে শোকাহত। ওঁর শেষকৃত্যের ক'টি চিত্রে রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

---------------------------------------------------------

হৃদয়ে আছেন কমলেশদা

মধুমিতা চক্রবর্তী

'নিজেকে বিপন্নতার খাদের ধারে নিয়ে না এলে কীভাবে কবিতা লিখবি'-- কমলেশদার অমোঘ উক্তিটি আজও তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে কবিতার ঝরনাতলায়। আপনি হৃদয়ে আছেন কমলেশদা। অনন্ত শ্রদ্ধা জানাই।

---------------------------------------------------------

কবিতায় আত্মভোলা এমন মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি

সঞ্চিতা দাশ 

কমলেশদা সাহিত্যজীবনে আমার অভিভাবকস্বরূপ। আসতে যেতে তাঁর কোয়ার্টারে আড্ডা, এটা একসময় নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। অনেক অনুষ্ঠানে দ্বৈত কণ্ঠে গান গেয়েছি। কবিতায় আত্মভোলা এমন মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি। তিনি চিরদিন আমার অন্তঃস্থলে শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন।

---------------------------------------------------------

তাঁর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাই

উত্তম চৌধুরী

জীবনের অমোঘ সত্য মেনে কমলেশদা চলে গিয়েছেন। এ যাওয়া অপূরণীয়। আমাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় কবি। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। সে সব মনে পড়লে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে উঠি। তাঁর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাই।

---------------------------------------------------------

ওঁর সৌজন্যে আমি মুগ্ধ

শান্তনু দত্ত

প্রথম কমলেশদাকে যখন দেখি সেটা ২০০২ সাল। এর আগে আমি আলিপুরদুয়ারে নিয়মিত থাকলেও সামাজিক প্রতিবেশে সেভাবে মেলামেশার সুযোগ পাইনি। ওঁর পুত্র অরুণাভ আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদে এবং আমার প্রধান শিক্ষকতায় নিয়োজিত হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হয় এবং শীঘ্রই আমি কমলেশদার লেখালিখির প্রেমে পড়ি। ‘আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে’-- এ কথা শুনে উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া ওঁর মতো বড় মাপের কবির কাছে তুচ্ছ হলেও সেদিন ওঁর সৌজন্যে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

---------------------------------------------------------

শূন্যতা কোনও দিনই পূর্ণ হবে না

কল্যাণ হোড়

সেই শৈশব থেকে চিনতাম কমলেশদাকে। পরবর্তীতে ৮০-র দশকে লেখালিখি সূত্রে ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্টতা। অসাধারণ মনের এবং অসাধারণ লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি সবার প্রিয় ছিলেন। ওঁর শূন্যতা কোনও দিনই পূর্ণ হবে না। দাদা যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন।


লেখালিখির ক্ষেত্রে তাঁর কাছে আমার অনেক ঋণ

প্রশান্ত দেবনাথ

সকলকেই চলে যেতে হয় একদিন জীবনের ওপারে। এই সত্য জানি। কিন্তু কারও চলে যাওয়া একেবারে নির্বাক করে দেয়। কথাগুলো যেন পাথর হয়ে যায়। কবি কমলেশ রাহারায় আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। লেখালিখির ক্ষেত্রে তাঁর কাছে আমার অনেক ঋণ। তিনি চলে গেছেন এ কথা ঠিক। কিন্তু কমলেশদা আমাদের ভালোবাসায় এখনও আছেন, এভাবে চিরদিনই থাকবেন। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা জানাই।

---------------------------------------------------------

তিনি যে আমার জীবনের ধ্রুবতারা

আমিনুর রাহমান

প্রিয় মানুষ। প্রিয় কবি। আমার প্রিয় দাদা আজ ঘরে নেই। কিন্তু এ ঘরে তাঁর ঘ্রাণ পাচ্ছি, তাঁর কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছি সৃষ্টি। অন্তরে তাঁর প্রতিধ্বনি আমাকে শিহরিত করছে তেমনই। 'বৈঠা'র জন্মলগ্ন থেকে তাঁর ছায়া পেয়েছি, স্নেহ-মায়া পেয়েছি অনাবিল। সংস্কৃতি আর সাহিত্যের প্রিয় শহর আলিপুরদুয়ারকে চিনিয়েছিলেন হাত ধরে। কত গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি পিতৃসম দাদার হাত ধরে।

সারা জীবনেও শিক্ষা ফুরায় না দেওয়া-নেওয়ার ফুলেল নৈবেদ্য। তাঁর কাছে শুধু নিয়েছি আর নিয়েছি। দিয়েছি তাঁরই আশির্বাদের 'বৈঠার ছলাৎছল শব্দটুক' শুধু।

যতদিন বইতে পারব-- বৈঠার প্রতিটি ঢেউ ভাঙার ভাষায় মনে রবেন কমলেশদা। জানি প্রতি মুহূর্তে পাব তাঁর সাড়া। তিনি যে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। স্মৃতির প্রতি গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

---------------------------------------------------------

কবি জেগে থাকেনই

উত্তমকুমার মোদক

সঙ্গীত ও সাহিত্যের মাধুর্য্য পাশাপাশি আত্মলীন বহন করে গিয়েছেন কমলেশ রাহারায়। আমি নয় দশকের প্রথমার্ধে কবির সঙ্গে পরিচিত হই। এরপর তিনি স্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন আমাদের, বিনিময়ে অকপট, অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা পেয়েছেন সঙ্গীত ও কাব্যকৃতীর জন্য আন্তরিক। বলা যায়, কমলেশদা ছিলেন আমাদের সাহিত্যচর্চার নায়ক ও নেতা। তিনি চিরস্মরণীয় থাকবেন।

---------------------------------------------------------

বিশ্বাসের কাছে সৎ ছিলেন কমলেশদা

সঞ্জয় সাহা

'কেন প্রেম দিলে দ্বীপ্রহরে

ভেবে দেখ,

পুনর্বার ভেবে দেখ, করলি তো ভুল

বৃষ্টিভেজা গল্পবকুল'

কমলেশদার এই কবিতাটা যখন পড়ি তখন আমি কমলেশদাকে চিনি না, জানিও না। বেরিয়েছিল একটি ছোট্ট ফোল্ডারের মতো কাগজ ‘মঞ্জিল’-এ (সম্ভবত)। বাংলার ১৩৯৯ সনের দিকে। কেননা স্মৃতিতে সেই সবুজ ফোল্ডারটির উপরের এই সন আর নিচে কমলেশদার কবিতাটা ভেসে উঠছে। পরিচয় তার একদশক পরে, সম্ভবত কোচবিহারে। বয়সের অনেক তফাৎ থাকলেও স্নেহ ও বন্ধুত্ব দুইই পেয়েছি। কমলেশদা একবার কবিতার নামে যা খুশি শব্দ প্রয়োগে ক্ষেপে গিয়েছিলেন বলে মনে আছে এই আলিপুরদুয়ারেরই বড় কবিসভায়। কেননা কোনও এক জনৈক কবি লিখেছিলেন-- ‘আলেকজান্ডার ট্রেনের কামরায় দাঁতন বেচেন’। বিশ্বাসের কাছে সৎ ছিলেন কমলেশদা। আরও অনেক মজার মজার যাপন কথা শুনেছি ওঁর বন্ধু রমাপ্রসাদ নাগের কাছে। কমলেশদার আত্মার শান্তি কামনা করি। প্রণাম দাদা।  

---------------------------------------------------------

বন্ধুর মতো মেশার সুযোগ পেয়েছি

অম্বরীশ ঘোষ

যেই মানুষটার কাছ থেকে আজীবন শুধু শিখেই গেলাম, দু’হাত পেতে নিয়েই গেলাম, সেই মানুষটা ‘নেই’-- এই শব্দটায় আমি বিশ্বাসী নই। যা কিছু জ্ঞান, প্রাপ্তি, জনসংযোগের উপায়, মানুষ হিসাবে বিস্তার, তার সবটা জুড়েই থেকে যাবেন এই মানুষটা। ‘মামা’ সম্বোধন করলেও বন্ধুর মতো মেশার সুযোগ পেয়েছি, সমাজ-সংস্কৃতিতে বিচরণের সৌভাগ্য হয়েছে ওনার সঙ্গে। যতদিন সাহিত্য-সংস্কৃতি থাকবে, ততদিন কমলেশ রাহারায় থাকবেন।

---------------------------------------------------------

কবিজন্মের কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হয় কবি কমলেশ রাহারায়ের স্নেহস্পর্শে

গৌরব চক্রবর্তী

'অথচ কেউ জানে না

কোন পাহাড়ে অদলবদল হল মেঘ

একা একা সূর্য উদয় হল...' 

              –কমলেশ রাহারায়

কাকু, অর্থাৎ কবি কমলেশ রাহারায় সম্পর্কে এই লেখা কীভাবে লিখব? কী লিখব? আমার এই সামান্য কবিজীবনের সূচনাকালীন ঘ্রাণ এই কাকুর কাছ থেকে পাওয়া! আমার কবিজন্মের কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হয় কবি কমলেশ রাহারায়ের স্নেহস্পর্শে, তাঁর আদরজনিত প্রশ্রয়ে, তাঁর কবিতার আশ্রয়ে এসেই। তিনি যে সন্তানস্নেহে তাঁর কবিতা ভাবনা ও কবিজীবন আমার যাপন ও জীবনের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন, সেই বীজ ফেটে ফেটে আজও কিছু চারাগাছের জন্ম হয় আমার লেখার খাতায় –সেগুলোকেই আমি কবিতা বলে ডাকি। কবি কমলেশ রাহারায় আমার শুরুর দিকের কবিতাগুলির ঠিকঠাক দিক-নির্দেশ করিয়া দিয়েছেন বলেই... আজও কেউ কেউ আমার নামের সঙ্গে ‘কবি’ শব্দটি জুড়ে দিতে পারেন আজও! এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়... শোধ করার নয়! কাকু আছেন। থাকবেন -কাকু হয়ে, বিরাট মাপের একজন কবি হয়ে থেকে যাবেন আমার হৃদয়ে চিরকাল...

---------------------------------------------------------

শূন্য ঘরে শুধু স্মৃতি পড়ে আছে

ব্রহ্মজিৎ সরকার

এই ঘরে ঢুকেই দেখি বিছানাটি নেই। বিছানার উপর কবিও নেই। প্রায় চার বছর আগে এখানেই কাকুর সঙ্গে অর্থাৎ কবি কমলেশ রাহারায়ের সঙ্গে শেষ আড্ডা ও কথা হয়েছিল।

আজ এই শূন্য ঘরে শুধু স্মৃতি পড়ে আছে। স্বর্গীয় কবি কমলেশ রাহারায়ের জন্য থাকল আমার প্রণাম ও অনেক অনেক শ্রদ্ধা।

---------------------------------------------------------

ভালোবাসাই বুঝি দুঃসাহসী করে তোলে

দেবায়ন চৌধুরী

অরুণাভ কতবার বলেছে বাড়িতে আসতে, হয়ে ওঠেনি। আজ হল। কিন্তু কাকুর সঙ্গে দেখা হল না। ওঁর ছবির সামনে যে দু-কথা লিখছি, এটা হয়তো দুঃসাহস। ভালোবাসাই বুঝি দুঃসাহসী করে তোলে।

কবির বাড়ি দেখলাম। উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে নদীর মতো…

শুদ্ধ হবার পালা...

---------------------------------------------------------

ভিডিও সাক্ষাৎকার শুনতে লিংকে ক্লিক করুন

কমলেশ রাহারায়ের ভিডিও সাক্ষাৎকার ১

কমলেশ রাহারায়ের ভিডিও সাক্ষাৎকার ২

কমলেশ রাহারায়ের ভিডিও সাক্ষাৎকার ৩



Saturday, September 23, 2023

চাহনি | পর্ব ৭ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

চক্ষুদান

চক্ষুদান কথাটার অর্থ আজকাল আমূল বদলে গেছে। সদ্যমৃতের সজীব চোখ আই ব্যাঙ্কে রেখে জীবিতকে চক্ষুষ্মান করা। এতে একজন দাতা এবং অন্যজন গ্রহীতা। আর পুরো কাজটি করেন চিকিৎসকেরা। এ এক মহতী সেবা। অন্ধ বা প্রায়ান্ধদের চোখে আলো ফোটে। আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে চক্ষুদান বলতে একমাত্র যা বোঝাতো তা হল, বিগ্রহের চোখ ফোটানো। এ কাজটি প্রথমে করতেন প্রতিমা শিল্পীরা। পরে পুজোপাঠের মধ্যে দিয়ে, সেই বিগ্রহে প্রাণ সঞ্চার করে তাকে সজল করে তুলতেন পুরোহিত। এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সকলের মনে হবে-– মা যেন চেয়ে আছেন।

বাড়ির খুব কাছেই ভটচায্যি বাড়িতে দুর্গা পুজা হতো। রথেরদিন খুঁটি পুজো করে ঘট বসত। এরপর কবে যেন মাটির ঢিবি রাখা হতো চণ্ডীমণ্ডপে; আর শুরু হয়ে যেত প্রতিমা গড়ার কাজ। একটা বাঁশের চালচিত্রে ছেলেপিলে বাহন-সহ মাদুগ্গার সংসার। প্রতিদিন ইস্কুলের পরে, বিকেলের খেলা বাদ দিয়ে আর ছুটির দিনগুলো দুপুর থেকে সেখানেই পড়ে থাকতাম। হাঁ করে দেখতাম সেই ঠাকুর গড়া। মাস খানেক ধরে সে পব্বো শেষ হলে, শুরু হতো মায়ের চক্ষুদান। তখন কিন্তু নির্জন মণ্ডপে একা সেই বুড়ো মানুষটি যিনি চোখ আঁকবেন। ভোর থেকে সবাই দেখতে পাবে মায়ের চোখ কেমন চেয়ে আছে। আমি অবশ্য অসুর এবং সিংহের চোখজোড়াও দেখতাম। সিংহের হুঙ্কার আর অসুরের ভয় দুটোই প্রকাশ পেত ওই আঁকা মণিতে। আর মায়ের চোখে যেন উৎসব। আমাদের নতুন জামা-জুতো পাওয়ার আনন্দ । মজা লাগত গণেশের কুতকুতে চোখ দেখেও। কী একটা আকর্ষণ থাকতো তাতেও। তবে কার্ত্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী-– এই তিনজনের চোখ প্রায় এক রকম। মিষ্টি মিষ্টি সেজে তাকিয়ে থাকা। 

প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে কত না প্রতিমা আর তার কী বিচিত্র সব অভিব্যক্তি! তেজ, শক্তি, প্রসন্নতা-– একেক শিল্পীর একেক রকম প্রকাশ। কিন্তু যে একটা ব্যাপারে সমতা ছিল, তা হল সবই কিন্তু প্রতিমার চোখ। এ চাহনি মানুষের দৃষ্টিতে পাইনি। এমনকি অভিনয় বা নাচেও তাঁদের প্রতিমার মতো মনে হয়; কিন্তু প্রতিমা মনে হয় না। এ চাহনি দেবীর। মনে হয় একমাত্র মূর্তিতেই ফুটে ওঠে কারণ তা স্থির। এ চোখের পলক পড়ে না।

প্রতি বছর একবার কুমোরটুলি যাই। যাই কালীঘাটের পোটো পাড়াতেও। তা ছাড়াও এ শহরের নানান আনাচ কানাচে কুমোরদের কিছু সাবেক ঘর এখনও নয় নয় করেও আছে। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা গড়ার কাজ। ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাখা মস্ত মস্ত প্রতিমা। মাটির কাজ শেষ হয়ে এবার রং এবং চক্ষুদান হবে। বেশিরভাগই বারোয়ারি পুজোর অর্ডারি ঠাকুর। শিল্পীদের জিজ্ঞাসা করি কেমন লাগে ওই চক্ষুদান পর্ব! সকলেরই প্রায় এক উত্তর– মা এসে আঁকিয়ে নেন। এই অনুভুতিটাই বোধহয় চক্ষুদানের আসল চাবি কাঠি। এবারেও যখন গেলাম, মনে হল ওই এ কোণা ও কোণা থেকেও মা যেন দেখছেন। বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তো পুতুলের, কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই তা যেন শক্তি! উৎসব।

হয়তো এ জন্যই মানুষের চেয়ে থাকায় যা চাহনি, দেবী মূর্তির ওই চেয়ে থাকা হল–- পূর্ণদৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে পলক পড়ে না। তবুও তা সতেজ এবং বাঙ্ময়।

Tuesday, September 5, 2023

অধরা গালিব ও তাঁর গজল | মহিউদ্দিন সাইফ

উর্দু শায়েরি আর গালিব যেন সমার্থক। গালিবের মনন, চিন্তন আর কল্পনা বিশ্বসাহিত্যে বিস্ময়কর। বড় কবিদের শায়েরির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল 'মানি আফ্রিনিশি' অর্থাৎ নতুন নতুন অর্থের জন্ম দেওয়া। গালিবের শায়েরি হল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমি চিরকালই গালিবের কবিতার ন্যাওটা। আর আমার উর্দু কাব্যচর্চাও শুরু হয় তাঁকে দিয়েই। যেমন ফারসি শুরু হয় মওলা রুমিকে দিয়ে। গালিবের কবিতা আমার নিজের কাব্যবোধ ও কাব্যভুবন গড়ে তুলতে এক অতুলন ভূমিকা রেখেছে। গালিব অনুবাদের কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না প্রথমে। কারণ অনুবাদে গালিব আনা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। কিন্তু তাঁর শের বা গজলের বাংলা অনুবাদ দেখে আমার আক্ষেপ হয়েছে বারবার। তখন থেকে স্বপ্ন দেখেছি যোগ্যতা অর্জন করলে, বুকের পাটা তৈরি হলে আমি নিশ্চয় একদিন গালিব অনুবাদে হাত দেব। বেশ কয়েকদিন ধরে গালিবের অনুবাদ বিষয়ে বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিপ্লবদার (কবি বিপ্লব চৌধুরী) ফোন থেকে একদিন কল এল। অরুণাভদার সঙ্গে আলাপ হতেই তিনি গালিবের অনুবাদের কথা তুললেন। আমি যেন মনে আরেকটু জোর পেলাম। তারই ফলস্বরূপ কাজে নেমে পড়া।

আমি আগেই বলেছি অনুবাদে গালিব নামানো পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। এটা জেনেই আমি তাতে হাত দিয়েছি। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করেছি মূলের ভাবটিকে অবিকৃত রাখার। চেষ্টা করেছি 'মানি আফ্রিনিশি'র আশ্চর্য বৈশিষ্টকে ঠিক রাখার। মূল গজলের ভঙ্গি মোতাবেক বাংলা অনুবাদে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহার করতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রচেষ্টা কতটুকু কৃতকার্য হয়েছে সেকথা রসিকজন ঠিক বলতে পারবেন। ত্রুটি দেখে করুণাবশে ক্ষমাও করবেন জানি। এখন তাহলে গালিব পড়ি!

১. 

(নক্শ ফরিয়াদি হ্যা কিস্ কি)


চিত্রগরীর খেয়ালিপনার অভিযোগ করে ছবি যে কার!

সামান্য এক কাগজ-লেবাস পরানো রয়েছে গায়ে সবার।


শুধিও না একাকীত্বের কথা, জীবনের এই দুর্বিপাক,

সন্ধে পেরিয়ে সকালকে আনা, গিরি কেটে আনা শীরের ধার।


বে-কাবু এই প্রেমের আবেগ বেড়ে গেছে দেখো এইভাবে,

তলোয়ার থেকে তীক্ষ্ণতা তার বেরিয়ে এসেছে বে-কারার।


যেভাবে পারুক বিছাক চেতনা শ্রবণের জাল, বুঝতে চাক,

আমার বাচনভঙ্গি পুরাণপাখির তুল্য, এই তো সার।


বন্দিত্বেও পায়ের তলায় আগুন রেখেই রই 'গালিব',

অগ্নিদগ্ধ লোমরাজিই তো শিকলের কড়া হল আমার।


২.

(শওক হর রঙ্গ্)


বাসনা শত্রু হল প্রতিপলে বাঁচবার উপায় গুলির,

ছবির পর্দা, তবু দেখা যায় মজনুর নগ্ন শরীর।


ক্ষতও তো বুঝল না হৃদয়ের ব্যাকুলতা, মর্ম গভীর

যখ্মি হৃদয় থেকে ডানা মেলে উড়ে গেল বেদনার তীর।


দীপের ধোঁয়াটি আর ফুলের সুবাস আর কান্না বুকের

তোমার আসর থেকে যে-ই বেরোল, হয়ে ব্যাকুল অধীর।


বাসনাদগ্ধ এই মন আমার বেদনার থালা সুস্বাদু,

বন্ধুরা তুলে নিল, যে যেমন নিতে পারে বেদনার ক্ষীর।


বাসনার পথে জেনো নিজেকে ত্যাজ্য করা কঠিন মোকাম

তাও পার হওয়া গেল, বাকি থাকে বল আর কোন কোন তীর?


হৃদয়ে আবার এক কান্নার হাহাকার উঠল 'গালিব'

বৃষ্টি হল না বলে ঝড় হয়ে বেরল যে তারই নজির।


৩.

(দহর মেঁ নক্শে-ওয়াফা)


অনুরক্তির ছবি এ জগতে প্রবোধের হল না কারণ,

নিজের অর্থে লাজ পেল না পেল না এই শব্দ এমন।


মৃত্যু কামনা করি ছাড়া পেতে অনুরক্তির গ্লানি হতে,

কিন্তু সে অবকাশটুকুও তো দিল না সে নিদয় এমন।


হৃদয় পথিক হয়ে থেকে যাক মদিরা ও পেয়ালার পথে,

খোদাভক্তির পথে প্রাণ আমার কিছুতেই গেল না যখন।


মিলনের কথা তুমি দাওনিকো, তবু রাজি হয়ে আছি আমি

সুসম্ভাষণ চেয়ে হল না এ কান আমার আতুর যেমন।


ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে আছি, কার কাছে করি অভিযোগ?

চাইছি মরণ হোক, হায়! তবু কিছুতেই আসে না মরণ।


মরে যাই ক্ষীণতনু গালিবের এমন নাজুক হাল দেখে,

জীবন ফিরিয়ে আনা ঈশার ও ফুঁ-টুকুও হল না সহন!


৪.

(ইশ্ক মুঝকো নহি)


প্রেম নয় এ উন্মাদনা, উন্মাদনাই হল

আমার উন্মাদনা তোমার খ্যাতির উপায় হল।


সম্পর্ক ছিন্ন তুমি কোরো না এইভাবে

কিছু না থাক না-হয় এবার শত্রুতাটাই রইল।


সঙ্গে আমি থাকলে তোমার কিসের অপমান?

লোকসমাজের ভয় থাকে তো নির্জনতায় চল।


আমি তোমার শত্রু তো নই, দ্বিধা কেন হায়!

না-হয় তোমার পরের সাথে ভালবাসাই হল।


যেটুক আছ, আছ নিজের অস্তিত্বের জোরে

চেতনা যদি না থাকে তো অচেতনাই হল।


প্রেমের থেকে বাফার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম হাত

প্রেমে থাকা না থাকে তো দুঃখে থাকাই হল।


অবিচারের আকাশ তুমি কিছু তো দাও হাতে

বিদায়বেলার তোফা না-হয় হা-হুতাশই হল।


আমিও সব মেনে নেওয়ার স্বভাব করে নেব

তোমার নাহয় স্বভাব হয়ে উপেক্ষাটাই রইল।


বঁধুর সাথে নেহার বাঁধন কেটে গেলে 'আসাদ'

মিলন তো আর থাকে না, তাই আকাঙ্ক্ষাটাই রইল।


(ভণিতায় কোথাও তিনি 'গালিব' কোথাও বা 'আসাদ' ব্যবহার করেছেন)


৫.

(সাতাঈশগর হ্যা যাহিদ)


আল্লার ভক্ত যে-স্বর্গের বাগিচার গুণগানে চুর হয়ে আছে,

অমন ফুলের তোড়া আমাদের বেখুদের ভুলে যাওয়া তাকে পড়ে আছে।


ফুরসত দেয় যদি সামান্য এ-জগত তবে আমি দেখাব জরুর,

হৃদয়ের দাগগুলি ঝাড়বাতি-প্রদীপের একেকটি বীজ হয়ে আছে।


তোমার রূপের বিভা এ আরশিনগরের কী হালত করে গেছে দেখো,

প্রতিদিন বাগানের শিশিরের ভুবনের রৌদ্র যে-হাল করে গেছে।


সৃষ্টিরই খাঁজে খাঁজে লুকায়িত আছে জেনো ধ্বংসের সমূহ কারণ,

ফসলবিনাশী বাজে যে তত্ত্ব আছে তা কৃষাণের ক্রোধেও তো আছে।


লাখে লাখ বাসনা সে নিহত লুকানো আছে এ নীরবতার অন্তরে,

অস্তি আমার যেন পথিকের কবরের নিভু নিভু দীপ হয়ে আছে।


এখন কেবল সেই প্রেমাষ্পদের স্মৃতি আর তার ছবিটি সহায়

বিধুর হৃদয় যেন ইসুফের কারাগারে কুঠুরি নিজন হয়ে আছে।


আমি তো দেখছি শুধু 'ফানা'র পথটি আছে দৃষ্টিতে আমার 'গালিব'

এ সেই সূত্র যাতে অস্তির কণাগুলি মালার মতন গাঁথা আছে।

Saturday, September 2, 2023

চাহনি | পর্ব ৬ | মন্দার মুখোপাধ্যায়


চোখে চোখ

চেনা মানুষকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু আহামরি কি! বিশেষত তাঁর সঙ্গে যদি প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ হয়; কারণ নিয়মিত কথা বলা ও সহাবস্থানের একটা নিজস্ব মেমরি বক্স থাকেই। যোগাযোগে থাকা মানুষ, ভিড়ের মধ্যেও তাই চট করে চোখে পড়ে যায়; মুখ না দেখেও, পিঠ ফিরিয়ে থাকা তার দেহ রেখাতেও চিনতে তাই ভুল হয় না। কিন্তু যে মানুষটির সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়েছে একবার বা বড় জোর দুবার, তাও প্রায় বছর দশেক আগে এবং তা আরও অনেকের মধ্যে, সেখানে নিকট বোধ গড়ে ওঠা বিস্ময়কর বৈকি। তা ছাড়াও মানুষটি এতোই বিশিষ্ট এবং আকাঙ্ক্ষিত যে, ওরকম গুচ্ছগুচ্ছ গুণগ্রাহী এবং রূপমুগ্ধদের সঙ্গে তাঁর প্রতিদিনই আলাপ পরিচয় হয়; ফলে আমাকে চেনা এবং মনে রাখা একেবারেই অসম্ভব; তা ছাড়াও তাঁর কোনও বৃত্ত মানে, কাজ বা পরিচিত গণ্ডি, কোথাওই আমি পড়ি না। ফলে আমার সেই চমকে ওঠার বিস্ময় ও বুক ধুক পুক আনন্দ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই আজও মন জুড়ে রাজত্ব করছে।

একটি স্মরণ সভার আমন্ত্রণ পেয়ে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় দেখি তাঁর নাম; লকডাউনের সময় ফেসবুক সক্রিয়তায় তাঁর সঙ্গে এক নিবিড় যোগাযোগ ঘটে। কবে বা কেন যে আমিও তার ‘ফ্রেন্ডস ওনলি’ বন্ধু গ্রুপে ধরা আছি, তা খেয়াল করিনি তেমন; কিন্তু লকডাউনে প্রতিদিন নিয়ম করে কবিতা পাঠ শুরু করলেন তিনি; একই সঙ্গে বাংলা কবিতা এবং তার ইংরেজি তর্জমা; আবার কখনও ইংরেজি তর্জমা সমেত অন্য ভাষার কবিতাও; তাঁর সেই জ্ঞান, প্রস্তুতি, নিষ্ঠা অনেকের সঙ্গে মুগ্ধ করেছে আমাকেও। লকডাউন শেষে সে সব পর্ব মিলিয়ে গেলেও, প্রায় বছর খানেক ধরে, ফেসবুকে প্রতিদিন দেখা হওয়ায় কেমন এক নিকট সান্নিধ্য গড়ে উঠেছিল; মনে হয়েছিল আলাপ পরিচয়ের মধ্যে কোনও দূরত্ব বা চ্ছেদ নেই যেন; দেখা হলেই কথা হবে, যেন বা এতটাই চেনা; কিন্তু সে তো আমার মনের ভাব; তাঁর মতো প্রথিতযশা মানুষটিরও যে এমনই মনে হবে, তা ভাবা বাতুলতা বৈকি! কিন্তু সেদিন তো তাইই ঘটল!

পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ, এবং প্রায়ান্ধকার; তাঁর আসবার অপেক্ষায় আমারা সকলে, কারণ তিনিই তো উদ্বোধক; সময়ের মিনিট তিনেক দেরিতে ঢুকতেই প্রবেশ দ্বারের আলো এসে পড়ল সামনের কয়েকটি সারিতে; আর হতবাক করে দিয়ে, তাঁর চশমা ঢাকা চোখেও উচ্ছ্বাস জাগিয়ে হাত নাড়লেন তিনি, দ্বিতীয় সারিতে বসা আমার দিকে সহজ তাকিয়ে! আমার দুপাশে বসা অতিথিরা আমাকে নজর করার আগেই লজ্জায় বা আনন্দে মাথা নামিয়ে নিলাম; ওই হাত নাড়া যেন আমার দিকে নয়; পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তাঁর চেনা মানুষের কী অভাব ঘটেছে! এটা বিশ্বাস করতে আমারও বেশ আরাম লাগল; কিন্তু মঞ্চে উঠে, নিজের চেয়ারে বসে এবার তিনি আরও ভাল করে মিলিয়ে নিলেন আমাকে; কোনও এক সময় ফেসবুকেই জানতে চেয়েছিলেন, আমার লেখা একটি বই সম্পর্কে; মানে কী ভাবে কোথায় পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি; ফলে, মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে ওই বইটি আমি সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, নিজে না পারলেও, কারও হাত দিয়ে ওইদিন ওঁর হাতে ঠিকই পৌঁছে দিতে পারব। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব সেরে, তিনি আবার যখন মঞ্চে এসে বসলেন, একজনকে অনুরোধ করামাত্র তিনি বইটি তাঁর হাতে দিয়ে এলেন। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের আগে চা পানের বিরতি হয়ে, আলো নিভলেই, চুপি সাড়ে বেরিয়ে এলাম, প্রেক্ষাগৃহ থেকে; পরদিন সকালে মোবাইল অন করতেই দেখি, ফেসবুকেই আমাকে লিখেছেন, ‘বই পেলাম, কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে প্রেক্ষাগৃহে ফিরে এসে, পরে আর তোমাকে দেখলাম না; তোমার সিটটা ফাঁকা…।’

তাঁর সেদিনের সেই চাহনি একথাই বুঝিয়ে দিল, আলো বা অন্ধকার যাই থাক না কেন– প্রাণে সাড়া জাগলে, সে তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে; আর বুঝিয়েও দেবে যে – এই তো, ঠিক দেখতে পেয়েছি! চাহনির এই সম্মোহনে শুধু চোখ নয়, দৃষ্টি নয় মনও কাজ করে; কাজ করে অন্তরঙ্গ যাপনের এক নিবিড় মাধুর্য; হয়তো সামান্য কিছু শূন্যতা বোধও। আর এই জন্যেই তা ভোলা যায় না; চিরকালের সম্পদ হয়ে রয়ে যায় মনের গভীরে।


আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৫ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

Saturday, June 17, 2023

কবীর চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

প্রশ্ন


হাতের উপর হাত রেখেছি, ঠোঁটের ফাঁকে বিষ, 

এইটুকুতেই প্রেমের কথা শেষ হলে কি চলে?

মন মেজাজের আবেশটুকু

তৃষ্ণা হয়ে ভিজতে ভিজতে 

শরীরজুড়ে নামলো এসে এক আষাঢ়ের জলে।

হাতের উপর হাতটি রাখা, আঙুলরা একজোট, 

এমন সময়ে শরীর কি তোর ছুটির কথা বলে?


ভাবিস না আর তার কথাটি, দেখবি ও সব খালি

মন-ভুলোনো ঘর-ফুরোনো প্রেম পিরিতির ধুলো, 

প্রতীক্ষাতেই থাকবি যদি

একলা বসে নিরবধি, 

কার দুয়ারে আস্তে আস্তে জমবে স্মৃতিগুলো?

হাতের উপর হাত রেখে দেখ, চোখের নীচে কালি, 

এই আকালে ঠোঁটদুটি তোর কার অন্ধকার ছুঁলো?


হাতের উপর হাত রেখেছি, ঠোঁটের ফাঁকে ঝড়,

দুটি জিভের এক সহবাস, স্বাদ কি পড়ে মনে?

আষাঢ় গেছে, শ্রাবণ গেছে

নিরুদ্দেশের অন্বেষণে,

এক ফালি মেঘ একরোখা তাও ফুঁসছে ঈশান কোণে।

হাতের উপর হাতের বসত, অনির্বাণ অধর, 

এমন সময়ে অপেক্ষাতে শরীর কি দিন গোনে?


নেটিভিটি


আজ ভোরের ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারেরা

আর পাশের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ কিশোরবাবু

এসেছেন

নবজাতক শিশুটিকে দেখতে। 


এখনও কথা ফোটেনি আধো-আধো বুলিতে, 

দীঘির মত স্বচ্ছ চোখে সে অবাক হয়ে দেখছে দুনিয়াটা।

ভাষা নেই, স্মৃতি নেই, শ্লেষ নেই, 

তবু তাকে দেখবে বলেই এসেছে 

ফড়িং আর মৌমাছি,

রুই কাতলা তেলাপিয়া আর

পাড়ার সবচেয়ে ডাকসাইটে হুলো বেড়ালটা। 


রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন,

তাঁর হেলিকপ্টার নামবে সামনের মাঠে

তাড়াহুড়ো করে বানানো জোড়াতালি হেলিপ্যাডে।

শতদল ক্লাবের চেয়ারম্যান দেবাশিসবাবু

আর বাবাই বলে যে ছেলেটা 

পাড়ায় সব্বার টিভি সারায়,

সবাই এসেছে নবজাতককে দেখতে। 


রিকশা থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমেছেন জ্যোতিষার্ণব, 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক সাহেব অবশ্য

ট্রামেই এসেছেন, 

বেসামাল ধুলোবালি উড়িয়ে এসেছে হেমন্তের হাওয়া,

আর আকাশে টিকিট না কেটেই ঢুকে পড়েছে

অকালের মেঘ।


হালকা বৃষ্টি এসেছে সকাল থেকেই, 

তার সঙ্গে মিষ্টির দোকানের মালিক অমিতদাও 

দুই মেয়ে আর স্কুলের বন্ধু রনিকে নিয়ে এসেছেন

নবজাতককে দেখবেন বলে।


এ নবজাতকের কথা লেখা আছে 

আদিম কবিতার খাতায়। 

পৃথিবীর কোনো এক অনির্দিষ্ট যুগে

সমুদ্রের গর্ভ থেকে উঠে আসবে এই শিশু, 

আকাশের বুক চিরে ছুটে যাবে আশ্চর্য উল্কা, 

আর পূবের দিগন্ত থেকে উপহার নিয়ে আসবে

তিনজন বেরসিক বুড়ো। 


আর ঠিক তখনই এই নবজাতক

দেয়ালা করতে করতে

রচনা করবে এক নতুন পৃথিবী।

তার এক পা থাকবে মহাকাশে, 

অন্য পা থাকবে আগ্নেয়গিরির অতলে,

আর সে দু’ হাত বাড়িয়ে খেলতে খেলতে

হয় পৃথিবীতে গড়ে তুলবে অতুলনীয় এক স্বর্গরাজ্য, 

নয় সবকিছু ধ্বংস করে

আবার নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে বসবে। 


দাড়ির গল্প


পঞ্জিকাতে লগ্ন দেখে সেলুন দিলাম পাড়ি, 

বাড়ি এবং হাঁড়ির পরেই সবসে প্যায়ারা দাড়ি!

দাড়ি ব্রহ্মা, দাড়ি বিষ্ণু, দাড়ি মহেশ্বর, 

আল্লাতালা, গড, যীশু সব দাড়ির মাতব্বর। 


সেই দাড়িটিই কাটতে হবে, পাষাণ সমাজ বলে;

আধকামানো গাল নিয়ে কি আপিস যাওয়া চলে?

ক্ষুরটি হাতে যতই কাছে আসেন পরামানিক, 

বিষণ্ণতায় দাড়ির কথাই ভাবছি বসে খানিক। 


কারোর দাড়ি লম্বামাফিক, কারোর দাড়ি খাটো, 

কারোর দাড়ি ছাগল-সমান, থুতনি আঁটোসাঁটো।

এক একজনের দাড়ির ডগা পিছনপানে মোড়া, 

কারোর দাড়ি গোঁফের সঙ্গে এক্কেবারে জোড়া। 


হরেক রকম দাড়ির বাহার দেখতে যাবো কোথা? 

এই জগতের যতেক মহান মানুষ দাড়ির হোতা। 

মার্ক্স, ফ্রয়েড, শোপেনহাউয়ার, লেনিন এবং র্যালে, 

মাথায় যাঁদের বুদ্ধি, তাঁদের দাড়িও থাকে গালে।


আমার দাড়ি কামায় যে’জন, সে’জন সুজন বটে, 

থুতনি জুড়ে রাখছি দাড়ি, মগজ থাকুক ঘটে। 

টাকা কামাই সাধ্য কোথায়? দাড়িই কামাই ব্লেডে।

কমুক টাকা, বাড়ুক দাড়ি, দাড়িরই পে-গ্রেডে। 


ঢিল মারো


মৌমাছির চাকে ঢিল মারো,

ইচ্ছে করেই। 


বহু দিন, বহু যুগ, বহু মুহূর্ত ধরে

ভন ভন ভন ভন শব্দে 

বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছো ভায়া।

দিনের বেলা সমস্যা না হলে'ও,

রাত বিরেতে খাওয়ার পালা শেষ করে

শুতে গেলে

অন্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ রাত্তিরে

ঐ একটানা একঘেয়ে ভন ভন শব্দটা

তোমার বিরক্তিকর লাগে না?


হাতের কাছেই পাটকেল আছে, 

পাঁচটি মধ্যবিত্ত কলমপেষা আঙ্গুলে 

জীবনে প্রথমবার

কোনো কিছুকে শক্ত করে চেপে ধরো,

এক চোখ বন্ধ করে নিশানায় টিপ করে নাও, 

অর্জুনের সেই পাখির চোখের মত।

তারপর বেশী না ভেবে, 

ইচ্ছেটা কেটে পড়বার আগেই

ধাঁই করে ঢিলখানা ছুঁড়ে মারো 

চাকের গায়ে, 

যেখানে হাজার হাজার মৌমাছি, 

না কি ভীমরুল, না কি বোলতা, 

ভন ভন শব্দে যে যার নিজের বাচালতাটুকু, 

নিজের অন্ধ বিশ্বাসটুকু ক্রমাগত জাহির করে চলেছে, 

বিবাদ বিতর্কের তোয়াক্কা না করে। 


মতামতের চাকে ঢিল মারো, 

ইচ্ছে করেই। 

শত সহস্র হুলের খোঁচা সহ্য করো, 

সহ্য করো নির্বোধ গালিগালাজের বিষের জ্বালা,

সহ্য করো ধর্মের দংশন, 

সহ্য করো ভদ্রলোকের ক্লীব তিরষ্কার,

সহ্য করো শ্রেণীহিংসার যাতনা, 

সহ্য করো, সহ্য করো ভাই,

দাঁতে দাঁত চিপে, জিভ কামড়ে 

সব সহ্য করেই

মতামতের চাকে ঢিল মারো, 

দেখোই না,

মধু মেলে কি না মেলে।

Thursday, June 1, 2023

চাহনি | পর্ব ৫ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

‘সাদা নেগেটিভ’

যখন একটা কিছু বলার আগেই, শুরু হয়ে যায় গড়াগড়ি পেড়ে হাসি, তখনই বোঝা যায় যে আলোচনার বিষয়টা কী। গল্পের আভাসে জনা দুই হাসে, আর বাকিরা অবাক হয়ে দেখে। গল্পটা আর বলাই হয় না। বাড়ি, বা ইস্কুল বন্ধু, বা পাড়ার বন্ধুদের আড্ডা মানেই তাই। একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বড় হওয়া মানেই, সময়ের সিন্দুকে জমে থাকা হাসির রসদ। আমাদের দু-বোনের চাল চলনে মিলের থেকে অমিলটাই বেশি। কিন্তু এই এক ব্যাপারে দুজনেই সেই “ঘাড় কেন কাত?/ আরে, আমরা যে এক জাত!” এখানেই অব্যর্থ দুজনের সেই দুষ্টুমি ভরা চাহনি, যা আজ এই বাষট্টি এবং পঁয়ষট্টি পার করেও একেবারে এক এবং অবিকল। 

এ বয়সে তো বেশিরভাগ জমায়েত মানেই শ্রাদ্ধ বা স্মরণ সভা; আর না হয়তো  বা দিন পনের, কী মাস খানেক কাটিয়ে ছেলে মেয়েরা বিদেশে ফিরে যাবার আগে, একবার গণ দেখা করে নেওয়া। ফলে মন খারাপের ভাগটাই উপচে থাকে। সেখানেও দেখলাম প্রৌঢ়ত্ব পার করে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেও দু-বোনের সেই ফক্কড়িও হেসে কুটিপাটি হওয়ায় কোনও ব্যতিক্রম হল না। কেউ হয়তো গমগমে গলায় গান ধরে, গেয়েই চলেছে; থামার নামটি নেই, বোন ওমনি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে, টুক করে ভ্রূ নাচিয়ে দেবে, আর আমিও কুল কুল করে হাসতে শুরু করব। এই যে মস্করা চাহনি এর যেন শেষ নেই। সেটা যে কোন চরমে যেতে পারে তা সেদিন বুঝলাম। মাস দুয়েক আগে আমার একটা সার্জারি হয়েছে, আর বোন ছাড়া পেয়েছে সদ্য। আমার হাঁটু এবং ওর পেট সব নড়ে চড়ে গেছে; কাছের মানুষদের আতুপুতু এবং তয় তপ্পনের শেষ নেই। তার মধ্যে শুরু হল চমকদার ঈশারা এবং গড়াগড়ি পেড়ে হাসি। ভারি বয়স, ভারি শরীর সঙ্গে নানা রকমের মনভার; কোথায় কী! হেসেই চলেছি। আমাদের ছেলে মেয়েদুটোরও এ সব প্রসঙ্গ শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ; ওদের তেমন হাসিও তাই পায় না। কিন্তু আমরা দুর্নিবার গতিতে এমন হাসছি, যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েই চলেছে। 

আর এও তো আশ্চর্য যে, সেই এক ঘনত্বের হাসি এবং একইরকম ইশারা। সেদিন খুবই গুরুগম্ভীর এক স্মরণ সভায় দুজনে গিয়েছি। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। সকলেরই মন ভার এবং বিশিষ্ট সঙ্গে সকলেই মার্জিত আচরণে বদ্ধপরিকর। তো একজন দেরিতে ঢোকায়, দরজা খুলতেই তাঁকে দেখা গেল, পূর্ণ আলোয়। আপাদমস্তক সাদা পোশাক এবং কলপহীন সাদায় মুখ মুন্ডল ঘেরায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, পরচুল মাথায় বিশেষ কোনও নাটকের চরিত্র যেন। ছায়াছন্ন অন্ধকারেও, পাশে বসে থাকা বোনের ঈশারাটি যেন কান দিয়েই দেখতে পালাম। দেখতে পেলাম, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তার হাসি চাপার চেষ্টা। সেই সংক্রমণে আমিও তখন ফুলে, ফেঁপে, দুলে একশা। ওই মানুষটিকে দেখে যত না হাসি পেয়েছিল, তার থেকে ঢের গুণ হাসি এল বোনের চোখ আর ভ্রূর ইশারায়; পাশাপাশি বসায়; কনুইয়ের গুঁতোগুঁতিতে। আমার কপট শাসন ওকে যেন আরও হাসাচ্ছে। এই যে দুজনের চাহনির ক্রশ কানেকশন– আসলে আমার কপট  শাসন যেন ওর অন্তহীন মস্করার প্রশ্রয়, এর কোনও ব্যখ্যা আছে! গপ্পোও কিছু নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে দেখা মানুষটা আজ যখন হাসি উস্কে দিলেন, তখন  তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা তাতে হাসি, তাঁকে আগেও যতবার দেখেছি তাতে হাসি; তাঁর এতদিনকার চলন, বলন, সাজ, গড়ন সব মুছে গিয়ে, ততক্ষনাৎ ফিস্ফিসিয়ে তাঁর  নতুন নামকরণ  হল– ‘এতো পুরো উল্টো নেগেটিভ রে– কালোর বদলে সবটাই সাদা’।

বুড়ো বয়সে অনেক কিছুর মতোই আর যা যা চেপে রাখা যায় না– তা হল চাহনি এবং কুলকুল করে বন্যার মতো হাসি।




আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৪ | মন্দার মুখোপাধ্যায়