Sunday, April 18, 2021

সেই নীল ঘর :: লেইরে বিয়াতে গার্সিয়া


অনুবাদ: শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 

ঘরটা খাপছাড়া, অসমান। বছর তিনেকের বাচ্চার হাতে আঁকা টেরাবাঁকা ড্রইংয়ের মতো। সিলিংটা জানলার দিকে ঢালু হয়ে আসায় ঘরের মধ্যে একটা আমন্ত্রণ ফুটে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। 

গৃহসজ্জা সাদামাটা। ঘর দেখলে বাসিন্দার সম্বন্ধে মোটামুটি একটা অনুমান করে নেওয়া যায়। দেওয়ালগুলিতে নীল রঙের প্লাস্টার। তার মধ্যে একটি আবার বাহারি পেন্সিল ও জলরঙে আঁকা ছবিতে, নানা দেশের মানচিত্রে আর অসমাপ্ত বাক্যে ভরা। জানলার দুপাশে যে পর্দাটা লেপ্টে আছে, তার রং নিশাচর নীল। জানালার নিচে বিছানা ও ডেস্ক। ডেস্কের উপর এক তাড়া কাগজ ও কয়েকটা কলম ইচ্ছামত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। 

ঘরের মধ্যে একটা ছোট চেয়ার। আমি তাতেই বসেছিলাম। বিছানায় বসা উচিৎ কি উচিৎ না – এই এক দ্বিধা ছিল। বিছানাটা চেয়ারের চাইতে অনেক বেশি আরামদায়ক বলে মনে হচ্ছিল। চেয়ারের পিঠটা বেশ উঁচু। কাপড়ের পুর দেওয়া সিট। চেয়ারের হাতলদুটো আমার পক্ষে একটু নিচুই বলা যায়। আমার পা দুটো আবার চেয়ারের তুলনায় লম্বা। অবাক কান্ড! তবুও চেয়ারটায় বসে আরাম পাচ্ছিলাম। আরেকটু জমিয়ে বসবো বলে একটু নড়েচড়ে বসার ভঙ্গিটা ঠিক করে নিতেই চেয়ারের পিঠের সঙ্গে আমার পিঠ খাপে খাপে মিলে গেলো। আমি আরামে হেলান দিলাম। 

ঘরটা একেবারে নিঃশব্দ। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরে ঢোকার আগে এত শব্দ ছিল। করিডরে মানুষের গলা, লোহার দরজাওয়ালা পুরনো লিফটের ঘড়ঘড়, রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে মানুষ আর গাড়ির গাদাগাদি ভিড়ের আওয়াজ। সোমবারের অফিস টাইমে সারা পৃথিবীর তাড়া থাকে, কারণ সবারই দেরি হয়ে যায়। কিন্তু, যখন থেকে আমি ওই ঘরটার ভেতর ঢুকে পড়লাম, একটা নিঃশ্বাসের শব্দও পাচ্ছিলাম না। কেউ ফিসফিসও করছিল না। শুধুই গভীর স্তব্ধতা। ওই পর্দার নীল রঙের মতই, বোবা। 

বিছানার চাদরটাও নীল বলে মনে হচ্ছিল। মহিলার চোখ দুটোও, সম্ভবত। আমার ঠিক মনে পড়ছে না এখন। আমার জিভ থেকে রঙের কোরকগুলো মুছে গেছে। শুধু মনে পড়ছে যে আমি ওই নীল নৈঃশব্দ্যের কথা আর ভাবতে পারছিলাম না। 

তারপর, আমি এলাম।




-------------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি: লেইরে বিয়াতে গার্সিয়ার জন্ম স্পেনের বিগোতে। বহু ভাষায় পারদর্শী এই লেখিকা একজন ভাষা শিক্ষিকা। বিগত দশকের প্রথম দিকে কয়েক বছর কলকাতায় ছিলেন। মূলত গদ্য লেখেন ইংরাজি ও স্প্যানিশ ভাষায়। সংবাদ প্রতিদিন, দুকূল, পরম্পরা, দ্য ড্রিমিং মেসিন প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর নানা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। নিজের লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করে চলেছেন।

Thursday, April 15, 2021

রবার্ট অ্যাডামসনের কবিতা


অনুবাদ: অরিত্র সান্যাল

শীতে, হাসপাতালের বিছানায়


ব্যথা বেদনার বড়িগুলোর ধাক্কায় লম্বা করিডোর দিয়ে

আমি যেখানে এলাম, স্মৃতি সেই ঘর

সবুজ ঢেউয়ের স্বচ্ছ বাষ্পে চড়ে যন্ত্রণা দূরে সরে যাচ্ছিল

কিছু কিছু ছবির ঝলক আসে, চলে যায়


সে বয়সে আমি কবিতা ছাপাবো বলে লিখিনি

তবে, আমার আশেপাশে জীবন যুদ্ধে পিষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু পাঠক ছিল  

আমি তাদের মনোযোগ পেতে চেয়েছি

আমার উঠোনে দুশ্চিন্তার মতো ওরা ভেসে বেড়াত


কখনও সিগারেটে টান দিচ্ছি কখনও ইতিউতি দেখছি

কী ভাঙার জন্য আর কী শাস্তি বাকি বা চিত্তবিক্ষেপ

স্মৃতির সূক্ষ্ম ধাতব পাত ভেসে উঠতে থাকে 

মনের উপরিতলে আবার কামড় দেবে বলে


আমার কোনও ধারণা নেই কেন কবিতা আমায় ধরে ফেলল স্কুইডের মতো

মগজ থেকে ঝুলে থাকল দুর্গত আবহাওয়ায়

ভিন পরিবেশে একটা প্রাণী

তার শতাব্দী প্রাচীন জীবন নিয়ে জেগে উঠছে


ভাবনা-চিন্তাকে কালির মতো হতে হবে এবং

হতে হবে এমন যাতে ঝটতি শিকারে টোপের কাজ করতে পারে

কালো চঞ্চুতে আর গভীর থেকে বোধ জেগে উঠবে

সে এক দিন ছিল যখন কবিতা ছিল বুনো জন্তু বশ করার ছল


তখন না ছিল মাছ, না ছিল পাখি তাই

আমি পংক্তি রচনা করেছি তাদের জন্য, জীবন যাদের তিক্ততায় ভরা

চোখ তাদের রোষে লাল চঞ্চল

যখন আগামী কবিতাগুলি আমার জন্য অপেক্ষায় রত



-------------------------------------------------------------------------

কবি পরিচিতি: অস্ট্রেলিয়ার সমসাময়িক কবিতার মানচিত্রে রবার্ট অ্যাডামসন সে ভাষাসংস্কৃতির প্রধানতম কবিদের একজন। জন্ম ১৯৪৩ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৭০ এ প্রকাশ পায়, ক্যান্টিকলস অন দ্য স্কিন। রবার্টের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৬-র বেশি। বিবিধ সম্মানে ভূষিত রবার্ট অস্ট্রেলিয়ার সম্ভ্রান্ত প্রকাশনা সংস্থা পেপার বার্ক প্রেসের কর্ণধার। 

-------------------------------------------------------------------------

অনুবাদকের পরিচয়: কবি এবং অনুবাদক অরিত্র সান্যালের জন্ম ১৯৮৩ সালে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-- নাবিক বিন্দু থেকে (২০১০), আজ কারও জন্মদিন নয় (২০১৩), নিজের আয়ুর মতো শ্যামবর্ণ (২০১৫) এবং একটা বহু পুরোনো নেই (২০১৮)। সমসাময়িক আমেরিকান কবিদের লেখা অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন – ‘ব্রিজেবল লাইনস’ (২০১৯) গ্রন্থে। এ বছর প্রকাশ পেয়েছে পৌলমী সেনগুপ্তর সঙ্গে যৌথ অনুবাদে কানাডিয়ান কবি আদিনা কারাসিকের কবিতা 'সালোমে বীরাঙ্গণা'।

Tuesday, April 13, 2021

অতিথি বীক্ষণ :: কমলেশ রাহারায়


আমি তার কেমন উত্তরসুরি, একদিন মেপে দেখি

দৈর্ঘ্যপ্রস্থ,মনের ভিতরে ঝিলিক দিচ্ছে রংবেরং মনস্তাপ

আর কোনও অঙ্কিত শব্দ নেই, শূন্য ভাঁড়ার  যেমন

থাকার কথা, প্রারম্ভিক বিষাদে তেমন রক্তমেঘ জমে যায় 

চেনা-অচেনা, দেখা অদেখায় তবু গ্রীবা তুলি 

সবুজ সংকেত পাঠাই, দহনের এই এক পরিণাম


অথচ যে কোনও মানুষ চায় অনুযোগ বাদ দিয়ে জোৎস্নার ভিতর

তার নিজস্ব প্রতিধ্বনি আকাশমাটি জলে স্বপ্নময় হোক

সারাদিন অসম সাহসী এক মেষপালক বধ্যভূমিতে

অন্তত একবার ভাঙাচোরা মুখ আর মাথাটা তুলুক

নিসর্গ শরীরে মানুষের শিরস্ত্রাণ একবার ঝলমল করে উঠুক 

কে না চায় ঝিনুকের ভিতর থেকে উঠে আসুক ব্রতকথা 


মূলত সব যেন অর্গ্যানের সুর, অস্ত্রবিহীন পথ

গোধূলির মাঠ ভেবে দেবদারু অতিথিবীক্ষণ

এতদূর এসে গেছি আমন্ত্রণ ছাড়া ,ভ্রুক্ষেপ করিনি


---------------------------------------------------------

Guest Vision

Kamalesh Raha Roy


How I am his successor, I try to measure;

An absent-minded flower flickers in my mind,

And there are no words drawn, the way an empty storage

Is expected, the way bloody cloud, known unknown,

Overcast, I lift my face to send the greenlight,

This is the consequence of combustion


Still a man wishes his own echo

Reflected everywhere, an intrepid shepherd

Raise his head in the slaughterhouse, his crown

Shimmer in the nature, who does not want 

Folklores from oyster shell!


Chiefly everything sounds like the music from the organ,

A path to walk unarmed, looking at the Deodar guest vision 

and thinking it the field of dusk, I have made so far

Without caring for a call.



Translated by Jagannath Biswas

Painter: Paul Klee

না-পাঠানো চিঠি :: উত্তমকুমার মোদক


ভারতবর্ষের নামে চিঠি পাঠাই এক বিশ্বগ্রাম থেকে

জানি, পরম্পরার ভেতর সব, গ্রিল বসানো ফাঁক

তবু, দেখো, আহ্নিক-একাদশী সারছে কামার্তরা।


একটি অন্ধরাস্তা ধ'রে খুনীরা আসে রক্তমাংস চেয়ে

লালফিতের ফাঁসে কাঁদছে অধিকারের পাখি!

সব প্রবাহের মুখগুলি পরিকল্পিত ঘোরানো!


উৎসের দিকে উল্টো, নামানো থাকছে,পতাকা!

মগজের ভেতর দিয়ে উড়ন্ত ফোরলেন

চাষের ক্ষেতে কর্পোরেটের গুদামঘরের তালা


সংবিধানের ধারায় জমছে পদার্থের রেচন

শাসকের মুখ ঝামলায় নয়া-খনার বচন!





চিত্রকলা: হিরণ মিত্র

Sunday, April 11, 2021

হৃদয় হোম চৌধুরী-র কবিতা


খেলা

আবেগ তোমায় আত্মীয় করেছি

হৃৎপিন্ডে সহস্র শব্দের হাহাকার না হলে দেখতাম

কী করে?

সহস্র সমুদ্রের অমৃতধারা নিয়ে

                   আমার মায়েরা 

হেঁটে গেছে দিগন্তের সূর্যে লাগাম ধরতে 

আর তোমাকে মৌচাকের ঘর গুনে 

জারুল পাতার মাঝে ঘুমোতে দেখেছি রাতে-

বিছানায় নিয়ে এসে

ভালোবাসায় গল্প করার ইচ্ছেটুকু উবে গেছে-

শবের এই শহরে লাশ কম পড়েছিল একবার

বিচ্ছেদী সুরের মতো ভজন বেজেছিল

কফিনের কত সপ্তম পেরেক ফেলে দিয়েছি-- সে সব জানেনি হয়তো কেউ-

শ্মশানে চুল্লি জ্বলে; লাশ সাজিয়ে দিন

আঠারোর জীবনে শেষ খেলা,  দেশ ও জীবনের মিলন


কবি

নদীর কিনারে ফেলা নোঙর-অন্ধ আতুড়ঘরের চিৎকার- 

                      শুনতে চাই না আর।

ভাঙা আকাশের নতমুখ শোকের অবাধ পাথরে

                              প্রেমের খাটিয়া পেতে বিশ্রাম নেয়।

এসবের মাঝেও মনে রেখো

   

ধূসর স্টেশনে আমার পার্থিব দাম্পত্য শেষ হবে আগামীকাল


ফাঁসীগামী আত্মার ক্রন্দনে আয়নার কফিন দেখব--

অন্ধ কালো বিড়াল দু'টি পেছনে ফুঁপিয়ে ওঠে 

পৃথিবীর কখন অসুখ হবে আমি কখন ওষুধ দেব

কখন আমার পায়ের ছাপে পৃথিবীর অঙ্ক কষব 

ওদের পদপিষ্টে ভাঙা ভাতের থালা

কোন বসন্তবিলাপের সঙ্গী হবে!

কবিতা সঙ্গমের জন্য অপেক্ষায় আছি

শেষ সীমান্তে পৌঁছে যাব বলে এসেছি

এখানে কবিরা কি মরুভূমিতে চেরী খায়?


নগ্নপায়ে পলাশের বেড়ি জড়িয়ে পান্ডুলিপির পর পান্ডুলিপিতে কী অক্ষর ছাপেনি ওরা!