Saturday, June 17, 2023

কবীর চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

প্রশ্ন


হাতের উপর হাত রেখেছি, ঠোঁটের ফাঁকে বিষ, 

এইটুকুতেই প্রেমের কথা শেষ হলে কি চলে?

মন মেজাজের আবেশটুকু

তৃষ্ণা হয়ে ভিজতে ভিজতে 

শরীরজুড়ে নামলো এসে এক আষাঢ়ের জলে।

হাতের উপর হাতটি রাখা, আঙুলরা একজোট, 

এমন সময়ে শরীর কি তোর ছুটির কথা বলে?


ভাবিস না আর তার কথাটি, দেখবি ও সব খালি

মন-ভুলোনো ঘর-ফুরোনো প্রেম পিরিতির ধুলো, 

প্রতীক্ষাতেই থাকবি যদি

একলা বসে নিরবধি, 

কার দুয়ারে আস্তে আস্তে জমবে স্মৃতিগুলো?

হাতের উপর হাত রেখে দেখ, চোখের নীচে কালি, 

এই আকালে ঠোঁটদুটি তোর কার অন্ধকার ছুঁলো?


হাতের উপর হাত রেখেছি, ঠোঁটের ফাঁকে ঝড়,

দুটি জিভের এক সহবাস, স্বাদ কি পড়ে মনে?

আষাঢ় গেছে, শ্রাবণ গেছে

নিরুদ্দেশের অন্বেষণে,

এক ফালি মেঘ একরোখা তাও ফুঁসছে ঈশান কোণে।

হাতের উপর হাতের বসত, অনির্বাণ অধর, 

এমন সময়ে অপেক্ষাতে শরীর কি দিন গোনে?


নেটিভিটি


আজ ভোরের ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারেরা

আর পাশের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ কিশোরবাবু

এসেছেন

নবজাতক শিশুটিকে দেখতে। 


এখনও কথা ফোটেনি আধো-আধো বুলিতে, 

দীঘির মত স্বচ্ছ চোখে সে অবাক হয়ে দেখছে দুনিয়াটা।

ভাষা নেই, স্মৃতি নেই, শ্লেষ নেই, 

তবু তাকে দেখবে বলেই এসেছে 

ফড়িং আর মৌমাছি,

রুই কাতলা তেলাপিয়া আর

পাড়ার সবচেয়ে ডাকসাইটে হুলো বেড়ালটা। 


রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন,

তাঁর হেলিকপ্টার নামবে সামনের মাঠে

তাড়াহুড়ো করে বানানো জোড়াতালি হেলিপ্যাডে।

শতদল ক্লাবের চেয়ারম্যান দেবাশিসবাবু

আর বাবাই বলে যে ছেলেটা 

পাড়ায় সব্বার টিভি সারায়,

সবাই এসেছে নবজাতককে দেখতে। 


রিকশা থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমেছেন জ্যোতিষার্ণব, 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক সাহেব অবশ্য

ট্রামেই এসেছেন, 

বেসামাল ধুলোবালি উড়িয়ে এসেছে হেমন্তের হাওয়া,

আর আকাশে টিকিট না কেটেই ঢুকে পড়েছে

অকালের মেঘ।


হালকা বৃষ্টি এসেছে সকাল থেকেই, 

তার সঙ্গে মিষ্টির দোকানের মালিক অমিতদাও 

দুই মেয়ে আর স্কুলের বন্ধু রনিকে নিয়ে এসেছেন

নবজাতককে দেখবেন বলে।


এ নবজাতকের কথা লেখা আছে 

আদিম কবিতার খাতায়। 

পৃথিবীর কোনো এক অনির্দিষ্ট যুগে

সমুদ্রের গর্ভ থেকে উঠে আসবে এই শিশু, 

আকাশের বুক চিরে ছুটে যাবে আশ্চর্য উল্কা, 

আর পূবের দিগন্ত থেকে উপহার নিয়ে আসবে

তিনজন বেরসিক বুড়ো। 


আর ঠিক তখনই এই নবজাতক

দেয়ালা করতে করতে

রচনা করবে এক নতুন পৃথিবী।

তার এক পা থাকবে মহাকাশে, 

অন্য পা থাকবে আগ্নেয়গিরির অতলে,

আর সে দু’ হাত বাড়িয়ে খেলতে খেলতে

হয় পৃথিবীতে গড়ে তুলবে অতুলনীয় এক স্বর্গরাজ্য, 

নয় সবকিছু ধ্বংস করে

আবার নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে বসবে। 


দাড়ির গল্প


পঞ্জিকাতে লগ্ন দেখে সেলুন দিলাম পাড়ি, 

বাড়ি এবং হাঁড়ির পরেই সবসে প্যায়ারা দাড়ি!

দাড়ি ব্রহ্মা, দাড়ি বিষ্ণু, দাড়ি মহেশ্বর, 

আল্লাতালা, গড, যীশু সব দাড়ির মাতব্বর। 


সেই দাড়িটিই কাটতে হবে, পাষাণ সমাজ বলে;

আধকামানো গাল নিয়ে কি আপিস যাওয়া চলে?

ক্ষুরটি হাতে যতই কাছে আসেন পরামানিক, 

বিষণ্ণতায় দাড়ির কথাই ভাবছি বসে খানিক। 


কারোর দাড়ি লম্বামাফিক, কারোর দাড়ি খাটো, 

কারোর দাড়ি ছাগল-সমান, থুতনি আঁটোসাঁটো।

এক একজনের দাড়ির ডগা পিছনপানে মোড়া, 

কারোর দাড়ি গোঁফের সঙ্গে এক্কেবারে জোড়া। 


হরেক রকম দাড়ির বাহার দেখতে যাবো কোথা? 

এই জগতের যতেক মহান মানুষ দাড়ির হোতা। 

মার্ক্স, ফ্রয়েড, শোপেনহাউয়ার, লেনিন এবং র্যালে, 

মাথায় যাঁদের বুদ্ধি, তাঁদের দাড়িও থাকে গালে।


আমার দাড়ি কামায় যে’জন, সে’জন সুজন বটে, 

থুতনি জুড়ে রাখছি দাড়ি, মগজ থাকুক ঘটে। 

টাকা কামাই সাধ্য কোথায়? দাড়িই কামাই ব্লেডে।

কমুক টাকা, বাড়ুক দাড়ি, দাড়িরই পে-গ্রেডে। 


ঢিল মারো


মৌমাছির চাকে ঢিল মারো,

ইচ্ছে করেই। 


বহু দিন, বহু যুগ, বহু মুহূর্ত ধরে

ভন ভন ভন ভন শব্দে 

বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছো ভায়া।

দিনের বেলা সমস্যা না হলে'ও,

রাত বিরেতে খাওয়ার পালা শেষ করে

শুতে গেলে

অন্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ রাত্তিরে

ঐ একটানা একঘেয়ে ভন ভন শব্দটা

তোমার বিরক্তিকর লাগে না?


হাতের কাছেই পাটকেল আছে, 

পাঁচটি মধ্যবিত্ত কলমপেষা আঙ্গুলে 

জীবনে প্রথমবার

কোনো কিছুকে শক্ত করে চেপে ধরো,

এক চোখ বন্ধ করে নিশানায় টিপ করে নাও, 

অর্জুনের সেই পাখির চোখের মত।

তারপর বেশী না ভেবে, 

ইচ্ছেটা কেটে পড়বার আগেই

ধাঁই করে ঢিলখানা ছুঁড়ে মারো 

চাকের গায়ে, 

যেখানে হাজার হাজার মৌমাছি, 

না কি ভীমরুল, না কি বোলতা, 

ভন ভন শব্দে যে যার নিজের বাচালতাটুকু, 

নিজের অন্ধ বিশ্বাসটুকু ক্রমাগত জাহির করে চলেছে, 

বিবাদ বিতর্কের তোয়াক্কা না করে। 


মতামতের চাকে ঢিল মারো, 

ইচ্ছে করেই। 

শত সহস্র হুলের খোঁচা সহ্য করো, 

সহ্য করো নির্বোধ গালিগালাজের বিষের জ্বালা,

সহ্য করো ধর্মের দংশন, 

সহ্য করো ভদ্রলোকের ক্লীব তিরষ্কার,

সহ্য করো শ্রেণীহিংসার যাতনা, 

সহ্য করো, সহ্য করো ভাই,

দাঁতে দাঁত চিপে, জিভ কামড়ে 

সব সহ্য করেই

মতামতের চাকে ঢিল মারো, 

দেখোই না,

মধু মেলে কি না মেলে।

Thursday, June 1, 2023

চাহনি | পর্ব ৫ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

‘সাদা নেগেটিভ’

যখন একটা কিছু বলার আগেই, শুরু হয়ে যায় গড়াগড়ি পেড়ে হাসি, তখনই বোঝা যায় যে আলোচনার বিষয়টা কী। গল্পের আভাসে জনা দুই হাসে, আর বাকিরা অবাক হয়ে দেখে। গল্পটা আর বলাই হয় না। বাড়ি, বা ইস্কুল বন্ধু, বা পাড়ার বন্ধুদের আড্ডা মানেই তাই। একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে বড় হওয়া মানেই, সময়ের সিন্দুকে জমে থাকা হাসির রসদ। আমাদের দু-বোনের চাল চলনে মিলের থেকে অমিলটাই বেশি। কিন্তু এই এক ব্যাপারে দুজনেই সেই “ঘাড় কেন কাত?/ আরে, আমরা যে এক জাত!” এখানেই অব্যর্থ দুজনের সেই দুষ্টুমি ভরা চাহনি, যা আজ এই বাষট্টি এবং পঁয়ষট্টি পার করেও একেবারে এক এবং অবিকল। 

এ বয়সে তো বেশিরভাগ জমায়েত মানেই শ্রাদ্ধ বা স্মরণ সভা; আর না হয়তো  বা দিন পনের, কী মাস খানেক কাটিয়ে ছেলে মেয়েরা বিদেশে ফিরে যাবার আগে, একবার গণ দেখা করে নেওয়া। ফলে মন খারাপের ভাগটাই উপচে থাকে। সেখানেও দেখলাম প্রৌঢ়ত্ব পার করে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেও দু-বোনের সেই ফক্কড়িও হেসে কুটিপাটি হওয়ায় কোনও ব্যতিক্রম হল না। কেউ হয়তো গমগমে গলায় গান ধরে, গেয়েই চলেছে; থামার নামটি নেই, বোন ওমনি আমার দিকে স্থির তাকিয়ে, টুক করে ভ্রূ নাচিয়ে দেবে, আর আমিও কুল কুল করে হাসতে শুরু করব। এই যে মস্করা চাহনি এর যেন শেষ নেই। সেটা যে কোন চরমে যেতে পারে তা সেদিন বুঝলাম। মাস দুয়েক আগে আমার একটা সার্জারি হয়েছে, আর বোন ছাড়া পেয়েছে সদ্য। আমার হাঁটু এবং ওর পেট সব নড়ে চড়ে গেছে; কাছের মানুষদের আতুপুতু এবং তয় তপ্পনের শেষ নেই। তার মধ্যে শুরু হল চমকদার ঈশারা এবং গড়াগড়ি পেড়ে হাসি। ভারি বয়স, ভারি শরীর সঙ্গে নানা রকমের মনভার; কোথায় কী! হেসেই চলেছি। আমাদের ছেলে মেয়েদুটোরও এ সব প্রসঙ্গ শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ; ওদের তেমন হাসিও তাই পায় না। কিন্তু আমরা দুর্নিবার গতিতে এমন হাসছি, যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েই চলেছে। 

আর এও তো আশ্চর্য যে, সেই এক ঘনত্বের হাসি এবং একইরকম ইশারা। সেদিন খুবই গুরুগম্ভীর এক স্মরণ সভায় দুজনে গিয়েছি। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। সকলেরই মন ভার এবং বিশিষ্ট সঙ্গে সকলেই মার্জিত আচরণে বদ্ধপরিকর। তো একজন দেরিতে ঢোকায়, দরজা খুলতেই তাঁকে দেখা গেল, পূর্ণ আলোয়। আপাদমস্তক সাদা পোশাক এবং কলপহীন সাদায় মুখ মুন্ডল ঘেরায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, পরচুল মাথায় বিশেষ কোনও নাটকের চরিত্র যেন। ছায়াছন্ন অন্ধকারেও, পাশে বসে থাকা বোনের ঈশারাটি যেন কান দিয়েই দেখতে পালাম। দেখতে পেলাম, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তার হাসি চাপার চেষ্টা। সেই সংক্রমণে আমিও তখন ফুলে, ফেঁপে, দুলে একশা। ওই মানুষটিকে দেখে যত না হাসি পেয়েছিল, তার থেকে ঢের গুণ হাসি এল বোনের চোখ আর ভ্রূর ইশারায়; পাশাপাশি বসায়; কনুইয়ের গুঁতোগুঁতিতে। আমার কপট শাসন ওকে যেন আরও হাসাচ্ছে। এই যে দুজনের চাহনির ক্রশ কানেকশন– আসলে আমার কপট  শাসন যেন ওর অন্তহীন মস্করার প্রশ্রয়, এর কোনও ব্যখ্যা আছে! গপ্পোও কিছু নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে দেখা মানুষটা আজ যখন হাসি উস্কে দিলেন, তখন  তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা তাতে হাসি, তাঁকে আগেও যতবার দেখেছি তাতে হাসি; তাঁর এতদিনকার চলন, বলন, সাজ, গড়ন সব মুছে গিয়ে, ততক্ষনাৎ ফিস্ফিসিয়ে তাঁর  নতুন নামকরণ  হল– ‘এতো পুরো উল্টো নেগেটিভ রে– কালোর বদলে সবটাই সাদা’।

বুড়ো বয়সে অনেক কিছুর মতোই আর যা যা চেপে রাখা যায় না– তা হল চাহনি এবং কুলকুল করে বন্যার মতো হাসি।




আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৪ | মন্দার মুখোপাধ্যায়