Wednesday, November 11, 2020

পাপ ও শাস্তি: পুনরাবলোকন


সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: 
দূরে কাছে, কেবলই ঘর ভাঙে। ঈশ্বরের বিকল্প হয়ে মানুষ পাপ করে আর সেই রক্তধারা বয়ে গেলে সময় সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করেছি: 'নদী, নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছো কি, মানুষের হৃদয়ের থেকে?’ আমি একটি উপন্যাস নিয়ে ভাবছিলাম। অনেকদিন পর সে লেখাটিকে আবার পড়া হল ব্যোমকেশ আর ফেলুদার কোলাহল ও কিচিরমিচিরের মাঝে। কি আশ্চর্য! আজ থেকে দেড়শ বছরেরও আগে প্রকাশিত হয় দস্তয়েভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট। ১৮৬৬ সাল জুড়ে বারো কিস্তিতে লেখাটি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। যে রুশ ছাত্রটি নেপোলিয়নের তরুণ দূত হিসেবে নিজেকে ভেবে একটি খুন করে, সে স্বছন্দে একটি গোয়েন্দা গল্পের জন্ম দিতে পারত। খুনের কাহিনী এত চমৎকার যে চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। কোনও সাক্ষ্য প্রমাণও ছিল না। তবু তরুণ রাসকলনিকভ কোনও সত্যান্বেষীর দ্বারা চিহ্নিত হয়নি বরং বিবেকের বোঝা বয়ে নিজেই সত্যান্বেষণ করে গেছে।

কি রুক্ষ, বন্ধুর, আর করুণ রঙিন পথে যে দস্তয়েভস্কি হেঁটেছিলেন! দ্যূতক্রীড়ায় সর্বস্ব হারিয়ে কুরু রাজসভায় যেমন যুধিষ্ঠির শেষ পর্যন্ত সত্যকেই পণ করেছিলেন, জুয়ার টেবিলে সর্বহারা দস্তয়েভস্কিরও কোনও বিকল্প ছিল না সত্যকে খুঁজে না পাওয়ার। এই উপন্যাস কোনও আখ্যান নয়, মানুষের পাপ-পুণ্য, চরম তীর্থযাত্রার একটি নিশ্চিত দলিল। শুধু গল্প লেখাই যদি দস্তয়েভস্কির উদ্দেশ্য হত তাহলে রচিত হতে পারত এক মনোরম চিত্রনাট্য। যেখানে মতাদর্শের নেশায় এক উন্মাদ যুবক পাপবিদ্ধ একটি কিশোরীকে অবলম্বন করে দুনিয়ার পাঠশালায় পড়তে যেতে চায়। এই চিত্রনাট্য সত্যি অনুনকরনীয়। কাহিনীতে বুদ্ধিজীবী মাতাল, স্নেহাতুর পিতা, নিরাসক্ত পুলিশ অফিসার ও দলিত কুসুমের মতো নারীকে দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক কোনও সিনেমার পক্ষে চূড়ান্ত আকর্ষণীয় এক চিত্রনাট্য। তবু যখন ত্রুফো হলিউডের সম্রাট হিচকককে ক্রাইম সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করেন তখন হিচকক সবিনয়ে মেনে নেন তাঁর অসামর্থ্যের কথা। কেননা হিচকক বুঝেছিলেন যে, এই গল্প আসলে সংস্কৃতির ধর্মশাস্ত্র। রাসকলনিকভকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বাইরে থেকে আইনের কোনও প্রতিমূর্তি যেমন ডিটেকটিভ নিয়োগ করতে যায় না। রাসকলনিকভের সমস্যা মূলত নৈতিকতার, সে বিবেককে নির্বাসনে পাঠিয়েছে তা-ই সে একা, পরিত্যক্ত, যন্ত্রণাবিধুর। তাঁর শাস্তি যতটা অন্তরের ততটা আদালত ঘোষিত নয়। লোভ ও ক্ষমতা নিজেই নিজেকে যুগপৎ শিকার ও শিকারি ভাবতে পারে।

দার্শনিক এই মলাটটুকু বাদ দিলে অনেক সময়ই মনে হয় কাহিনীর ছিলা টান টান বুননই তো যথেষ্ট। উপসংহারের কোনও প্রয়োজনই নেই। অথচ আজ কখনও ধর্ম কখনও রাজনীতি বা অন্য কোনও যৌথ মতাদর্শের সামনে ভীত আতঙ্কিত মানুষকে দেখলে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সে ক্রমাগত বন্দি হয়ে প্রাণহীন সত্তায় পর্যবসিত হয়েছে। মৃত্যুলোক থেকে তাঁর প্রত্যাবর্তিত হওয়া জরুরি।

কি বিধুর সেই অপরাহ্ণ যখন সনিয়া একটি সামান্য দেহ পসারিণী ও রাসকলনিকভ, একজন খুনি, বাইবেল থেকে নবকেস্টামেন্ট থেকে লাজারাসের গল্প পড়ে। যেন প্রতীচ্যের নচিকেতা যমলোক থেকে পুনরায় ইহজগতে নিষ্কলুষ ফিরে আসবে। ওই কিশোরীর শীর্ণ হাতে নিজের রক্তাক্ত হাত রেখে রাসকলনিকভ ভেবেছিল—’ যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম তব অকৃপণ করে!’ নাহলে আর সে সনিয়ার মতো তুচ্ছ পতিতার পায়ের তলায় আছড়ে পড়ে বলবে কেন I prostrate myself not beofre you, but before all suffering humanity. রাসকলনিকভ তরুণ ছাত্র– সে নেপোলিয়ান হতে চেয়েছিল। তাঁর ধারণা ছিল সম্রাটের কোনও বাধন থাকে না, ক্ষমতা যে কোনও গণহত্যাকেও অনুমোদন দেয়। আর সে তো পাপিষ্ঠা এক সুদখোর মহিলাকে খুন করতে চাইছে সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য। আর এই রাস্কলনিকভকে কত দেখা যায় সন্ত্রাসবাদে, জেহাদ, যুদ্ধে, আমরা ছোটবেলার ছাত্র আন্দোলনে এই খতমের রাজনীতি যে কতবার দেখলাম!

তবে কি দস্তয়েভস্কি বলতে চাইছিলেন আমরা অন্তিম মূল্য পেতে চাই প্রেমে? জানি না। কিন্তু ভাগ্যিস অপরাধ ও শাস্তির মতো মহাগ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তাই দেড়শ বছর বাদেও দেখি হৃদয় অব্দি যায়নি ছুরি, থমকে আছে। সত্যের জ্যোৎস্না পাপের ডালপালার ফোকর দিয়ে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে এঁকে দিয়েছে পুণ্যের কারুকাজ। অপরাধ ও শাস্তি আবার পড়ে মনে হল মাটির ধুলোবালি অশ্রু আর রক্ত ব্যবহার করে দস্তয়ভস্কি আমাদের বেঁচে থাকার গোঁড়ায় জল ছিটিয়ে দিয়েছেন।

---------------------------------------------------------

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর কয়েকটি বইয়ের নাম: স্থানাঙ্ক নির্ণয়, অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন, নাশকতার দেবদূত, হে চলমান চিত্রমালা, অন্যান্য ও ঋত্বিকতন্ত্র, পাতালের চিরকুট, বুনো স্ট্রবেরি, ইবলিশের আত্মদর্শন সম্পর্কিত, অনভিজাতদের জন্য অপেরা, দিনযাপনের উপাখ্যান। সম্পাদনা করেছেন কবি অনন্য রায়ের কবিতা সমগ্র। তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: মাস্কুলা ফেমিনা, অরফি (জঁ ককতো), সাইলেন্স (ইঙ্গমার বার্গম্যান), পিয়েরো ল্যো ফু (জঁ লুক গোদার)। আজ ফিওদোর দস্তয়েভস্কির জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখাটি প্রকাশ করা হল।

No comments:

Post a Comment