Tuesday, April 4, 2023

চাহনি | পর্ব ২ | দোলনচাঁপা | মন্দার মুখোপাধ্যায়

বছর আঠারো বয়েস। ইস্কুলের শেষ ক্লাস। পুজোর ছুটিতে মায়ের সঙ্গে এবার মধুপুর। বাবার বন্ধু সুরম্য জেঠুর বাড়ি। জেঠু জেঠিমা ছাড়াও বাড়ি ভর্তি লোক। সাত ভাইবোন সমেত, বড় দাদার এক বউ এবং দুটি ছানা। বাবা চলে যাবার পর, বহু মাস পরে, মাকে আবার হাসতে দেখল মিলি। সকাল সন্ধে জমিয়ে আড্ডা, গান, কবিতা আর দফায় দফায় চা। তিনখানি ঘরের একটা আটপৌরে, একতলা বাড়ি। রান্নাঘর লাগোয়া উঠোনের ওপারে, পাঁচিলের গায়ের নিচে যেটুকু মাটি, সেখানেই সাদা রঙের রাশি রাশি দোলন চাঁপা ফুটে আছে। নরম পাপড়ির মাঝখানে যেন লুকোনো সুগন্ধির ঝাঁপি। ভেতর উঠোন তাই সৌরভে ম ম করে। কুঁড়িগুলো সরু সরু লম্বা। এই ফুল ও সুগন্ধ মিলির কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। জেঠু বললেন, এর নাম দোলনচাঁপা।

ষষ্ঠীর সকাল। মায়ের কেনা সেই ফলসা রঙা তাঁতের ডুরে শাড়িটা পরে, কী মনে হল, একগুচ্ছ দোলনচাঁপা তুলে, নিজের একবেণীর বাঁ পাশে, যত্ন করে, ক্লিপ দিয়ে লাগাল মিলি। বাকি সকলে, এখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে, বারান্দায় দাঁড়াল মিলি। এখান থেকে গেট অবধি জমি; অনেকখানি এমনিই পড়ে আছে। ঘাস ভর্তি প্রজাপতি আর শালিখের ওড়াউড়ি। থামের গায়ে হেলান দিয়ে মিলি দেখছে, ঘাসের ওপর তার লম্বাটে ছায়া। সেই ছায়ার কাছে আরও একটি ছায়ার আভাস দেখা যেতেই, মিলি চোখ তুলে তাকাল। ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে এলে, জুতোর শব্দ হয় না; তাই সে টের পাইনি।

মিলি দেখল, একজন আত্মবিশ্বাসী যুবক তাকে দেখছে, অপার মুগ্ধতায়। আনত চোখে মিলি হাত ছোঁয়াল তার বেণিতে লাগানো, সেই দোলনচাঁপা গুচ্ছে। তার মনে হল, এটাই যেন দৃষ্টি টানছে ওই যুবকের। স্মার্ট বললেও কম বলা হয়। বলিষ্ঠ শরীরে যেন বিদেশ বাসের ছাপ। পায়ে ভারি জুতো। চোখে চোখ রেখে সে জানতে চাইল, ‘তুমি কে’? মিলি বলল, ‘বেড়াতে এসেছি; এটা আমার জেঠুর বাড়ি’। দু-পায়ে সবল দাঁড়িয়ে মিলিকে সে শুধু দেখছে তো দেখেছই। সেই সম্মোহনে মিলি স্থাণুবৎ। ভেতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে, সহর্ষে ভেতরে ডেকে নিল তাকে। মিলি জানল যে, যুবকটি এ বাড়ির বউদির ভাই। আগের রাতেই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে। ওখানকার পড়া শেষ করে, এবার সে এখানে চাকরি করবে।

সন্ধেবেলা আবার সে এলো। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির ওপর, গলায় একটা প্রিন্টেড সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে। মিলিকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যামেলিয়া লাগাওনি’? 

মিলি বলল, ‘দোলনচাঁপা’।

সদ্য বড় হয়ে ওঠা, সবে শাড়ি ধরা মিলি বুঝল যে, এ দেখাকেই বলে নিমেষ; বলে সম্মোহন। 

No comments:

Post a Comment