খুব আনন্দ হয়েছিল, গুরু গোবিন্দন কুট্টি আমাকে যখন নাচ শেখাতে রাজি হয়েছিলেন। অল্প বয়সে, নাচের পরীক্ষক হিসেবে আমার নাচ দেখে দু’একবার উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য। সে সময় সম্ভব হয়নি; কারণ তখন আমার বেশি মন ছিল চাকরি ও সংসারের দিকে। বছর চল্লিশ পার করে হঠাৎই মনে হল। এখন একবার তাঁর কাছে গেলে কেমন হয়! কারণ আমি নাচ ছাড়লেও, নাচ তো আমাকে ছাড়েনি। ওজনই বা কত আর বেড়েছে! এখন তো দক্ষিণেই থাকি। কতটুকুই বা দূর ওই ডোভার লেন! ডায়াল করে ‘হ্যালো’ শুনেই বুঝলাম যে পুরনো নম্বরই আছে। আমার ওজন এবং নাচ দেখে সাগ্রহে রাজি হলেন। শুরু হল সপ্তাহে দু’দিন করে ঈশ্বর-দর্শন। শরীরে সে এক নতুন উৎসব। নাচের বোল, মুদ্রা আর অভিনয়ে, প্রতিটি ক্লাসেই গুরুজি যেন সুন্দরের বীজ বুনে চলেছেন।
পঁচাত্তর পার করে তাঁর মাথার সব চুল গরদের মতই মখমল এবং গঙ্গাজল রঙের। হালকা ছিপছিপে শরীর; ট্রাউজারের ওপর ঢিলে পাঞ্জাবি এবং কাঁধে একটা লম্বা ঝোলা। তাঁর হেঁটে আসার ছন্দেও যেন কাঁসার সেই ভারি ঘুঙু্ট-জোড়ার নিক্বণ। ক্লাসে পৌঁছতে এক মিনিট দেরি হলেই রাগ; আবার দু’মিনিট আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখলেও অসন্তুষ্ট। কী জ্বালা রে বাবা! তাঁর ডোভার লেনের বাড়ি থেকে ভেতর দিয়ে হেঁটে আসেন, ডোভার রোডের বাড়িটায়। একতলাটা ভাড়া নিয়েছেন স্পেশাল ক্লাস করাবার জন্যেই। কোলাপসিবলের চাবি খুলে, বারান্দায় রাখা ফুলের টবে জল দিয়ে নিজের চেয়ারে যখন বসবেন ঠিক তখনই ঢুকতে হবে। প্রতিদিনই আমার যেন মঞ্চে প্রবেশ। ব্যাগটা মাটিতে রেখে, ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে আমি দাঁড়াব। একটা ছোট্ট লাঠি পকেট থেকে বের করে নিজের চেয়ারের পাশে রাখা টুলটায় নামিয়ে উনি বলবেন, শুরু কর। তাঁর পা ছুঁয়ে শুরু হবে আমার মারদাঙ্গা অনুশীলন।
ক্লাসটা হাসি হাসি মুখে প্রণাম দিয়ে আরম্ভ হলেও, কিছু পরেই দেখা দেবে তাঁর রুদ্রমূর্তি। নাচের সময় গলা ও থুতুনির অবস্থানে হাফ ইঞ্চি ফারাকের হেরফের হলেই রে রে করে তাড়া। তালে ভুল হলেই লাঠিটা ছুঁড়বেন হাঁটু তাক করে। আমি যখন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যাব, টুল থেকে উঠে এসে নিজেই আবার কুড়িয়ে নেবেন। বার বার করে শেখাবেন, দু’মাত্রা থেকে দশমাত্রার জোড়া তাল এবং তারই মাঝে মাঝে বেজোড় তালে পাঁচ এবং সাত মাত্রা। প্রথম দিকের সেই হিমসিম অবস্থাটাই কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই এক খেলা হয়ে গেল। নাচের ঠিকাদারি নিয়ে স্থপতি ডি সি পালের মতোই আমার শরীরটাও বুঝতে শিখল যে কোন জমি ঠিক কেমন বাড়ি চায়!
তাল কিছুটা আয়ত্তে এলে শুরু হল গানের সঙ্গে অনুশীলন। সে এক কঠিন প্যাঁচ, না জানি তামিল ভাষা, না বুঝি তার সুরের চলন। কোনও একদিন শেখাচ্ছেন দময়ন্তীর বর্ণনায় নলের বাগানের শোভা এবং তা দেখে দময়ন্তীর প্রেমিকা-ভাব। গুরুজিকেই দেখছি। এ কি শেখা যায়? যতোই যা করি না কেন, তালের ফাঁকে ফাঁকে ধরতাইয়ের মজাগুলো কেবলই ফসকাচ্ছে। হাত-পা-চোখ-ভ্রু –- সবই বেসামাল; বকুনির ভয়ে শিউরে উঠছে। হঠাৎই একটুও না বকে, শান্ত হয়ে বললেন।
‘আমাকেই দেখ ………আআআমাকেই’ –
সাহস করে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে কী নিবিড় দৃষ্টিতে আমার মধ্যে তিনি হাতড়ে চলেছেন নাচ এবং আগ্রহ। ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেললাম। মনে হল, উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট কত পুরুষই তো আমাকে দেখেছে! হয় আসক্তি, নয় মুগ্ধতায়। কেউ তো এমন অপার হয়ে বলেনি যে ‘আমাকেই দেখ’! এই প্রথম দেখলাম পৌরুষ নয়, শুধুমাত্র সৌন্দর্য-বোধের আধিপত্য। গুরুজি নিজে এমন রূপ, গুণ আর শক্তির আধার হয়েও তিনি আমাকে টেনে নিতে চাইছেন আমারই মর্মস্থলে! সে চাহনিতে কোনও মুগ্ধতা নেই আমার দেহসৌষ্ঠব বা রূপে। উল্টে সে সব থেকে মুক্ত করে আমাকে করে তুলতে চাইছেন এমন এক বোধ ও অনুভবের আধার যেখানে নাচও যেন আভরণের মতোই খসে যায় শরীর থেকে।
গুরুজির ওই দৃষ্টিপাতে এ জীবনে সেই একবারই ঈশ্বর-দর্শন হয়েছিল।
বার বার মনে পড়েছিল সেই দু’কলি--
‘মেঘের মাঝে মৃদং তোমার বাজিয়ে দিলে কী ও
সেই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিও দিও’।।