Saturday, April 22, 2023

চাহনি | পর্ব ৩ | মন্দার মুখোপাধ্যায়

 

সতর্ক

সাদার্ন আভেন্যুয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই রেলিং ঘেরা লেক। বিকেল পাঁচটা; এখনও তবু গণগণে রোদ্দুর; সঙ্গে দুর্জয় গরম। চৈত্র শেষ হতে চলেছে যে! লায়ন সাফারি পার্কের গেট দিয়ে ঢুকলে, হাঁটার স্ট্রেচটা বেশ ফাঁকাই থাকে। হকারদের ঝামেলাও নেই। উপরন্তু, ব্যাটারি চালিত একটা সাদা বেঁটে চারচাকায় পুলিশের ধীর টহলদারি। এরই মধ্যে, বড় গেট পেরিয়ে ঢুকেই যে রেলিং ঘেরি, সেটা বেশ নিরিবিলি। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু উঁচু বসার জায়গা; কোনওটা সোজা বেঞ্চি;  কোনওটা আবার অর্ধেক গোল। নিচেটা যদিও ঝাঁট দেওয়া সাফ সুতরো, তা হলেও বেঞ্চিগুলোয় পাখিদের সাদা এবং ধুসর হাগুর টাটকা বা বাসি ছোপ থাকবেই। যারা নিয়মিত আসে, তারা বেশ খবরের কাগজ বা টুকরো পিচবোর্ড নিয়েই আসে। অনেকে গামছা পেতে সটান লম্বা হয়ে, নাক ডাকিয়ে, বেঞ্চি জুড়ে ঘুমোয়। ভাল পোশাকের ডেলিভারি বয়রা হাত পা ছড়িয়ে টিফিন খায়; বাকিরা আসে জোড়ায় জোড়ায়, আদরে জুড়তে। হন্টন বিলাসীরাও এদিকে আসে না; আসেনা টহলদার পুলিশ; এ বেশ মাধবীকুঞ্জের মনোরম আবেশ। তবে, আমার মতো ঠায় বসে কোকিলের ডাক শুনতে, বা গাছের ওপর ধীরে ধীরে আলোর বদল দেখতে, কিম্বা পাখিদের স্নান দেখে মজা পেতে-- আর কেউ আসে বলে মনে হয় না। সকলেই আসে কিছু কিছু না কিছু কাজ সারতে; ঘুম, খাওয়া বা আদরের উদ্দেশে। এমন কি পাখিরাও তাই, কাজে আসে। আমিই বোধহয় একমাত্র সেই হঠকারি আলসে, যে শুধু বসতে আসে দু দণ্ড।

প্রথমদিকে, গাছের নিচে যুগলদের অবস্থান দেখে একটু অস্বস্তি যে হতো না তা নয়। পরে মনে হতো, একাই বসে আছি; কারণ সকলেরই তো সেই একই পোষ মানা আচরণ আর নিঃশব্দে টুক করে বেঞ্চি খালি করে চলে যাওয়া। আর এও আশ্চর্য যে আমার পছন্দের বেঞ্চিটা সব সময় খালি পাই, কারণ সেটি খুবই প্রকাশ্য। আজ ঢুকেই দেখি দুধ সাদা জলের ফোয়ারা ছুটছে; সঙ্গে ওয়াটার লাইটের বাহারি জ্বলা নেভা। ফলে পাখিরা সব পালিয়েছে, এমনকি কাকও। সেই আওয়াজে বাতাস বা পাতার শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। আর আমার বসার জায়গায় একজন পুরুষ জমকালো লুঙ্গি ও কালো গেঞ্জি পরে, নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে; রাস্তার বাঁদিকে খালি না পেয়ে ডান দিকে বসে দেখি, মাথার ওপর পাতার ছায়া আর ফাঁক ফোকর গলে, চড়া রোদের ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ঝিলিমিল। ফোয়ারার শোভায় পাখিদের হারিয়ে, এদিক ওদিক তাকাতেই ডানদিকে অল্প দূরেই দেখি, মিষ্টি মিষ্টি চেহারার মেয়েটি নিশিন্তে নিজেকে সঁপে দিয়েছে একজন তুলনায় বয়স্ক ছেলের হাতে। ছেলেটি একেবারেই প্রেমিকোচিত নয়। মনে হচ্ছে বাজারের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে, মেয়েটাকে আদর নামক প্রবোধ দিয়ে, আবার বাজার করে বাড়ি ফিরে বউকে বলবে, ‘তোমার হাতের সেই লেবু চা’! মেয়েটাকে দেখে কী যে ভাল লাগছিল; কী সরল, আর কী নির্ভরতা! অনভিজ্ঞতার আরাম আর আনন্দ ওর সবটুকু জুড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার ওদিকে চোখ বোলাতেই দেখি, মেয়েটিকে বেঞ্চিতে বসিয়ে, দুষ্টু কাকু গোছের ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়াল, মুখোমুখি। লগ্ন মেয়েটি তাতেও মুখ গুঁজে, নিশিন্তে তাকে জড়িয়ে; আর ছেলেটি যেন স্নেহের স্পর্শ বোলাতেই এসেছে, অভিভাবক সুলভ এমন ভঙ্গিতে, মেয়েটির মাথা থেকে কাঁধ বেয়ে হাত নামাতে নামাতে, বাহুর নিচে স্পর্শ করেই, সন্তর্পণে আমার দিকে ঘুরে দেখতে লাগল। আমিও  স্থির দৃষ্টিতে দেখলাম যে, নিজের নাকে সে কখন যেন চশমা এঁটে নিয়েছে; মেয়েটার কোনও আড়ষ্টতা নেই; অথচ লোকটা (ছেলে নয় তো!) বাহু বন্ধনে মেয়েটিকে ধরে রেখেও, অপরাধীর চোখে আমাকেও দেখছে। ভাগ্যিস চোখ সরাইনি; না হলে তো দেখতেই পেতাম না, প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে মোবাইল বের করে, সঙ্গোপনে তার সময় দেখা; হায় রে! উঠে দাঁড়ানো, নাকে চশমা আঁটা এবং মোবাইলে সময় দেখা-– এসবই হল মেয়েটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেড়ে যাবার ছল। ধূর্তের অভিজ্ঞ প্রস্তুতি!

কোথায় ভাবছি ,

প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস…

তা না, অতি লোলুপের, আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে, অতি সতর্ক চাহনি!



আগের পর্ব

চাহনি | পর্ব ২ | দোলনচাঁপা | মন্দার মুখোপাধ্যায়

Tuesday, April 4, 2023

চাহনি | পর্ব ২ | দোলনচাঁপা | মন্দার মুখোপাধ্যায়

বছর আঠারো বয়েস। ইস্কুলের শেষ ক্লাস। পুজোর ছুটিতে মায়ের সঙ্গে এবার মধুপুর। বাবার বন্ধু সুরম্য জেঠুর বাড়ি। জেঠু জেঠিমা ছাড়াও বাড়ি ভর্তি লোক। সাত ভাইবোন সমেত, বড় দাদার এক বউ এবং দুটি ছানা। বাবা চলে যাবার পর, বহু মাস পরে, মাকে আবার হাসতে দেখল মিলি। সকাল সন্ধে জমিয়ে আড্ডা, গান, কবিতা আর দফায় দফায় চা। তিনখানি ঘরের একটা আটপৌরে, একতলা বাড়ি। রান্নাঘর লাগোয়া উঠোনের ওপারে, পাঁচিলের গায়ের নিচে যেটুকু মাটি, সেখানেই সাদা রঙের রাশি রাশি দোলন চাঁপা ফুটে আছে। নরম পাপড়ির মাঝখানে যেন লুকোনো সুগন্ধির ঝাঁপি। ভেতর উঠোন তাই সৌরভে ম ম করে। কুঁড়িগুলো সরু সরু লম্বা। এই ফুল ও সুগন্ধ মিলির কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। জেঠু বললেন, এর নাম দোলনচাঁপা।

ষষ্ঠীর সকাল। মায়ের কেনা সেই ফলসা রঙা তাঁতের ডুরে শাড়িটা পরে, কী মনে হল, একগুচ্ছ দোলনচাঁপা তুলে, নিজের একবেণীর বাঁ পাশে, যত্ন করে, ক্লিপ দিয়ে লাগাল মিলি। বাকি সকলে, এখনও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে, বারান্দায় দাঁড়াল মিলি। এখান থেকে গেট অবধি জমি; অনেকখানি এমনিই পড়ে আছে। ঘাস ভর্তি প্রজাপতি আর শালিখের ওড়াউড়ি। থামের গায়ে হেলান দিয়ে মিলি দেখছে, ঘাসের ওপর তার লম্বাটে ছায়া। সেই ছায়ার কাছে আরও একটি ছায়ার আভাস দেখা যেতেই, মিলি চোখ তুলে তাকাল। ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে এলে, জুতোর শব্দ হয় না; তাই সে টের পাইনি।

মিলি দেখল, একজন আত্মবিশ্বাসী যুবক তাকে দেখছে, অপার মুগ্ধতায়। আনত চোখে মিলি হাত ছোঁয়াল তার বেণিতে লাগানো, সেই দোলনচাঁপা গুচ্ছে। তার মনে হল, এটাই যেন দৃষ্টি টানছে ওই যুবকের। স্মার্ট বললেও কম বলা হয়। বলিষ্ঠ শরীরে যেন বিদেশ বাসের ছাপ। পায়ে ভারি জুতো। চোখে চোখ রেখে সে জানতে চাইল, ‘তুমি কে’? মিলি বলল, ‘বেড়াতে এসেছি; এটা আমার জেঠুর বাড়ি’। দু-পায়ে সবল দাঁড়িয়ে মিলিকে সে শুধু দেখছে তো দেখেছই। সেই সম্মোহনে মিলি স্থাণুবৎ। ভেতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে, সহর্ষে ভেতরে ডেকে নিল তাকে। মিলি জানল যে, যুবকটি এ বাড়ির বউদির ভাই। আগের রাতেই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে। ওখানকার পড়া শেষ করে, এবার সে এখানে চাকরি করবে।

সন্ধেবেলা আবার সে এলো। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির ওপর, গলায় একটা প্রিন্টেড সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে। মিলিকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যামেলিয়া লাগাওনি’? 

মিলি বলল, ‘দোলনচাঁপা’।

সদ্য বড় হয়ে ওঠা, সবে শাড়ি ধরা মিলি বুঝল যে, এ দেখাকেই বলে নিমেষ; বলে সম্মোহন।