Saturday, November 25, 2023

চাহনি | পর্ব ১০ | দৃষ্টি বিনিময় | মন্দার মুখোপাধ্যায়

তিনতলায় বাবার স্টুডিও ঘর। বিশাল ঘরের উত্তর দিকের সদর দরজাটা আজ হাট করে খোলা। দক্ষিণের বড় জানলাটার কয়েকটা শিকও খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে জ্যেঠামণির দিক থেকেও সহজে ঢুকে আসা যায়। খোলা রয়েছে ঘর থেকে বার হয়ে পুবের বারান্দায় যাবার বাহারি কাচের দু’টো দরজা এবং তার মাঝখানের জানলাটাও। খোলা ওই ঘরের পশ্চিম দেওয়ালের গঙ্গা আঁকা খান ছয়েক জানলাও। চারিদিকে আত্মীয় স্বজনের নীরব কান্না। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে বাবা চলে যাচ্ছেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে। ডাক্তার কিষাণ কাকা ইনজেকশন দিতে এসে, কোনও হাতেই ভেইন পাচ্ছেন না। বিকেল তিনটে। ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে সূর্যাস্তের মরা আলো আর জোয়ার-বহা গঙ্গার বাতাস। কার্তিকের শেষ। হিম আর শিশির দু’ইই পড়ছে রাতে আর দিনে। তবু শীত বস্ত্র রাখছেন না গায়ে। পরিষ্কার স্বরে বললেন, আমি আর কুড়ি মিনিট; কাটাছেঁড়া আর নাই বা করলে!

বাবার ছাপান্ন বছরের লম্বা শরীরের মাঝামাঝি বসে আছেন আমাদের মা; মাথা নিচু করে। তাঁর ওই ঊনচল্লিশ বছরেই, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘনিয়ে আসবে বৈধব্য। নতুনদিদা এসে তাঁর বাঁ হাত থেকে খুলে নেবেন এয়োতীর লোহা। একে একে আমাদের দু’বোনকে দিয়ে চামচে করে তাঁর গালে দেওয়ানো হল শেষ জলটুকু। বাবা তাকালেন না। তাঁর ঠোঁট দু’টি ভিজে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে এল অশ্রু। ঠাকুমা আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছিয়ে দিতেই, এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে; বা হয়তো চোখের দিকে। ঘর ভর্তি গুরুজনদের উপস্থিতি ভুলে, মা-ও তো  অপলক। দু’জনের গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণ পথ কেটে হেঁটে এল মৃত্যু। বিকেল ঠিক তিনটে কুড়িতেই চোখ বুজলেন বাবা। থেমে গেল দৃষ্টি বিনিময়। স্থাণুবৎ মা, স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তাঁদের যৌথ জীবনের লোপাট হয়ে যাওয়া অস্তিত্বের দিকে। 

মৃত্যুকে মাঝখানে রেখে দু’জনের এমন চাহনি বিনিময় আর কি দেখেছি!

Saturday, November 11, 2023

চাহনি | পর্ব ৯ | নাচের গুরুজি | মন্দার মুখোপাধ্যায়

খুব আনন্দ হয়েছিল, গুরু গোবিন্দন কুট্টি আমাকে যখন নাচ শেখাতে রাজি হয়েছিলেন। অল্প বয়সে, নাচের পরীক্ষক হিসেবে আমার নাচ দেখে দু’একবার উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য। সে সময় সম্ভব হয়নি; কারণ তখন আমার বেশি মন ছিল চাকরি ও সংসারের দিকে। বছর চল্লিশ পার করে হঠাৎই মনে হল। এখন একবার তাঁর কাছে গেলে কেমন হয়! কারণ আমি নাচ ছাড়লেও, নাচ তো আমাকে ছাড়েনি। ওজনই বা কত আর বেড়েছে! এখন তো দক্ষিণেই থাকি। কতটুকুই বা দূর ওই ডোভার লেন! ডায়াল করে ‘হ্যালো’ শুনেই বুঝলাম যে পুরনো নম্বরই আছে। আমার ওজন এবং নাচ দেখে সাগ্রহে রাজি হলেন। শুরু হল সপ্তাহে দু’দিন করে ঈশ্বর-দর্শন। শরীরে সে এক নতুন উৎসব। নাচের বোল, মুদ্রা আর অভিনয়ে, প্রতিটি ক্লাসেই গুরুজি যেন সুন্দরের বীজ বুনে চলেছেন। 

পঁচাত্তর পার করে তাঁর মাথার সব চুল গরদের মতই মখমল এবং গঙ্গাজল রঙের। হালকা ছিপছিপে শরীর; ট্রাউজারের ওপর ঢিলে পাঞ্জাবি এবং কাঁধে একটা লম্বা ঝোলা। তাঁর হেঁটে আসার ছন্দেও যেন কাঁসার সেই ভারি ঘুঙু্ট-জোড়ার নিক্বণ। ক্লাসে পৌঁছতে এক মিনিট দেরি হলেই রাগ; আবার দু’মিনিট আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখলেও অসন্তুষ্ট। কী জ্বালা রে বাবা! তাঁর ডোভার লেনের বাড়ি থেকে ভেতর দিয়ে হেঁটে আসেন, ডোভার রোডের বাড়িটায়। একতলাটা ভাড়া নিয়েছেন স্পেশাল ক্লাস করাবার জন্যেই। কোলাপসিবলের চাবি খুলে, বারান্দায় রাখা ফুলের টবে জল দিয়ে নিজের চেয়ারে যখন বসবেন ঠিক তখনই ঢুকতে হবে। প্রতিদিনই আমার যেন মঞ্চে প্রবেশ। ব্যাগটা মাটিতে রেখে, ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে আমি দাঁড়াব। একটা ছোট্ট লাঠি পকেট থেকে বের করে নিজের চেয়ারের পাশে রাখা টুলটায় নামিয়ে উনি বলবেন, শুরু কর। তাঁর পা ছুঁয়ে শুরু হবে আমার মারদাঙ্গা অনুশীলন।

ক্লাসটা হাসি হাসি মুখে প্রণাম দিয়ে আরম্ভ হলেও, কিছু পরেই দেখা দেবে তাঁর রুদ্রমূর্তি। নাচের  সময় গলা ও থুতুনির অবস্থানে হাফ ইঞ্চি ফারাকের হেরফের হলেই রে রে করে তাড়া। তালে ভুল হলেই লাঠিটা ছুঁড়বেন হাঁটু তাক করে। আমি যখন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যাব,  টুল থেকে উঠে এসে নিজেই আবার কুড়িয়ে নেবেন। বার বার করে শেখাবেন, দু’মাত্রা থেকে দশমাত্রার জোড়া তাল এবং তারই মাঝে মাঝে বেজোড় তালে পাঁচ এবং সাত মাত্রা। প্রথম দিকের সেই হিমসিম অবস্থাটাই কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই এক খেলা হয়ে গেল। নাচের ঠিকাদারি নিয়ে স্থপতি ডি সি পালের মতোই আমার শরীরটাও বুঝতে শিখল যে কোন জমি ঠিক কেমন বাড়ি চায়! 

তাল  কিছুটা আয়ত্তে এলে শুরু হল গানের সঙ্গে অনুশীলন। সে এক কঠিন প্যাঁচ, না জানি তামিল ভাষা, না বুঝি তার সুরের চলন। কোনও একদিন শেখাচ্ছেন দময়ন্তীর বর্ণনায় নলের বাগানের শোভা এবং তা দেখে দময়ন্তীর প্রেমিকা-ভাব। গুরুজিকেই দেখছি। এ কি শেখা যায়?  যতোই যা করি না কেন, তালের ফাঁকে ফাঁকে ধরতাইয়ের মজাগুলো কেবলই ফসকাচ্ছে। হাত-পা-চোখ-ভ্রু –- সবই বেসামাল; বকুনির ভয়ে শিউরে উঠছে। হঠাৎই একটুও না বকে, শান্ত হয়ে বললেন।

‘আমাকেই দেখ ………আআআমাকেই’ – 

সাহস করে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে কী নিবিড় দৃষ্টিতে আমার মধ্যে তিনি হাতড়ে চলেছেন নাচ এবং আগ্রহ। ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেললাম। মনে হল, উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট কত পুরুষই তো আমাকে দেখেছে! হয় আসক্তি, নয় মুগ্ধতায়। কেউ তো এমন অপার হয়ে বলেনি যে ‘আমাকেই দেখ’! এই প্রথম দেখলাম পৌরুষ নয়, শুধুমাত্র সৌন্দর্য-বোধের আধিপত্য। গুরুজি নিজে এমন রূপ, গুণ আর শক্তির আধার হয়েও তিনি আমাকে টেনে নিতে চাইছেন আমারই মর্মস্থলে! সে চাহনিতে কোনও মুগ্ধতা নেই আমার দেহসৌষ্ঠব বা রূপে। উল্টে সে সব থেকে মুক্ত করে আমাকে করে তুলতে চাইছেন এমন এক বোধ ও অনুভবের আধার যেখানে নাচও যেন আভরণের মতোই খসে যায় শরীর থেকে।

গুরুজির ওই দৃষ্টিপাতে এ জীবনে সেই একবারই ঈশ্বর-দর্শন হয়েছিল। 

বার বার মনে পড়েছিল সেই দু’কলি--

‘মেঘের মাঝে মৃদং তোমার বাজিয়ে দিলে কী ও

সেই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিও দিও’।।

Thursday, November 2, 2023

আমার মা | শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

 

মায়ের কথা বলতে গেলেই যেন আমার ভিতরে একটা বাঁধভাঙার মতো অবস্হা হয়। কত কথা যে মনে আসতে থাকে, যেন কথা আর ফুরোবেই না। মায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল মহামায়া। দাদামশাই মাকে সারদেশ্বরী আশ্রমে পাঠিয়ে দেন মানুষ হওয়ার জন্য। সারদেশ্বরী আশ্রমে স্বয়ং গৌরীমার তত্ত্বাবধানে আমার মা বড় হয়েছেন। মায়ের মাথায় একঢল মেঘের মতো ঘণ, কোঁকড়া চুল ছিল, আর তাই আশ্রমে মায়ের নামই হয়ে গিয়েছিল চুলওয়ালা মহামায়া। আশ্রমবাসের ফলে আমার মায়ের আধ্যাত্মিক ভাব ছিল গভীর, আর তেমনি দয়ামায়া। জীবনে মাকে কখনও কারও সঙ্গে গলা তুলে ঝগড়া করতে শুনিনি। রাগ হলে বকাঝকা করতেন বটে, বিশেষ করে আমাকে, তবে তাতে তেমন ঝাঁঝ থাকত না। আমার মা যেমন শান্তপ্রকৃতি ছিলেন তেমনি আমি ছিলাম বেজায় দুষ্টু আর বাঁদর। আমাকে সামলাতে মাকে হিমসিম খেতে হত। আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ এত দুষ্টু ছিল না। আর তাই আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তাও ছিল বেশি। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাড়িতে কোনও ভিখিরিকে খালিহাতে ফেরানো হয় না। যুদ্ধের সময়ে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে তখনও মা এই নিয়মের ব্যাত্যয় করেননি। মাঝেমাঝে ক্ষুধার্ত ভিখিরিকে বাইরে বসিয়ে গরম ভাত ডাল তরকারি খাওয়াতেন। বাসিপচা জিনিষ কখনও খাওয়াতেন না। অথচ আমাদের অবস্হা যে খুব সচ্ছল ছিল তা নয়। আমার সৎপ্রকৃতির বাবা রেলে চাকরি করতেন বটে, কিন্ত ঘুঁষ খেতেন না বলে আমাদের চিরকালই টানাটানির সংসার। ওই সামান্য হিসেব করা পয়সা থেকেই অল্পস্বল্প বাঁচিয়ে মা তাঁর সামান্য দানধ্যান করতেন। যখন আমার তিন কি চার বছর বয়স তখন প্রতি দুপুরে খাওয়ার পর মা আমাকে নিয়ে মাদুর পেতে মেঝেয় শুতেন আর দুষ্টু ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য রবি ঠাকুরের কবিতা শোনাতেন। সেই মোহময় কবিতা আমার ভিতরে এক সম্মোহন তৈরি করে দিত, তাই আজও আমি কবিতার পরম অনুরাগী। তখন আমার মা ছিলেন আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মা ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না। কিন্ত বাবার বদলির চাকরি, দেশভাগ ইত্যাদির ফলে আমাকে হস্টেলে চলে যেতে হয়। তাতে মায়ের ওপর টান আরও বেড়েছিল, আর মাও আমার জন্য বড্ড ব্যাকুল থাকতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে কি যে আদর হত আমার! আজ কত বছর হয়ে গেল মা নেই, তবু আজও মায়ের অভাবে যেন মাঝেমাঝে বুক টনটন করে। একটা মজার কথা বলি। হস্টেল থেকে বাড়ি গেলে আমি সারাক্ষণ মায়ের কাছেকাছে থাকতাম। মা রান্না করতেন আর আমি কাছটিতে বসে গল্প করতাম। আর এইভাবেই মায়ের তোলা উনুনে রান্না করা দেখেদেখেই আমি নিজের অজান্তে পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছি। আমার রান্না খেয়ে অনেকেই আজও প্রশংসা করে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন | অমর মিত্র

 


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পড়ছি সেই  স্কুলের শেষ আর কলেজের আরম্ভ থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুনপোকা ঠিক কবে বেরিয়েছিল এখন মনে নেই, তবে ঘুনপোকার আগে পড়েছি উজান, এরপর আরো পরে পারাপার, মানব জমিন, যাও পাখি ইত্যাদি। মাঝে ঘুনপোকা। তারপর তো পড়েই চলেছি। ছোটদের বড়দের নানা গল্প উপন্যাস। বড় হয়েও তাঁর ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস না পড়া মানে শৈশবকে ভুলে মারা। গন্ধটা খুব সন্দেহ জনক, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাইবাগানের ভূত…, তিনি এখনো আমাকে আমার শৈশব ফিরিয়ে দেন। কত যে পড়েছি সব আনন্দমেলায়। সঙ্গে সেই সব গল্প যা আমাকে  এখনো ঘুরে ঘুরে পড়ার কথা ভাবায়,  সেই গঞ্জের মানুষ, ট্যাঙ্কি সাফ থেকে উত্তরের ব্যালকনি, প্রতীক্ষার ঘর..., কত গল্প।  তিনি তাঁর গল্প নিয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর প্রবেশ করেন। তিনি আমাদের জীবনের নানা বিহ্বলতার কথা মনে করান। শীর্ষেন্দু অতি সূক্ষ্মতায় জীবনকে দেখতে পারেন। জীবন এখানে নির্ভার মগ্নতার,  জীবন এখানে  অজ্ঞাত এক আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি  দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস তাঁর গল্পের দুঃখী মানুষের ভিতর সঞ্চারিত হয়।  উত্তরের ব্যালকনিতে বা গঞ্জের মানুষ কেন তাঁর অনেক গল্পেই আমি তা দেখেছি। দেখেছি উপন্যাসে। উজান- উপন্যাসে এ এক ভিখিরির সামান্য খুদকুড়ো ছড়িয়ে দিল বালক, তার কী অসম্ভব গর্জন। বালক মাটিতে ছড়ান খুদ খুঁটে খুঁটে তুলে দিতে থাকে ভিখিরির বাটিতে।  শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে অনুভব করতে হয়। অনুভব করতে চেয়েছি। তিনি অনুভব করাতে পারেন। তাঁর গল্প আমার ভিতরে অপরাহ্ণের আলো আর বিমর্ষতা নিয়ে আসে। উত্তরের ব্যালকনি এক প্রেমের গল্প। দুঃখীর গল্প। ব্যালকনিটি উত্তরে। সংসারটি তুষার আর কল্যানীর। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে লোকটিকে দেখা যায়। সে বসে থাকে বকুল গাছটির নিচে। এবার গাছে ফুল এসেছে খুব। তলাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সেইখানে নিবিড় ধুলোমাখা ফুলের মাঝখানে লোকটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। ঘন নীল জামা, খাকি ফুল প্যান্ট, লজ্জাস্থানগুলিতে ছেঁড়া তা। মাথার চুলে জটা, গালে অনেক দাড়ি, গায়ে চিট ময়লা, কনুইয়ে ঘা। সে অরুণ। সে পাগল।  ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তুষার লোকটাকে দ্যাখে। এখনো চেনা যায় অরুণকে। না আগের চেহারাটা তেমন মনে পড়ে না। এখনকার অরুণকে সে চিনতে পারে। কেন না সে পাঁচ বছর সে ওই গাছতলায় বসে আছে। অফিসে বেরোনর আগে পানের পিক ফেলতে ব্যালকনিতে এসে তুষার দ্যাখে ওকে। পাগলও একবার মুখ তুলে তাকায় যেন। আগে ওই চোখে ঘৃণা, আক্রোশ, প্রতিশোধের ছায়া দেখত তুষার। এখন কিছুই না। তুষার টের পায় কেবল অবিন্যস্ত চিন্তারাশি বয়ে যায় ওর মাথার ভিতর দিয়ে।  শুধুই শূন্যতা। আর কল্যানী? তুষার চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তুষারের ভেজা ধুতি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে মেলে দিতে দিতে দ্যাখে আকীর্ণ ধুলো মাখা ফুলের ভিতর বসে আছে অরুণ। পাগল। তার একদা প্রেমিক। অরুণ তাকিয়ে আছে। কল্যানী স্পষ্ট দেখতে পায় ফাঁক হয়ে থাকা মুখের ভিতর নোংরা হলুদ দাঁত, পুরু ছ্যাতলা পড়েছে। ওই ঠোঁট জোড়া ছ-সাত বছর আগে  জোর করে কল্যানীকে চুমু খেয়েছিল একবার। ভাবলে এখন ঘেন্না করে। কল্যানী প্রতিদিন শেষবেলায় ঠিকে কাজের লোককে দিয়ে ভাত পাঠায় ওকে। অরুণকে সে কখনো ভালবাসে নি,সে ভালবেসেছিল তুষারকে। কিন্তু পাগল হয়ে অরুণ যখন ওই গাছতলায় আশ্রয় নিল, ঘরের মধ্যে তারা দুজন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। যদি পাগল ঘরে এসে ওঠে ? কী মায়াময় ভালবাসার গল্প এই উত্তরের ব্যালকনি। একতরফা ভালবাসায় ব্যর্থ অরুণের ছিল পৃথিবী হারানোর দুঃখ। সেই দুঃখ তার দুবর্ল  মাথা সহ্য করতে পারে নি। তাই এসে বসেছিল কল্যানীদের সংসারের দোরগোড়ায়। আগে সে চিৎকার করত, অব্যক্ত আর্তনাদ করত, এখন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তুষার সমস্তদিন ধরে কাজের চাপে বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। অরুণের প্রতি তার মায়া আছে। আবার সংসার করতে করতে ক্লান্ত তুষার অন্য নারীর কাছে গিয়েও ভালবাসাহীন হয়েই ফেরে। এই গল্প জটিল নাগরিক জীবনের। এই গল্প হৃদয়ের অতি অন্তঃস্থলের। কল্যানীর ভয় আছে, তুষারের নেই। কল্যানী চলে যেতে চেয়েছিল এই জায়গা থেকে। তুষার বলেছিল, গিয়ে লাভ নেই, ও খুঁজে খুঁজে ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। তুষারের খুব মায়া। ভাত দেওয়ার ব্যবস্থা তার। এই গল্পে অনেক মাত্রা। মদ খেয়ে ফেরে তুষার। তার গায়ে মেয়েমানুষের গন্ধ, শার্টে তার লিপস্টিকের দাগ। কল্যানী কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ফুরোয়। বাইরে বকু্লগাছের তলায় পাগল অনেক অনেক ফুল নখে ছিঁড়ে স্তুপ করেছে। উগ্র চোখে সে ব্যালকনির দিকে তাকায়। ক্ষুধার্ত হয়েছে সে। তুষার নিজে গিয়ে তাকে ভাত খাইয়ে আসে। ডাল তরকারীতে মাখা কাগজ ছিঁড়ে গেছে। পথের ধুলোয় পড়েছে ভাত। পাগল তাই খুঁটে খাচ্ছে। ক্লান্ত তুষারের বুকের ভিতরে বহু উঁচু থেকে ক্রেন-হ্যামার যেন ধম করে নেমে আসে। এই দৃশ্য সে দেখেছিল একদিন অফিস ফেরতা। সে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে আছে। এই জীবন থেকে বেরোতে হবে। মুক্তি, মুক্তি চাই যেন তার। পাহাড়ে কিংবা সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে হয় এই শহর ছেড়ে। একদিন রাতে ভাত দিতে গিয়ে সে অরুণকে জিজ্ঞেস করে, কল্যানীকে তার দেখতে ইচ্ছে করে কি? জবাব দেয় না পাগল। একদিন তুষার  হাত ধরে অরুণকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। কী অসামান্য সেই নিয়ে আসা। কল্যানী ভয় পায়। আর্তনাদ করে ওঠে। তুষার তাকে অভয় দেয়। পাগলের হাত ধরে সমস্ত ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখায়। নিজের সমস্ত সুখের চিহ্ন দেখায়। পাগল দেখেই যায়। তারপর ডাইনিং টেবিলে বসে পেট ভরে খায়। তাকে থাকতে বলে। কিন্তু সে কিছুই না বলে নিজে নিজে নেমে চলে যায় বকুল বিছানো ধুলোয়। কল্যানী দেখেছে পাগলকে। তার চোখে শুধুই বিস্মৃতি। ভালবাসায় পাগল হওয়া অরুণের হৃদয় জুড়িয়ে গেছে বকুলতলায় বকুলছায়ায় বসে। সে কল্যানীকে চেনে না আর, ভাতের জন্য বসে থাকে। তুষারের এত ক্লান্তি কাজে, কল্যানীর এত প্রত্যাখ্যান নিয়ে বাঁচা, এর ভিতরে যেন আবছায়া এক নদীর পাড়ে বসে আছে পাগল। আধা আলো আধা অন্ধকার, স্মৃতিময় স্রোত বয়ে যায় অবিরল। পাগলের কোনো ক্লান্তি নেই। সে বসে থাকে। পাঠক এই গল্প আর শোনাতে পারছি না আমি। বিকেলের নিভে আসা আলোয় পাগলকে দেখছি বকুল ঝরানো ছায়ায়। নদীর পাড়ে। সব কিছু থেকে মুক্তি পেয়েছে এই দুঃখী। নতজানু হই লেখকের কাছে।