Sunday, August 30, 2020

পল মালডুনের কবিতা


অনুবাদ: প্রসূন মজুমদার

ছুঁড়ে ফেলা

অনুমানে বুঝলাম

    এ চিঠি তোমার। আমি চিনেছি

ওই বাদামী কালি,

                   হাইফেনের দাগ

পোস্টমার্ক আর তারিখ পড়েছে কেউ,

              অধৈর্যকে চাপা দিলাম

একটা পেপারওয়েটে।

                তোমার চিঠি নিয়ে ঠিক এগারোটায়

গেলাম বাগানে

                 সঙ্গে চা।

আর হঠাৎ হলুদ গোপন আঠা

            অর্ধ্বেক উঠে এলো

যেন পাকা কুলবন

              ছাড়িয়েছে খোসা।

সৌরভহারানো পাতাগুলো ঝরে যেতে দিই

আবার তুলি

আমার নির্লজ্জ হাতে। চিঠিটা ওল্টাই 

             পিছনে

তোমার মুখ দেখব বলে

       মুখ তুলি। রোগা, সাদা মুঠো

আমার তামাটে হাতের থেকে ঝুলে আছে।


বর্ষজীবীর মৃত্যুমাস


সে শুনেছে আছে এক গাছ

বছরের সবক'টি দিনে

আরও গাছ গজানোর আঁচ

পাওয়া যাবে চাঁদ চিনে চিনে।


তবু রোজ ব্যথা কুরে খায়

গাছেদের স্তন নেই কোনও

হৃদি ঢাকে সবুজ হাতায়

ফেটে পড়ে নাড়িভুঁড়ি, মনও।


দুম করে প্রেমে পড়ে তার

বাসাভাঙা অন্ধ সে পাখি

গোলাপি হাঁ ভাঙা ঘড়িটার

সে পাখির প্রেমে হাত রাখি।


কার পথ চেয়ে সে কী দেখে

শহরের পথে পথে রোজ

সময়ের বিধিবাধা থেকে

যে হারাল তাকে করে খোঁজ।

---------------------------------------------------------

পল মালডুনের জন্ম ১৯৫১ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের আরমাঘে। ১৯৮৭ থেকে আমেরিকার বসবাস। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটি বিভাগের অধ্যাপক। ২০০৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অফ পোয়েট্রি নিযুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে পান টি এস এলিঅট পুরস্কার।

Sunday, August 23, 2020

গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিতা



অনুবাদ: সুজিত মান্না

খুদে পা


এক শিশুর খুদে পা,

নীল, যেন ঈশ্বর প্রেরিত নীল,

কীভাবে তারা দেখেও তোমায় রক্ষা করার কথা ভাববে না?

হে ঈশ্বর!


খুদে আঘাতপ্রাপ্ত পা,

আহত করে গেছে নুড়ি পাথরেরা

ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে বরফ এবং মাটি!


মানুষ, অন্ধ হয়ে আছে, উপেক্ষা করছে তোমায়

আর তুমি পা ফেলছো, রেখে যাচ্ছ উজ্জ্বল ফুলেদের,

তুমি যেখানে রেখে যাচ্ছ ক্ষতদাগের পদচিহ্ন

সেখানে বেড়ে উঠছে তীব্র গন্ধের কোন রজনীগন্ধা।


এরপরেও রাস্তা বরাবর একই সরলরেখায়

হেঁটে যাচ্ছ তুমি,

আমি বলিঃ তুমি সাহসী, ভয়ডরহীন


শিশুর খুদে পা,

যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া দুটো মণি,

কীভাবে মানুষ না দেখার ভান করে শুধু উপেক্ষা করে হেঁটে চলে যায়


ধর্ম


আমি আমার হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি 

আহত হৃদয় ঈশ্বরের ভেতর ডুবে যেতে যেতে গান গেয়ে ওঠে

জীবিত পুষ্করিণী থেকে ক্রমশ উঠে যায়

ঠিক যেন কোন সদ্যজাত


আমি আমার হ্রদয় দিয়ে বিশ্বাস করি যা আমি নিজের থেকে নিংড়ে নিই

লাল পাণ্ডুবর্ণের রং দিয়ে 

জীবনের ক্যানভাসকে আলোকিত করতে

ঝলমলে পোশাকের ভেতর এটাকে আচ্ছাদন করে নিই


তিনি তো এক জ্যোতির্ময়ী-কর্তা


নিরর্থক তুমি চেষ্টা করছো 

আমার গানকে শ্বাসরুদ্ধ করতে

লক্ষ লক্ষ শিশুরা

একসুরে এই গান গেয়ে যাচ্ছে

সূর্যের নিচে


নিরর্থক তুমি চেষ্টা করছো

আমার দুঃখের কবিতাগুলিকে 

নষ্ট করতে

সেইসব শিশুরা এইসব গানও

গেয়ে যাচ্ছে ঈশ্বরের সামনে


গোলাপ


গোলাপটির হৃদয়ের ভেতর যে সম্পদ লুকিয়ে আছে

তা তো তোমার হৃদয়েও বাস করে।

ছড়িয়ে দাও এইসব সম্পদসামগ্রী যেভাবে গোলাপটি মেলে ধরে

দেখবে তোমার সমস্ত দুঃখ তখনই তার হয়ে গেছে।


কোন এক গানের ভেতর এটিকে ছড়িয়ে দাও

কিংবা কোন তীব্র প্রেমের বাসনার ভেতর।

শুধু গোলাপটিকে আটকে দিও না

দেখো যেন আটকাতে গিয়ে নিজেকেই না পুড়িয়ে ফেলো শেষে।

---------------------------------------------------------

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (১৮৮৯–১৯৫৭)। আসল নাম: লুসিলা দে মারিয়া দেল পেরপেতুও সোকোরো গোদোয় আলকায়াগা। তিনি ছিলেন একজন কবি, কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও নারীবাদী কর্মী। ১৯৪৫ সালে প্রথম লাতিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল। গ্যাব্রিয়েলা ছিলেন বাস্ক ও আমেরিন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত। দক্ষিণ আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনা যাদের হাতে, তাদের অন্যতম তিনি। ১৯১৪ সালে Sonetos de la Muerte বা মৃত্যুর সনেট বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই খ্যাতিলাভ করেন। কৈশোরে পাবলো নেরুদা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এই নারীর কবিতা থেকে।

Saturday, August 15, 2020

ব্রিজের কাছে একজন বয়স্ক :: আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

অনুবাদ: মাহমুদ মিটুল

ময়লা কাপড় এবং চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা পড়া এক বৃদ্ধ রাস্তার পাশে বসে ছিল। সেখানে নদীর ওপর একটা দোলনা ব্রিজ এবং মালগাড়ি, ট্রাক ও মহিলা-শিশু-পুরুষ সেই ব্রিজ দিয়ে পার হচ্ছিল। খাঁচা আকৃতির একটা মালগাড়ি ব্রিজের খাঁড়া ঢালে আটকে আছে এবং সৈনিকরা সেই মালগাড়ির চাকা ঠেলে ব্রিজে তোলার চেষ্টা করছে। ট্রাকগুলো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষকরা গোড়ালি পর্যান্ত কাদা ঠেলে এগোচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধ না নড়ে সেখানেই বসে। সে এতটাই ক্লান্ত যে এক পা-ও এগোতে পারছিল না।

আমার দায়িত্ব ছিল ব্রিজ পার হয়ে পরের প্রান্তে গিয়ে লক্ষ্য রাখা যে শত্রুরা কতদূর এগিয়েছে। আমি কাজটি করে ব্রিজ ধরে ফিরছিলাম। এখন আর খুব বেশি মালগাড়ি অবশিষ্ট নেই এবং পায়ে হাঁটা লোকের সংখ্যাও খুব কম। বৃদ্ধটি তখনও সেখানে বসে ছিল।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কোত্থেকে এসেছেন?

সে হেসে জানালো, 'স্যান কার্লোস।'

সেটাই তার বাড়ি এবং নিজের বাসস্থানের কথা বলে আনন্দবোধ করেই সে হেসেছিল।

সে আরও জানাল, 'আমি পশু-পাখি দেখাশোনা করতাম।'

পুরোপুরি না বুঝেই আমি বললাম, 'আচ্ছা।'

সে আবার বলল, 'হ্যাঁ, আপনি জানেন, আমি সেখানে থাকতাম এবং পশুপাখির দেখাশোনা করতাম। আমিই স্যান কার্লোস ছেড়ে আসা শেষ মানুষ।'

তাকে দেখে পশুপালক বা দলনেতা গোছের কিছু মনে হল না। আমি তার ময়লা কাপড়, তার ধূসর মুখ এবং স্টিলের ফ্রেমের চশমার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে জানতে চাইলাম, 'সেগুলো কী ধরনের প্রাণী ছিল?'

সে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, 'বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। আমাকে সেগুলো ছেড়ে আসতে হয়েছে।'

আমি ব্রিজের দিকে লক্ষ্য রেখে আফ্রিকান দেশের মতো দেখতে ইব্রো ডেল্টা দেশটা দেখছিলাম এবং ভাবছিলাম শত্রুদের নাগাল পেতে আরও কতক্ষণ লাগতে পারে। একই সঙ্গে সব আওয়াজ শুনছিলাম যদি কোনও অদ্ভুত শব্দ পাই! বৃদ্ধ তখনও সেখানে বসে ছিল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'সেগুলো কী ধরনের প্রাণী?'

সে বোঝাল, 'সেখানে এক সঙ্গে তিন ধরনের প্রাণী ছিল। দুটো ছাগল, একটা বেড়াল এবং চারজোড়া পায়রা।'

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আর আপনাকে সেগুলো ছেড়ে আসতে হয়েছে?'

'হ্যাঁ, আর্টিলারির কারণে। ক্যাপটেন এসে আমাকে বলল, এখান থেকে চলে যাও।'

ব্রিজটির শেষ মাথায়, যেখানে অবশিষ্ট কয়েকটি মালগাড়ি তাড়াহুড়ো করে পার হবার চেষ্টা করছে, দেখতে দেখতে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, 'আর আপনার পরিবার?'

সে জানাল, 'না, কেবল ওই প্রাণীদের সঙ্গে আমি থাকতাম। বেড়ালটা নিশ্চয়ই এখনও ভালো আছে। একটা বেড়াল নিজেকে নিজেই টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না যে বাকিদের অবস্থা কী হয়েছে।'

আমি জানতে চাইলাম, 'আপনি কি রাজনীতি করেন? কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক?'

সে বলল, 'আমি রাজনীতি করি না। আমার বয়স ছিয়াত্তর বছর। আমি বারো কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে আমি আর সামনে এগোতে পারব না।'

আমি জানালাম, 'থামার জন্য এটা মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। আপনি পারলে রাস্তায় গিয়ে একটা গাড়িতে উঠে পড়ুন, যা আপনাকে টরটোসায় পৌঁছে দেবে।'

সে বললো, 'আমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর যাব। ট্রাকগুলো কোথায় যাচ্ছে?”

আমি তাকে জানালাম, 'বার্সেলোনা।'

সে বলল, 'সেখানে আমার কোনও পরিচিত লোক নেই। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।'

সে ক্লান্ত-শূন্য দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল, এরপর এমনভাবে কথা বলল যেন তার দুঃখের কথা কাউকে জানাচ্ছে, 'আমি নিশ্চিত যে বেড়ালটা ঠিকঠাক আছে। বেড়ালের ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু অন্যগুলো। এখন অন্যপ্রাণিগুলোর ব্যাপারে আপনি কী মনে করছেন?'

'কেন? সেগুলোও যে যার মতো বের হয়ে গেছে এবং ঠিক আছে।'

'আপনি তাই মনে করছেন?'

নদীর ওপারে দূরে যেখানে আর কোনও মালগাড়ি নেই সেদিকে দেখতে দেখতে বললাম, 'কেন নয়?'

'কিন্তু আর্টিলারির মধ্যে তারা কিভাবে আছে যেখানে ওই আর্টিলারির কারণে আমাকেই চলে যেতে বলা হল?'

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কি কবুতরের খাঁচা খোলা রেখে এসেছেন?'

'হ্যাঁ।'

'তাহলে সেগুলো উড়ে গেছে।'

'হ্যাঁ, তারা অবশ্যই উড়ে যেতে পারে। কিন্তু বাকিগুলো। বাকিদের কথা আর চিন্তা না করাই ভালো।' সে বলল।

আমি তাকে তাগাদা দিলাম, 'আপনি যদি বিশ্রামে ক্ষান্ত দেন তাহলে আমি যাব। এখন উঠে একটু হাঁটেন।'

সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। টলতে টলতে আবার কাদার মধ্যেই বসে পড়ল।

সে আমাকে লক্ষ্য না করে নিজে নিজেই কাতর ভাবে বলতে লাগল, 'আমি পশুপাখি দেখাশোনা করতাম। আমি কেবল পশুপাখি দেখাশোনাই করতাম।'

তার জন্য আর কিছুই করার ছিল না। এটা ছিল ইস্টার সানডে এবং ফ্যাসিস্টরা ইব্রোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সেদিন খুব নিচু ধূসর মেঘ ছিল বলে তাদের যুদ্ধবিমানগুলো উড়তে পারেনি। এটাই হল বিষয় যে বেড়ালগুলো নিজেদেরকে নিজেরাই দেখভাল করতে জানে যা সব সময় বৃদ্ধের নিয়তি জুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ছিল।

---------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি: আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) একজন আমেরিকান উপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও সাংবাদিক। তাঁর আইচবার্গ থিওরি বিংশ শতাব্দির ফিকশন রচনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে তাঁর চমকপ্রদ জীবনযাপন তৎকালীন তরুণদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাতটি উপন্যাস, ছ'টি গল্পগ্রন্থ ও দু'টি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত বেশিরভাগ ফিকশনই আমেরিকায় ক্লাসিক হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫৩ সালে হেমিংওয়ে ফিকশনের জন্য পুলিৎজার ও ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ পান।

---------------------------------------------------------------

অনুবাদকের পরিচয়: মাহমুদ মিটুলের জন্ম ১৪ নভেম্বর ১৯৮৬। বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানসহ মাস্টার্স। কবি, অনুবাদক, সম্পাদক ও শিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ- মুমূর্ষা ও গোঙানি, বিস্ময় মুছে দিও না, অনুবাদ-‌ বব ডিলান: গোল্ডেন কর্ডস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। সম্পাদনা- বিজন অশ্রুবিন্দু। ইমেল: mahmud_mitul@yahoo.com

Friday, August 14, 2020

মুজিব সিঁড়ি :: কিং সউদ

 

রক্তে আগুন চোখে ফাগুন 

মুক্তি নেশায় চিরঞ্জীব

কেবল শুধু বাঙালির নয়

বিশ্বের নেতা শেখ মুজিব

এক পৃথিবী চায়নি মুজিব 

চেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ 

দিয়েছে রক্ত দিয়েছে প্রাণ

তবুও মুজিব অনিঃশেষ

অন্ধকারে আলোর ঝর্ণা 

নদীতে ঘেরা আগ্নেয়গিরি 

স্বাধীনতার সোনার মঞ্চে 

তুলে দিলো মুজিব সিঁড়ি

প্রাণ প্রেরণা প্রণয় পালক

পাখির নীড়ে ছানার গান

ওড়ার স্বপ্ন ঘোরার স্বপ্ন 

দেখালো মুজিবুর রহমান

যুগ জনতা বদলে গেছে 

স্বাধীনতা বদলায়নি 

মুজিবের দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে 

নেই কোন আর হয়রানি

কারাগারকে ঘর বানিয়ে 

সংগ্রাম করে কেটেছে দিন

ঘরগুলো সব দূর্গ করার

সুর বাজালো মুজিববীণ

মুরালে নয় ছবিতে নয় 

নয় তো কোন জাদুঘরে 

মুজিব ছিলো মুজিব আছে 

সব বাঙালির হৃদয় জুড়ে

লোভ লালসা ক্ষমতা শাসন 

পারেনি ছুঁতে মুজিবমন

জয় বাংলা বাঙালির জয়ে

ভেবে ছিলেন প্রতিটিক্ষণ

মৃত্যু ক্ষুধা ঝড় বন্যায় 

মানুষের ছায়া শেখ মুজিব 

মানুষের প্রতি মায়া মমতার

গড়ে ছিলেন মজবুত ভিত

১০

যুদ্ধ দিনে মুজিব ছিলেন 

সব যোদ্ধার অস্ত্র হয়ে

মেরেছে সব শত্রুসেনা 

থাকেনি বাঙালি মৃত্যু ভয়ে

১১

ধর্ষিত বোন ধর্ষিত মা

লাশের ওপর লাশ

মুজিব তবুও আপোষ করেনি

স্বাধীনতার ইতিহাস

১২

লালন হাছন জীবনানন্দের 

গান কবিতার দেশে

মুজিব হলেন পরশ পাথর 

মানুষ ভালোবেসে

১৩

মুজিব মায়া মুজিব প্রেম

মুজিব নীতি দর্শন 

মুজিব স্মৃতি মুজিব শোক 

মুজিবেই আকর্ষণ

১৪

ধর্মে দাঙ্গা দেশ দুই ভাগ

ভাষার জন্য আন্দোলন 

মুজিব ছিলেন মানুষের দলে

মাথা পেতে নিয়ে নির্যাতন

১৫

ধানমন্ডি না টুঙ্গিপাড়া 

কোথায় থাকেন মুজিব 

মুজিব থাকেন সবার ঘরে

সৌম্য শান্ত সজীব

সময়ের গন্ধ :: গৌতম চৌধুরী

প্রত্যেক সময়ের একটা গন্ধ আছে। যেমন প্রত্যেক মহল্লার। গন্ধটা সেখানেই স্থির হয়ে থাকে। স্থির হয়ে থাকতে থাকতে প্রাচীন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু গন্ধের ডানা গজায়। ডানায় ভর ক’রে নিজের সময় থেকে বেরিয়ে বয়ে যেতে থাকে অন্য সব সময়ের ওপর দিয়ে। দ্যাখে, একেকটা সময়ের গন্ধের কোনও প্রবল চরিত্র নেই। কোনও সময়ের আবার ভারি বদ গন্ধ। যেন, বিষবাষ্প ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। তার ভারি ইচ্ছে করে খারাপ গন্ধটার নুটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে। যাতে সেটা তার সময়কে ছেড়ে পালায়। কিন্তু পার হয়ে আসা সময়কে তো আর পালটানো যায় না। আরও পরের দিকের সময়ের পানে ডানা ভাসায় সে। ভাসতে ভাসতে একটা গন্ধকে ভারি পছন্দ হয় তার। অনেকটা যেন তারই মতো। আবার আলাদাও। বিরক্ত করে না তাকে। নিজের ডানা থেকে একটা পালক ঝরিয়ে ভাসিয়ে দেয় সেখানে। তারপর ফিরে আসে নিজের সময়ে। ফেলে-আসা পালক থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেই আগের সময়ের গন্ধ। পরের সময়ের গন্ধের মধ্যে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকে তা। কেউ হয়তো টেরই পায় না।




Painter: Willi Baumeister (1889–1955), Germany

Wednesday, August 12, 2020

রাহাত ইন্দোরির গজল


অনুবাদ: আমান রহমান

অচেনা এই ইচ্ছেগুলো পারি না বুকে পুষতে

এমনই এই চঞ্চল পাখি পারি না উড়িয়ে দিতে

এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেব মনের যত ধুলো 

এটা তো তোমার চিঠি নয়, তাই পারব না জ্বেলে দিতে!

আমার লজ্জা এমনই যে, ভরা মেহফিলে কাছে ডাকলে, 

মধুর স্বরে বুক বিঁধে যায়, পারি না কাছে আসতে।

ফলগুলো সব পেকে রয়েছে গাছের ডালে ডালে

ডালগুলো তবু এতই নরম, নাড়লেই ভেঙে পড়বে!

কোনও এক ক্ষণে খুঁজে নেব ঠিক তোমাকেই,  তোমাকেই

ঠোকর তো আর বিষ নয় যে, খেয়ে নিলে হবে মরতে!


ভিজে চোখ নিয়ে, ঠোঁটে আগুনের ফুলকি রেখো 

বাঁচতে চাইলে, উপায়টুকুও সাজিয়ে রেখো 

পথে পড়ে থাকা পাথরগুচ্ছ ছাড়া, কীই-বা তোমার আছে?

পথ বলে তাই: হে বন্ধু, পথ চলতে থেকো।


দুইটি তীরের মধ্যিখানে বয়ে চলে একা নদী

জীবন যদি বন্ধু হয়, মৃত্যুকে পাশে রেখো,

বয়ে চলা মহাকাল তোমার কানে বলে

'যুদ্ধ হবে যুদ্ধ হবে', বন্ধু তৈরি থেকো।


চোখের পলকে ভরসা যেন সর্বদা স্থির থাকে

চোখে ঘুম নিয়ে অথবা জেগেই, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখো।

দমকা হাওয়ায়, না উড়ে যায় শুকনো পাতার দেহ

পাথরে যেন ওজন থাকে সে দিকে নজর দিয়ো

সবাই বলছে, 'বাজারে এসেছে রাহাতের কবিতা'

বাজার বলে কি সস্তা হবে! একটু  খেয়াল রেখো।

---------------------------------------------------------------

করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন বিশ্বখ্যাত উর্দু কবি রাহাত ইন্দোরি। কয়েক মাস আগে দেশ যখন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উত্তাল, তখন তাঁর কলম থেকে আগুন ঝরেছিল। সেই সময় রাহাত লেখেন: 'সভি কা খুন হ্যায় শামিল ইহাঁ কি মিট্টি ম্যায়, কিসি কি বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়!' তাঁর লেখা এই লাইন তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। দেশ হারাল এক নির্ভিক কবি ও শিল্পীকে।

Sunday, August 9, 2020

চার্লস সিমিক-এর কবিতা

অনুবাদ: শৌভিক দে সরকার

যুদ্ধ


মহিলাটির কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো

আহতদের লিস্ট বেয়ে নামছিল

বরফ পড়ার প্রথম সন্ধ্যাবেলা


হিম হয়ে যাওয়া একটা বাড়ি, খুব লম্বা একটা লিস্ট


আমাদের সবার নাম ওই লিস্টটাতে ছিল। 


পিকনিক 


প্লেগের সময় পিকনিক যে রকম হয় 

সে রকমই একটা দিন আজ

মুরগির মাংস, ভাত

টেবিলের ওপর সসেজ, চিংড়ি


আনন্দে লাল হয়ে যাওয়া লাল, ডুমো ডুমো মুখ

পুরনো একটা বুড়ো গাছের ছায়া,

তেতে ওঠা দুপুরের আঁচ

মাছিরাও ঝিমিয়ে পড়ছে বারবার

মদে টলে যাচ্ছে মাথা

মেয়েরা বুক খুলে দিচ্ছে

ছেলেরা জামা খুলে খালি গায়ে বসে আছে


সবাইকে হঠাৎ খুব সুন্দর লাগছে

এমনকি ঘাসের ওপর কুকুরদের সঙ্গে

শুয়ে থাকা মেয়েটাকেও,   

হাসিতে ফেটে পড়ছে মেয়েটা

নাক থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়েছে সবে।


অনেকগুলো শূন্য


গোটা ক্লাসের সামনে চুপ করে দাঁড়ালেন মাস্টারমশাই

ফ্যাকাসে, ঠোঁট বন্ধ করে থাকা বাচ্চারা

ওনার পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডটা পৃথিবী থেকে 

অনেক আলোকবর্ষ দূরের আকাশের মতো কালো


মাস্টারমশাই স্তব্ধতাই ভালবাসেন

অনন্তের স্বাদ লেগে থাকে এর ভেতরে 

তারারাও বাচ্চাদের পেন্সিলের গায়ের দাঁতের দাগগুলো ভালবাসে  

একবার শোনো ওদের, হাসতে হাসতে বললেন মাস্টারমশাই


কাকতাড়ুয়া


ভগবানকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু শয়তান থেকেই গেছে 


এবছর টম্যাটোগুলো দেখার মতো হয়েছে

ওদের একবার কামড়ে দ্যাখো, মার্থা

ঠিক যেভাবে পাকা আপেলে কামড় দাও

প্রত্যেকটা কামড়ের পর একটু নুন


যদি টম্যাটোর রস তোমার গাল বেয়ে

খোলা বুকের ওপর এসে পড়ে

রান্নাঘরের সিঙ্কে ওপর ঝুঁকে দাঁড়াও


ওখান থেকে তুমি তোমার স্বামীকে দেখতে পাবে

ফাঁকা মাঠের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা

ফুরিয়ে যাওয়া একটা চিন্তার সামনে 

কাকতাড়ুয়ার মতো মেলে দিচ্ছে দুটো হাত।  

-------------------------------------------------------------------------

কবি পরিচিতি: সমকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কবি চার্লস সিমিকের জন্ম ১৯৩৮ সালে যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড শহরে। ১৬ বছর বয়সে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় চলে এসেছিলেন। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘হোয়াট দা গ্রাস সেইস’। ‘নাইট পিকনিক’, ‘হোটেল ইনসোম্যানিয়া’, ‘আনএন্ডিং ব্লুজ’ তাঁর বিখ্যত কাব্যগ্রন্থ। ১৯৯০ সালে ‘দা ওয়ার্ল্ড ডাজ নট এন্ড’-এর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন সিমিক। এছাড়া গ্রিফিন ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি প্রাইজ, ওয়ালস স্টিভেনস অ্যাওয়ার্ড- এর মতো পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ইউনিভার্সিটি অফ নিউ হ্যাম্পশায়ারে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পাশাপাশি ‘প্যারিস রিভিউ’ পত্রিকার কবিতা বিভাগ সম্পাদনা করেছেন তিনি।

-------------------------------------------------------------------------

অনুবাদকের পরিচয়: নব্বইয়ের দশকের কবি ও অনুবাদক শৌভিক দে সরকার। জন্ম ১৯৭৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। ‘একটি মৃদু লাল রেখা’, ‘যাত্রাবাড়ি’, ‘দখলসূত্র’, ‘অনুগত বাফার’ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন রবের্তো বোলানিওর কবিতা, খুলিও কোর্তাসারের কবিতা,  রুদ্রমূর্তি চেরানের কবিতা, মার্টিন এস্পাদার কবিতা, নামদেও ধাসালের কবিতা, সদত হসন মণ্টোর ‘স্যাম চাচাকে লেখা চিঠি’, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার নাটক ‘বেরনার্দা আলবার বাড়ি’ ইত্যাদি।

Friday, August 7, 2020

গাছেরা কথা বলতে পারে :: অ্যালান মার্শাল

অনুবাদ: অরিত্র সান্যাল 

পায়ের শব্দ পেয়ে তাকাতেই দেখা গেল একটা লোক ডিশ নিয়ে খালের ধার ধরে নেমে যাচ্ছে।

তিন মাইল দূর টাউনের এক দোকানদার আমায় বলেছিল, “ও কোনওদিন কথা কয় না। দু-এক জন ‘হ্যালো’-ট্যালো বলতে শুনেছে বটে। কিন্তু বাদবাকি কাজকম্মো লোকটা শুধু মাথা নেড়েই চালিয়ে দেয়”।

“কেন? কিছু গোলমাল আছে নাকি?” শুধিয়েছিলাম।

“না না। চাইলে কথা বলতে পারে। এখন ওর নামই হয়ে গেছে সাইলেন্ট জো”।

যেখানে এসে খাল একটু প্রশস্ত হয়ে গিয়েছে, লোকটা উবু হয়ে সেখানে বসে। হাতায় করে জল তুলে ডিশে দেয়। তারপর উঠে এসে ঝুঁকে পড়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডিশ থেকে ময়লা ধুতে থাকে।

আমি ক্রাচদুটো তুলে নিই মাটি থেকে। টুক টুক লাফিয়ে নুড়ি পাথর পেরিয়ে খালের ধারে লোকটার ঠিক উল্টোদিকে এসে দাঁড়ালাম। “গুড ডে” বলে শুভেচ্ছা ছুঁড়ে দিই, “চমৎকার দিন”।

মাথা তুলে তাকায় সে। ঘোলাটে দুই চোখ, সবুজ ঘোলাটে। গুল্মের ঝোপে ঝাড়ে যে সবুজ দেখা যায়, সেই সবুজ। দৃষ্টিতে কোনও কষাটে বিদ্বেষ নেই, কিছু যেন খুঁজছে।

ঠিক যেভাবে খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, “হ্যাঁ”, সেইভাবে চোখদুটোয় হঠাৎ অভিব্যক্তি বদলে গেল।

আমি বসে বসে ওকে দেখতে থাকি। খালের পরিষ্কার জলে ময়লা ঢেলে দেয় লোকটা।

ঘন হয়ে নেমে সে ময়লা ছুঁয়ে ফেলতে থাকে খালের তলার বালি, কিছুটা বেঁকে-চুড়ে, ঘূর্ণি করে জলের টানের জটিলতায় পাক খেতে থাকে যতক্ষণ না পাতলা মেঘের অবস্থায় মিশে যায়, তারপর স্রোতের সঙ্গে বয়ে যায়।

ও বাকি সব বাসন বারবার ধুয়ে নিচ্ছিল।

আমি খাল পেরিয়ে কাছে চলে গেলাম।

“কিছু পেলেন?”

আমার দিকে ডিশ তুলে ধরে লোকটা। ডিশের ধারের দিকে বালির আস্তরণ, তার মধ্যে তিন দানা সোনা চকচক করছে।

“তাহলে এই হল সোনা” আমি বলি, “তিন দানা, এহ! দুনিয়ার অর্ধেক গণ্ডগোল তো এইরকম কয়েকটা দানার জন্যই শুরু হয়”।

লোকটা স্মিত হেসে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে গড়ে ওঠা এক হাসি। ধীরে ধীরে ওর মুখ বেয়ে উঠে এল, কেন জানি না আমি দেখলাম একটা উড়ন্ত বকের ছবি, এই তার ডানা ছিল, আর এই হাপিশ।

বড় সহৃদয়তা নিয়ে আমার দিকে তাকায় লোকটা। আর এক মুহূর্তের জন্য আমি দেখতে পেলাম সেই লতাগুল্মময় ঝোপটাকে, খুব দূর থেকে করুণার মতো নয়, বরং যেন ডাকছে, বন্ধুর মতো। লোকটা খুব গাছেদের মতো, গাছেরা ওর মধ্যে দিয়ে কথা বলে।

আমার মনে হল এই মানুষটাকে বুঝতে পারলে, আমি একটা গুল্মলতাকে বুঝতে পারব। 

কিন্তু আবার ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, আঠার মতো, আবার দূরের কেউ হয়ে সরে যায়, সরে যায় সংযোগ থেকে নিজের নৈশব্দ দিয়ে। এই নৈশব্দ শব্দহীনতার নয়, বরং গাছেদের সরব নীরবতার।

বললাম, “আমি আপনার সঙ্গে আসছি”। 

আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। আমার চলার সুবিধের জন্য ও খুব খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিলো রাস্তা। পা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল ডাল, পথিমধ্যস্থ যে ডাল পালাময় বাধা পাহাড়তলি অব্দি ছড়িয়ে আছে, তাকে দু'হাতে ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলেছিল লোকটা।

আমরা ঘন বনে প্রবেশ করলাম। সূর্যের আলো ডালপালার ছাঁদনা ফুঁড়ে নেমে এসে আমাদের ঘাড়ের ওপর পাতার নক্সি ফুটিয়ে তুলছিল। একটা শীতল, পাতার-ছাঁচে ফেলা পৃথিবীর নিঃশ্বাস উঠে আসছিল পদচিহ্নের শৈবাল থেকে। এরমধ্যেই রাস্তা হঠাৎ খানিকটা ক্ষয়ে একটা ছোট্ট মুক্তাঞ্চলের সামনে শেষ হল।

পাতলা ঘাসের স্তর অসহায় ভাবে গাছেদের ব্যুহের মধ্যে পড়ে তিরতির কেঁপে চলেছে।

এই এলাকার ঠিক কেন্দ্রে হলুদ মাটির একটা ঢিবি উঠেছে একটা খাড়া তক্তার ধার ঘেঁষে। ঢিবির ওপর একটা চরকি সম্পূর্ণ ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে রেখেছে।

লোহার একটা শক্তপোক্ত ভারি বালতি রোলার থেকে ঝুলছে।

“তা এই আপনার খনি!”

চরকির দিকে তাকিয়ে লোকটা দিলখুশ মুখ করে মাথা নাড়ল।

ঢিবির চুড়োয় উঠে অন্ধকারে উঁকি মারি আমি। ভিতর থেকে একটা স্যাঁতস্যাঁতে পাথরের, মাটির ঠান্ডা হাওয়া ধাক্কা মারে আমার মুখে। একটা ছোট্ট পাথর ঠেলে দিই। মুহূর্তে অদৃশ্য, সময়ের সরু অন্ধকার রেখার মধ্যে দিয়ে দ্রুত নেমে গিয়ে মাটির কোনও গভীরে পৌঁছে পতনশব্দে বেজে ওঠে।

“উরিব্বাস, এ তো ভালো গভীর!”

আমার পাশে ও দাঁড়িয়েছিল, মনে হল আমার বিস্ময়ে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে।

“এই মই দিয়ে আপনি নিচে যান?” চারা কেটে বানানো এক মই সামনের তক্তায় হেলানো ছিল, আমি হাত দিয়ে দেখালাম।

লোকটা মাথা নেড়ে জানায় “হ্যাঁ”।

এই মই বেয়ে কীভাবে নামা যায় ভাবতে ভাবতেই আমি বিড়বিড় করে বলে উঠি, “আমি মই চড়তে পারি, কিন্তু এটা পারবো না”।

প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে সে আমার দিকে ঘুরে তাকায়, মুখে সমবেদনার ছায়া পড়ছে।

“ছেলেবেলার অসুবিধে,” আমি বললাম, “মাঝেমধ্যে জ্বালাতন করে। ওই বালতি করে কি আমায় নামিয়ে দিতে পারবেন? যেখান থেকে সোনা পান, সে জায়গাটা দেখতে চাই”।

আমি ভেবেছিলাম লোকটা স্রেফ “না” করে দেবে। সেটাই স্বাভাবিক। বিপদ আশংকা করে ঘন ঘন মাথা নাড়বে, ভেবেছিলুম।

কিন্তু কোনও দ্বিধা নেই। তক্তার ওপাশে গিয়ে বালতি টেনে আনল লোকটা। মাটিতে ক্রাচ রেখে আমি চড়ে বসি দুদিকে পা ঝুলিয়ে, দু'হাঁটুর ফাঁকে থাকল হাতল। দড়ি ভালো করে আঁকড়ে ধরে বললাম, “ঠিক ঠাক। আপনি মই বেয়ে আসছেন তো?”

মাথা সম্মতিতে ঝুঁকিয়ে ও বালতির হাতল ধরল। টেনে তুলতেই আমি ঝুলতে লাগলাম তক্তার ওপর। বালতিটা পাক খেতে খেতে থেমে আবার উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করে। চরকিটা ধরে তার ঠেকনাটা সরিয়ে দেয় লোকটা। চাপের মুখে ওর হাত দু'টোকে দেখি। শক্ত দুই বাহু ধীরে ধীরে স্টিয়ারিয়ের মতো ঘুরছিল। আমি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে ডুবে গেলাম। এখানে শুধুই ব্যাঙের গন্ধ।

আমার হঠাৎ মনে হল, “খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, মরতে আমি এখানে এলাম কেন? বড্ড বোকার মতো কাজ হয়ে গেল”।

বালতি আস্তে বেঁকে যায়। দেওয়ালের গায়ে খোঁচে উঠে থাকা পাথরের ঘূর্ণ-বিন্যাস আর পলির স্তর আমার চোখের সামনে উঠে আসতে থাকে। একদিকে ধাক্কা খেলাম। ধীরে ধীরে একটা বাঁকে এসে ওপরের খোলামুখটা অদৃশ্য হয়ে এল। আমি একা।

এক ধারে ঘেঁষে বসলাম, পাথরের ঘষা থেকে পাদুটোকে বাঁচাতে। বালতিটা ঘষা খেয়ে নেমে গেল, তার সঙ্গে একরাশ কাদা।

আমার ওপর চেপে বসে ভারি অন্ধকার। আমি একেবারে নীচে পৌঁছে গিয়েছি। বালতি থেকে পিছলে বেরিয়ে আমি বালতিটার পাশে গিয়ে বসি।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মইয়ের আওয়াজ পেলাম। ময়লা আর নুড়ি টুপটাপ এখানে পড়ছে। অন্ধকারে আমি বুঝতে পারলাম কেউ আমার কাছে আসছে। আর তখনই ফস করে একটা দেশলাই, মোমবাতি জ্বালালো লোকটা। একটা হলুদ ফলার মতো শিখা জ্বলে উঠল তার মুখের দিকে, তারপর আবার থিতিয়ে গেল নুয়ে থাকা সলতেতে। লোকটা দু'হাতে সেই শিখাকে আগলে রাখে যতক্ষণ না মোম গলতে থাকে, আর ছায়ারা টানেলের দিকে সরে যায়। এখান থেকে টানেলের একটা শাখা দেখা যায়।

আমি বললাম, “আমি একটা আস্ত বোকা, ক্রাচদুটোই আনিনি”।

লোকটা আমাকে চিন্তামগ্নভাবে দেখতে থাকে। মোমবাতির ছায়া মুখের ওপর ফুরফুর উড়ে বেড়ায়, যেন মথ। একটা সিদ্ধান্তে এসে ওর অভিব্যক্তি স্থির হল। আর যেন কথা বলেছে, সেভাবেই আমি জবাব দিলাম ওর নীরব অভিলাষে।

“ধন্যবাদ, আমি খুব একটা ভারি নই”।     

ঝুঁকে ও আমায় পিঠে তুলে নেয়। ওর ফেডেড নীল শার্টের নীচে কাঁধের পেশি সচল হয়ে উঠতে থাকে, আমি বুঝতে পারি।

মাথায় যাতে পাথরের ঠোক্কর না লাগে, তাই লোকটা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। প্রতি ধাপে আমি উঠছি আর নামছি।

অন্ধকার পরিষ্কার করতে করতে মোমবাতির আলো চলেছে আমাদের আগে আগে।

এই যাত্রার শেষে এসে ও আমায় মাটিতে নামায়।

মোমবাতি মুখের কাছে ধরে আমায় ও দেখায় একটা পাথরের ওপর একটা আড়াআড়ি ক্ষত।

“আচ্ছা! তাহলে ওইটা!” আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি।

আমি খুঁটে একটা টুকরো তোলার চেষ্টা করছিলাম। একটা ছোট্ট ঢেলা মাটি থেকে তুলে ও নালায় ঢুকিয়ে দেয়। আমি অল্প কয়েকটা টুকরো তুলে আলোয় দেখার চেষ্টা করলাম। আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে লোকটা পাথরটা দেখার চেষ্টা করে, তারপর আমার হাত থেকে সেটা নিয়ে নেয়। জিভ দিয়ে চেটে মুচকি হেসে আবার আমার দিকে তুলে ধরে। বুড়ো আঙুল দিয়ে লোকটা দেখিয়েছিল, পাথরের উপরিতলে এক দানা সোনা লেগে আছে।

আমি তো আত্মহারা হয়ে গেলাম। হাজারও প্রশ্ন করতে থাকলাম।

হাত জড়ো করে ও চুপচাপ বসে থাকল। মাঝেমাঝে মাথা নাড়া, আর অভিব্যক্তির উজ্জ্বলতা। এইভাবেই যখন যা উত্তর আসতে থাকে।

এক সময় মোমবাতির আলো তিরতির কেঁপে ওঠে।

“এবার মনে হয় বেরিয়ে যাওয়াই ভাল” আমি বললাম।

উঠে আমায় ঘাড়ে তুলে লোকটা আবার এগিয়ে যায়। এবার আমি নিজের ঠ্যাং দুটো দড়িতে বেঁধে তারপর বালতিতে বসি। ডানপায়ে আমার কোনও বশ নেই, বাঁপায়ের সঙ্গে বাঁধা না থাকলে ডান পা এক দিকে ঝুলে যায়। আমি বালতির এক ধারে বসে চরকির দড়িটা চেপে ধরে থাকলাম। এখন অপেক্ষা। মোমবাতি হঠাৎ তার সবটুকু উজ্জ্বলতা উপচে দিয়ে তিরতির করতে করতে ফুরিয়ে গেল। আমি শুধু রুগ্ন মইটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি এখন, তারপর কিছু না।

গোটা দুনিয়ায় একা আমিই বেঁচে আছি। অন্ধকারের একটা কালো কম্বলের মতো নক্সা আছে, কম্বলের মতো ওজন। এই নৈঃশব্দের মধ্যে কোনও সম্ভাবনা ছিল না। আমার মধ্যে থেকে সমস্ত সূর্যের আলো, সমস্ত গান বেরিয়ে গিয়েছে, আমি ঘন একটা ঘোরে বসে থাকলাম। পাখিদের পৃথিবী, হাসির পৃথিবী, গাছেদের পৃথিবী এখান থেকে নক্ষত্রের মতো দূরে মনে হয়।

কারণ ছাড়াই, মনে হল কোনও বস্তু ছাড়াই, বুদবুদের মতো ওপরে উঠতে থাকি। শূন্যতায় আমি দুলছি, মহাশূন্যতায় এগিয়ে চলেছি, আমায় চালনা করছে এই গ্রহ নক্ষত্রের টান। এর ওপর আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

তারপর একদিকে ধাক্কা খাই আমি, বালতির মুখ টাল খেল একটা পাথরের জিভে আটকে। তলাটা উপরে উঠে আসছিল। বালতির ধারটা খুলে যাওয়ায় আমি হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলুম।

এসময় হ্যাচোরপ্যাঁচোর করে কোনওক্রমে অন্ধকারের পলিস্তর থেকে ক্রমে বেড়ে ওঠা আলোর দিকে উঠে এলাম। মাথার ওপর বেরোবার রাস্তার মুখ বড় হয়ে উঠছে।

হঠাৎ উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় প্রায় ফেটে পড়লাম। একটা বাহু এগিয়ে এল, একটা হাত বালতির হাতল ধরল। একটা হ্যাঁচকা টান, মাটির ঘনরূপ অনুভব করলাম নিজের নীচে। নড়ছে না-– এমন কিছুর ওপর দাঁড়াতে ভাল লাগে, সূর্যালোক মুখে পড়ছে, ভাল লাগে।

আমায় লোকটা দেখছিল, বাড়িয়ে রাখা ওর হাতটা ওর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ওরই মত দেখতে একটা ধুসর বক্স-ট্রির সেতুবন্ধন করছিল।

আমি ওকে ধন্যবাদ জানাই, তারপর পাথরকুচির ওপর বসে একটা রাঙা আলু নিই। আমি ওকে নিজের কথা বলতে থাকি, যাদের যাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় আছে, তাদের কথাও। ও নিথরভাবে শুনে যেতে থাকে, কিন্তু আমি কোনওভাবে বুঝতে পারছিলুম শব্দকে ও শুকনো মাটির জল শুষে নেওয়ার মত শুষে নিচ্ছে।

“আসি”, ছেড়ে আসার আগে হ্যাণ্ডশেক করে বললাম।

আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু ঘন বনের কাছে আসার আগে একবার ঘুরে তাকাই, হাত নাড়ি ওর দিকে।

ও দাঁড়িয়ে আছে, ধুসর বাক্সের আগে, গাছেদের স্বজাতির মত। কিন্তু ঝট করে সোজা হয়ে যায় লোকটা। হাত নাড়ে।

“গুডবাই” লোকটা বলল। যেন বলে উঠল একটা গাছ। 

-----------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি: অ্যালান মার্শালের জন্ম ১৯০২ সালে, অস্ট্রেলিয়ায়। লেখক, গল্প-বলিয়ে, মানবতাবাদী অ্যালান ছিলেন একজন social documenter। পোলিও আক্রান্ত হয়ে ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটি পা বিকল। সমসাময়িক কবিবন্ধু হ্যাল পোর্টারের ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত স্মৃতিচারণায় অ্যালান একজন উষ্ণ, কেন্দ্রীভূত মানুষ হিসেবে ফুটে ওঠেন। পোর্টার লিখছেন, যাকে দেখে করুণ লাগে আর যাকে দেখে মনে হয় স্বেচ্ছায় নির্ভীক তাদের মাঝে টানা একটা বিভাজনরেখা বরাবর সহজ ও উদাসভাবে অ্যালান হাঁটেন– এবং এটা খুব একটা সরল ব্যাপার নয় একেবারেই – আমি সে অন্ধকারে নামার হিম্মত রাখি না। অ্যালানের তিন খণ্ডের আত্মজীবনীর প্রথমটিই– I can Jump Puddles (১৯৫৫) তাঁর জীবনের সেরা কাজ বলে আলোচিত হয়। অস্ট্রেলিয়ান লিটারেচার সোসাইটি প্রদত্ত শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড তিনি তিনবার পেয়েছে, ১৯৩৩-এ প্রথম। ১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেসন তাঁর জীবনের ওপর ভিত্তি করে একটি নয় এপিসোডের মিনিসিরিজ নির্মাণ করে টেলিভিসনের জন্য। অ্যালানের মৃত্যু ১৯৮৪-তে। মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে তাঁর জন্মভিটে নুরাতে একটি গাছ উৎসর্গ করা হয়। যে গল্পটি অনুদিত হল, তার মূল শিরোনাম– Trees Can Speak.

ঘরবন্দি নিউ ইংল্যান্ড :: অলকেশ দত্তরায়

ক্যালেন্ডারের পাতা মৃত্যুর লিঙ্ক পাঠিয়ে যায় রোজ

মার্কিনি স্ট্রাইপড্ ব্যানারে রাতের আকাশের তারা

লকডাউন ট্রেন-স্টেশনে তাকিয়ে থাকে মৃত যাত্রীর অপেক্ষায় 

ঘরের দরজা এখন আর খোলা হয় না পৃথিবীকে স্বাগত জানাতে

যখন সকালের আলো পাতাহীন গাছের ডাল বেয়ে গলতে থাকে

তখন শেষ তুষারপাতের পথে হেঁটে যায় আরেকটা কোয়ারান্টাইনড্ দিন

প্রতিটি নতুন শব্দ জন্ম দেয় পুরোনো আরেকটি শব্দর

ঠিক যেমন আমরাও জন্ম দিই বাবা-মা’র স্মৃতি 

ছবির শেল্ফে ডিসইনফেকট্যান্ট দিয়ে মুছে যাওয়া দিনে

বৃষ্টি এখন উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারে ধুয়ে দিচ্ছে রোববারের বিকেল

পোস্ট-ট্রুথ ধুয়ে দেওয়া ফেক-নিউজের মতো

কাঠের বারান্দার ডেকে প্রতিফলিত সেই ভাইরাল সময় আপলোড হয়েছিল গতকাল

এভাবেই তাপমান বাড়িয়ে যাবে শরীরের পালস্-বিট 

দূরের ছায়ায় চেনা অচেনা মৃতদেহ কেঁপে উঠবে বারবার


কবি শুধুই দেখতে থাকবে তার নির্বাক জল-ধোওয়া হাত

Thursday, August 6, 2020

নীল হলের কবিতা :: মশলা চা


অনুবাদ: শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 

একটি ভারতীয় আবহ 

বিদায়ী অশ্রুতে ডুবে থাকা 

সান্ধ্য চায়ে কোনও এক সকালের আলো

একটি সোনালি হলুদ কাপে ধীর লয়ে সমর্পণ করল নিজেকে

কাপের সুডৌল রিমে তার কান্নাভেজা 

রংমাখা ঠোঁট বুদ্ধের চুম্বন এঁকে দিল

একেকটি চুমুক এবং আহ! মশলা দেওয়া চা


প্লেটের ওপর রাখা উচ্ছ্বল হলুদ সেই পোর্সিলিন কাপ

জেনে-বুঝে করা তার দারুণ মেকআপ, হৃদয় আকৃতির হাতল

সে আমার হাতেই ভার দিল

দারুণ সন্তর্পণে ছুঁতে হবে তাকে... তারপর ধীর সমর্পণ 


আমার সারাজীবনের প্রেম, সে ঢেলে দিচ্ছে 

সুগন্ধি মিশেলে ভরা কৃষ্ণকলি চায়ের নির্যাস

মৌরি দেওয়া, উত্তেজনায় ভরানো

দারুচিনির আদরে মাখামাখি 

সবুজ এলাচের আবেশে মাতোয়ারা 

লবঙ্গ, আদার গন্ধ শরীরে জড়িয়ে নেওয়া তার নগ্নতা

উর্বর কৃষ্ণাঙ্গী গোলমরিচে জারানো

এক তরল মিষ্টি দুধ

রূপোর চামচ দিয়ে আলতো নাড়ানো, তার আবেদনে  

আমার অলিন্দ-নিলয় ডুবে গেল


তোমাদের মশলাদার ভারতীয় আবহ, 

বিদায়ী চোখের জলে ডুবে থাকা সকালের চা

হলুদ পোর্সিলিন কাপে ঢালা প্রেমের কবিতা 

সে আমার হাতে তুলে দিল 

বিচ্ছেদের কান্নাটুকু যত্ন করে ঢেলে দিতে বলল আমাকে


কবি পরিচিতি: নীল হল একজন মননশীল সংগ্রামী মানুষ, সমাজকর্মী এবং কবি। উত্তর আমেরিকার কবিতা জগতে তিনি উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, বিষয়ের ওপর তাঁর তুমুল দখল এবং তাঁর চূড়ান্ত প্রগতিশীল কলম কবিতার দুনিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতা এতটাই শক্তিশালী, যে তাঁর কবিতা পড়ার পর বর্ণবৈষম্য এবং সামাজিক বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা আমূল বদলে যেতে পারে। নীচে মূল কবিতাটি দেওয়া হল:

Masala Chai

Neal Hall

a Hindu milieu,

a morning’s light of evening tea,

steeped in parting tears

gently poured an Amarillo cup,

whose encircling rim, her tear stained,

lip stick’d lips imprint the Buddha‘s kiss

each sip and sigh, Masala Chai


an Amarillo porcelain cup, saucer’d and sassy

polished with purpose, appointed her

heart shaped handle, she hands me to handle her

to pour her with gentle care . . . a gentle pour


amour de ma vie, she pours,

an amalgamated aromatic extract of

Black tea, fennel’d aphrodisiac

caressed in cinnamon,

possessed of green cardamom,

unclothed to clothe in cloves, a gingered mist,

a black peppered corn estrus marinated

a watery milky sweet - steeped -

silver spoon stirred, slowly, sensuously

my four chambered fervent heart


A Hindu masala milieu of you, infused

a morning tea steeped in parting tears

gently poured an amarillo, amoretto porcelain cup,

she hands me to handle her to pour her

with gentle care, a gentle pour of parting tears

Wednesday, August 5, 2020

কিশোর ঘোষের কবিতা


আপডেট

পটাপট ক্যাশবাক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ছে
দোকানির দুঃখ
করাতকলের শব্দ বেয়ে উঠছে-নামছে
                           কাঠবেড়ালী জীবন
সরল মেয়ে পেয়ে কার ধর্ষণ করে গেল নদীটিকে
সেই নদীখাতে আমাদের ভালোমন্দ চাষ!

কবে যেন দুপুর পড়ে গেল দু'কুলে
অন্যের কান্নার জলে 
তেষ্টা মেটানোর দিন পড়ে গেল
তবে, অক্সিজেন মাস্ক পরা বাতাস ঝুলছে মোড়ে মোড়ে

আর এবছর সরকার 
রেশনে সরকারি নিঃশ্বাস দিচ্ছে


আয়নাবাজার

তারপর আলোময় জ্বালিল আঁধার 
অনেক কারণ ছিল তাহার কাঁদার 
লাগেজ বাড়িল কবি জন্ম হল ব'লে
ঘুমের গাছেতে তায় স্বপ্নভূত দোলে

যদিও কৃষক যিনি, ধানশিরমণি
লোন করা আয়ু তাঁর জ্বালানির খনি
রোপণ করেন তারা মহাকাশ রাত
শিউলিতলায় ঝরে যতটা প্রভাত

এরপর ট্রাম ফেরে অফিস ফুরোলে
ময়দান গায় গান সাপুড়ে ঘুমোলে
সুরারোপ করে গ্লাস... কাচের রেস্তোরাঁ 
আয়নাবাজারে বাড়ে লটারির পাড়া

তবুও লালন সাঁই রেডিয়ো বাজান
গ্রাম এসে গেয়ে যায় ভাড়াটিয়া গান
কারা যেন পিকনিকে নদীতিরও খান

ধন্য বাথরুম, বন্য নিজস্বীর স্নান!

Monday, August 3, 2020

কিং সউদের কবিতা


খনন

কতটুকু কান্না করলে ফুরাবে অশ্রু? এই মাটি লগ্ন শরীর তোমাকে কেবল পদপিষ্ট করে চলে! তবু চন্দ্রাবতী আষাঢ়ে বৃক্ষের ভেজা দেখে তুমিও ভিজতে চাও দুঃখ ধুয়ে নিতে! তোমার পাশের বালিশে ঘুমায় একটা অক্টোপাস! তোমার স্বপ্নও আটকে রাখে পিচ্ছিল নরম আর লোভাতুর পা দিয়ে! তুমি সৈকত হয়ে জন্ম নাওনি! তবু ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে ভুলে গেছো লবঙ্গ বনগামী জাহাজের নাবিকের মুখ! তোমার বুকে শুধু স্তন নেই, সাহসের খনিও আছে, শুধু তুমি খনন করো...

কলিংবেল

মৃত্যুকে খুঁজতে গেলে বাড়ি পাবে না তোমার জন্য! মৃত্যু তোমাকে খুঁজে নেবে! তুমি বরং বৃক্ষের মূলে জল দাও, কামরাঙা পাতার সতেজতা দেখো, সফেদার ডালে এসে বসা চড়ুইয়ের সাথে কথা বলো, ও চড়ুই সঙ্গমেই সুখ নয়, এই ধূসর ডানায় মেঘ ছুয়ে দেখো, তুমিও পাবে রঙ্ধনুর জীবন! তোমার শরীরকে ছেড়ে দাও বাসি পূজোর ফুলের মতো ভোরের স্রোতে। তোমার মনকে ঘরের কলিংবেল করে রাখো। আমি এসে বাজাবো যেকোন সময়...

অবসর

এই ঘোড়াহীন ভ্রমণের নাম জিজ্ঞাসা! সব পথের পাশে মাইলফলক থাকে না। আমার ক্লান্তি মাপার উপায় কি? সামনে কেবলই আকাশ হেলে থাকতে দেখি। যেনো মাটিকে চুমু খেতে চায় অনাদিকাল থেকে। চন্দ্র সূর্যের কাছে মানুষের দায় দায়িত্ব দিয়ে আমার অবসর চাই। আমাকে অনেক আঁচল বাধতে গিয়ে শাড়ির কুচি খুলে গেছে! আমি ঘোড়া ভেবে কুপথে গমন করেছিলাম অতীতে!