অনুবাদ: শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
ঘরটা খাপছাড়া, অসমান। বছর তিনেকের বাচ্চার হাতে আঁকা টেরাবাঁকা ড্রইংয়ের মতো। সিলিংটা জানলার দিকে ঢালু হয়ে আসায় ঘরের মধ্যে একটা আমন্ত্রণ ফুটে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল একটা নিজস্ব চরিত্র আছে।
গৃহসজ্জা সাদামাটা। ঘর দেখলে বাসিন্দার সম্বন্ধে মোটামুটি একটা অনুমান করে নেওয়া যায়। দেওয়ালগুলিতে নীল রঙের প্লাস্টার। তার মধ্যে একটি আবার বাহারি পেন্সিল ও জলরঙে আঁকা ছবিতে, নানা দেশের মানচিত্রে আর অসমাপ্ত বাক্যে ভরা। জানলার দুপাশে যে পর্দাটা লেপ্টে আছে, তার রং নিশাচর নীল। জানালার নিচে বিছানা ও ডেস্ক। ডেস্কের উপর এক তাড়া কাগজ ও কয়েকটা কলম ইচ্ছামত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে।
ঘরের মধ্যে একটা ছোট চেয়ার। আমি তাতেই বসেছিলাম। বিছানায় বসা উচিৎ কি উচিৎ না – এই এক দ্বিধা ছিল। বিছানাটা চেয়ারের চাইতে অনেক বেশি আরামদায়ক বলে মনে হচ্ছিল। চেয়ারের পিঠটা বেশ উঁচু। কাপড়ের পুর দেওয়া সিট। চেয়ারের হাতলদুটো আমার পক্ষে একটু নিচুই বলা যায়। আমার পা দুটো আবার চেয়ারের তুলনায় লম্বা। অবাক কান্ড! তবুও চেয়ারটায় বসে আরাম পাচ্ছিলাম। আরেকটু জমিয়ে বসবো বলে একটু নড়েচড়ে বসার ভঙ্গিটা ঠিক করে নিতেই চেয়ারের পিঠের সঙ্গে আমার পিঠ খাপে খাপে মিলে গেলো। আমি আরামে হেলান দিলাম।
ঘরটা একেবারে নিঃশব্দ। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরে ঢোকার আগে এত শব্দ ছিল। করিডরে মানুষের গলা, লোহার দরজাওয়ালা পুরনো লিফটের ঘড়ঘড়, রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে মানুষ আর গাড়ির গাদাগাদি ভিড়ের আওয়াজ। সোমবারের অফিস টাইমে সারা পৃথিবীর তাড়া থাকে, কারণ সবারই দেরি হয়ে যায়। কিন্তু, যখন থেকে আমি ওই ঘরটার ভেতর ঢুকে পড়লাম, একটা নিঃশ্বাসের শব্দও পাচ্ছিলাম না। কেউ ফিসফিসও করছিল না। শুধুই গভীর স্তব্ধতা। ওই পর্দার নীল রঙের মতই, বোবা।
বিছানার চাদরটাও নীল বলে মনে হচ্ছিল। মহিলার চোখ দুটোও, সম্ভবত। আমার ঠিক মনে পড়ছে না এখন। আমার জিভ থেকে রঙের কোরকগুলো মুছে গেছে। শুধু মনে পড়ছে যে আমি ওই নীল নৈঃশব্দ্যের কথা আর ভাবতে পারছিলাম না।
তারপর, আমি এলাম।
-------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি: লেইরে বিয়াতে গার্সিয়ার জন্ম স্পেনের বিগোতে। বহু ভাষায় পারদর্শী এই লেখিকা একজন ভাষা শিক্ষিকা। বিগত দশকের প্রথম দিকে কয়েক বছর কলকাতায় ছিলেন। মূলত গদ্য লেখেন ইংরাজি ও স্প্যানিশ ভাষায়। সংবাদ প্রতিদিন, দুকূল, পরম্পরা, দ্য ড্রিমিং মেসিন প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর নানা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। নিজের লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করে চলেছেন।