Saturday, July 2, 2022

কবিতায় ভস্মীভূত এক কবি: কে সচ্চিদানন্দনের কবিতা | অনুবাদ: অরিত্র সান্যাল

[কবিকে তাঁর মূল ভাষায় পড়তে না পারার দুঃখ একটি পবিত্র অনুভূতি। এতে পাঠকের বিবেক অটুট থাকে। এই অশ্রু-ঝলোমলো বিশ্বাস নিয়েই কবি কোইয়ামপারাম্বাথ সচ্চিদানন্দনকে অনুবাদ করে ফেলা। কবি লেখেন মালায়লম ভাষায়, পরে অনুবাদ নিজেই করেন ইংরেজিতে। সেই ইংরেজি থেকে বাংলায়, খঞ্জপদক্ষেপে, কবিতাগুলিকে বয়ে আনবার কাজটি অপরাধের হল কি না – তা আর কবেই বা কে জানতে পেরেছেন!

জুন মাসের অগ্নিদাপট চলছে বাইরে। অ্যান্টনিম পত্রিকার উদ্যোগে শহরে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সে যোগ দিতে এসে কবি এসে উঠেছেন পূর্ব কলকাতার একটি পান্থনিবাসে। তারই একটা ঘরে বসে আছি, অর্থাৎ, একটি ঘরে বসে দুই ভারতীয় পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতে আড্ডা মারছে। এর মাঝে চা এল। কবি ও পাঠকের মধ্যে ভাষার দূরত্ব নিয়ে গভীর কথা পাড়তে যাব কি এমন সময় কবি ফুড়ুত হেসে হঠাৎ বলে উঠলেন – যখনই কোলকাতা আসি, আমি হতবাক হয়ে যাই। সারা পৃথিবী জুড়ে মালায়লি মানুষ ছড়িয়ে আছেন, কিন্তু এত বাঙালি একসঙ্গে কেরালা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।

অতঃপর, আমি প্রশ্নটি গিলে নিই। নিশ্চিন্ত হই-– আমরা সর্বত্র আছি।]   


আঙুলের ছাপ


প্রাচীন কেল্লার ফটকে

এই আঙুলের ছাপগুলো দেখো:

কয়েকটি ঝুলেকালিতে ছাপা হয়ে আছে,

কয়েকটি অশ্রুতে,

তার মধ্যে কিছু, যারা উঁকি দিয়েছিল সেই শিশুদের,

কিছু, এখানে ঢুকতে পারার আগেই

খিদের চোটে ধ্বসে পড়া বুড়োদের,

আর কিছু, সেই জোয়ান ছোঁড়াদের যারা

জোর করে ঢুকতে গিয়ে, অশেষ রাত্রিতে

সটান থুবড়ে পড়েছিল।


আমিও এই সিংহদরজায়

রেখে যাচ্ছি নিজের আঙুলের ছাপ, রক্তে:

যারা অনাগত তাদের প্রতি

একটি স্মারক আর একটি হুঁশিয়ারি:

আমার কবিতা। 


রচনাকাল: ১৯৮৮


কবিতায়


নিজের কবিতায় আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাই,

ঠিক যেমন চিতায়।

কাঁচা কাঠের মতো শব্দের পর শব্দ

আমি লেখায় গুছিয়ে তুলেছি।


কলাপাতা থেকে যখন আমায় চড়ানো হল

চিতার ওপর, শব্দে দাউদাউ আগুন।

সেখান থেকে আমার হাড়ের ভেঙে ফাটার 

আওয়াজ পাবে তুমি, 

হৃৎপিণ্ড পুড়ে যাবার তেল ছ্যাঁকছ্যাঁক ধ্বনি,

গলা পুড়ে যাবার নিঃশব্দ গান।


আমার চারদিকে তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখ

যে জীবন আমি নিজের চোখে দেখি

তাতে জ্বলন্ত কয়লা পড়তে থাকে,

আমার শিরা দিয়ে গলগল করে স্বপ্ন 

বেরিয়ে যায়, আমার হুহু বয়ে যাওয়া ঘিলু থেকে

স্মৃতি আলুথালু।


তুমি তেল ঢালছ, আর চাপাচ্ছ কাঠের ওপর কাঠ,

আমার অন্ত্রনাড়িভুঁড়িজাল নেড়ে দিচ্ছ কাঠি দিয়ে।

একটা ঘুমপাড়ানি গান আমার কানে পুড়ছে,

গিঁঠ থেকে গিঁঠ খুলে একে একে আমার আঙুলগুলো পড়ে যাচ্ছে,

যেটুকু দূরত্ব আমি হেঁটে এসেছি জ্বলে যাচ্ছে,

আমি ছাই হয়ে যাচ্ছি। 

সেই ছাইয়ে এক বেড়াল তার ছানাপোনা নিয়ে উষ্ণতার ওম খুঁজে নেয়,

সেই ছাইয়ে একটা বুনো দারুচিনি গাছ গজিয়ে ওঠে, ফুল ফোটায়। 

সেই ছাইয়ে কালো কালো বাচ্চারা লাফায় দাপায়, খেলা করে।

তুমি এ ছাই গঙ্গায় ঢেলো না, অনুরোধ করি।


[কেরালার আদি রীতি অনুসারে মৃতদেহকে প্রথমে কলাপাতায় শোওয়ানো হয়। তারপর চিতায়।] 

                       

রচনাকাল: ১৯৯২


যখন কবিতা পুড়ে যায়


যখন কবিতা পুড়ে যায়, তা থেকে

গ্যাস চেম্বারে দগ্ধ শিশুদের গন্ধ আসে।

এখানে মড়-মড় করে যে ভাঙার শব্দ 

তা যুদ্ধের ধোঁওয়ায় পুড়ে আংড়া হয়ে যাওয়া পাতার।

অনাথ, ল্যাংটা, সারা গায়ে পোড়া দাগ,

রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়ায় কবিতা।

যা-কিছু অতিক্রম করে সব ছাই:

স্টক এক্সচেঞ্জ, প্রমোদ-বিপণী,

অস্ত্রাগার, দেওয়াল, দেওয়াল।

কবিতার ছাই থেকে একটি তোতা উঠে আসে

তার খোঁড়া জিভের ওপর নির্বাসিতা সীতার

প্রতিশোধের গল্প নিয়ে। 


রচনাকাল: ১৯৯২


ঘর, একটি জন্তু


ঘর একটি জন্তু যার ফুসফুস থাকে শরীরের বাইরে। সে কারণে 

সামান্য রৌদ্র বা তুষার লাগলেই তার জ্বর হয়ে যায়। 

হাওয়া-বাতাস ঝড়-জল এমন চলতেই থাকলে ঘর একদিন মরে যাবে। 


রচনাকাল: ১৯৯৫


অমরত্ব


হাজার হাজার কবি লিখেও

আজ বিস্মৃত।

স্মরণে শুধু একজনই থেকে যান।

একা একা অমর হবার থেকে

আমি চাইব বরং বিস্মৃত হয়ে যেতে

হাজার হাজার কবির সঙ্গে


রচনাকাল: ১৯৯৬



ঢোল


কোথা থেকে শব্দ আসে – তা উৎসুক হয়ে

খুঁজতে গিয়ে আমি একবার

ঢোলের চামড়ায় ছ্যাঁদা করে ফেলি

তারপর ভিতরে উঁকি দিই


অরণ্য আছে ভিতরে,

ঝমঝম বৃষ্টিতে জন্তুজানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে,

বানে নদী ক্ষিপ্ত, বাতাস

ঘণীভূত আকাশের নিচে ক্ষেপে উঠেছে।

একটা জংলি দেবতা বাইসন চড়ে

শিঙায় ফুঁ মারছে।

আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, পালিয়ে আসি।

তখন আমার বয়স চার বছর।


এখনও যখন ঢোলের আওয়াজ শুনি,

আমি অকাতরে বৃষ্টির মধ্যে একটা

অরণ্যে পৌঁছে যাই,

সমুদ্রের মাঝে একটা দ্বীপ,

আর আমি সেখানে অপেক্ষা করি, ঝড় থামবার,

রক পাখির চঞ্চু থেকে সূর্যের জ্যান্ত দেখা দেবার,

আর মূল ভূখণ্ড থেকে

আমার সহচরের

ফুল, আর কলম নিয়ে আসবার


রচনাকাল: ২০০০



ভয়


ছোটবেলায়

আমি খুব ভয় পেতাম পেঁচার ডাকে

আর মায়ের আড়ালে লুকিয়ে যেতাম।

এখন শীতের চাঁদ

মেঘ থেকে সেই ডাক ছাড়ে।

মা মৃত্যুর আড়ালে লুকিয়ে গেছে

শৈশব মেঘের ওপার থেকে উঁকি দেয়

চাঁদের চোখের প্রাপ্তবয়স্ক ঝিলিক

তার ওপর পড়ে।


আর আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। 


রচনাকাল: ২০০২  



শিলং যাবার পথে


শিলং যাবার পথে

উমিয়াম লেকের কালচে বাদামী ঘাটে

একটি নীল কৃষ্ণচূড়ার ঝালর,

তার তলায় আমি তাঁকে দেখিঃ বনলতা সেন।


আজ, এক দশক পার করে

আবার সে লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।

উনি এখনও সেখানেই দাঁড়িয়েঃ

উপচে পড়া নীল কৃষ্ণচূড়া

এক খণ্ড বেগুনি মেঘের তলে

আকাশে ধাবমান।


রচনাকাল: ২০০৩


বয়ঃসন্ধি


মাস্টারমশাই অঙ্ক মুছে দিয়ে চলে গিয়েছেন,

শুধু যোগচিহ্ন, বিয়োগচিহ্ন আর মোটে একটা শূন্য

পড়ে আছে ব্ল্যাকবোর্ডে।

যোসেফ যোগচিহ্ন নিয়ে নিল

আর আমিনা, বিয়োগচিহ্নটা।

আমি শূন্য পকেটে ভরে

চলেই আসছিলাম কি এমন সময়

একটা বিশাল কাক ডেকে উঠল,

একটা গাছ রাস্তা পেরিয়ে গেল,

পথে একটা তারা খসে পড়ে

ভেঙে খান খান।

মুষলধারা বৃষ্টিতে আমার

শূন্যটিও গলে যায়।


আমি ফিরে যাই আর

আয়নায় দেখি:

আমার গোঁফ গজিয়েছে। 


রচনাকাল: ২০০৪


দরজাওয়ালা একটা মানুষ


দরজা নিয়ে একটা মানুষ

শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে,

একটি লাগসই বাড়ি চাই।


সে মানুষ নিজের মানুষীর

স্বপ্ন দেখছে, বাচ্চাকাচ্চা, ইয়ারদোস্ত 

সবাই এই দরজা দিয়েই ঢুকে আসছে।

এখন সে দেখতে পায়

আস্ত দুনিয়াই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে

তার না-হওয়া বাড়িতে:

কত লোক, গাড়ি-ঘোড়া, গাছপালা

পশু পাখি, সবকিছু।


আর দরজাটা, দরজার স্বপ্নটা

মাটির ওপর উঠে যাচ্ছে,

তার ইচ্ছে স্বর্গের স্বর্ণদুয়ার হয়ে ওঠার,

সে কল্পনা করছে মেঘ, রঙধনু,

দত্যিদানো, পরী আর সাধুসন্তেরা

তার মধ্যে দিয়ে চলাচল করছে।


কিন্তু দরজাটির জন্য যে প্রকৃত অপেক্ষা করে আছে

নরকের অধিপতি।

এখন দরজাটি চায়

গাছ হতে, ফুল পাতার সম্ভার

দুলে উঠবে হাওয়ায়,

গৃহহারা ফেরিওয়ালাকে

ছায়া দিতে।


দরজা নিয়ে একটি মানুষ হেঁটে যাচ্ছে

শহরের রাস্তায় রাস্তায়,

একটি তারা হেঁটে যাচ্ছে তার সঙ্গে। 


রচনাকাল: ২০০৬



ঋণস্বীকার:

কে সচ্চিদানন্দনের The Missing Rib (Collected Poems 1973-2015) নামক কাব্যসংকলনটি প্রকাশ করেছে Poetrywala। মূলত সেই সংকলন থেকেই কবিতাগুলো চয়ন করা।

2 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. অরিত্র আর অরুণাভকে অনেক ধন্যবাদ, এই কবিতাগুলি পড়ার সুযোগ ক'রে দেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete