Saturday, August 15, 2020

ব্রিজের কাছে একজন বয়স্ক :: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

অনুবাদ: মাহমুদ মিটুল

ময়লা কাপড় এবং চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা পড়া এক বৃদ্ধ রাস্তার পাশে বসে ছিল। সেখানে নদীর ওপর একটা দোলনা ব্রিজ এবং মালগাড়ি, ট্রাক ও মহিলা-শিশু-পুরুষ সেই ব্রিজ দিয়ে পার হচ্ছিল। খাঁচা আকৃতির একটা মালগাড়ি ব্রিজের খাঁড়া ঢালে আটকে আছে এবং সৈনিকরা সেই মালগাড়ির চাকা ঠেলে ব্রিজে তোলার চেষ্টা করছে। ট্রাকগুলো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষকরা গোড়ালি পর্যান্ত কাদা ঠেলে এগোচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধ না নড়ে সেখানেই বসে। সে এতটাই ক্লান্ত যে এক পা-ও এগোতে পারছিল না।

আমার দায়িত্ব ছিল ব্রিজ পার হয়ে পরের প্রান্তে গিয়ে লক্ষ্য রাখা যে শত্রুরা কতদূর এগিয়েছে। আমি কাজটি করে ব্রিজ ধরে ফিরছিলাম। এখন আর খুব বেশি মালগাড়ি অবশিষ্ট নেই এবং পায়ে হাঁটা লোকের সংখ্যাও খুব কম। বৃদ্ধটি তখনও সেখানে বসে ছিল।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কোত্থেকে এসেছেন?

সে হেসে জানালো, 'স্যান কার্লোস।'

সেটাই তার বাড়ি এবং নিজের বাসস্থানের কথা বলে আনন্দবোধ করেই সে হেসেছিল।

সে আরও জানাল, 'আমি পশু-পাখি দেখাশোনা করতাম।'

পুরোপুরি না বুঝেই আমি বললাম, 'আচ্ছা।'

সে আবার বলল, 'হ্যাঁ, আপনি জানেন, আমি সেখানে থাকতাম এবং পশুপাখির দেখাশোনা করতাম। আমিই স্যান কার্লোস ছেড়ে আসা শেষ মানুষ।'

তাকে দেখে পশুপালক বা দলনেতা গোছের কিছু মনে হল না। আমি তার ময়লা কাপড়, তার ধূসর মুখ এবং স্টিলের ফ্রেমের চশমার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে জানতে চাইলাম, 'সেগুলো কী ধরনের প্রাণী ছিল?'

সে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, 'বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। আমাকে সেগুলো ছেড়ে আসতে হয়েছে।'

আমি ব্রিজের দিকে লক্ষ্য রেখে আফ্রিকান দেশের মতো দেখতে ইব্রো ডেল্টা দেশটা দেখছিলাম এবং ভাবছিলাম শত্রুদের নাগাল পেতে আরও কতক্ষণ লাগতে পারে। একই সঙ্গে সব আওয়াজ শুনছিলাম যদি কোনও অদ্ভুত শব্দ পাই! বৃদ্ধ তখনও সেখানে বসে ছিল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'সেগুলো কী ধরনের প্রাণী?'

সে বোঝাল, 'সেখানে এক সঙ্গে তিন ধরনের প্রাণী ছিল। দুটো ছাগল, একটা বেড়াল এবং চারজোড়া পায়রা।'

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আর আপনাকে সেগুলো ছেড়ে আসতে হয়েছে?'

'হ্যাঁ, আর্টিলারির কারণে। ক্যাপটেন এসে আমাকে বলল, এখান থেকে চলে যাও।'

ব্রিজটির শেষ মাথায়, যেখানে অবশিষ্ট কয়েকটি মালগাড়ি তাড়াহুড়ো করে পার হবার চেষ্টা করছে, দেখতে দেখতে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, 'আর আপনার পরিবার?'

সে জানাল, 'না, কেবল ওই প্রাণীদের সঙ্গে আমি থাকতাম। বেড়ালটা নিশ্চয়ই এখনও ভালো আছে। একটা বেড়াল নিজেকে নিজেই টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না যে বাকিদের অবস্থা কী হয়েছে।'

আমি জানতে চাইলাম, 'আপনি কি রাজনীতি করেন? কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক?'

সে বলল, 'আমি রাজনীতি করি না। আমার বয়স ছিয়াত্তর বছর। আমি বারো কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে আমি আর সামনে এগোতে পারব না।'

আমি জানালাম, 'থামার জন্য এটা মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। আপনি পারলে রাস্তায় গিয়ে একটা গাড়িতে উঠে পড়ুন, যা আপনাকে টরটোসায় পৌঁছে দেবে।'

সে বললো, 'আমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর যাব। ট্রাকগুলো কোথায় যাচ্ছে?”

আমি তাকে জানালাম, 'বার্সেলোনা।'

সে বলল, 'সেখানে আমার কোনও পরিচিত লোক নেই। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।'

সে ক্লান্ত-শূন্য দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল, এরপর এমনভাবে কথা বলল যেন তার দুঃখের কথা কাউকে জানাচ্ছে, 'আমি নিশ্চিত যে বেড়ালটা ঠিকঠাক আছে। বেড়ালের ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু অন্যগুলো। এখন অন্যপ্রাণিগুলোর ব্যাপারে আপনি কী মনে করছেন?'

'কেন? সেগুলোও যে যার মতো বের হয়ে গেছে এবং ঠিক আছে।'

'আপনি তাই মনে করছেন?'

নদীর ওপারে দূরে যেখানে আর কোনও মালগাড়ি নেই সেদিকে দেখতে দেখতে বললাম, 'কেন নয়?'

'কিন্তু আর্টিলারির মধ্যে তারা কিভাবে আছে যেখানে ওই আর্টিলারির কারণে আমাকেই চলে যেতে বলা হল?'

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কি কবুতরের খাঁচা খোলা রেখে এসেছেন?'

'হ্যাঁ।'

'তাহলে সেগুলো উড়ে গেছে।'

'হ্যাঁ, তারা অবশ্যই উড়ে যেতে পারে। কিন্তু বাকিগুলো। বাকিদের কথা আর চিন্তা না করাই ভালো।' সে বলল।

আমি তাকে তাগাদা দিলাম, 'আপনি যদি বিশ্রামে ক্ষান্ত দেন তাহলে আমি যাব। এখন উঠে একটু হাঁটেন।'

সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। টলতে টলতে আবার কাদার মধ্যেই বসে পড়ল।

সে আমাকে লক্ষ্য না করে নিজে নিজেই কাতর ভাবে বলতে লাগল, 'আমি পশুপাখি দেখাশোনা করতাম। আমি কেবল পশুপাখি দেখাশোনাই করতাম।'

তার জন্য আর কিছুই করার ছিল না। এটা ছিল ইস্টার সানডে এবং ফ্যাসিস্টরা ইব্রোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সেদিন খুব নিচু ধূসর মেঘ ছিল বলে তাদের যুদ্ধবিমানগুলো উড়তে পারেনি। এটাই হল বিষয় যে বেড়ালগুলো নিজেদেরকে নিজেরাই দেখভাল করতে জানে যা সব সময় বৃদ্ধের নিয়তি জুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ছিল।

---------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি: আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) একজন আমেরিকান উপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও সাংবাদিক। তাঁর আইচবার্গ থিওরি বিংশ শতাব্দির ফিকশন রচনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে তাঁর চমকপ্রদ জীবনযাপন তৎকালীন তরুণদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাতটি উপন্যাস, ছ'টি গল্পগ্রন্থ ও দু'টি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত বেশিরভাগ ফিকশনই আমেরিকায় ক্লাসিক হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫৩ সালে হেমিংওয়ে ফিকশনের জন্য পুলিৎজার ও ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ পান।

---------------------------------------------------------------

অনুবাদকের পরিচয়: মাহমুদ মিটুলের জন্ম ১৪ নভেম্বর ১৯৮৬। বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানসহ মাস্টার্স। কবি, অনুবাদক, সম্পাদক ও শিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ- মুমূর্ষা ও গোঙানি, বিস্ময় মুছে দিও না, অনুবাদ-‌ বব ডিলান: গোল্ডেন কর্ডস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্পাদনা- বিজন অশ্রুবিন্দু। ইমেল: mahmud_mitul@yahoo.com

No comments:

Post a Comment