চক্ষুদান
চক্ষুদান কথাটার অর্থ আজকাল আমূল বদলে গেছে। সদ্যমৃতের সজীব চোখ আই ব্যাঙ্কে রেখে জীবিতকে চক্ষুষ্মান করা। এতে একজন দাতা এবং অন্যজন গ্রহীতা। আর পুরো কাজটি করেন চিকিৎসকেরা। এ এক মহতী সেবা। অন্ধ বা প্রায়ান্ধদের চোখে আলো ফোটে। আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে চক্ষুদান বলতে একমাত্র যা বোঝাতো তা হল, বিগ্রহের চোখ ফোটানো। এ কাজটি প্রথমে করতেন প্রতিমা শিল্পীরা। পরে পুজোপাঠের মধ্যে দিয়ে, সেই বিগ্রহে প্রাণ সঞ্চার করে তাকে সজল করে তুলতেন পুরোহিত। এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সকলের মনে হবে-– মা যেন চেয়ে আছেন।
বাড়ির খুব কাছেই ভটচায্যি বাড়িতে দুর্গা পুজা হতো। রথেরদিন খুঁটি পুজো করে ঘট বসত। এরপর কবে যেন মাটির ঢিবি রাখা হতো চণ্ডীমণ্ডপে; আর শুরু হয়ে যেত প্রতিমা গড়ার কাজ। একটা বাঁশের চালচিত্রে ছেলেপিলে বাহন-সহ মাদুগ্গার সংসার। প্রতিদিন ইস্কুলের পরে, বিকেলের খেলা বাদ দিয়ে আর ছুটির দিনগুলো দুপুর থেকে সেখানেই পড়ে থাকতাম। হাঁ করে দেখতাম সেই ঠাকুর গড়া। মাস খানেক ধরে সে পব্বো শেষ হলে, শুরু হতো মায়ের চক্ষুদান। তখন কিন্তু নির্জন মণ্ডপে একা সেই বুড়ো মানুষটি যিনি চোখ আঁকবেন। ভোর থেকে সবাই দেখতে পাবে মায়ের চোখ কেমন চেয়ে আছে। আমি অবশ্য অসুর এবং সিংহের চোখজোড়াও দেখতাম। সিংহের হুঙ্কার আর অসুরের ভয় দুটোই প্রকাশ পেত ওই আঁকা মণিতে। আর মায়ের চোখে যেন উৎসব। আমাদের নতুন জামা-জুতো পাওয়ার আনন্দ । মজা লাগত গণেশের কুতকুতে চোখ দেখেও। কী একটা আকর্ষণ থাকতো তাতেও। তবে কার্ত্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী-– এই তিনজনের চোখ প্রায় এক রকম। মিষ্টি মিষ্টি সেজে তাকিয়ে থাকা।
প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে কত না প্রতিমা আর তার কী বিচিত্র সব অভিব্যক্তি! তেজ, শক্তি, প্রসন্নতা-– একেক শিল্পীর একেক রকম প্রকাশ। কিন্তু যে একটা ব্যাপারে সমতা ছিল, তা হল সবই কিন্তু প্রতিমার চোখ। এ চাহনি মানুষের দৃষ্টিতে পাইনি। এমনকি অভিনয় বা নাচেও তাঁদের প্রতিমার মতো মনে হয়; কিন্তু প্রতিমা মনে হয় না। এ চাহনি দেবীর। মনে হয় একমাত্র মূর্তিতেই ফুটে ওঠে কারণ তা স্থির। এ চোখের পলক পড়ে না।
প্রতি বছর একবার কুমোরটুলি যাই। যাই কালীঘাটের পোটো পাড়াতেও। তা ছাড়াও এ শহরের নানান আনাচ কানাচে কুমোরদের কিছু সাবেক ঘর এখনও নয় নয় করেও আছে। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা গড়ার কাজ। ছোট্ট ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাখা মস্ত মস্ত প্রতিমা। মাটির কাজ শেষ হয়ে এবার রং এবং চক্ষুদান হবে। বেশিরভাগই বারোয়ারি পুজোর অর্ডারি ঠাকুর। শিল্পীদের জিজ্ঞাসা করি কেমন লাগে ওই চক্ষুদান পর্ব! সকলেরই প্রায় এক উত্তর– মা এসে আঁকিয়ে নেন। এই অনুভুতিটাই বোধহয় চক্ষুদানের আসল চাবি কাঠি। এবারেও যখন গেলাম, মনে হল ওই এ কোণা ও কোণা থেকেও মা যেন দেখছেন। বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তো পুতুলের, কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই তা যেন শক্তি! উৎসব।
হয়তো এ জন্যই মানুষের চেয়ে থাকায় যা চাহনি, দেবী মূর্তির ওই চেয়ে থাকা হল–- পূর্ণদৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে পলক পড়ে না। তবুও তা সতেজ এবং বাঙ্ময়।