Saturday, September 23, 2023

চাহনি | পর্ব ৭ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

চক্ষুদান

চক্ষুদান কথাটার অর্থ আজকাল আমূল বদলে গেছে। সদ্যমৃতের সজীব চোখ আই ব্যাঙ্কে রেখে জীবিতকে চক্ষুষ্মান করা। এতে একজন দাতা এবং অন্যজন গ্রহীতা। আর পুরো কাজটি করেন চিকিৎসকেরা। এ এক মহতী সেবা। অন্ধ বা প্রায়ান্ধদের চোখে আলো ফোটে। আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে চক্ষুদান বলতে একমাত্র যা বোঝাতো তা হল, বিগ্রহের চোখ ফোটানো। এ কাজটি প্রথমে করতেন প্রতিমা শিল্পীরা। পরে পুজোপাঠের মধ্যে দিয়ে, সেই বিগ্রহে প্রাণ সঞ্চার করে তাকে সজল করে তুলতেন পুরোহিত। এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সকলের মনে হবে-– মা যেন চেয়ে আছেন।

বাড়ির খুব কাছেই ভটচায্যি বাড়িতে দুর্গা পুজা হতো। রথেরদিন খুঁটি পুজো করে ঘট বসত। এরপর কবে যেন মাটির ঢিবি রাখা হতো চণ্ডীমণ্ডপে; আর শুরু হয়ে যেত প্রতিমা গড়ার কাজ। একটা বাঁশের চালচিত্রে ছেলেপিলে বাহন-সহ মাদুগ্গার সংসার। প্রতিদিন ইস্কুলের পরে, বিকেলের খেলা বাদ দিয়ে আর ছুটির দিনগুলো দুপুর থেকে সেখানেই পড়ে থাকতাম। হাঁ করে দেখতাম সেই ঠাকুর গড়া। মাস খানেক ধরে সে পব্বো শেষ হলে, শুরু হতো মায়ের চক্ষুদান। তখন কিন্তু নির্জন মণ্ডপে একা সেই বুড়ো মানুষটি যিনি চোখ আঁকবেন। ভোর থেকে সবাই দেখতে পাবে মায়ের চোখ কেমন চেয়ে আছে। আমি অবশ্য অসুর এবং সিংহের চোখজোড়াও দেখতাম। সিংহের হুঙ্কার আর অসুরের ভয় দুটোই প্রকাশ পেত ওই আঁকা মণিতে। আর মায়ের চোখে যেন উৎসব। আমাদের নতুন জামা-জুতো পাওয়ার আনন্দ । মজা লাগত গণেশের কুতকুতে চোখ দেখেও। কী একটা আকর্ষণ থাকতো তাতেও। তবে কার্ত্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী-– এই তিনজনের চোখ প্রায় এক রকম। মিষ্টি মিষ্টি সেজে তাকিয়ে থাকা। 

প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে কত না প্রতিমা আর তার কী বিচিত্র সব অভিব্যক্তি! তেজ, শক্তি, প্রসন্নতা-– একেক শিল্পীর একেক রকম প্রকাশ। কিন্তু যে একটা ব্যাপারে সমতা ছিল, তা হল সবই কিন্তু প্রতিমার চোখ। এ চাহনি মানুষের দৃষ্টিতে পাইনি। এমনকি অভিনয় বা নাচেও তাঁদের প্রতিমার মতো মনে হয়; কিন্তু প্রতিমা মনে হয় না। এ চাহনি দেবীর। মনে হয় একমাত্র মূর্তিতেই ফুটে ওঠে কারণ তা স্থির। এ চোখের পলক পড়ে না।

প্রতি বছর একবার কুমোরটুলি যাই। যাই কালীঘাটের পোটো পাড়াতেও। তা ছাড়াও এ শহরের নানান আনাচ কানাচে কুমোরদের কিছু সাবেক ঘর এখনও নয় নয় করেও আছে। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা গড়ার কাজ। ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাখা মস্ত মস্ত প্রতিমা। মাটির কাজ শেষ হয়ে এবার রং এবং চক্ষুদান হবে। বেশিরভাগই বারোয়ারি পুজোর অর্ডারি ঠাকুর। শিল্পীদের জিজ্ঞাসা করি কেমন লাগে ওই চক্ষুদান পর্ব! সকলেরই প্রায় এক উত্তর– মা এসে আঁকিয়ে নেন। এই অনুভুতিটাই বোধহয় চক্ষুদানের আসল চাবি কাঠি। এবারেও যখন গেলাম, মনে হল ওই এ কোণা ও কোণা থেকেও মা যেন দেখছেন। বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তো পুতুলের, কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই তা যেন শক্তি! উৎসব।

হয়তো এ জন্যই মানুষের চেয়ে থাকায় যা চাহনি, দেবী মূর্তির ওই চেয়ে থাকা হল–- পূর্ণদৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে পলক পড়ে না। তবুও তা সতেজ এবং বাঙ্ময়।

Tuesday, September 5, 2023

অধরা গালিব ও তাঁর গজল | মহিউদ্দিন সাইফ

উর্দু শায়েরি আর গালিব যেন সমার্থক। গালিবের মনন, চিন্তন আর কল্পনা বিশ্বসাহিত্যে বিস্ময়কর। বড় কবিদের শায়েরির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল 'মানি আফ্রিনিশি' অর্থাৎ নতুন নতুন অর্থের জন্ম দেওয়া। গালিবের শায়েরি হল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমি চিরকালই গালিবের কবিতার ন্যাওটা। আর আমার উর্দু কাব্যচর্চাও শুরু হয় তাঁকে দিয়েই। যেমন ফারসি শুরু হয় মওলা রুমিকে দিয়ে। গালিবের কবিতা আমার নিজের কাব্যবোধ ও কাব্যভুবন গড়ে তুলতে এক অতুলন ভূমিকা রেখেছে। গালিব অনুবাদের কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না প্রথমে। কারণ অনুবাদে গালিব আনা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। কিন্তু তাঁর শের বা গজলের বাংলা অনুবাদ দেখে আমার আক্ষেপ হয়েছে বারবার। তখন থেকে স্বপ্ন দেখেছি যোগ্যতা অর্জন করলে, বুকের পাটা তৈরি হলে আমি নিশ্চয় একদিন গালিব অনুবাদে হাত দেব। বেশ কয়েকদিন ধরে গালিবের অনুবাদ বিষয়ে বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিপ্লবদার (কবি বিপ্লব চৌধুরী) ফোন থেকে একদিন কল এল। অরুণাভদার সঙ্গে আলাপ হতেই তিনি গালিবের অনুবাদের কথা তুললেন। আমি যেন মনে আরেকটু জোর পেলাম। তারই ফলস্বরূপ কাজে নেমে পড়া।

আমি আগেই বলেছি অনুবাদে গালিব নামানো পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি। এটা জেনেই আমি তাতে হাত দিয়েছি। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা করেছি মূলের ভাবটিকে অবিকৃত রাখার। চেষ্টা করেছি 'মানি আফ্রিনিশি'র আশ্চর্য বৈশিষ্টকে ঠিক রাখার। মূল গজলের ভঙ্গি মোতাবেক বাংলা অনুবাদে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহার করতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রচেষ্টা কতটুকু কৃতকার্য হয়েছে সেকথা রসিকজন ঠিক বলতে পারবেন। ত্রুটি দেখে করুণাবশে ক্ষমাও করবেন জানি। এখন তাহলে গালিব পড়ি!

১. 

(নক্শ ফরিয়াদি হ্যা কিস্ কি)


চিত্রগরীর খেয়ালিপনার অভিযোগ করে ছবি যে কার!

সামান্য এক কাগজ-লেবাস পরানো রয়েছে গায়ে সবার।


শুধিও না একাকীত্বের কথা, জীবনের এই দুর্বিপাক,

সন্ধে পেরিয়ে সকালকে আনা, গিরি কেটে আনা শীরের ধার।


বে-কাবু এই প্রেমের আবেগ বেড়ে গেছে দেখো এইভাবে,

তলোয়ার থেকে তীক্ষ্ণতা তার বেরিয়ে এসেছে বে-কারার।


যেভাবে পারুক বিছাক চেতনা শ্রবণের জাল, বুঝতে চাক,

আমার বাচনভঙ্গি পুরাণপাখির তুল্য, এই তো সার।


বন্দিত্বেও পায়ের তলায় আগুন রেখেই রই 'গালিব',

অগ্নিদগ্ধ লোমরাজিই তো শিকলের কড়া হল আমার।


২.

(শওক হর রঙ্গ্)


বাসনা শত্রু হল প্রতিপলে বাঁচবার উপায় গুলির,

ছবির পর্দা, তবু দেখা যায় মজনুর নগ্ন শরীর।


ক্ষতও তো বুঝল না হৃদয়ের ব্যাকুলতা, মর্ম গভীর

যখ্মি হৃদয় থেকে ডানা মেলে উড়ে গেল বেদনার তীর।


দীপের ধোঁয়াটি আর ফুলের সুবাস আর কান্না বুকের

তোমার আসর থেকে যে-ই বেরোল, হয়ে ব্যাকুল অধীর।


বাসনাদগ্ধ এই মন আমার বেদনার থালা সুস্বাদু,

বন্ধুরা তুলে নিল, যে যেমন নিতে পারে বেদনার ক্ষীর।


বাসনার পথে জেনো নিজেকে ত্যাজ্য করা কঠিন মোকাম

তাও পার হওয়া গেল, বাকি থাকে বল আর কোন কোন তীর?


হৃদয়ে আবার এক কান্নার হাহাকার উঠল 'গালিব'

বৃষ্টি হল না বলে ঝড় হয়ে বেরল যে তারই নজির।


৩.

(দহর মেঁ নক্শে-ওয়াফা)


অনুরক্তির ছবি এ জগতে প্রবোধের হল না কারণ,

নিজের অর্থে লাজ পেল না পেল না এই শব্দ এমন।


মৃত্যু কামনা করি ছাড়া পেতে অনুরক্তির গ্লানি হতে,

কিন্তু সে অবকাশটুকুও তো দিল না সে নিদয় এমন।


হৃদয় পথিক হয়ে থেকে যাক মদিরা ও পেয়ালার পথে,

খোদাভক্তির পথে প্রাণ আমার কিছুতেই গেল না যখন।


মিলনের কথা তুমি দাওনিকো, তবু রাজি হয়ে আছি আমি

সুসম্ভাষণ চেয়ে হল না এ কান আমার আতুর যেমন।


ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে আছি, কার কাছে করি অভিযোগ?

চাইছি মরণ হোক, হায়! তবু কিছুতেই আসে না মরণ।


মরে যাই ক্ষীণতনু গালিবের এমন নাজুক হাল দেখে,

জীবন ফিরিয়ে আনা ঈশার ও ফুঁ-টুকুও হল না সহন!


৪.

(ইশ্ক মুঝকো নহি)


প্রেম নয় এ উন্মাদনা, উন্মাদনাই হল

আমার উন্মাদনা তোমার খ্যাতির উপায় হল।


সম্পর্ক ছিন্ন তুমি কোরো না এইভাবে

কিছু না থাক না-হয় এবার শত্রুতাটাই রইল।


সঙ্গে আমি থাকলে তোমার কিসের অপমান?

লোকসমাজের ভয় থাকে তো নির্জনতায় চল।


আমি তোমার শত্রু তো নই, দ্বিধা কেন হায়!

না-হয় তোমার পরের সাথে ভালবাসাই হল।


যেটুক আছ, আছ নিজের অস্তিত্বের জোরে

চেতনা যদি না থাকে তো অচেতনাই হল।


প্রেমের থেকে বাফার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম হাত

প্রেমে থাকা না থাকে তো দুঃখে থাকাই হল।


অবিচারের আকাশ তুমি কিছু তো দাও হাতে

বিদায়বেলার তোফা না-হয় হা-হুতাশই হল।


আমিও সব মেনে নেওয়ার স্বভাব করে নেব

তোমার নাহয় স্বভাব হয়ে উপেক্ষাটাই রইল।


বঁধুর সাথে নেহার বাঁধন কেটে গেলে 'আসাদ'

মিলন তো আর থাকে না, তাই আকাঙ্ক্ষাটাই রইল।


(ভণিতায় কোথাও তিনি 'গালিব' কোথাও বা 'আসাদ' ব্যবহার করেছেন)


৫.

(সাতাঈশগর হ্যা যাহিদ)


আল্লার ভক্ত যে-স্বর্গের বাগিচার গুণগানে চুর হয়ে আছে,

অমন ফুলের তোড়া আমাদের বেখুদের ভুলে যাওয়া তাকে পড়ে আছে।


ফুরসত দেয় যদি সামান্য এ-জগত তবে আমি দেখাব জরুর,

হৃদয়ের দাগগুলি ঝাড়বাতি-প্রদীপের একেকটি বীজ হয়ে আছে।


তোমার রূপের বিভা এ আরশিনগরের কী হালত করে গেছে দেখো,

প্রতিদিন বাগানের শিশিরের ভুবনের রৌদ্র যে-হাল করে গেছে।


সৃষ্টিরই খাঁজে খাঁজে লুকায়িত আছে জেনো ধ্বংসের সমূহ কারণ,

ফসলবিনাশী বাজে যে তত্ত্ব আছে তা কৃষাণের ক্রোধেও তো আছে।


লাখে লাখ বাসনা সে নিহত লুকানো আছে এ নীরবতার অন্তরে,

অস্তি আমার যেন পথিকের কবরের নিভু নিভু দীপ হয়ে আছে।


এখন কেবল সেই প্রেমাষ্পদের স্মৃতি আর তার ছবিটি সহায়

বিধুর হৃদয় যেন ইসুফের কারাগারে কুঠুরি নিজন হয়ে আছে।


আমি তো দেখছি শুধু 'ফানা'র পথটি আছে দৃষ্টিতে আমার 'গালিব'

এ সেই সূত্র যাতে অস্তির কণাগুলি মালার মতন গাঁথা আছে।

Saturday, September 2, 2023

চাহনি | পর্ব ৬ | মন্দার মুখোপাধ্যায়


চোখে চোখ

চেনা মানুষকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু আহামরি কি! বিশেষত তাঁর সঙ্গে যদি প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ হয়; কারণ নিয়মিত কথা বলা ও সহাবস্থানের একটা নিজস্ব মেমরি বক্স থাকেই। যোগাযোগে থাকা মানুষ, ভিড়ের মধ্যেও তাই চট করে চোখে পড়ে যায়; মুখ না দেখেও, পিঠ ফিরিয়ে থাকা তার দেহ রেখাতেও চিনতে তাই ভুল হয় না। কিন্তু যে মানুষটির সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়েছে একবার বা বড় জোর দুবার, তাও প্রায় বছর দশেক আগে এবং তা আরও অনেকের মধ্যে, সেখানে নিকট বোধ গড়ে ওঠা বিস্ময়কর বৈকি। তা ছাড়াও মানুষটি এতোই বিশিষ্ট এবং আকাঙ্ক্ষিত যে, ওরকম গুচ্ছগুচ্ছ গুণগ্রাহী এবং রূপমুগ্ধদের সঙ্গে তাঁর প্রতিদিনই আলাপ পরিচয় হয়; ফলে আমাকে চেনা এবং মনে রাখা একেবারেই অসম্ভব; তা ছাড়াও তাঁর কোনও বৃত্ত মানে, কাজ বা পরিচিত গণ্ডি, কোথাওই আমি পড়ি না। ফলে আমার সেই চমকে ওঠার বিস্ময় ও বুক ধুক পুক আনন্দ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই আজও মন জুড়ে রাজত্ব করছে।

একটি স্মরণ সভার আমন্ত্রণ পেয়ে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় দেখি তাঁর নাম; লকডাউনের সময় ফেসবুক সক্রিয়তায় তাঁর সঙ্গে এক নিবিড় যোগাযোগ ঘটে। কবে বা কেন যে আমিও তার ‘ফ্রেন্ডস ওনলি’ বন্ধু গ্রুপে ধরা আছি, তা খেয়াল করিনি তেমন; কিন্তু লকডাউনে প্রতিদিন নিয়ম করে কবিতা পাঠ শুরু করলেন তিনি; একই সঙ্গে বাংলা কবিতা এবং তার ইংরেজি তর্জমা; আবার কখনও ইংরেজি তর্জমা সমেত অন্য ভাষার কবিতাও; তাঁর সেই জ্ঞান, প্রস্তুতি, নিষ্ঠা অনেকের সঙ্গে মুগ্ধ করেছে আমাকেও। লকডাউন শেষে সে সব পর্ব মিলিয়ে গেলেও, প্রায় বছর খানেক ধরে, ফেসবুকে প্রতিদিন দেখা হওয়ায় কেমন এক নিকট সান্নিধ্য গড়ে উঠেছিল; মনে হয়েছিল আলাপ পরিচয়ের মধ্যে কোনও দূরত্ব বা চ্ছেদ নেই যেন; দেখা হলেই কথা হবে, যেন বা এতটাই চেনা; কিন্তু সে তো আমার মনের ভাব; তাঁর মতো প্রথিতযশা মানুষটিরও যে এমনই মনে হবে, তা ভাবা বাতুলতা বৈকি! কিন্তু সেদিন তো তাইই ঘটল!

পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ, এবং প্রায়ান্ধকার; তাঁর আসবার অপেক্ষায় আমারা সকলে, কারণ তিনিই তো উদ্বোধক; সময়ের মিনিট তিনেক দেরিতে ঢুকতেই প্রবেশ দ্বারের আলো এসে পড়ল সামনের কয়েকটি সারিতে; আর হতবাক করে দিয়ে, তাঁর চশমা ঢাকা চোখেও উচ্ছ্বাস জাগিয়ে হাত নাড়লেন তিনি, দ্বিতীয় সারিতে বসা আমার দিকে সহজ তাকিয়ে! আমার দুপাশে বসা অতিথিরা আমাকে নজর করার আগেই লজ্জায় বা আনন্দে মাথা নামিয়ে নিলাম; ওই হাত নাড়া যেন আমার দিকে নয়; পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তাঁর চেনা মানুষের কী অভাব ঘটেছে! এটা বিশ্বাস করতে আমারও বেশ আরাম লাগল; কিন্তু মঞ্চে উঠে, নিজের চেয়ারে বসে এবার তিনি আরও ভাল করে মিলিয়ে নিলেন আমাকে; কোনও এক সময় ফেসবুকেই জানতে চেয়েছিলেন, আমার লেখা একটি বই সম্পর্কে; মানে কী ভাবে কোথায় পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি; ফলে, মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে ওই বইটি আমি সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, নিজে না পারলেও, কারও হাত দিয়ে ওইদিন ওঁর হাতে ঠিকই পৌঁছে দিতে পারব। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব সেরে, তিনি আবার যখন মঞ্চে এসে বসলেন, একজনকে অনুরোধ করামাত্র তিনি বইটি তাঁর হাতে দিয়ে এলেন। দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠানের আগে চা পানের বিরতি হয়ে, আলো নিভলেই, চুপি সাড়ে বেরিয়ে এলাম, প্রেক্ষাগৃহ থেকে; পরদিন সকালে মোবাইল অন করতেই দেখি, ফেসবুকেই আমাকে লিখেছেন, ‘বই পেলাম, কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে প্রেক্ষাগৃহে ফিরে এসে, পরে আর তোমাকে দেখলাম না; তোমার সিটটা ফাঁকা…।’

তাঁর সেদিনের সেই চাহনি একথাই বুঝিয়ে দিল, আলো বা অন্ধকার যাই থাক না কেন– প্রাণে সাড়া জাগলে, সে তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে; আর বুঝিয়েও দেবে যে – এই তো, ঠিক দেখতে পেয়েছি! চাহনির এই সম্মোহনে শুধু চোখ নয়, দৃষ্টি নয় মনও কাজ করে; কাজ করে অন্তরঙ্গ যাপনের এক নিবিড় মাধুর্য; হয়তো সামান্য কিছু শূন্যতা বোধও। আর এই জন্যেই তা ভোলা যায় না; চিরকালের সম্পদ হয়ে রয়ে যায় মনের গভীরে।


আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ৫ | মন্দার মুখোপাধ্যায়