Saturday, July 2, 2022

আমি চাই, সব সিনিয়র কবি জুনিয়র কবিদের দিকে নজর রাখুক: কে সচ্চিদানন্দন

কে সচ্চিদানন্দনের জন্ম ১৯৪৬ সালে। ভারতীয় কবিতার সুপরিচিত নাম। মালায়ালাম এবং ইংরেজি দুই ভাষায় কবিতা লেখেন তিনি। একই সঙ্গে সাহিত্য সমালোচক, নাট্যকার ও অনুবাদক। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সে যোগ দিতে। The Missing Rib তাঁর কবিতা সংকলনের নাম। অধ্যাপনা করেছেন। সাহিত্য অকাদেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। দিল্লিতে বসবাসের পর এখন ফিরে গিয়েছেন কেরালায়, নিজের জন্মভূমিতে। সেখানে বসেই নিয়মিত কবিতাচর্চা করে চলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ: অরুণাভ রাহারায়

প্র: আপনি আগে দিল্লিতে থাকতেন। এখন রাজধানীর থেকে দূরে থাকেন। কেরালায় আপনার জন্মভূমিতে চলে গিয়েছেন। আপনি কী মনে করেন, একজন তরুণ কবিকে কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকতে হবে? নাকি কেন্দ্র থেকে দূরে বসবাস করেও সে সারভাইভ করতে পারবে?

উ: আমার জন্ম কেরালায়। ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত কেরালাতেই ছিলাম। দিল্লিতে যাই ৪৫ বছর বয়সে। আমি একটা কলেজে পড়াতাম। সেখান থেকে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করি। তারপর আমি সাহিত্য অকাদেমিতে যোগ দিই। প্রথমে ‘ইন্ডিয়ান লিটরেচার’-এর সম্পাদক হিসেবে, পরে অকাদেমির সেক্রেটারি হয়েছিলাম। তরুণ কবি হিসেবে আমি আমার নিজের গ্রামেই ছিলাম, যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল। সেখানেই আমি কলেজে পড়াতাম। পরে এক জায়গায় যাই, সেটাও গ্রামের খুব কাছেই। যখন খুব ছোট ছিলাম, কবি হিসেবে নিজেকে গড়ছিলাম তখন নিজের জায়গাতেই ছিলাম। আমার ভাষাকে ঘিরে ছিলাম। আমার থেকে বড়, আমার থেকে ছোট এবং আমার সমবয়সি-- এই তিন প্রজন্মের কবির সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি এর পরের প্রজন্মের কবিরাও আমার বাড়িতে দেখা করতে আসত। আমরা একে অপরের সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলোচনা করতাম। গঠনমূলক আলোচনা। তখন আমি কবি হয়ে উঠছিলাম। আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। তখন আমার বয়স ২৬। তখন আমার সব বই কেরালা থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিল। দিল্লিতে আসার পরেও আমার অনেক বই কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লিতে আসার পরেও কেরালায় আমার যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। দু’টো কারণে। প্রথমত, আমার সব বই কেরালা থেকে প্রকাশ হত। সেখানে আমার অনেক পাঠক। যদিও গোটা বিশ্বেই আমার পাঠক রয়েছে। কারণ, কেরালার নাগরিক গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। তাই আমার কবিতার পাঠক গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রতি বছর আমি বহুবার কেরালায় যেতাম। বছরে অন্তত ৮ থেকে ১০ বার। বিভিন্ন বৈঠকে বা কবিতাপাঠের আসরে যোগ দিতে। আমি নতুন কবিদের সঙ্গে দেখা করতাম। তাদের সঙ্গে আড্ডা হত।

এরই মধ্যে বড় পরিবর্তন চলে আসে। কম্পিউটার আসে ঘরে, মোবাইল চলে আসে। অনেকেই লেখার জন্য সাইবার স্পেস ব্যবহার করতে শুরু করেন। তাঁদের নিজেদের ব্লগ তৈরি হয়। আমিই কিন্তু সর্বপ্রথম মালায়ালম ভাষায় কবিতার ব্লগ সম্পাদনা করি প্রায় ১০ বছর আগে। একটা বড় প্রকাশনা সংস্থা আমায় এই কাজটা করতে বলেছিল। সেই সংস্থা আমারও কবিতা বইও প্রকাশ করেছে। প্রকাশনা সংস্থাটি আমায় বলেছিল ব্লগ থেকে কবিতা নির্বাচন করতে। সেখানকার বহু কবির লেখা তখনও প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশকরা আমায় বলেছিল ব্লগ পড়ে কবিতা নির্বাচন করতে। সেটা আমি আমার ফেসবুকে প্রচার করি। তারপর থেকে আমার কাছে প্রচুর ব্লগের লিঙ্ক আসে। আমি প্রায় সবকটিই পড়ি। অন্ততপক্ষে ৬০ হাজার কবিতা পড়েছিলাম এই সংগ্রহটির জন্য। যার মধ্যে থেকে আমি মাত্র ৬০টা নির্বাচন করি। আমি ওই সংগ্রহটার নাম দিই ‘দি ফোর্থ স্পেস’। বিখ্যাত সমালোচক হোমি ভাবা বলেছিলেন, যে মানুষরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে এসেছেন, তাঁরা থার্ড স্পেসে বসবাস করছেন। এখানেও নয়, ওখানেও নয়। তো আমার মনে হয়েছিল সাইবার স্পেস হল চতুর্থ স্পেস। যেখানে গোটা বিশ্বের মানুষ একত্রিত হতে পারেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন। এখনও আমি ব্লগ, ফেসবুকে প্রকাশিত বিভিন্ন কবিতা নিয়মিত পড়ি, ভার্চুয়াল জগতে থাকি।

প্র: কেরালায় বসেই আপনি কি গোটা বিশ্বের সাহিত্যকে ছুঁতে পারছেন? 

উ: অবশ্যই। এখন তো বটেই, ছোটবেলাতেও ছুঁতে পেরেছিলাম। আমি গ্রামে জন্মেছি। আমাদের গ্রামে দু’টো গ্রন্থাগার ছিল। অনেকে জানেন কেরালায় একটা বড় গ্রন্থাগার আন্দোলন হয়েছিল। ফলস্বরূপ প্রতিটি গ্রামে অন্ততপক্ষে একটা গ্রন্থাগার ছিল। কোথাও কোথাও একের অধিকও ছিল। আমাদের গ্রামে দু’টো। যার মধ্যে একটা ছিল বিশ শতকের প্রথমদিকের বিখ্যাত কবি কুমারানাশানের নামে। ওই গ্রন্থাগারে খুব ভালো বইপত্র ছিল, বিশেষ করে অনুবাদগ্রন্থ। মালায়ালাম একটা অনুবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। আমরা নানা সাহিত্য অনুবাদ করতে থাকি। তাই যখন একজন মালায়ালম সাহিত্যিককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সবথেকে জনপ্রিয় মালায়ালাম লেখক কে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মার্কেজ এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন মালায়ালাম ভাষায়। 

প্র: আপনি অনেক কম বয়সে পাবলো নেরুদার নির্বাচিত কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। আপনার কি মনে হয় কবিতার অনুবাদের মধ্যেও সৃজন থাকে?

উ: নিশ্চয়ই। আমি মনে করি, একটি অনুবাদ বইয়ে দু’জনের সৃজনশীলতা থাকে। অনুবাদে আমাকেও দেখা যাবে, নেরুদাকেও। অবশ্যই প্রথমে নেরুদাকে ও তারপর আমাকেও দেখতে পাবেন। আমি নেরুদার সৃষ্টিকে আমার ভাষায় অনুবাদ করেছি। আমার ভাষা বলতে মালায়ালাম নয়, আমার নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি বোঝাতে চেয়েছি। বহুদিন আগে সম্ভবত ১৯৪০ দশকের শেষে এবং ৫০ দশকের শুরুর দিকে নেরুদার কবিতা মালায়ালামে অনুবাদ করা হয়েছিল। আমার মনে হয়, ওই সময় মালায়ালাম ভাষা নেরুদার জন্য, নেরুদার সৃষ্টিকে ভালোভাবে অনুবাদের জন্য যথেষ্ট পরিপক্ক ছিল না। একজন গতানুগতিক মাপকাঠিতে অনুবাদ করেন। অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে না পেরে কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ওটা একটা অসম্পূর্ণ অনুবাদ ছিল। যার কথা বলছি, তিনি একজন কমরেড ছিলেন। তিনি হয়তো নেরুদা, মায়কোভস্কির অনুবাদ করাকে নিজের দায়িত্ব ভেবেছিলেন। সেটা করেওছিলেন। আমি অনুবাদ করি ৭০-এর দশকে। বইটা প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ততদিনে মালায়ালাম কবিতা আধুনিক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে একটা নতুন ধরন, দেখার নতুন আঙ্গিক এবং একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাষা ছিল। তখন আমি নেরুদাকে ভালো করে অনুবাদ করতে পারি। নেরুদার মতো একজন কবি, যাকে আমি নিজে প্রচণ্ড অ্যাডমায়ার করি, তাঁর সৃষ্টিকে অনুবাদ করার সাহস দেখিয়েছিলাম।

প্র: সুবোধ সরকার তাঁর 'আমার কবিতা আমার জীবন' (প্রকাশ ২০১৫) বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, তিনি গত পাঁচ বছরে বিদেশে যে কয়েকটি সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, তাঁকে সুপারিশ করেছেন আপনি অথবা সীতাংশু যশচন্দ্র। কবিতার ক্ষেত্রে কি রেকমেন্ডেড হওয়া জরুরি?

উ: হ্যাঁ। আমি চাই, সব সিনিয়র কবি জুনিয়র কবিদের দিকে নজর রাখুক। নতুন কবিতা পড়ুন, সেগুলো সম্পর্কে লিখুন। আমি গোটা জীবন ধরে তা করে আসছি। তখন থেকে যখন আমি মালায়ালামে নন-পোয়েট ছিলাম। এমনকি দিল্লিত থাকার সময়ও নতুন মালায়ালাম কবিদের লেখা পড়তাম। তাঁরা আমাকে লেখা পাঠাতেন। তাদের বই কিনতাম বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে পড়তাম। আমি এইসব কবিদের সারা বিশ্বে কবিতা সম্মেলনের জন্য সুপারিশও করে থাকি। যেমনটা সুবোধ সরকারকে করেছিলাম। আমি যাদের কবিতা পড়ি তাদের ভারতে এবং মাঝেমধ্যে বিদেশেও বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে সুপারিশ করি। 

আমি তাঁদের কখনও কখনও কবিতা অনুবাদও করতে বলি। কারণ, কবিতা অনুবাদ হল একটা শেখার অভিজ্ঞতা। যখন আপনি কবিতা অনুবাদ করেন তখন যেন আপনি একজন মহান শিল্পীকে কাজ করতে দেখছেন। কীভাবে তাঁর হাত চলে, কীভাবে লাইন গঠন হয়, কীভাবে তিনি রঙের ব্যবহার করেন। যখন আপনি একজন কবিকে অনুবাদ করেন তখন আপনি বোঝার চেষ্টা করতে পারবেন আসল কবিতাটা লেখার সময় কবির ইমাজিনেশন কীভাবে কাজ করছিল। তিনি নির্দিষ্ট চিত্রকল্পে কীভাবে পৌঁছলেন বা লাইনটা কীভাবে জন্ম নিল। আপনি কিছু শিখতে পারবেন অনুবাদ করতে গিয়ে। তাই আমি সব তরুণ কবিদের বলে থাকি অনুবাদ করুন। আমি তাঁদের বলছি না, সব অনুবাদ প্রকাশ করতে হবে। হয়তো প্রকাশ করবেন না, তবু নিজের জন্য অনুবাদ করুন। অনুবাদ যে ভালো হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। তবুও, অনুবাদ হল শেখার জন্য একটা অভিজ্ঞতা। 

আমি হাই স্কুলের ছাত্র থাকার সময় অনুবাদ করতে শুরু করি। ওমর খৈয়াম এবং কয়েকজন ব্রিটিশ রোম্যান্টিক কবির লেখা অনুবাদ করি। কারণ ওই বয়সকালে সেইসব কবিরাই বেশি টানত। সারাজীবনই আমার কবিতা এবং আমার অনুবাদ একসঙ্গে চলেছে। এখনও আমার একটা মান্থলি কলাম রয়েছে। সেখানে আমি ভারতের এমনকি ভারতের বাইরের কবিদের পরিচয় করাই তাঁদের কবিতা মালায়ালামে অনুবাদ করার মাধ্যমে। একটা ছোট্ট ভূমিকা লিখি, তারপর তাঁর কবিতা অনুবাদ করি। অনুবাদ ও সৃষ্টি দুটোই আমার সমান্তরাল ভাবে চলেছে। আমার অনুভব, এই অনুবাদগুলি আমার নিজের কবিতার জগতের একটা অংশ। কেউ যদি আমার সব কবিতাকে একসঙ্গে প্রকাশ করে তাহলে আমার মনে হয় তার একটা অংশে নিজের কবিতা থাকবে, আরেকটা অংশে আমার অনুবাদ করা কবিতাগুলো থাকবে। কারণ, আমার সৃজনশীলতা, আমার ইমাজিনেশন, আমার ভাষাগত দক্ষতা-- এই সবকিছু আলাদাভাবে হলেও আমার দু’ধরনের কাজের মধ্যেই রয়েছে। আমি সবসময় বলি, যখন একজন কবিকে মূল্যায়ন করছেন বা তাঁর অনুবাদকে দেখছেন, তখনই আপনি ওই কবিকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিজের কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। করীরও করেছিলেন। আমার মনে হয় না সেগুলো খুব ভালো অনুবাদ। কারণ পরে আমি আরও ভালো অনুবাদ দেখতে পেয়েছি। কিন্তু, তাঁরা যে অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখনও এই বয়সে আমি গোটা বিশ্বের কবিতা পড়ি এবং সেইসব লেখাকে মালায়ালি পাঠক সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমি এই কাজটা করি মূলত মালায়ালি যুব কবিদের জন্য। যাতে তাঁরা জানতে পারেন যে এরকম একজন কবি রয়েছেন, এই ধরনের কবিতার ভঙ্গি রয়েছে, এই কবি এই ধরনের ইমেজ ব্যবহার করেন বা অন্য একজন কবি আরেক ধরনের সিনটেক্স ব্যবহার করেন। তাঁরা অনুবাদের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারেন। অনুবাদ একটা সৃজনশীল কাজ। কারণ, সেখানে তোমার ইমাজিনেশন কাজ করছে, তুমি তোমার সমস্ত ভাষাগত দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছ। তাই আমার মতে, গোটা প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত সৃজনশীল।

প্র: ক্রিস্টোফার মেরিলের সঙ্গে আপনার একটা ছবি দেখেছি। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইটিং ওয়ার্কশপে ও সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?

উ: আইওয়াতে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। কিন্তু, সেই সময় যেতে পারিনি। রটারডামে একটা ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলাম। তারপর ভেলসে শহরে একটা ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। ভেলসের পর ম্যানচেস্টারে গিয়েছিলাম একটা ওয়ার্কশপে। সেখানেই সম্ভবত ক্রিস্টোফার মেরিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। স্পেনে মাদ্রিদেও ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছি। প্রথম শুরু হয়েছিল ভোপালের ভারত ভবনে। তখন ডিরেক্টর ছিলেন অশোক বাজপেয়ী। সেখানে অনেক কবি আসতেন। কবি সম্মেলন হত। প্রায় সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করতাম। মাঝেমাঝে কয়েকটা ওয়ার্কশপও হত। হিন্দিতে আমার অনুবাদের বই রয়েছে। একবার একটা ওয়ার্কশপে তিনজন ছিলাম। আমি, হিন্দি ভাষার একজন যুব কবি ছিলেন রাজেন্দ্র থোটাপকর, আর একজন ছিলেন, তিনি মালায়ালাম ও হিন্দি দুই ভাষাই জানতেন। কর্মশালাটা ১৫ দিন ধরে চলেছিল। শেষে আমার প্রথম হিন্দি বইটা প্রস্তুত হয়। তারপর দিল্লিতে রাজকমল প্রকাশ করেছিল। সেই শুরু। তারপর একে একে বহু ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি দেশ ও দেশের বাইরে।

প্র: বাংলার অনেক পরিচিত কবি আপনার বন্ধু। ভারতীয় কবিতার মনচিত্রে কবিতা কবিতার অবস্থান ঠিক কোথায়?

উ: বাংলা কবিতা গতিশীল, জীবন্ত। বাংলায় অনেক লিটল ম্যাগাজিন আছে, কবিতা পত্রিকা রয়েছে। যদিও আমি সব ভাষার কবিতা পড়িনি। হয়তো কেউই পড়েননি। তবু, আমার মতে, মারাঠি, মালায়ালাম এবং বাংলা সব থেকে এগিয়ে রয়েছে ভারতীয় কবিতা মানচিত্রে। হয়তো হিন্দিও রয়েছে এই তালিকার ওপরের দিকে। মুশকিল হল, হিন্দি ভাষায় লেখা কবিতা কিছু পাঠকের ছোট বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূলত, অ্যাকাডেমিশিয়ান, কলেজ পড়ুয়া, কলেজের অধ্যাপক, তাঁরাই প্রধান পাঠক হিন্দি কবিতার। মালায়ালামে তা হয় না। বাংলা বা মারাঠির ক্ষেত্রেও তা হয় বলে আমার মনে হয় না। নানা স্তরের মানুষ বাংলা কবিতা পড়েন। যখন আমি কেরালায় যাই তখন অটো-রিক্সা চালকও আমার কাছে আসেন, আমাকে চিনতে পারেন। একবার তো একজন অটো চালকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয় কবিতা নিয়ে! আমি তাঁর মুখ দেখতে পাইনি কারণ তিনি সামনে বসেছিলেন। কিন্তু, তাঁর সঙ্গে আমার অনেক গভীর আলোচনা হয়, নিজের বর্তমান কবিতা ও আগের লেখা কবিতার পার্থক্য নিয়ে! এমন ঘটনা আমার সঙ্গে কয়েক বার হয়েছে। একটা গ্রামে একজন পান বিক্রেতা আমার নতুন কবিতা পড়েছেন শুনে বিস্মিত হয়েছি। সেটা আবার আমাকে মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন! একটা রেস্তোরাঁয় এক বেয়ারার সঙ্গেও একই ধরনের ঘটনা। যদিও আমি খুব জনপ্রিয় কবি নই। সবার জন্য লিখি না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমার কবিতা সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে ভেবে ভালোই লাগে। এটা আমি কেরালায় টের পেয়েছি। আমার মনে হয় বাংলা কবিতার জন্যেও সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসাটা রয়েছে। মারাঠির জন্য বড় মাপে রয়েছে। হিন্দিতে অনেক ভালো কবিতা রয়েছে। কিন্তু,  সেই তুলনায় পাঠক সংখ্যা খুবই কম। এটা আমি ভালো করে জানি। এই চার ভাষার কবিতাই অত্যন্ত গতিশীল।

প্র: ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল আপনার। শুনতে চাই সেই স্মৃতি...

উ: হ্যাঁ সেবার দেখা হয়েছিল অলোকদার সঙ্গে। আমার কবিতার অনুবাদ হয়েছে অন্তত ৩০টি ভাষায়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমার কবিতার জার্মান অনুবাদ-গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। কেরলের একজন মহিলা অ্যানা কুট্টি আমার কবিতার অনুবাদ করেছিলেন জার্মান ভাষায়। তাঁর স্বামী জার্মান। তিনি নিজেও জার্মান জানেন। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা পড়ান। তিনি জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মালায়ালমও পড়ান। অ্যানা কুট্টি একজন কবি এবং জার্মান ভাষাতেও লেখেন। তিনি আমার কবিতা মালায়ালাম থেকে সরাসরি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। বইটা যথেষ্ট বড় হয়েছিল। কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সেই বই প্রকাশ করেছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। আমি অলোকরঞ্জনের অনেক কবিতা পড়েছি। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখাও পড়েছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার সিনিয়র বন্ধুর মতো ছিলেন। ভোপালে ওয়ার্কশপে শক্তি এসেছিলেন। সেই সময় শক্তির কবিতাও অনুবাদ করা হচ্ছিল হিন্দিতে। করছিলেন কেদারনাথ সিং। সেই সময় বিভিন্ন ভাষার কবিদের দল একে অপরের লেখা অনুবাদ করেছিলেন।

প্র: আপনার কন্যা সবিতা সচ্চি কবিতা লেখেন। তাঁর বই প্রকাশ পেয়েছে। কীভাবে দেখেন বিষয়টা 

উ: হতে পারে ব্যাপারটা জেনেটিকসের জন্য। একথা বলব না যে সবিতা আমার থেকে কবিতা পেয়েছে। কবিতা পড়েই কবিতার প্রতি ঝোঁক এসেছে ওঁর। তাছাড়া, ছোটবেলায় আমাকে সবসময় লিখতে দেখত। আমি খুবই খুশি এবং গর্বিত ওঁর জন্য। ওঁর কবিতা চারদিকে ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে, আলোচিত হয়েছে। কবিতার প্রতি ওঁর টান তৈরি হওয়ায় ভালোই হয়েছে। কারণ, ও এমন একটা বাড়িতে বড় হয়েছে যেখানে কবিতার বইয়ের ছড়াছড়ি। আমার তিনটে বড় তাক-ভর্তি সারা বিশ্বের কবিতার বই। আমার কবিতা ও ঘরে থাকা কবিতার বইগুলো পড়ে বড় হয়েছে সবিতা। ওঁর কবিতার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পেছনে এই কারণগুলো থাকতেই পারে। আগ্রহটা নিজেরই ছিল। পরিবেশও হয়তো কিছুটা সাহায্য করেছে।

প্র: লকডাউনে আপনার সম্পাদনায় কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। লকডাউনের সময়টা কীভাবে কাটিয়েছিলেন? 

উ: লকডাউন আমার জন্য অত্যন্ত সৃজনশীল সময় হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, একবার আমারও কোভিড হয়েছিল। তবে, ছোট আকারে। জ্বর ইত্যাদি হয়েছিল। সেটা বাদ দিয়ে আমি অনেকটা সময় পেয়েছি। অন্য সময় প্রচুর সভায় বক্তব্য রাখতে ডাকা হয় আমাকে। সেই সময়ও কয়েকটা অনলাইন মিটিং পড়েছিল। অংশ নিয়েছি এবং প্রায় ৬০টা অনলাইন লেকচার দিয়েছি! কিন্তু, ব্যাপারটা অনলাইনে হওয়ার কারণে আমায় কোথাও যেতে হয়নি। যা আমায় অনেক অবসর সময় দিয়েছিল। সেই সময় আমি প্রতি সপ্তাহে মালায়ালাম অনুবাদ কলামের কাজটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আরেকটা কথা, আমি এই সময় ভক্তি এবং সুফি কবিতা অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিই। সেটাই মূলত করেছিলাম লকডাউনে। তা থেকে পাঁচটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি হয়ে উঠল। তার মধ্যে তিনটি প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। বাকি দুটির কাজ চলছে। সঙ্গে শেক্সপিয়রের সব সোনেট অনুবাদের চেষ্টা। আমি আগেই একটা সংগ্রহের জন্য অনেকটা অংশ অনুবাদ করেছিলাম। এবার মোট ১৫৪ সনেটের সবকটিই অনুবাদ করেছি মেট্রিক্যালি। কারণ, সনেট মিটারে অনুবাদ করতে হয়। 

আমার কাছে একটা গোটা বই রয়েছে কবীরের। নাম 'কনভার্সেসন উইথ গড'। 'সুফি পোয়েমস বাই বুল্লেহ শাহ' নামে সুফি কবি বুল্লেহ শাহর একটা বই। তৃতীয় বইটি তুকারামের কবিতা নিয়ে। চতুর্থ বই কানাডার সাইবার পোয়েটস। আমার পঞ্চম বইটি একটি অ্যান্থলজি। তাতে আমি প্রায় ৫০ জন ভিন্ন ভাষার সুফি এবং ভক্তি কবিকে একসঙ্গে অনুবাদ করেছি। পাঁচটি বই ভক্তি এবং সুফি কবিতার ও একটা শেক্সপিয়রের সনেটের বই। সবকটিই লকডাউনের আড়াই বছরে অনুবাদ করা। সঙ্গে আমি নিজের কবিতাও লিখছিলাম। পরিস্থিতির বিচারে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছিলাম। আমি বেশ কিছু কবিতা সরাসরি লকডাউন নিয়ে না লিখলেও পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে লিখি। যেমন, একাকীত্ব, সামাজিক দূরত্ব, পরিযায়ী শ্রমিকদের মাইগ্রেশন ইত্যাদির ওপর। আমার লেখা একটা কবিতা রয়েছে 'ট্রেন' নামে। একজন শ্রমিক ট্রেন ধরতে পারেননি এবং তিনি মারা যান। তাঁর আত্মা ট্রেনে যাত্রা করে। এভাবেই আমি ইমাজিন করেছি। তিনি গ্রামে পৌঁছন। কিন্তু, তাঁকে সবাই আসল মানুষ হিসেবে দেখতে পান। তাঁর বাচ্চারা বেরিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে, গ্রামবাসীরা তাঁর নাম ধরে ডাকে। তিনি বাই-সাইকেলে ঘুরে বেড়ান। এভাবেই আমার‌ কল্পনা দিয়ে কবিতাটা লিখেছিলাম।

প্র: গত বছর আপনি কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরোধী একটি কার্টুন শেয়ার করেছিলেন বলে আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট একদিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল

উ: আমি তো লিখেই চলেছি এইসবের বিরোধীতা করে। কারণ, বর্তমানে ভারতে ঘৃণার সংস্কৃতি চলছে। যা তৈরি করেছে নতুন সরকার। আমি তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দিয়ে থাকি। ফেসবুকে লিখে থাকি। শুধু লেখা নয়, নানা জায়গায় বলিও। দিল্লিতে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছি। এছাড়াও শাসক বিরোধী অনেক প্রতিবাদ সভায় অংশ নিয়েছি। কেরালাতেও আমি এইসব মানুষদের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকি। ফেসবুকে কার্টুন বা সমালোচনামূলক মন্তব্য পোস্ট করতে থাকি। অশ্লীল কিছু নয়, শুধু কঠোর সমালোচনামূলক রাজনৈতিক মন্তব্য। কিন্তু, একদিন দেখতে পাই আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছি না। বারবার পাসওয়ার্ড দিয়েও ঢুকতে পারছি না! দু'দিন এই অবস্থায় ছিল। তিনদিনের দিন আবার ঢুকতে পারি। আমি ফেসবুকের থেকে ওয়ার্নিংও পাই যে, আপনি আবার কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের বিরুদ্ধে গিয়েছেন। কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড শব্দটা ব্যবহার করেছিল ওঁরা। বলেছিল, আপনার পোস্ট আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের বিরুদ্ধে। তাই আমরা পোস্টটি সরাতে বাধ্য হয়েছি। আপনি আবার এ রকম করলে আমরা একই রকম ব্যবস্থা নেব। এ ঘটনার বিরুদ্ধে কেরালায় বড় বড় প্রতিবাদ হয়। স্কুল পড়ুয়ারা পর্যন্ত তাতে সামিল হয়েছিল।

কবিতায় ভস্মীভূত এক কবি: কে সচ্চিদানন্দনের কবিতা | অনুবাদ: অরিত্র সান্যাল

[কবিকে তাঁর মূল ভাষায় পড়তে না পারার দুঃখ একটি পবিত্র অনুভূতি। এতে পাঠকের বিবেক অটুট থাকে। এই অশ্রু-ঝলোমলো বিশ্বাস নিয়েই কবি কোইয়ামপারাম্বাথ সচ্চিদানন্দনকে অনুবাদ করে ফেলা। কবি লেখেন মালায়লম ভাষায়, পরে অনুবাদ নিজেই করেন ইংরেজিতে। সেই ইংরেজি থেকে বাংলায়, খঞ্জপদক্ষেপে, কবিতাগুলিকে বয়ে আনবার কাজটি অপরাধের হল কি না – তা আর কবেই বা কে জানতে পেরেছেন!

জুন মাসের অগ্নিদাপট চলছে বাইরে। অ্যান্টনিম পত্রিকার উদ্যোগে শহরে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সে যোগ দিতে এসে কবি এসে উঠেছেন পূর্ব কলকাতার একটি পান্থনিবাসে। তারই একটা ঘরে বসে আছি, অর্থাৎ, একটি ঘরে বসে দুই ভারতীয় পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতে আড্ডা মারছে। এর মাঝে চা এল। কবি ও পাঠকের মধ্যে ভাষার দূরত্ব নিয়ে গভীর কথা পাড়তে যাব কি এমন সময় কবি ফুড়ুত হেসে হঠাৎ বলে উঠলেন – যখনই কোলকাতা আসি, আমি হতবাক হয়ে যাই। সারা পৃথিবী জুড়ে মালায়লি মানুষ ছড়িয়ে আছেন, কিন্তু এত বাঙালি একসঙ্গে কেরালা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।

অতঃপর, আমি প্রশ্নটি গিলে নিই। নিশ্চিন্ত হই-– আমরা সর্বত্র আছি।]   


আঙুলের ছাপ


প্রাচীন কেল্লার ফটকে

এই আঙুলের ছাপগুলো দেখো:

কয়েকটি ঝুলেকালিতে ছাপা হয়ে আছে,

কয়েকটি অশ্রুতে,

তার মধ্যে কিছু, যারা উঁকি দিয়েছিল সেই শিশুদের,

কিছু, এখানে ঢুকতে পারার আগেই

খিদের চোটে ধ্বসে পড়া বুড়োদের,

আর কিছু, সেই জোয়ান ছোঁড়াদের যারা

জোর করে ঢুকতে গিয়ে, অশেষ রাত্রিতে

সটান থুবড়ে পড়েছিল।


আমিও এই সিংহদরজায়

রেখে যাচ্ছি নিজের আঙুলের ছাপ, রক্তে:

যারা অনাগত তাদের প্রতি

একটি স্মারক আর একটি হুঁশিয়ারি:

আমার কবিতা। 


রচনাকাল: ১৯৮৮


কবিতায়


নিজের কবিতায় আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাই,

ঠিক যেমন চিতায়।

কাঁচা কাঠের মতো শব্দের পর শব্দ

আমি লেখায় গুছিয়ে তুলেছি।


কলাপাতা থেকে যখন আমায় চড়ানো হল

চিতার ওপর, শব্দে দাউদাউ আগুন।

সেখান থেকে আমার হাড়ের ভেঙে ফাটার 

আওয়াজ পাবে তুমি, 

হৃৎপিণ্ড পুড়ে যাবার তেল ছ্যাঁকছ্যাঁক ধ্বনি,

গলা পুড়ে যাবার নিঃশব্দ গান।


আমার চারদিকে তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখ

যে জীবন আমি নিজের চোখে দেখি

তাতে জ্বলন্ত কয়লা পড়তে থাকে,

আমার শিরা দিয়ে গলগল করে স্বপ্ন 

বেরিয়ে যায়, আমার হুহু বয়ে যাওয়া ঘিলু থেকে

স্মৃতি আলুথালু।


তুমি তেল ঢালছ, আর চাপাচ্ছ কাঠের ওপর কাঠ,

আমার অন্ত্রনাড়িভুঁড়িজাল নেড়ে দিচ্ছ কাঠি দিয়ে।

একটা ঘুমপাড়ানি গান আমার কানে পুড়ছে,

গিঁঠ থেকে গিঁঠ খুলে একে একে আমার আঙুলগুলো পড়ে যাচ্ছে,

যেটুকু দূরত্ব আমি হেঁটে এসেছি জ্বলে যাচ্ছে,

আমি ছাই হয়ে যাচ্ছি। 

সেই ছাইয়ে এক বেড়াল তার ছানাপোনা নিয়ে উষ্ণতার ওম খুঁজে নেয়,

সেই ছাইয়ে একটা বুনো দারুচিনি গাছ গজিয়ে ওঠে, ফুল ফোটায়। 

সেই ছাইয়ে কালো কালো বাচ্চারা লাফায় দাপায়, খেলা করে।

তুমি এ ছাই গঙ্গায় ঢেলো না, অনুরোধ করি।


[কেরালার আদি রীতি অনুসারে মৃতদেহকে প্রথমে কলাপাতায় শোওয়ানো হয়। তারপর চিতায়।] 

                       

রচনাকাল: ১৯৯২


যখন কবিতা পুড়ে যায়


যখন কবিতা পুড়ে যায়, তা থেকে

গ্যাস চেম্বারে দগ্ধ শিশুদের গন্ধ আসে।

এখানে মড়-মড় করে যে ভাঙার শব্দ 

তা যুদ্ধের ধোঁওয়ায় পুড়ে আংড়া হয়ে যাওয়া পাতার।

অনাথ, ল্যাংটা, সারা গায়ে পোড়া দাগ,

রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়ায় কবিতা।

যা-কিছু অতিক্রম করে সব ছাই:

স্টক এক্সচেঞ্জ, প্রমোদ-বিপণী,

অস্ত্রাগার, দেওয়াল, দেওয়াল।

কবিতার ছাই থেকে একটি তোতা উঠে আসে

তার খোঁড়া জিভের ওপর নির্বাসিতা সীতার

প্রতিশোধের গল্প নিয়ে। 


রচনাকাল: ১৯৯২


ঘর, একটি জন্তু


ঘর একটি জন্তু যার ফুসফুস থাকে শরীরের বাইরে। সে কারণে 

সামান্য রৌদ্র বা তুষার লাগলেই তার জ্বর হয়ে যায়। 

হাওয়া-বাতাস ঝড়-জল এমন চলতেই থাকলে ঘর একদিন মরে যাবে। 


রচনাকাল: ১৯৯৫


অমরত্ব


হাজার হাজার কবি লিখেও

আজ বিস্মৃত।

স্মরণে শুধু একজনই থেকে যান।

একা একা অমর হবার থেকে

আমি চাইব বরং বিস্মৃত হয়ে যেতে

হাজার হাজার কবির সঙ্গে


রচনাকাল: ১৯৯৬



ঢোল


কোথা থেকে শব্দ আসে – তা উৎসুক হয়ে

খুঁজতে গিয়ে আমি একবার

ঢোলের চামড়ায় ছ্যাঁদা করে ফেলি

তারপর ভিতরে উঁকি দিই


অরণ্য আছে ভিতরে,

ঝমঝম বৃষ্টিতে জন্তুজানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে,

বানে নদী ক্ষিপ্ত, বাতাস

ঘণীভূত আকাশের নিচে ক্ষেপে উঠেছে।

একটা জংলি দেবতা বাইসন চড়ে

শিঙায় ফুঁ মারছে।

আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, পালিয়ে আসি।

তখন আমার বয়স চার বছর।


এখনও যখন ঢোলের আওয়াজ শুনি,

আমি অকাতরে বৃষ্টির মধ্যে একটা

অরণ্যে পৌঁছে যাই,

সমুদ্রের মাঝে একটা দ্বীপ,

আর আমি সেখানে অপেক্ষা করি, ঝড় থামবার,

রক পাখির চঞ্চু থেকে সূর্যের জ্যান্ত দেখা দেবার,

আর মূল ভূখণ্ড থেকে

আমার সহচরের

ফুল, আর কলম নিয়ে আসবার


রচনাকাল: ২০০০



ভয়


ছোটবেলায়

আমি খুব ভয় পেতাম পেঁচার ডাকে

আর মায়ের আড়ালে লুকিয়ে যেতাম।

এখন শীতের চাঁদ

মেঘ থেকে সেই ডাক ছাড়ে।

মা মৃত্যুর আড়ালে লুকিয়ে গেছে

শৈশব মেঘের ওপার থেকে উঁকি দেয়

চাঁদের চোখের প্রাপ্তবয়স্ক ঝিলিক

তার ওপর পড়ে।


আর আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। 


রচনাকাল: ২০০২  



শিলং যাবার পথে


শিলং যাবার পথে

উমিয়াম লেকের কালচে বাদামী ঘাটে

একটি নীল কৃষ্ণচূড়ার ঝালর,

তার তলায় আমি তাঁকে দেখিঃ বনলতা সেন।


আজ, এক দশক পার করে

আবার সে লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।

উনি এখনও সেখানেই দাঁড়িয়েঃ

উপচে পড়া নীল কৃষ্ণচূড়া

এক খণ্ড বেগুনি মেঘের তলে

আকাশে ধাবমান।


রচনাকাল: ২০০৩


বয়ঃসন্ধি


মাস্টারমশাই অঙ্ক মুছে দিয়ে চলে গিয়েছেন,

শুধু যোগচিহ্ন, বিয়োগচিহ্ন আর মোটে একটা শূন্য

পড়ে আছে ব্ল্যাকবোর্ডে।

যোসেফ যোগচিহ্ন নিয়ে নিল

আর আমিনা, বিয়োগচিহ্নটা।

আমি শূন্য পকেটে ভরে

চলেই আসছিলাম কি এমন সময়

একটা বিশাল কাক ডেকে উঠল,

একটা গাছ রাস্তা পেরিয়ে গেল,

পথে একটা তারা খসে পড়ে

ভেঙে খান খান।

মুষলধারা বৃষ্টিতে আমার

শূন্যটিও গলে যায়।


আমি ফিরে যাই আর

আয়নায় দেখি:

আমার গোঁফ গজিয়েছে। 


রচনাকাল: ২০০৪


দরজাওয়ালা একটা মানুষ


দরজা নিয়ে একটা মানুষ

শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে,

একটি লাগসই বাড়ি চাই।


সে মানুষ নিজের মানুষীর

স্বপ্ন দেখছে, বাচ্চাকাচ্চা, ইয়ারদোস্ত 

সবাই এই দরজা দিয়েই ঢুকে আসছে।

এখন সে দেখতে পায়

আস্ত দুনিয়াই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে

তার না-হওয়া বাড়িতে:

কত লোক, গাড়ি-ঘোড়া, গাছপালা

পশু পাখি, সবকিছু।


আর দরজাটা, দরজার স্বপ্নটা

মাটির ওপর উঠে যাচ্ছে,

তার ইচ্ছে স্বর্গের স্বর্ণদুয়ার হয়ে ওঠার,

সে কল্পনা করছে মেঘ, রঙধনু,

দত্যিদানো, পরী আর সাধুসন্তেরা

তার মধ্যে দিয়ে চলাচল করছে।


কিন্তু দরজাটির জন্য যে প্রকৃত অপেক্ষা করে আছে

নরকের অধিপতি।

এখন দরজাটি চায়

গাছ হতে, ফুল পাতার সম্ভার

দুলে উঠবে হাওয়ায়,

গৃহহারা ফেরিওয়ালাকে

ছায়া দিতে।


দরজা নিয়ে একটি মানুষ হেঁটে যাচ্ছে

শহরের রাস্তায় রাস্তায়,

একটি তারা হেঁটে যাচ্ছে তার সঙ্গে। 


রচনাকাল: ২০০৬



ঋণস্বীকার:

কে সচ্চিদানন্দনের The Missing Rib (Collected Poems 1973-2015) নামক কাব্যসংকলনটি প্রকাশ করেছে Poetrywala। মূলত সেই সংকলন থেকেই কবিতাগুলো চয়ন করা।