মুহূর্ত মানেই কি পলকে দেখা! চোখের পাতা পড়লেই অন্য সময়ে ঢুকে পড়া! গড়িয়ে যেতে যেতে আবার অপেক্ষা- আরও এক নতুন মুহূর্তের জন্য, যখন আবার পলক পড়বে না; স্থির হয়ে দেখিয়ে দেবে হৃদয় কী চায়! মূক বা বাকরহিতও তো চোখে কথা বলে। স্বচ্ছ দীঘির মধ্যে কালো ছিপ-নৌকার মতো দুরন্ত ঘুরে বেড়ায় সেই চোখের মণি; হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেই তৈরি হয় এক বিশেষ উচ্ছ্বাস। কিছুটা আচেনা; হয়তো অজানাও। মনও তখন আঁকড়ে ধরে সেই দৃষ্টিটুকুই। ধরে রাখতে চায় সেই গোপন সঙ্কেত, না হারানো বিশ্বাসের মতোই। রোজকার কথা, হাঁটাচলা, মানুষে মানুষে যাতায়াত, গাছে জল দেওয়া, খাবার বানানো, বার চারেক তা খাওয়া, নিয়ম করে স্নান-– সব ভুলে যাই ক্রমে। ঘুমিয়ে থাকা কিছু অপলক দৃষ্টি, কত কী যে মনে করিয়ে দেয়! সব যেন থরে থরে সাজানোই থাকে। কোনওটা সাধারণ তাকে, কোনওটা বা মোহর জ্ঞানে নিভৃত লকারে।
কমলা, এমনই চকিতে দেখেছিল, তার দ্বিতীয় বরের সেই দৃষ্টি। প্রথম বিয়ে ভেঙে দ্বিতীয়তেও সুখী হয়নি কমলা; আবার সে পা বাড়িয়েছিল, নতুন প্রেমিকের রোশনাই ইশারায়। আধিপত্যের জেরে কানাই তা আন্দাজ করতেই, জোর লড়ালড়ি। গালাগালির অল্প পরেই মার-– লাথি ও চুলের মুঠি ধরে দুরমুশ। বিয়ে ছেড়ে, ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল কমলা; তবু সে ভুলতে পারে না, সেই এক ছবি। বেদম মারের পর কানাইয়ের হাত দুখানা নিজের হাতে জড়ো করে সে বলছে,
-চলো খেয়ে নেবে; তোমার পছন্দের রুটি তড়কাই বানিয়েছি।
মিথ্যে চুম্বনের আশ্বাস জাগিয়ে বলছে,
- এমন মার কেউ মারে!
রাগ ভুলে কানাইও চেয়ে আছে অপলক, কমলার চোখে। জানে, যে কমলার চোখে যা কিছু, সবটুকু মিথ্যে আর ছল; বরের মার থেকে নিজেকে বাঁচাবার পথটুকু সে শুধু করুণা বিছিয়ে দিয়েছে; তবু নরম হয়ে আসে কানাইয়ের রাগ আর ক্ষোভ; কমলা অবাক তাকায়-– এত স্বচ্ছ! এত নরম! এত নির্ভরতা! লজ্জায় নিভে আসে দুর্বল কমলা।
চুম্বন বা সঙ্গম নয়; আজও তার মনে পড়ে, কানাইয়ের সেই দৃষ্টিটুকু।
বৃষ্টি শেষে ভেজা মাঠের মতো, ঝকঝকে সবুজ।