Wednesday, December 16, 2020

কালীঘাটের মেয়ে পরিণীতা

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়: তখনও বেশি রাত হয়নি। দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে ফিরছি। আমরা জনা চারেক। একটা ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম। এখানে বেশ ভিড়। তবে বাইরে খোলা আকাশের নীচে চেয়ার-টেবিল পেতে বেশ গুছিয়ে রেখেছে ধাবা মালিক। চারটে চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা গল্পগুজব করছি। আমাদের লাগোয়া টেবিলে এক দম্পতি বসে। সঙ্গে আট-দশ বছরের একটি কন্যা। সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষ করি কন্যাটির মা আমার দিকে তাকাচ্ছে– যেন কিছু বলতে চায়! আমারও চোখটা ক্ষণে ক্ষণেই সেই মহিলার দিকে অজান্তে চলে যাচ্ছে। বলতে গেলে একটু অস্বস্তিই হচ্ছে। এইভাবে চলে কিছুকাল। তারপর ওই ভদ্রলোক ধাবার ভিতরে ঢোকে, হয়তো কিছু নতুন অর্ডার করতে, তখন হঠাৎই সেই মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বোঝার আগেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, ‘স্যার ভালো আছেন?’ আমি তো যাকে বলে হতভম্ব! কে এই মেয়ে, কীভাবেই বা আমি তার স্যার হলাম তা কোনও অনুমানেই বুঝতে পারছি না। কোনও ভাবেই মেলাতে পারছি না। একবার মনে হল, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের ছাত্রী ছিল কিনা। তা-ও হতে পারে না। কেননা গত দশ বছর যে সব ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি তাদের প্রত্যেকের মনে আছে– যাদের আমি নামে চিনি। এখনও আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হইনি। তবে কে এই ছাত্রী?

এরপর আমার অবস্থা মালুম পেয়ে মেয়েটি বলে, ‘চিনতে পারছেন না স্যার? আমার নাম নীতা। আপনি আমাকে পরিণীতা বলে ডাকতেন– কালীঘাট। এই ‘কালীঘাট’ শব্দটির সঙ্গে যেন কয়েক কোটি ক্যালেন্ডারের পাতা আমার চোখের সামনে ঝরে পড়ল। আমি যেন ফিরে গেলাম সাতাশ-আঠাশ বছর পিছনে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার উপান্তে। বস্তি সংগঠনের এক নেতা সেই সময় আমাকে পটিয়ে ফেলেন যে, সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, যারা সমাজে পিছিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাদের জন্য কাজ করার লোক নেই। তো কী সেই কাজ? ঠিক হল কালীঘাটের নিষিদ্ধ পল্লিতে যে শিশু-কিশোররা আছে তাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এদের মধ্যে কিছু ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় বটে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। এদের উৎসাহিত করতে হবে। আমার সেই বয়সে এমন ধরনের কাজে নিযুক্ত হওয়াকে বেশ গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। সপ্তাহে দুদিন পড়াতে হবে। ফলে তেমন কোনও চাপ নেই ভেবে শুরু করে দিলাম।

চাপ কি আর ছিল না? টালিনালার ধারে যাকে বলা যায় আদি গঙ্গা, তার দূষিত জলে, পচা গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে, একটা চালাঘরের মাটির দাওয়ায় প্রাথমিক ভাবে প্রায় জনা আটেক বাচ্চাকে নিয়ে আমার ক্লাস শুরু হল। চারদিকে মাছি ভন ভন করছে। দুর্গন্ধে প্রথম প্রথম বমি পেত। চারদিকের আবহ যাকে বলে মদোমাতাল আর কাঁচা খিস্তির বন্যায় রচিত হয়েছে। এখানে কেউ সোজা বা যাকে বলে সাধারণ ভাষায় কথা বলে না। সবাই উদমার্গের খিস্তি সম্বলিত ভাষাতেই অভ্যস্ত। এমনকী বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে সেই একই ভাষায় কথা বলছে বড়োরা। প্রথম দিকে মনে হত এসব বন্ধ করতে হবে। মাথা গরম হয়ে যেত। কিন্তু ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যাই। সেই দাদা নেতাটি আমায় বুঝিয়েছিলেন, ‘আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার তাবৎ পরিবেশ পালটানো তোমার কাজ নয়। আর তা পারবেও না। আমরা যদি এই বাচ্চাগুলোকে একটু লেখাপড়া শেখতে পারি তো জানবে বিরাট কাজ করা গেল।’ কথাটার যৌক্তিকতা আমার মনে ধরেছিল। ফলে বছর খানেক টানা টালিনালার পাশে এইসব বাচ্চাকাচ্চাদের পড়িয়ে গেছি। এদের লোক না হয়েও। কোথাও পুলিশ ঝামেলা করছে, কোনও খদ্দের মদ খেয়ে এসে হুজ্জুতি করছে, কার পালিয়ে যাওয়া বর এসে হুজ্জুতি করছে তার গতর খাটিয়ে বউ-এর কাছে, কে কাকে মারল ধরল, সব কিছুর মধ্যে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকলাম। কিন্তু আমার মূল কাজ ছিল সপ্তাহে দুদিন এই তথাকথিত বাপহারা ছেলে মেয়েদের পড়ানো। ‘বাপহারা’ কথাটা লিখলাম এই কারণে যে, প্রায় প্রত্যেকটি ছেলে মেয়ে জানে না বা তাদের জানানো হয় না যে কে তার বাবা, কী তার নাম। কখনও কখনও মায়েরা মিথ্যে নাম বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে যখন এরা স্কুলে ভরতি হতে গেছে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব সময়েই বাপের নামটাই প্রধানত গ্রাহ্য করা হয়, ফলে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। আর তখন তো আইন-কানুনও এখনকার মতো হয়নি।

এখানে এইসব শিশুকিশোরদের পড়াতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, বিশেষ করে এই স্কুলে ভরতি করার সময়। আজকে প্রচুর না হলেও অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকলেও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এদের জন্য লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে। সে-সময় এই ধরনের কিছু সংগঠন থাকলেও তা যে খুব উচ্চকিত ছিল তা নয়। হয়তো সম্ভবও ছিল না। সে যাই হোক, এই ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার মধ্যে ধরে রাখাই ছিল একটা বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ। কেননা মায়ের খদ্দের এলে তার মদটা, সিগারেটটা, খাবার-দারারটা নিয়ে এলেই কাঁচা পয়সা পাওয়া যায়। আর ওদের পড়াশোনা করার সময় ছিল সন্ধেবেলা। সে সময় তো এই অঞ্চল গমগম করছে।তখন কি আর পড়াশোনায় মন বসে! এদের মধ্যে অনেকেই ছিল লেখাপড়ায় বেশ ভালো, চটপট বুঝতে পারতো। কেউ কেউ একটু পিছিয়ে থাকা। তার করণটাও সহজেই বুঝে ফেলি। যে অবহেলায় ও মানসিক নিপীড়নের মধ্যে এরা জন্মায়, বড়ো হয়ে ওঠে– তাতে এই ধরণের সমস্যা খুব স্বাভাবিক। যেমন, আগেই বলেছি যে, একমাত্র মা-ই এদের ভরসা। তথাপি সেই মা যে তার ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য খুব একটা কিছু করতে পারে তা নয়। নিদেন দুবেলা খাওয়াও অনেকের জোটে না। তারপর আছে রোগভোগ। আপাতত ফিরে যাই সেই কালীঘাট থেকে উঠে আসা নীতার সঙ্গে দেখা হওয়া প্রসঙ্গে।

কালীঘাট শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার পর যথারীতি আমি নীতাকে চিনতে পারি। বলি, ‘কেমন আছিস মা?’ বেশ গর্বের সঙ্গে সে বলে, ‘খুব ভালো আছি স্যার।’ মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ‘এই আমার মেয়ে, আর ওই উনি হলেন আমার স্বামী।’ ইতিমধ্যে নীতার স্বামী ধাবা থেকে বেরিয়ে আসে। নীতা বলে, ‘ইনি, সেই স্যার, আমাদের কালীঘাটে পাড়াতেন।’ বুঝলাম, ছেলেটি আমার নাম পর্যন্ত জানে। স্বামী হাত মুখ ধুতে গেলে নীতাকে জিজ্ঞেস করি, ‘হ্যাঁ রে, পড়াশোনা কতটা করতে পড়েছিলি?’ নীতা এক গাল হেসে বলে ‘হায়ার সেকেন্ডারি অব্দি কিন্তু তারপর আর হল না। সংসার, মেয়ে সব সামলে আর পড়া হয়নি।’ ক্রমে সে চাপা গলায় শুরু করল তার জীবনবৃন্তান্ত। এই ছেলেটি নাকি ছিল তার মায়ের খদ্দের, প্রায়ই আসত। বয়সে প্রায় পনের বছরের বড়। সে-ই নাকি তার মাকে বুঝিয়ে নীতাকে বিয়ে করে। পাইপের ব্যবসা করে। আজ তার ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে; বোঝা গেল সঙ্গের গাড়িটা দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর মা-র খবর কী?’ নীতা ছলছলে চোখে জানায়,’কঠিন ব্যাধিতে মারা গেছে।’ শেষ বয়সে আমার কাছেই থাকত। আর কটা দিন আগে মাকে নিজের কাছে নিয়ে এলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম।’ এ তো প্রায় হিন্দি ছবির মিলানন্তক কাহিনি। তা হোক, আমায় কেন জানি একটা তৃপ্তির হাওয়া ছুঁয়ে গেল। ওরা পয়সা মিটিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি খনিকক্ষণ স্মৃতির মেঘের মধ্যে যেন ডুবে গেলাম। এই রকম তো আরও ছাত্রছাত্রীরা ছিল। তাদের কী হল? তাদের সঙ্গে কখনও কি দেখা হয়ে যাবে! আজও তার অপেক্ষায়ই আছি।

Sunday, December 6, 2020

ল্যান্ডরে, রাস্কিন বন্ডের আইভি কটেজে


শিবু মণ্ডল: একটা শৈলশহর থেকে পর্যটক যখন অন্য শৈলশহরে যায় তখন তার কাছে দুটো অপশন থাকে– হয়তো সে কিছুটা উষ্ণতা রেখে যাবে নয়তো কিছুটা বাড়তি উষ্ণতা নিয়ে যাবে। এর আগে মুসৌরি তিনবার গিয়েছি কিন্তু ভালো লাগেনি। কেন যে শুধু শুধু দার্জিলিঙের তুলনা চলে আসত। ঘরের শহর বলেই কিনা, কে জানে! মাঝে ঋতুর ব্যবধান না থাকলেও, স্মৃতির ব্যবধান থেকে যায়। এই পার্থক্য একটা দূরত্ব তৈরি করেছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু এবার মুসৌরি এলাম নিজে ড্রাইভ করে। মনে হল যেন স্বপ্নে দেখা এক নৌকো চালিয়ে স্মৃতির স্রোতে ভেসে ভেসে চলে এলাম। গাড়িটি কেনার পর থেকে তাকে নৌকো ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। আর যে কোনো ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার স্মৃতিকে স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়। কেনো যে এমন মনে হয় জানি না! তবে আমার ঠাকুরদার একটা ছোটো ডিঙি নৌকা ছিল দেশের বাড়িতে- ঠাকুরমার মুখে শুনি। ঠাকুরদাকে আমি দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে কল্পনায় আসে একটি নদীঘেরা গ্রাম। বর্ষাকালে উঠানে হাঁটুজল। দাদু নৌকোয় বসে মাছ ধরে। ‘ইচ্ছা হইলে ঢাকা শহরে কামে যাইত। ইচ্ছা হইলে যাইত না- নাও নিয়া বাইরইয়া পড়ত।’- কথাগুলো বলার সুরে বিরক্তি ঝরে পড়লেও দীর্ঘশ্বাস লুকোতে পারে না আমার ঠাকুমা। আচ্ছা দাদু কি মৃত্যুর পরেও নৌকো চালান? যদি তাই হয় তবে তো সে নৌকো নিয়ে সব জায়গায় যেতে পারবেন। পাহাড়েও! আমিও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি নৌকো নিয়ে হিমালয়ে চলে গেছি ঈশ্বরের খোঁজে।

রাস্কিন বন্ডের সঙ্গে দেখা হতে পারে এই ভেবেই হোটেল নিয়েছিলাম ল্যান্ডরের কাছাকাছি। যে পাহাড়ে আমাদের হোটেল তার উল্টোদিকের পাহাড়ের শিরদাঁড়ার একপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে সেই আইভি কটেজ। নেট ঘেঁটে আগেই সেই ঠিকানা জেনে নিয়েছিলাম। এত জনপ্রিয় ও ভালবাসার সৃষ্টিকর্তা যে আমার ঘরের কোণেই চুপটি করে বসে আছেন ভাবতে অবাকই লাগে। হরিদ্বার থেকে মুসৌরির দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিমি। আর মুসৌরি থেকে ৮ কিমি পুব দিকে গেলেই তার যমজ শহর ল্যান্ডোর। সেদিন পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকাল নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে সবাই। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেও গেলাম আইভি কটেজের সামনে। নৌকার গলুইয়ের মতো বাড়িটির দুপাশে দুটি রাস্তা উঠে গেছে লালটিব্বা ভিউ পয়েন্টে। কিন্তু বাড়ি কোথায়? এ তো একটি তিব্বতি সরাইখানা। নাম ডোমা’স ইন! দেয়ালে তিব্বতি সংস্কৃতি ও বৌদ্ধধর্মের নানা রংবেরঙের চিত্রকলা অঙ্কিত বাড়িটি অনেক দূর থেকেই নজর কাড়ে। ডোমাস ইনের পিছনেই সাদা চুনকাম করা ছিমছাম একটি তিনতলা বাড়ি। জানালার বর্ডার ও টিনেরছাদ মেরুন রঙে রাঙানো। বাড়িটির অন্য পাশ দিয়ে রাস্তা থেকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে সরু একটি সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।

জানা ছিল মুসৌরির ম্যাল রোডের কেমব্রিজ বইয়ের দোকানে প্রতি শনিবার বিকেল ৪ টে থেকে ৬ টা পর্যন্ত রাস্কিন বন্ড পাঠক ও টুরিস্টদের সঙ্গে সময় কাটান। উৎসুক ও মুগ্ধ পাঠকেরা তাঁর অটোগ্রাফ নেয়, তাঁর সাঙ্গে ছবি তুলে ঈশ্বর দেখার মতো আনন্দ পায়। শৈশব ও কৈশোর থেকেই যার গল্প পড়ার পর চারপাশের চেনাজানা জীবন ও চরিত্রগুলিও যেন সেই গল্পের মতো লাগতে শুরু করে। চারপাশের অকিঞ্চিৎকর মানুষের জীবনও কত সুন্দর, কত মায়াময় হয়ে ওঠে তাঁর বই পড়ার পরে। মুসৌরি ও দেরাদুন হয়ে ওঠে পাঠকের স্বর্গ ও স্বর্গের দ্বার। এমনই সুন্দর ও সহজ অথচ কত গভীর শব্দ দিয়ে গড়া তাঁর সাহিত্যের জগৎ! এমন এক ধ্রুপদী লেখকের সান্নিধ্য পেয়ে পাঠকেরা আত্মহারা হবেন এটাই স্বাভাবিক। মনে পড়ে যেদিন পৌঁছলাম দিনটি ছিল রবিবার। সন্ধেবেলা ম্যাল রোডে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলাম দোকানটি। সামনে বড় একটি ব্যানারে রাস্কিন বন্ডের ছবি। দোকানটির যে র‍্যাকে তাকাই শুধু রাস্কিন বন্ডের বই। সর্বাগ্রে জ্বলজ্বল করছে রাস্কিন বন্ডের আত্মজীবনী ‘Lone Fox Dancing’! এক বছর আগেই বেরিয়েছে। এদিকে শিখা আগামীকাল আমার জন্মদিনের জন্য একটি পছন্দসই গিফট খুঁজছিল। বইটি দেখেই বললাম এটি আমায় গিফট দেবে? দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম লেখকের অটোগ্রাফ পেতে পারি কিনা। দোকানদারের বই বিক্রি দিয়ে কথা। অটোগ্রাফ তো উনি বিক্রি করেন না। তবু সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন কাল একবার ওনার বাড়ি চলে যান বইটি নিয়ে অটোগ্রাফ পেয়ে যাবেন। মনে মনে ভাবছি, ওনার মতো লেখক কি বিনা অ্যাপেয়ন্টমেন্টে দেখা করবেন? তাও আবার আমার সঙ্গে? আচ্ছা ওনার ফোন নম্বরটা দিন না! দোকান মালিক ফোন নম্বর দিতে চাইছেন না। বলল ফোন করার দরকার নেই উনি এমনিই দেখা করেন। সকালের দিকে চলে যাবেন। শেষে জোরাজুরি করাতে একটি ল্যান্ডফোনের নম্বর দিলেন।

সিঁড়ির বাইশটি ধাপ উত্তরণের পর যে ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালাম তার দরজায় কাঠের ফলকে লেখা রাস্কিন বন্ড, নিচে রাকেশ, বীণা। বিগত চল্লিশ বছর ধরে এই বাড়িতেই থাকেন রাস্কিন বন্ড তাঁর পরিবারের সঙ্গে! রাস্কিনের জন্ম হিমাচলের কসৌলিতে হলেও প্রায় ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেরাদুন ও মুসৌরিতেই কাটিয়েছেন। যদিও যৌবনের প্রথমদিকে ভাগ্যসন্ধানে বছর তিনেক ইংল্যান্ডে ও পড়ে ফিরে এসে চাকুরিসূত্রে দিল্লীতে চার বছর কাটান। শেষে চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে সমস্তরকম উচ্চাশা ত্যাগ করে শুধু লেখালেখিকেই আঁকড়ে ধরতে চাইলেন। সব ছেড়ে পালিয়ে গেলেন হিমালয়ের নির্জনতায়। ১৯৬৩ থেকে পাকাপাকি ভাবে থেকে গেলেন মুসৌরিতে। সঙ্গী শুধু এক বালক, প্রকৃতির নির্জনতা আর সেই নির্জনতা ভঙ্গকারী টাইপরাইটারের শব্দ! সবুজ দরজাটির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছি ডোরবেল বাজাবো কিনা। ৮৫ বছরের রাস্টি হয়তো তার ছাদের ঘরে বসে কোনও গল্পের প্লট ভাবছেন। অথবা অতীতের স্মৃতিচারণায় মগ্ন। আবার ডোরবেলের কর্কশ শব্দে তার মগ্নতা ভেঙে না-যায়! যদি বিরক্ত বোধ করেন? 

সেই ভেবেই স্ত্রী শিখা ও আমাদের দুই সন্তানকে সঙ্গে আনিনি। ওদের নীচের রেস্টুরেন্টে অপেক্ষায় রেখে এসেছি। ডোরবেল না বাজিয়ে দরজায় কান পাতি যদি তাঁর টাইপরাইটারের খটাখট শব্দে কোনও গল্পকথা ভেসে আসে। না তাও আসছে না। নার্ভাস আঙুলে আলতো করে দরজায় টোকা দিলাম। কেউ শুনতে পেল কি? না। মৃদু আওয়াজে ডাকলাম মিঃ বন্ড বাড়ি আছেন? মিঃ বন্ড শুনতে পাচ্ছেন! আমি একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই! না কেউ শুনতে পেল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাইশটি ধাপ গুনে গুনে আবার নিচে নেমে এলাম। এবার হয়তো আর সাক্ষাৎ হল না। মোবাইল বের করে রাস্তা থেকে বাড়িটির কয়েকটি ছবি তুলে রেস্টুরেন্টের দিকে ফিরছি এমন সময় দেখি একজন বাড়িটির দিকে আসছে। লোকটি কি এই বাড়ির কেউ? নাকি কোনও কাজে এসেছে? জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম তিনি স্থানীয় পৌরসভার সাফাই কর্মচারী। বাড়ি বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করা ও সাফাই করা তার কাজ। রাস্কিনের বাড়িতেই যাছে সাফাইয়ের কাজে। এই তো সুযোগ। লোকটিকে অনুরোধ করে যদি বাড়ির কারোর সঙ্গে কথা বলা যায়। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম লোকটি মদের নেশায় একটু মাতাল হয়ে আছে। গুরুত্ব দিয়ে তার নামধাম সাকিন ঠিকানা জানতে চাইতেই রাস্তার ধারে নিয়ে আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। নাম মুকেশ। আদতে বিহারের বাসিন্দা। তবে ছোটবেলাতেই কাকার সঙ্গে মুকেশ চলে আসে মুসৌরি রোজগারের উদ্যেশ্যে। তারপর এখানেই সংসার পেতে ছোটো একটি ভাড়াবাড়িতে বাস করছে। ছোটখাটো কালো দেখতে মুকেশের চেহারায় বেশ একটা পরিপাটির ছাপ আছে। ব্যাকব্রাশ করা চুলে তেলের গাঢ়তা চিকচিক করছে। তবে পরনের সবুজ টিশার্টটি ওদের ইউনিফর্ম। শেষে ওর কাজের কথা ভুলে আমাকে রাস্কিনের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য যেন পণ করে বসল। 

আমাকে নিয়ে গেল বাড়িটির নিচের তলায় একটি অপ্রচলিত ছোটো দরজার কাছে। সেখানে ডোরবেল টিপতেই যে লম্বা মতন তরুণ বেরিয়ে এলেন দেখে তাঁকে রাকেশ বলেই মনে হল। আমার আসার কারণটি জানতে চাইল। তারপর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলল‘রাস্কিন তো এখন বাড়ি নেই।’ আমি বুঝতে পারলাম একজন সাধারণ দর্শন প্রার্থীকে এড়িয়ে যাবার সবচেয়ে সহজ পন্থাটিই আমার উপরে প্রয়োগ করেছেন তিনি। তাঁকে অনুরোধ করে বললাম যে ওঁনার একটি অটোগ্রাফ নিয়েই চলে যাবো। সে বলল ঠিক আছে আমাকে বইটি দিন আমি অটোগ্রাফ নিয়ে আসছি। ‘মিঃ রাকেশ বহুদূর থেকে এসেছি আমি শুধু ঈশ্বরতুল্য প্রিয় লেখকটিকে একবার নিজের চোখে দেখব বলে। বাংলা থেকে এসেছি কাল। আগামীকাল চলে যাবো হরিদ্বার। বাড়ির দোরগোড়ায় এসেও যদি দেখা না করে ফিরে যাই খুবই মনখারাপ হয়ে যাবে।’ অগত্যা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে একটি ইমোশনাল পরিবেশ সৃষ্টি করতেই হল। মুহূর্তক্ষণ চেয়ে থেকে সে বলল আচ্ছা দাঁড়ান, আমি একবার জিজ্ঞেস করে আসছি। কিছুক্ষণ বাদেই রাকেশ এসে বলল ‘বাইরের সিঁড়িটি দিয়েই দোতলার ঘরে চলে আসুন। তবে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেবেন না।’ আহ্‌! কি স্বস্তি যে পেলাম।

অতি সাধারণ অপরিসর এক ড্রয়িং রুম থেকে একটি কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে তিনতলায়। সিঁড়ির নিচে একপাশে একটি ছোটো আলমারি ভর্তি বই। দুয়েকটি ছোটো টেবিলেও বই ও পত্রপত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আলমারিটির উপরে একপাশে বাগ্‌দেবীর ছবি, পাথরের একটি বুদ্ধমূর্তি, তারপর ভগবান বালাজির ছবি, আর পিছনের দেওয়ালে পূর্ণিমা রাতে নৃত্যরত একটি লাল রঙের পাহাড়ি শিয়ালের অপূর্ব ছবি। আর আলমারির সামনে একটি সোফায় যিনি বসে আছেন তিনি ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের সম্রাট রাস্কিন বন্ড। অনেক পাঠকের কাছেই তিনি দেবতা স্বরূপ। তবে আমার মনে হল দেবতা নন যেন একটি দেবশিশু বসে আছেন। জামনগর এস্টেটের গৃহশিক্ষকের সেই চার-পাঁচ বছরের দুষ্টু, গোঁয়ার শিশু সন্তানটি যার মনে চারপাশের সম্বন্ধে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন ছিল সেই শিশুটিই বিগত ৭০ বছর ধরে একের পর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি করে গেছেন। বিস্ময় তাঁর গল্পের মধ্যে নয়, কাহিনির মধ্যে নয়, বিস্ময় তাঁর গল্প বলার ভাষায়, তার সহজতায়। আজ তাঁর মনে আর সেই জিজ্ঞাসা নেই তার মানে এই নয় যে ফুরিয়ে গেছে। ছোটো চঞ্চল একটি পাহাড়ি ঝরনা ৮৫ বছর ধরে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বইতে বইতে যেন এক সাগরে এসে নিজেই সাগরে পরিণত হয়ে গেছে। সেই গভীরতা সেই তরঙ্গের ঘাত আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারব না। তাঁর সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা সেই ঘাত প্রতিঘাত অনুভব করি। একটি অতি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর জীবনেরও যে সব মানবিক অনুভূতি- বেদনা, বাসনা, দ্বিধা,দ্বন্দ্ব,কিছু হারিয়ে ফেলবার ভয়, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা সব, সব এই মহাজীবনের হৃদয়ে, তাঁর দেখার মধ্যে, তাঁর লেখার মধ্যে সমাহিত হয়ে আছে। শুধু অনুভবি পাঠকই নন, অতি সাধারণ পাঠকও সেই অনুভূতির তরঙ্গকে তার গভীরতাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে। 

-ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

-আসলে সে সম্পর্কে আমি ভাবিনি কখনও। 

যে সারাজীবন ধরে ছোটো, বড়, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে শুধু মানুষের জীবনকে দেখে গেছে, তাদের হৃদয়ের কথাগুলি ভেবেছেন তাঁর আর ঈশ্বরের কথা ভাববার প্রয়োজন কী!

লেখা প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলি। সেদিন আমার সাত বছরের কন্যা সৃজা পাশের আবাসনের তার সমবয়সি একটি বাচ্চার সঙ্গে ক্লে দিয়ে মূর্তি বানিয়ে খেলছিল। বাচ্চাটি একটি চারহাতওয়ালা গণেশের মূর্তি বানাতেই সৃজা প্রশ্ন করল চার হাত কেন ওঁর? বালিকাটি বলল গনেণেশজি ভগবান, তাই ওঁর চারটি হাত। উত্তরে সৃজা সন্তুষ্ট হতে পারল না। সে তার খেলার সঙ্গীটিকে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল যে-- ভেবে দেখ ভগবান নিজে যেমন হবে সে মানুষকেও তো ঠিক তেমনই বানাবে। তাহলে মানুষের দুটি হাত হলে ভগবানের চারটি হাত কেমন করে হতে পারে?

কথাটি ভীষণভাবে আমাকে ছুঁয়ে গেল। আর এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আজ রাস্কিনের সেই মতামতটির সারমর্ম আমি টের পাচ্ছি।

খুব সাধারণ কথাবার্তাও হয়েছিল আমাদের মধ্যে সেদিন। সাহিত্য নিয়ে। আমি যে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে একটু আধটু চর্চা করি সেটা জানতেই রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এলো। নিজেই জানালেন তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে রবিঠাকুর অন্যতম। ইংরেজি অনুবাদে তিনি পড়েছেন রবীন্দ্র সাহিত্য। চাকুরীসূত্রে হরিদ্বারে থাকি জেনে হরিদ্বারের প্রসঙ্গও এলো। বিশেষ করে এখানকার ফরেস্ট ও লেপার্ডের কথা। তবে তিনি যে লেপার্ডের কথা বলেছিল সেগুলি নিশ্চয়ই একপ্রকার নিরীহ ও মানুষের প্রতি অহিংস ভাব পোষণ করতো। অনেকটা তাঁর গল্পের মতো। কিন্তু আমাদের এই সাক্ষাৎকারের ছয়মাস পরেই আমার সেই ভুল ভেঙে যাবে। আমাদের ভেলের আবাসিক এলাকার মধ্যেই যখন দু’দুটি মানুষ লেপার্ডের আক্রমণে শুধু ক্ষতবিক্ষতই হবে না, অভাবনীয় ভাবে তারা সেই লেপার্ডটির শিকারে পরিণত হবে। আর আবাসিকদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী সেই চিতাটি (একটি না হয়ে দুটি ঘটনায় দুটি ভিন্ন ভিন্ন চিতাও হতে পারে) উত্তরাখণ্ড সরকার দ্বারা মানুষখেকো উপাধিতে ভূষিত হবে এবং মাস চারেকের মধ্যেই বনবিভাগের দ্বারা ভাড়া করা শিকারির গুলিতে সেটির মৃত্যু হবে। যাইহোক এই বন ও বন্যজন্তুদের প্রতি তাঁর অকৃত্তিম সনহানুভুতির কথাও আমরা পড়েছি। 

আধুনিক উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে হরিদ্বার-দেরাদুন-মুসৌরির কত কত বনাঞ্চল পাকাপাকি ভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে আমরা জানি। রাস্কিন কিন্তু সেই উন্নয়ন মেনে নিতে পারেননি। নতুন নতুন রাস্তাঘাট ও নানা পরিযোজনার জন্য যে লক্ষ লক্ষ গাছ কাটা গেছে, যেসব হাজার হাজার পাখি ও বন্যজন্তুরা গৃহহারা হয়েছে তাদের কান্না, হাহাকার রাস্কিনের লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। আজও তাঁর নিশ্চল (নাকি ছলছল) চোখদুটি মনে করে বুঝতে পারছি সে কতটা বেদনার্ত হয়ে পড়েছিল সেই হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলি মনে করে। যতই সে বলুক যে এই দীর্ঘ জীবনের প্রতি তাঁর কোনও অভিযোগ নেই তবুও আমার বারবার মনে হয় এই বন, এই পাহাড়, তার ঝরনা, এখানকার পশুপাখি, সঞ্চরণশীলমেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশা-ছায়া-রোদ প্রকৃতির এইসব কিছুই এখানকার মানুষের মতই তাঁর জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আর এই অংশে যখন যখন লোভী সমাজ তার করাল হাত বাড়িয়েছে তখনই সে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কাটা পড়া গাছেদের কান্না, বাসাহীন পাখিদের ছটফটানি, গৃহহীন পশুদের ভয়ার্ত চাহনি, কুয়াশার চলমানহীনতা, রোদের পাগলামি, ছায়ার অন্ধকার আর বৃষ্টির প্রতিশোধ তার লেখার চরিত্র হয়ে উঠেছে। গোঁয়ার রাস্টিও যেন প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে এই নোংরা ও বদ উপায়ে প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী সমাজের প্রতি। 

সেই জন্যই কি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ও বেস্টসেলার লেখক হয়েও টাইপরাইটার থেকে কম্পিউটারে, ল্যান্ডফোন থেকে মোবাইলে (স্মার্ট ফোনের তো কথাই নেই) আর হাত বাড়াননি তিনি? মাত্র সতেরো বছর বয়সে যে ছেলেটি ভাগ্য সন্ধানে বিলেতে গেল, উন্নত ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে তিন বছর পরে সে একপ্রকার পালিয়ে এল নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে। তারপরে আবার মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সেই দিল্লির সম্পন্ন চাকরি ছেড়ে দিলেন পাকাপাকিভাবে। আশ্রয় নিলেন পাইন, ওক, স্প্রুস, ম্যাপল বনে ঘেরা মুসৌরির একটি নির্জন কটেজে (১৯৬৩ সাল নাগাদ যখন রাস্কিন পাকাপাকিভাবে মুসৌরিতে থাকতে এনেল তখন ম্যাপলউড কটেজের একটি রুমেই প্রথম ভাড়া থাকতেন)। এহেন রাস্কিন বন্ডকে ভারতের ভূমিপুত্র বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা কিংবা সংকোচ নেই। অথচ তাঁকেই ভিন্ন ধর্মের ও বিদেশি বিচার করে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, কোণার্কে বিদেশিদের জন্য ধার্য অতিরিক্ত প্রবেশ শুল্ক আদায় করে তবেই দর্শন করতে দেওয়া হয়। হায় রে আমার ভারতবর্ষ!

সেই জন্মদিনটিতে যে আবেশ নিয়ে ফিরেছিলাম তার সুগন্ধ সারাজীবন আমাকে সুবাসিত করে রাখবে। একটা স্বপ্ন থেকে ছবি,সেই ছবি থেকে বৃষ্টি! ঘর ভেসে যায়। ভেসে যাচ্ছে কাগজের নৌকা। আমি কি তুলে নেব? আমি কি ভেসে যাবো এতে আরোহণ করে আরও উপরের দিকে? নাকি এখান থেকেই নামতে শুরু করবো ঘরের দিকে! একটা সংক্ষিপ্ত অথচ মহাবিস্ফোরণকারী আলাপ থেকে আমি হাঁটা শুরু করি একলা নিঃসঙ্গ পথে। এর আগে তিন তিনটি সফরেও যে শহর আমার কাছে রুক্ষ হয়ে ছিল। আমার অতীত গল্পের কাছে ধূসর প্রতীতি হয়ে ছিলো সে শহরের এক গোপন সুড়ঙ্গ আমি খুঁজে পেয়েছি। যার মাধ্যমে সেই অতীতের সাথে যোগসূত্র গড়ে তুলতে পারি। এদিকে ঝরনার পাগলামি এসে ধুয়ে মুছে দিচ্ছে এর নাগরিক কোলাহল। আমি ট্রাফিক জ্যাম থেকে মুক্ত হয়ে প্রাচীন ঘণ্টাঘরের ধ্বনির কাছে ঋণী হতে যাব এবার। ফেলে আসা প্রিয়তমা আমায় বাঁধা দিও না। এক সূর্যোদয় থেকে আরেক উদয়ের দিকে যাচ্ছি আমি। আকাশ কি খানিকটা মেঘম্লান! হোক না। ভালোবাসার মেঘ জমলে তো ভালোই। ভালোবাসায় দূরত্বও অনির্বচনীয়। শৈশব থেকে আমার মণিমাণিক্য তুলে এনে তারুণ্যকে সাজিয়ে তুলতে পারবো। রাস্কিন বন্ড নামের এক নক্ষত্র থেকে যে কিরণ আমাকে স্পর্শ করে গেল তার শিহরণ আজীবন থেকে যাবে। আর যে পাহাড় এই নক্ষত্রের আলোতে উদ্ভাসিত সেই পাহাড় যেন নতুন বর্ণে, গন্ধে খুলে যাচ্ছে তার অগুনতি ভাঁজ নিয়ে। এইতো একটা ভাঁজ খুলতেই একটি পাইন বনের টিলা। নাম পরি টিব্বা! ওটাই কি এ অঞ্চলের খাণ্ডব বন? পরিত্যক্ত পোড়া একটি গৃহের অবয়ব দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন জাতের একটি কিশর-কিশোরী সমাজে তাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি না পেয়ে চলে গেছে অভিমানে সেই নির্জন টিলার দিকে নতুন সমাজ গড়বে বলে। ওইতো শোনা যাচ্ছে ওদের গোঙানি! এটা কি ওদের মিলনের শীৎকার নাকি দহনের চিৎকার ধ্বনি!

ওই তো আরেকটা ভাঁজ খুলতে খুলতে পথের দাবিতে কাটা পড়ে যাওয়া এপ্রিলের ওক সেজে উঠছে তার নতুন পাতা নিয়ে, ম্যাপলের পাতাগুলিতে সবুজ রং ধরেছে, মধুলোভী ভ্রমরেরা আবার গান গাইছে- রডোডেনড্রন, রডোডেনড্রন...! এ মুসৌরির ছবিতো আগে কখনও দেখিনি আমি। ঘন বন তার ফাঁকফোকরে ধরে রেখেছে ফালি ফালি পূর্ণিমা আলো। ম্যাজিক, ম্যাজিক বলতে একটি একলা হয়ে যাওয়া শেয়াল নেচে উঠল! নাচছে এখনও। আমি আড়াল থেকে দেখছি আর গাছেদের ছায়া হয়ে তাকে অনুকরণ করতে করতে নিচের রাস্তা ধরে একটি বাংলো মতন বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। এটাই কি ম্যাপলউড কটেজ! তার একটি রুমের ভিতরে টাইপরাইটারটি কি আগে থেকেই সাজানো ছিল?

খটাখট খটাখট শব্দে এ শহরের যানবাহনের কর্কশ শব্দ, নাগরিক কোলাহল, সব মিলিয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাসে। 

এবার ঠিক আমি সেই নিঃসঙ্গ শেয়ালের নাচের একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে পারব। 


গতরাতে ঘরের পথে হেঁটে যেতে যেতে 

দেখলাম, একটি শেয়াল একা 

নৃত্য করছে চাঁদের আলোয়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বুঝলাম

এই রাত্রিটি একান্তই তার, তারপর  

চেনা নিচু রাস্তা ধরে নেমে গেলাম।

সকালের শিশিরের সঙ্গে যদি কখনো 

সঠিক তালে শব্দ বেজে ওঠে 

আমিও নেচে উঠি নিঃসঙ্গ শেয়ালের মতো!


(লেখকের অনুবাদে রাস্কিন বন্ডের কবিতা)

---------------------------------------------------------

রাস্কিন বন্ডের ছবি এঁকেছেন অতনু দেব