সতর্ক
সাদার্ন আভেন্যুয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই রেলিং ঘেরা লেক। বিকেল পাঁচটা; এখনও তবু গণগণে রোদ্দুর; সঙ্গে দুর্জয় গরম। চৈত্র শেষ হতে চলেছে যে! লায়ন সাফারি পার্কের গেট দিয়ে ঢুকলে, হাঁটার স্ট্রেচটা বেশ ফাঁকাই থাকে। হকারদের ঝামেলাও নেই। উপরন্তু, ব্যাটারি চালিত একটা সাদা বেঁটে চারচাকায় পুলিশের ধীর টহলদারি। এরই মধ্যে, বড় গেট পেরিয়ে ঢুকেই যে রেলিং ঘেরি, সেটা বেশ নিরিবিলি। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু উঁচু বসার জায়গা; কোনওটা সোজা বেঞ্চি; কোনওটা আবার অর্ধেক গোল। নিচেটা যদিও ঝাঁট দেওয়া সাফ সুতরো, তা হলেও বেঞ্চিগুলোয় পাখিদের সাদা এবং ধুসর হাগুর টাটকা বা বাসি ছোপ থাকবেই। যারা নিয়মিত আসে, তারা বেশ খবরের কাগজ বা টুকরো পিচবোর্ড নিয়েই আসে। অনেকে গামছা পেতে সটান লম্বা হয়ে, নাক ডাকিয়ে, বেঞ্চি জুড়ে ঘুমোয়। ভাল পোশাকের ডেলিভারি বয়রা হাত পা ছড়িয়ে টিফিন খায়; বাকিরা আসে জোড়ায় জোড়ায়, আদরে জুড়তে। হন্টন বিলাসীরাও এদিকে আসে না; আসেনা টহলদার পুলিশ; এ বেশ মাধবীকুঞ্জের মনোরম আবেশ। তবে, আমার মতো ঠায় বসে কোকিলের ডাক শুনতে, বা গাছের ওপর ধীরে ধীরে আলোর বদল দেখতে, কিম্বা পাখিদের স্নান দেখে মজা পেতে-- আর কেউ আসে বলে মনে হয় না। সকলেই আসে কিছু কিছু না কিছু কাজ সারতে; ঘুম, খাওয়া বা আদরের উদ্দেশে। এমন কি পাখিরাও তাই, কাজে আসে। আমিই বোধহয় একমাত্র সেই হঠকারি আলসে, যে শুধু বসতে আসে দু দণ্ড।
প্রথমদিকে, গাছের নিচে যুগলদের অবস্থান দেখে একটু অস্বস্তি যে হতো না তা নয়। পরে মনে হতো, একাই বসে আছি; কারণ সকলেরই তো সেই একই পোষ মানা আচরণ আর নিঃশব্দে টুক করে বেঞ্চি খালি করে চলে যাওয়া। আর এও আশ্চর্য যে আমার পছন্দের বেঞ্চিটা সব সময় খালি পাই, কারণ সেটি খুবই প্রকাশ্য। আজ ঢুকেই দেখি দুধ সাদা জলের ফোয়ারা ছুটছে; সঙ্গে ওয়াটার লাইটের বাহারি জ্বলা নেভা। ফলে পাখিরা সব পালিয়েছে, এমনকি কাকও। সেই আওয়াজে বাতাস বা পাতার শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। আর আমার বসার জায়গায় একজন পুরুষ জমকালো লুঙ্গি ও কালো গেঞ্জি পরে, নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে; রাস্তার বাঁদিকে খালি না পেয়ে ডান দিকে বসে দেখি, মাথার ওপর পাতার ছায়া আর ফাঁক ফোকর গলে, চড়া রোদের ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ঝিলিমিল। ফোয়ারার শোভায় পাখিদের হারিয়ে, এদিক ওদিক তাকাতেই ডানদিকে অল্প দূরেই দেখি, মিষ্টি মিষ্টি চেহারার মেয়েটি নিশিন্তে নিজেকে সঁপে দিয়েছে একজন তুলনায় বয়স্ক ছেলের হাতে। ছেলেটি একেবারেই প্রেমিকোচিত নয়। মনে হচ্ছে বাজারের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে, মেয়েটাকে আদর নামক প্রবোধ দিয়ে, আবার বাজার করে বাড়ি ফিরে বউকে বলবে, ‘তোমার হাতের সেই লেবু চা’! মেয়েটাকে দেখে কী যে ভাল লাগছিল; কী সরল, আর কী নির্ভরতা! অনভিজ্ঞতার আরাম আর আনন্দ ওর সবটুকু জুড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার ওদিকে চোখ বোলাতেই দেখি, মেয়েটিকে বেঞ্চিতে বসিয়ে, দুষ্টু কাকু গোছের ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়াল, মুখোমুখি। লগ্ন মেয়েটি তাতেও মুখ গুঁজে, নিশিন্তে তাকে জড়িয়ে; আর ছেলেটি যেন স্নেহের স্পর্শ বোলাতেই এসেছে, অভিভাবক সুলভ এমন ভঙ্গিতে, মেয়েটির মাথা থেকে কাঁধ বেয়ে হাত নামাতে নামাতে, বাহুর নিচে স্পর্শ করেই, সন্তর্পণে আমার দিকে ঘুরে দেখতে লাগল। আমিও স্থির দৃষ্টিতে দেখলাম যে, নিজের নাকে সে কখন যেন চশমা এঁটে নিয়েছে; মেয়েটার কোনও আড়ষ্টতা নেই; অথচ লোকটা (ছেলে নয় তো!) বাহু বন্ধনে মেয়েটিকে ধরে রেখেও, অপরাধীর চোখে আমাকেও দেখছে। ভাগ্যিস চোখ সরাইনি; না হলে তো দেখতেই পেতাম না, প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে মোবাইল বের করে, সঙ্গোপনে তার সময় দেখা; হায় রে! উঠে দাঁড়ানো, নাকে চশমা আঁটা এবং মোবাইলে সময় দেখা-– এসবই হল মেয়েটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেড়ে যাবার ছল। ধূর্তের অভিজ্ঞ প্রস্তুতি!
কোথায় ভাবছি ,
প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস…
তা না, অতি লোলুপের, আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে, অতি সতর্ক চাহনি!
আগের পর্ব