Tuesday, November 16, 2021

দাক্ষিণ্য | অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

ফিরে এসে দেখি আমাদের ছাউনির

মাঝখান দিয়ে রেললাইন ছাড়াই

ট্রান্সআটলান্টিক এক্সপ্রেস 

ছুটে গেছে, আর সমস্ত সুনশান


যাবার মুখে বিলিয়ে গেছে তার 

করুণাঘন একটি ইশতেহার:

"যারা মৃত তাদের জন্য আর 

ভিসা লাগবে না নায়েগ্রা দেখবার।।"



কবির পাণ্ডুলিপি সৌজন্যে: এলিজাবেথ গ্যুন্টার

Poems of Alokeranjan Dasgupta | Translated by Elisabeth Gunther

I HAVE REMAINED AN EXAMINEE

Alokeranjan Dasgupta


Still I have remained a mere examinee, the bearers, 

having laid me down on the cremation ground 

and taken their reward, began investigating whether 

my singing voice was still intact. A portly priest 

pocketed his fee and wanted to see my bio-data; 

his holy thread was dirty enough, but penetratingly 

he assessed how pure I had been in manner of life. 

Were I to give him a false reply, that scoundrel 

wouldn't give me a chance to enter errata, but simply 

lay me out on the pyre. Even if I were to provide 

the right response, he would sell my body to the flames.

Autumn and winter are watching me now, almost algebraically. 

 

I AM THE BLISS

Alokeranjan Dasgupta

  

I am the bliss you render

     into a lonely night 

so that no-one can decipher

     your identity ever. 

               

I am the juvenile

     élan vital that you

transmute into an abysmal smile          

     so that no-one may find a clue 

to your innermost blessedness 

     beyond pleasure and grief

where you and I each other embrace

     lying on a lotus leaf.


Photo Courtesy: Elisabeth Gunther, Germany

প্রহরশেষের অলোকরঞ্জন | রজতকান্তি সিংহচৌধুরী

'সভামিছিল এবং শায়াশেমিজের পিছনে ছোটাই সকল কালের সব যুবকের স্বধর্ম হতে পারে না।' পঞ্চাশের সেই শুরুর দিনগুলোতে লিখেছিলেন নানা অর্থেই অগ্রজ কবি অরুণকুমার সরকার। সেদিন পঞ্চাশের তরুণ কবিদের মুখপত্র 'শতভিষা'র (অষ্টাদশ সংকলন, ১৩৬৩) পাতায় 'বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা' নামের এক নির্ণায়ক নিবন্ধে। কী ছিল এ লেখার পটভূমি? পঞ্চাশের সূচনার দিনে একদিকে ছিল 'জনগণের কবিতা চাই', 'বিপ্লবী কবিতা লেখো' ধরনের ফতোয়া। অন্যদিকে ছিল যৌন কবিতার দাবি, 'সকল কবি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে কামুক হয়ে উঠতে পারেননি' ধরনের আক্ষেপ। তার মধ্যেই 'শতভিষা'র (১৯৫১) অঙ্গীকার ছিল, আমরা কবিতাকে আবার কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনব।' অনেকটা ডব্লিউ বি ইয়েটসের ধরনে উচ্চারণ, 'যা-কিছু কবিতা নয়, তাকে কবিতা থেকে বাদ দিতে হবে একেবারে।' কবিতার অন্তর্মুখীনতা এবং শুদ্ধতার কাছে ফিরে আসাটাই ছিল 'শতভিষা'র শপথ। বছর দুয়েকের ভেতরে বেরুল ‘কৃত্তিবাস' (১৯৫৩)। 'শতভিষা'র ঝোঁক যদি ছিল 'ব্যক্তিত্বচিহ্নিত' কবিতার দিকে, ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রবণতা 'স্বীকারোক্তিমূলক' কবিতায়। 

বাংলা কবিতার মৌলিক লিরিক্যাল স্বর, যা পঞ্চাশের অব্যবহিত আগে কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিল, তা ফিরে এল ‘শতভিষা’য়, ‘কৃত্তিবাস’-এ, পঞ্চাশের নতুন কবিতায়। গত শতকের পাঁচের দশকটি ছিল পুনরধিকারের, পুনরাবিষ্কারের, পুনর্জন্মের, পুনরুজ্জীবনের প্রাচুর্যে, প্রত্যয়ে, সামর্থ্যে স্পন্দমান। পঞ্চাশের কবিদের মেধায়, অনায়াস শব্দছন্দদক্ষতায়। এঁদের জন্ম বিশ্বব্যাপী মন্দার ভেতরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে, বয়ঃসন্ধি স্বাধীনতালগ্ন দেশদ্বিখণ্ডনের ছিন্নভিন্নতার মধ্যে। তবু এঁদের লেখালেখিতে টি এস এলিয়ট-কথিত 'পোড়ো জমি' পেরিয়ে দিকপ্রান্তে ক্ষীণ নীলাঞ্জনরেখার অনুসন্ধান দুর্নিরীক্ষ্য নয়। রবীন্দ্রকবিতা থেকে স্বরের স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পেতে তিরিশের কবিতা যেমন মনীষিতা আর শিল্পিতাকে আশ্রয় করেছিল, চল্লিশের কবিতার একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছিল জনসংহতির লড়াকুপনায়, পঞ্চাশের কবিদের ফিরে যাওয়া ছিল কবিতার বিশুদ্ধতায়, সহজ শুশ্রূষায়। আলোক সরকারের কবিতায় বাংলা কবিতার বিশুদ্ধতম রূপ আমরা খুঁজে পাই। (সেই শুদ্ধস্বরের উত্তরাধিকার এই শতকে গত দুই দশকে যেসব তরুণ লিখতে এসেছেন, তাঁদের কবিতায় প্রগাঢ় আর এটাই হয়তো তাঁদের ভেতরে আলোক সরকারের কবিতার প্রতি ভালোবাসার কারণ।) অলোকরঞ্জনও বিশুদ্ধতারই কবি, তবে অসংখ্য বাঁকবদল আর স্পন্দিত আঙ্গিকে ওঠানামা তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। ছেচল্লিশটি কবিতার বই নিয়ে তাঁর কাব্যপ্রবাহে শাশ্বত হতে চাওয়া কবিতার পাশাপাশি সমকালের রক্তক্লেদে লগ্ন কবিতাও দেখতে পাব। পঞ্চাশের সেই সূচনার দিনগুলি শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু সহ অতজন প্রধান প্রধান কবির ভেতরেও তিনি ছিলেন নিজভূমে স্বরাট। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের সেই ঐতিহাসিক কবিসম্মেলনে জীবনানন্দ থেকে তরুণতম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবধি বাহাত্তর জন কবির ভেতরেও কুড়ি বছরের তরুণ অলোকরঞ্জনের 'আমার ঠাকুমা' কবিতাটি কীভাবে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তা লিখেছেন কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ, 'একটি নতুন আবিষ্কার ওই সন্ধ্যার যাবতীয় যাদুস্পর্শ ছাপিয়ে গিয়েছিল: অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সে সময়ে যাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর, একটি কবিতাপাঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন আপ্লুত করে দিয়েছিলেন, কবিতাটি ছিল “আমার ঠাকুমা”।' ('আধুনিক কলকাতার সাহিত্যলোক : ১৯৪১ থেকে ১৯৮০', শঙ্খ ঘোষ)। এই কবিতাটি দিয়েই 'শতভিষা'য় অলোকরঞ্জনের আত্মপ্রকাশ, পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগে অন্যতম সম্পাদক দীপঙ্কর দাশগুপ্ত কবিতা চেয়ে চিঠি দেন অলোকরঞ্জনকে। পরে ‘যৌবনবাউল’-এ অন্তর্ভুক্ত এ কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন অরুণকুমার সরকার, এ লেখার গোড়ায় উদ্ধৃত সেই নিবন্ধটিতে। আর তাঁর কবিতা সম্পর্কে অনেক পরে  কবিবন্ধু আলোক সরকারের নিরীক্ষা, 'রূপদক্ষ, ভাষাভূষণপ্রিয় কবি অলোকরঞ্জন। শব্দ তাঁর হাতে পালিত সারমেয়ের মতো ওঠে বসে।' 

অলোকরঞ্জন তাঁর কবিতাযাত্রায় প্রসন্নতার সম্বুদ্ধ স্বরূপ থেকে সরে এসেছেন রক্তক্ষরণের মরপৃথিবীতে। তাঁর চলতে থাকার চালচিত্তিরে 'যুদ্ধ' তাঁর কাছে দুই সিলেবলের অশ্লীলতম শব্দ হয়ে উঠেছে। তাঁর দেশজ দোতারাতে বেজেছে ভুবনতল্লাটের সুর। বাংলা ভাষাই হয়ে উঠেছে দীর্ঘ  প্রবাসে তাঁর অনন্য আবাসন। তাঁর কবিতায় বারেবারেই এসেছে বাঁকবদল। বারেবারে হারানোর মধ্যে ফুটেছে নতুন করে পাবার আকুতি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাযাত্রায় তত-আলোচিত-নয় যে-শেষ দশকটি সেখানে আমরা দেখব, তাঁর কবিতা নব নব উন্মেষশালিনী কল্পনামনীষার দৌলতে নতুন নতুন দিগন্তের অভিসারী। বাংলা কবিতার প্রথানুগ সীমান্তরেখাকে অতিক্রম করে গেছে অনায়াস শৈলীতেই। 

আমাদের এই মিতকথনে, আমরা তাঁর শেষ পাঁচ বছরের অসামান্য কবিকৃতি থেকে কয়েকটি কণিকা মাত্র দেখবার চেষ্টা করি?

দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি

প্রথম বই ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) থেকে দ্বিতীয় বই 'নিষিদ্ধ কোজাগরী'র (১৯৬৭) আট বছরের ব্যবধান ছিল। পরে পরপর প্রকাশিত দুটি বইয়ের ভেতরে ব্যবধান কমে আসে। আর ২০১৬ থেকে ২০২০ তাঁর জীবনের এই শেষ পাঁচ বছরে প্রতি বছর একটি করে কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে অলোকরঞ্জনের। অশীতিপর বয়সে এই সৃষ্টিশীলতা বিস্ময়কর। 

২০১৩ সালে কবি আশি বছর পেরিয়েছেন। চলে গেছেন জীবনসঙ্গিনী শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত (২০০৫)। বিধ্বংসী শোক পেরিয়ে কবি উপনীত হলেন উত্তরপর্বে। রবীন্দ্রনাথ এক অর্থে তাঁর জীবনদেবতা। তাঁর অন্ত্য পর্বের সৃজনশীলতা শেষ দশকের রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ায়।

দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি'। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের উত্তরপর্বের কবিতায় এক উজ্জ্বল মাইলফলক। সদ্যপ্রয়াত কবির ছ'দশক জোড়া  দীর্ঘ কবিতাযাত্রার শিখরে 'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি'(২০১৬), 'তোমরা কি চাও, শিউলি না টিউলিপ' (২০১৭), 'শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮), 'ঝাউ-শিরীষের শীর্ষসম্মেলনে (২০১৯), 'বাস্তুহারার পাহাড়তলি' (২০২০) নিয়ে শেষ পঞ্চকের সূচনা এই অন্তময়তার রেশ মাখানো কবিতার বইটি দিয়েই। লক্ষ করবেন, তাঁর অধিকাংশ কবিতার বইয়ের নামও ছন্দোময়, তাঁর কবিতার মতোই। মালার্মের মতো তিনি বিশ্বাস করেন, সরকার আসবে যাবে, কিন্তু ছন্দ থেকে যাবে। এ বইটির নামে এসে গেছে একেবারে লোকায়ত, প্রায়  সবার জানা এক ছেলেভুলানো ছড়ার চরণ এবং ছন্দ, শ্বাসাঘাতপ্রধান স্বরবৃত্তে। বইয়ের নামকরণে এবং অনেক কবিতায় বেলাশেষের বা বিদায়ের ছবি, কিন্তু সে বিদায়সুর কোনো নিরাশায় তলিয়ে যায় না। সে-সুর মধুর, কৃতজ্ঞতার,মুগ্ধতার। এই আলো এই সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর মাঝখানে তিনি  হয়ত থাকবেন না, কিন্তু কীই বা আসে যায় তাতে!  এইখানে তাঁর জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের সুরে সুরে গেয়ে উঠতেই পারেন সুধাকণ্ঠ  অলোকরঞ্জন 'নাই যদি রোস নাই রবি'। 'অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ' ভরিয়ে তোলবার নেশায়, হলই বা সেটা সায়ন্তনের 'ক্লান্ত' ফুলের গন্ধ।

মূলত 'যৌবনবাউল' এবং অংশত তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের কবিতা নিয়েই তাঁর কবিতার অনেক আলোচনা শেষ হয়, 'মরমী করাত' (১৯৯০) বা 'রক্তমেঘের স্কন্দপুরাণ'(১৯৯৩) অবধি যার শেষ সীমা। এর একটা কারণ হয়তো, ছোট ছোট প্রকাশন থেকে বের হওয়া তাঁর অনেক বইয়ের অলভ্যতা, দে'জ-কৃত কবিতা সংগ্রহের এ তাবৎ তিনটি খণ্ডই প্রকাশিত। 

'শ্রেষ্ঠ কবিতা' নিঃশেষিত। এইসব কারণে এরপর থেকেই বুঝি শুরু হয়ে যায় পূর্বজ আর এক দাশগুপ্ত কবির মতো পাঠক হারানোর বৃত্তান্ত। উত্তরপর্বের জীবনানন্দ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর অনাগ্রহ কি একই ধাঁচের নয়? 

এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। ছোটোবেলায় ঠাকুর্দার মুখে শোনা  গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের এই বীক্ষা মেনে  কবিতা থেকে কবিতার সঞ্চারপথে পুনরুক্তিপ্রবণতা খারিজ করে চলা অলোকরঞ্জনের নানা পর্যায়ের কবিতার ধরতাই এখনও অনেক কবিতাপ্রেমী পাঠকের অধরা।

এ শতকে তাঁর  লেখালেখি নিয়ে আলোচনা নজরে পড়ে কম। শুধুমাত্র শেষ পাঁচটি কবিতার বইয়ের ঋদ্ধিঋণ বাংলাভাষাভাষী হিসেবে  বর্তমান বিনীত প্রতিবেদককে কৃতজ্ঞ করে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গাল্ফ যুদ্ধ ‘যৌবনবাউল’ -এর এই প্রতীতির জায়গাটাকে আরোই দীর্ণ করে দিল, লেখা হল 'আয়না যখন নিঃশ্বাস নেয়' (১৯৯২), 'রক্তমেঘের স্কন্দপুরাণ' (১৯৯৩)-এর মতো বই, যুধ্যমান বিশ্বে কবির বিমূঢ়তা, বিবমিষা। 'যুদ্ধ' হয়ে ওঠে তাঁর কাছে দুই সিলেবলের অশ্লীলতম শব্দ। মানুষের মুখ উৎকীর্ণ হয়, এমন কবিতার প্রতি অকুণ্ঠ আসক্তি প্রকাশ করছেন তাঁর বয়ানে। অবশ্য সেই  মানুষের মাঝখানে 'আলোকতোয়া' নদী আর 'জ্যোতিগৃহ সম্পন্ন' করবার স্বপ্ন ও প্রস্তুতি তাঁকে ছেড়ে যায়নি।  

নতুন শতকে  দ্বিতীয় যন্ত্রবিপ্লব সাধিত হল। মোবাইল, কম্প্যুটার, ইন্টারনেট, আই ফোন, সোশ্যাল  মিডিয়া -শাসিত বিশ্বে কবি অনুসন্ধান করতে লাগলেন প্রাথমিক মানবিক সম্পর্কগুলোকে। পারস্যের কবি হাফিজের অনুরণনে লেখা জার্মান মহাকবি গ্যোয়েটের 'ডিভান' কাব্যের বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে বাউল-সুফি-মরমিয়া-দরবেশদের ভাবলোককে পুনরাবিষ্কার করলেন ‘যৌবনবাউল’। মোবাইলে মুখ-গোঁজা, শপিং মলে কথাহারা ইঙ্গিতে বাজার-করা ভাষাহীনতার যান্ত্রিক পৃথিবীতে আমরা দেখব ‘যৌবনবাউল’ ক্রমশ তাঁর অনাহত প্রতীতির বিদীর্ণ জায়গাটার শুশ্রূষায় নিবিষ্ট। ভোগবাদের মহামারীর বিপরীতে বহিরঙ্গ ছেড়ে চিদঘন অন্তর্লোকের অনুসন্ধানী অলোকরঞ্জন। ‘দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি' (২০১৬) তাঁর এই পর্বের উল্লেখ্য ফসল।

পার্থপ্রতিম দাসের অসামান্য প্রচ্ছদে শোভিত পাঁচ ফর্মা-ছাপানো এই 'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি' বইয়ের বিভাব কবিতায় কবি লিখছেন,

মনের ভেতর গুমরে ওঠে 

ধাই-মার সেই দাবি

'মাছের কাঁটা পায়ে বিঁধলে

দোলায় চেপে যাবি


দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি 

    গুনতে গুনতে যাবি'... 

প্রথম কবিতার নাম '২০২'।  বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিবিজড়িত ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ ঘিরে  "আমাদের তারুণ্যের শেষ তীর্থ 'কবিতা ভবন'।" শ্মশানের অন্য নাম 'পিতৃবন'। এ বইয়ের 'পিতৃবন' কবিতায় তাই পেয়ে যাই তাঁর স্নেহাপ্লুত বাবা বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্তকে, শ্রীমান অলোকরঞ্জনকেই যেন  তিনি চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁর 'ক্ষমাহীন দুর্বলতায়'। দূরান্বয়ে স্মরণে আসে, কবি শ্রীমধুসূদনের 'মেঘনাদবধকাব্যে'র 'প্রেতপুরী' নামধেয় অষ্টম সর্গে লক্ষ্মণের শক্তিশেলের প্রতিকারকামনায় সশরীরে স্বর্গলোকগামী রামের দর্শন পেয়ে ঊর্ধ্বলোকবাসী পুত্রশোকে লোকান্তরিত দশরথের স্নেহাকুল মুখচ্ছবি, যিনি রামকে দেখে বলে উঠছেন, 'আইলি কি রে এ দুর্গম দেশে / এতদিনে, প্রাণাধিক, দেবের প্রসাদে,/ জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়?'।  'পিতৃবন' কবিতায় অলোকরঞ্জন দেখেন, তাঁর পিতার পিছনেই দাঁড়িয়ে পিতামহ দক্ষিণারঞ্জন, 'যৌবনবাউল'-এর সুখ্যাত 'আমার ঠাকুমা' কবিতার সেই 'শহরবিদ্বেষী' মানুষটি,  যিনি সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় ভিটেপত্তন করে  তাঁর বড়ো নাতি অলোকরঞ্জনের বয়স যখন 'বড়োজোর পনেরো', তখনই সেই জ্যেষ্ঠ পৌত্রের হাতে 'তবু আমায় পারিবারিক দুর্গাপূজার ভার তুলে দিয়েছিলেন'। এভাবেই পরিজনেরা ঘুরে ঘুরে আসেন অলোকরঞ্জনের কবিতায়, যেমন অনুধাবন করেছেন  শঙ্খ ঘোষ ('আমার বন্ধু অলোকরঞ্জন')। আর সেই পরিজনদের সীমা বিস্তারিত হতে হতে চলে দুনিয়াভর, রক্তসম্পর্কহীন  দীনতম বৃদ্ধ মানুষটিও কবির আত্মীয়। 

আর, এ বইতেই টানা গদ্যে লেখা 'অনাবাসী যদি অনুবাদ করে' কবিতায় লিখলেন, 'তুলসীতলার আজলকাজল মায়ামদির নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে ইহমানুষের কপাল থেকে বাস্তুদেবতার আশীর্বাদ চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে যায়, তার বরাতে তখন চলতে থাকার চালচিত্তির ছাড়া অন্যতর কোনো বিধিলিপি অবশিষ্ট থাকে না। তখন থেকেই সম্ভবত ভাষাই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র আবাসন।' হাইডেগার-অনুরণিত এই আভাষণ অলোকরঞ্জনেরই সিলমোহর হয়ে ওঠে আজকের  ভুবনজোড়া শরণার্থীর মেলায়।

অলোকরঞ্জনের কবিতা-বইয়ে শতেক যুগের কবিদলের আনাগোনা, শতেক যুগের গীতিকা হাতে। এ বইয়ের 'স্বরশয্যায়' কবিতায় স্বভাবসম্মিত সৌজন্যেই উপস্থিত শিল্পাচার্য শিলার ও শিষ্য নোভালিস।

'দাহ' কবিতার শেষ দুই চরণ এক মুগ্ধ বিস্ময়ের সামনে আমাদের উপনীত করে: 

      অর্থাৎ কিনা আমার মৃত্যু হয়নি সুচারুভাবে, 

      অর্থাৎ কিনা আমাকে নিয়েই তোমরা দিন কাটাবে..


তাই হোক, তবে তাই হোক, অলোকদা!

'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি' বইয়ের উপান্ত্য কবিতা 'পালকি করে যারা আমায় নিয়ে চলেছে'তে পাই, তাঁর পালকির বাহকেরাই কখন নিজেদের অজান্তেই তাঁর শববাহক হয়ে উঠেছে। 'আমার হাতে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি', একটি বাহক, যার নাম হয়ত নিখিল, সে চায়, শেষ বইটির 'অপূর্ণতা পূরণ' করে ছাপতে দিতে, পুঁথি বিষয়ে গবেষণায় যার নাকি ডি. ফিল.'..

আহা, সত্যিই আজ যদি আমরা এমন 'অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি' খুঁজে পেতাম। 'কবিসম্মেলন', 'কবিতা আশ্রম'-সমেত নানা পত্রপত্রিকায় তাঁর  সাম্প্রত শারদ অঞ্জলি এখনও তো গ্রন্থভুক্ত হতে বাকি। দৈববাণীর মতো দূরভাষে ভেসে আসা কিছু কবিতার শ্রুতিলিপিকর তো এই প্রতিবেদকও। 

এ বইয়ের উপান্ত্য কবিতা 'পালকি করে যারা আমায় নিয়ে চলেছে' পড়ে যেই না পাঠক সজলচক্ষু হতে যাবেন, অমনি আসে অলৌকিক শৈলীতে অমোঘ আশ্বাস, বইটির সবশেষ কবিতায়:

আমার জন্য  হা-হুতাশন কোরো না, অরুণাভ,

উত্তরাধিকার সূত্রে পুণ্য পারমিতার 

ছ'পণ কড়ি সঞ্চয়িত আছে আমার দোলায়, 

বাকিটা পথ গুনতে গুনতে যাব!

এ বই কবি উৎসর্গ করেছেন কবি নাসের হোসেন আর বর্তমান প্রতিবেদককে। এ তাঁর উদার কবিচারিত্র‍্যেরই এক মুদ্রা।

৩      

'তোমরা কী চাও, শিউলি না টিউলিপ?' (২০১৭) পরবর্তী বই। উৎসর্গ করা হয়েছে অমিয় দেব এবং সৌরীন ভট্টাচার্যকে। কবির প্রথম পর্বের কবিতা ছিল দেশজ নিসর্গকে নিয়ে, লোকজীবন, আস্তিক্যবোধকে জড়িয়ে। তাকে তিনি শিউলি বলে অভিহিত করছেন। আর উত্তরপর্বের আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লাগা কবিতা তাঁর টিউলিপ ফুল। পাঠকের কাছে প্রশ্নময় শিরোনাম তাই, 'তোমরা কী চাও, শিউলি না টিউলিপ?' আমরা অবশ্য দুটোই চ্চাই। এক সভায় এমন কথাই জানিয়েছিল এই প্রতিবেদক।

কবির ঠাকুর্দা দিনাজপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধান শিক্ষক দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত অবসর গ্রহণের পর সাঁওতাল পরগনার রিখিয়া গ্রামে নতুন করে ভিটে পত্তন করে  বাস করতে শুরু করেন। পশ্চিমের নিসর্গনন্দিত রিখিয়ায় তিনি যৌথ পরিবারের বসবাসোপযোগী একটি মনোরম পরিসরও নির্মাণ করেন। বড়ো নাতি অলোকের জন্মের পর তিনি সেখানে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন, অলোকরঞ্জনের ওপর এই পুজোর ভারও দিয়ে যান তিনি। পুজো উপলক্ষ্যে বৃহৎ যৌথ পরিবারের সবাই সেখানে জড়ো হত। অলোকরঞ্জনের শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি রিখিয়ার সঙ্গে যুক্ত, ‘যৌবনবাউল’-এর বহু কবিতায় রিখিয়া, বাবুডি, আমরুয়া, চানন নদী,  হিরনা টিলা, ত্রিকূট পাহাড় সহ এখানকার নিসর্গ ও লোকজীবনের ছবি। প্রায় চল্লিশ বছর চলেছিল এই বসতবাড়ির পুজো। বইটির বিভাব কবিতাতেই আমরা তাই দেখব,  'বসত বাড়ির শেষ বারকার পুজোয়/ শেফালিকার শুভ্র আগুনটাকে/ চয়ন করে বেরিয়ে পড়লাম/ প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে'। এই বেরিয়ে পড়া থামল এক ভিনদেশের গাঁয়ে, 'সেখানে দেখি অজস্র টিউলিপ/ যা শুধু লাগে নশ্বরের কাজে'। শিউলি পূজার উপচার, অন্যদিকে টিউলিপের তেমন কোনো আধ্যাত্মিক গরিমা নেই, নশ্বরের কাজেই তার ব্যবহার। মরমী কবির প্রথম পর্বের কবিতা যদি অতীন্দ্রিয়তায় লগ্ন, পরবর্তীতে তাঁর কবিতায় নৈমিত্তিকের নশ্বর সৌন্দর্য ও কদর্যতার অভিক্ষেপ। 

উত্তরপর্বে তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লাগলেও কবি স্বদেশের সঙ্গে নিরন্তর সংলাপরত। বাংলা ভাষাই হয়ে ওঠে তাঁর আবাসন। দেশজ আচার, পার্বণ আরো নতুন তাৎপর্য পায় তাঁর কবিতায়। 

'ভাইফোঁটার দেয়ালটা' কবিতায় বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে প্রয়াত মেজদির জন্য প্রবাসী ভাইদের বেদনা এক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে ওঠে কবির অননুকরণীয় শৈলীতে: 'মেজদি মারা গেলে আমরা ছ-ভাই যথারীতি প্রথানুগত সম্ভ্রমে টালিগঞ্জের/ পোড়ো সেই বাড়িটায় জড়ো হয়েছিলাম। বাপুয়া এসেছিল ব্রেজিল থেকে/ বিবদমান দুই শিবিরের মধ্যে সাময়িক মোকাবিলা/ স্থগিত রেখে ৷ লিবিয়ায় ভ্রাতযুদ্ধে শামিল হয়ে ডানচক্ষু/ জখম হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং পিন্টু এসে হাজির, তাকে আগলিয়ে/ ধরে ধরে এনেছিল বাদল আর বুলবুল ৷ গোরা আজকাল কানে/ শুনতেই পায় না, তবু একে-ওকে জিগ্‌গেস করে শেষ মুহূর্তে কী করে জানি হাজিরা দিল।/ পাশের বাড়ির মালি তালা খুলে আমাদের নিয়ে গেল চোরাগোপ্তা/ একটি কুঠুরিতে যার একটাই মাত্র দেয়াল । যে সব ভাই ভাইফোঁটার দিন/ আসতে পারেনি সেই দেয়াল জুড়ে তাদের জন্য মেজদির দেওয়া চন্দনের ফোঁটা থরে থরে বিকীর্ণ রয়েছে!/প্রথমে অনপনেয় যুদ্ধাপরাধীর মতো নিজেকে মনে হলেও পরক্ষণে মনে হল/এ আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রপ্রদর্শনী'। 

লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বরাবরই আশাবাদী অলোকরঞ্জন। শেষ দিকে মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন। 'অমৃতলোক' পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক সমীরণ মজুমদারকে নিয়ে একটি কবিতা আছে এ বইতে।  শেষ দু-লাইন, 

'পরবর্তী বিশেষ সংখ্যার জন্য অভিমন্যুতার     অভিমানে

সে যেন আমৃত্যু লেখে লিটল ম্যাগাজিনের      টানে।'

                                                             ('সমীরণ মজুমদার')

অভিমন্যুর পুরাণপ্রতিমা শেষ দশকে তাঁর খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, জয়-পরাজয় বলে কিছু হয় না, নিজের সত্যের কাছে সত্যবান থাকাটাই জয়। অভিমন্যুর মতো তিনি নিজেকে দ্বিতীয় বিজয়ী বলে দেখতে চান। শেষ দিকে তাঁর ভয়, কলকাতায় এলে আমি বাংলা ভুলে যাব।…আমি যদি কলকাতা থেকে দূরে কোথাও প্রয়াত হই, আমার স্মৃতির কলকাতা বুকে নিয়ে সানন্দে মরে যাব।' ('সন্ধিক্ষণের সাক্ষাৎকার', নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট?, ২০১৬)

এ বইয়ের শেষ কবিতা সদ্যপ্রয়াত কবিবন্ধু আলোক সরকারের স্মৃতিতে অনুস্যূত:

না-দেখা সে-ও আরেক দেখা

আসন্ন বই মেলার মুখে 

শরৎমেঘের সিংহদুয়ার 

তীর্ণ হয়ে চলে গেলেন আলোক সরকার;


লিটল ম্যাগাজিনের মুখে 

আজ নিদারুণ উত্তেজনা: 

এই তো সময় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবার


বস্টনের দিক থেকে 

যেই নায়েগ্রা দেখছিল আলোক 

কানাডা থেকে একই প্রপাত দেখতে গিয়ে পুষ্পস্তবক


বন্ধুকে দিই কৃতাঞ্জলি-

ক্ষীণ সাহসে তাই তো বলি:

না-দেখা সে-ও আরেক দেখা, আমার এ শোক হোক-না শোলোক!

এ কবিতা আমাদের অনিবার্যত মনে পড়ায় অনেক আগে লেখা ‘আলোক সরকার' নামের কবিতাকে। নায়েগ্রা জলপ্রপাতের  নিসর্গ দেখে উচ্ছ্বসিত আলোক সরকার বন্ধু অলোকরঞ্জনকে ফোন করেন, তারই পটভূমিতে লেখা হয়েছিল কবিতাটি।

'শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮) তাঁর পরবর্তী বই। 'গিলোটিনে আলপনা' বা 'মরমী করাতে'র মতো এ বইয়ের নামকরণেও বিরোধাভাস ।  আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যই যার মূলসূত্র। এই বিপর্যাসের টানে আশাবাদও ধূসরিম হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায় :

কারুক্কে বলিনি তা:

আমার ভিতরে

এক ধরনের ধূসরিম আশাবাদ 

তৈরি হতে চলেছে


ধূর্ত অতনু আকাশে-বাতাসে 

এই খবরটা রটিয়ে দেওয়ার আগে 

স্বর্ণিল আশাবাদের ওপর লিখে চলি আমি 

কবিতা কবিতা কবিতা              ('বিপর্যাস')

তাঁর শিকড়চেতনা সংলগ্ন হয় বিশ্বজোড়া শরণার্থীচেতনার সঙ্গে।  সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী-সংকটে তিনি স্মরণ করেন  আরাকান রাজসভায় মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের কথা, 'যেমন কিনা সৈয়দ আলাওল/ পেরিয়েছিলেন পথের ডামাডোল' ('রোহিঙ্গা! রোহিঙ্গা!')

তবু বিশ্বসংকট ও বিপর্যয়েও তিনি শুদ্ধ কবিতার শুকতারার আলোকে ভুলতে পারেন না। প্রাচীন গ্রিসের মাউন্ট হেলিকনের আবহমান ধারায় অভিস্নাত হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেসের অনুগামী কবি :

    আবহমান

    কোথায় কবে শুনেছিলাম মাউন্ট হেলিকন

     রয়েছে গ্রিসে, তারি হৃদয় থেকে 

     ঝরনা হয়ে কবিতা নামে যার শ্রুতিলিখন


            করে গেছেন হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেস; 

            আরও আমার অনেক শতেক পূর্বসূরি,

             আমার যতেক পদ্য লেখা তাঁদের কাছেই চুরি।


              হেলিকনের মুক্তধারা একটু আগেই আমায় 

               বিসর্পিল বলল এঁকেবেঁকে :

           ‘একটি নতুন কবিতা চাই তোমার হাত থেকে।'

গ্রিসের মিথসঞ্জাত হেলিকন অনায়াসেই মিশে যায় কবির নিজস্ব রাবীন্দ্রিক মুক্তধারার মুক্তিস্রোতে।

'নিজেকে খুঁজতে গিয়ে' কবিতায় পাচ্ছি পূর্বসূরি গ্যোয়েটেকে, মিকেলেঞ্জেলো বা রাফায়েল নয়, 'নিছক রক্তের টানে'ই তাঁর গ্যোয়েটের সন্ধান রোমে। প্রসঙ্গত, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'গ্যোয়েটে ও রবীন্দ্রনাথ', জার্মানির সর্বোচ্চ গ্যোয়েটে পুরস্কারেও তিনি বৃত। হাইনে, রিলকে, হ্যোল্ডারলিনের মতো গ্যোয়েটের কবিকৃতির তিনি মূল জার্মান থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন।

ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৯) অলোকরঞ্জনের উপান্ত্য বই। অনুজ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য এবং পার্থপ্রিয় বসুকে উৎসর্গ করা। 'বিভাব কবিতা' বিষয়টি বাংলা কবিতায় তাঁরই সংযোজন। অনুজ অনেক প্রধান কবি তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাঁদের বইয়ে বিভাব কবিতা যোগ করেছেন। এ বইয়ের বিভাব কবিতায় আমরা দেখব, পরিবেশ-সচেতন অলোকরঞ্জনকে, যিনি ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে দেখছেন একটিও গাছ নেই!  আমরা জানি, ইতিমধ্যেই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন পরিবেশবাদী জার্মান কবি সারা কীর্শের কবিতা।  আর ‘যৌবনবাউল’-এর দিন থেকেই তাঁর দর্শনে, 'বৃক্ষের বিষাদনেত্রে আয়ত পত্রের অশ্রু ঝরে।' উল্লিখিত এই বিভাব কবিতার শেষে দেখছি অবশ্য, 

             এক হাজার কবিতার স্পন্দনে 

             আচম্বিতে লক্ষ করা গেল 

             চোখের সামনে অমূর্ত গোলাপ

              আত্মসমালোচনার ঢঙে কবিদের নার্সিসাসবৃত্তিকেও দায়বিদ্ধ হতে হয়,

                     আর নার্সিসাস আমরা এখনও পদ্যের চর্চা করি, 

                     তবে কিনা প্রত্যেকেই পড়ি শুধু নিজের কবিতা!

এ বইয়ের শেষে অনুস্যূত হয়েছে রাজেশ্বরী দত্তের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে একটি অসামান্য দীর্ঘ কবিতা 'রাজেশ্বরী : একটি শোকগাথা'। কবি উপনীত এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউ-টিউব, স্মার্ট ফোনের তড়িঘড়ি সংযোগময়তার দৌলতে বসুন্ধরা থেকে 'নির্বাসিত নিভৃত পৃথিবী' :

            তখন তো হোয়াট্স-অ্যাপ ইউ-টিউব কিংবা স্মার্ট ফোন 

            ইত্যাদি ছিল না, আজ ঘরে ঘরে এসেছে ডিভিডি, 

           কারুরই দরকার নেই, ধরিত্রীর সঙ্গে সরাসরি 

           বনিবনা ঘটে যায় মুহূর্তেই আর যার ফলে 

           বসুন্ধরা থেকে আজ নির্বাসিত নিভৃত পৃথিবী।       


     এ কবিতা শেষ হচ্ছে, 

              আমার গহন কুলুঙ্গিতে রাত্রিদিন কয়েকটি মোম জ্বলে 


উদযাপনের উল্লাসে নয়, নিছক বেঁচে থাকার কৌতূহলে।

দ্বিতীয় পাঠে এই শেষ দু লাইনের প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়তে বাধ্য। দুটি চরণেই ১০+১২ বাইশ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । উদ্ধৃত প্রথম লাইনে ৩+৩+৪ এবং ৪+৪+২+২ এর সরল, প্রথানুগত বিন্যাস। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে তা ভেঙে যাচ্ছে ৫+৩+২ আর ৩+২+৩+৪ এর বিপ্লবে।

সেই কারণেই হয়তো অপ্রেম আর সংকটের পৃথিবীতে বসেও এ বইয়ে বলেন, 'অপ্রেমে ধরণী/ ক্লিন্ন হয়ে যাবে, তবু ছন্দ লিখতে হবে।' অবশ্য এই অন্ত্য পর্বে গদ্যে লেখা কবিতাও তাঁর কম নয়। কবির কাজ গোষ্ঠীর ভাষাকে অমলিন রাখা। গত ষাট-সত্তর বছরে যে-স্বল্পসংখ্যক গুণিজন বাংলাভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে ব্রতী, অলোকরঞ্জন তাঁদের অন্যতম। নতুন নতুন সমাসবদ্ধ পদ বা প্রতিশব্দ নির্মাণই শুধু নয়, কবি ব্যবহার করেন মান্য বাংলায় অধুনা-অপ্রচলিত মধ্যযুগীয় শব্দ অথবা লোকভাষার শব্দ। এ বইতে যেমন এসেছে মাস্তুল শব্দের প্রতিশব্দ 'মালুমকাঠ' ( 'প্রতিশব্দেরা')। বাংলাভাষার মালুমকাঠগুলিকে এইভাবে চিনে নেন কবি। 'ভিসা ও ভবিষ্যৎ' কবিতায় এক অবিস্মরণীয় চিত্রকল্পে দেখি, তাঁর লুপ্ত ভিটের লাইব্রেরিতে রেখে যাওয়া দ্বিজ মাধবের পুঁথি এক কামিনী ফুলের ঝাড় হয়ে ফুটে আছে। 

বাস্তুহারার পাহাড়তলি (২০২০) আপাতত তাঁর শেষ বই। ইতিমধ্যে অভূতপূর্ব এক অতিমারির কবলে পৃথিবী কম্পমান। সংবেদনশীল কবির অনুভূতিকে তা স্পর্শ করে স্বভাবতই। তার ছাপ এ বইয়ে।

আজীবন ভারতীয় নাগরিকতা এবং পাশপোর্ট বজায় রাখা কবি শেষ ক’বছরে দেশে ফিরতেন বছরের শেষে ডিসেম্বরে, আর জার্মানির হির্শবার্গে তাঁর আবাসনে ফিরে যেতেন পরের বছরের শুরুতে, কলকাতা বইমেলার পরে। শেষ ফিরে যাওয়া ২০১৯ এর গোড়ায়। ২০১৯ এর শেষে মেরুদণ্ডের অপারেশনের কারণে তাঁর আসা নিষেধ ছিল। ২০২০ তে তো বিশ্ব পড়ল অতিমারির কবলে। তার মাঝখানেই ১৭ নভেম্বর, ২০২০ তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ। মাসখানিক আগে ৬ অক্টোবর তিনি অষ্টআশি বছরে পা দিয়েছিলেন। যদিও লেখালেখি বা চল্যাবলায় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ  সৃজনশীল ও সুস্থ। জন্মদিনের ঠিক আগে চলে গেলেন তাঁর আদরের ছোট বোন ছন্দা ( ৫ অক্টোবর, ২০২০ )।  একটি বৃহৎ পরিবারের 'বড়দা' অলোকরঞ্জন হয়তো তাঁর সবচেয়ে ছোটো বোন ছন্দার মৃত্যুশোক সামলাতে পারেননি। শেষবার ফোন করেছিলেন বোনের চলে যাওয়ার সংবাদ দিয়েই।

এই বই উৎসর্গ করা হয়েছে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্য ভারততত্ত্ব বিভাগে তাঁর উত্তরসুরি এবং প্রিয়শিষ্য হান্স হার্ডার এবং তাঁর স্ত্রী আন্দ্রেয়াকে। 

অলোকরঞ্জনের পারিবারিক শিকড় ঢাকা বিক্রমপুরের তেলিরবাগে। আমরা আগেই দেখেছি, তাঁর ঠাকুর্দা দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত পশ্চিমের সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় নতুন করে ভিটেপত্তন করেন। অলোকরঞ্জনের জন্ম অবশ্য কলকাতায়, যদিও রিখিয়া-শান্তিনিকেতনে তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা কেটেছে। তাঁর শিকড়চেতনা ক্রমশ মিশেছে বিশ্বজোড়া বাস্তুহারা মানুষের শরণার্থীচেতনায়।

গদ্যে লেখা এ বইয়ের বিভাব কবিতায় দেখব, 'এতদিন ধরে অন্তরঙ্গ যে সমস্ত আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে পথ চলছিলাম একে একে তাদের নিজস্ব জন্মভিটেয় নামিয়ে দিয়ে ভ্যানুইবের সৈকত ঘেঁষে বাসটা আমায় পৌছিয়ে দিল অস্তাচলে বাভারিয়া জঙ্গলের মনঃপূত একটি পরিসরে। পাহাড়তলির পর পাহাড়তলি দিয়ে গাঁথা এই জায়গাটা যেন আমার জন্যেই নির্বাচিত হয়েছিল।' প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রগবেষক অলোকরঞ্জন আগে দেখিয়েছেন, এই বাভারিয়ার জঙ্গলেই ১৯২৬ সালে 'ছোটো কথার ঝাঁকে' আক্রান্ত জার্মানপ্রবাসী রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আত্ম-উদ্বোধনের সেই আলোকিত গানটি, 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে'। 

বিভাব কবিতায় আমরা আরো দেখব, তাঁর যত্ন-আত্তির একবিন্দু বিরাম নেই। ক্ষণে ক্ষণে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখা হচ্ছে । দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত এক নার্স বৌদ্ধ হবে বলে কবির কাছে  শিখছে পালি ভাষা। কবি বলছেন, 'না, এখন থেকে প্রকাশ্য কোনো আলোচনাচক্রে যোগ দিতে আমি যাব না আর। মাত্র ন-দশটি পুথি-পত্তরসুদ্ধু একটিমাত্র নৌকো নোঙরে বেঁধে রেখে দিয়েছি, এইমাত্র। ধরিত্রী আমার ভঙ্গুর ভ্রূযুগ সন্ধিক্ষণে তার বরণডালা ছুইয়ে দিয়ে এক লহমা তাকাতেই আমার শিরা-উপশিরায় বেজে উঠল আমার সমগ্র বাঁচার সজল পিছুটান।' এমনতরো প্রসন্ন বিশ্রাম বা বিদায়ের প্রস্তাবনা দিয়েই সূচিত হয় বইটি। 

সংগীতের মতো শিল্পস্থাপত্যকলারও তিনি ভিতরমহলের বাসিন্দা কবি। তাঁর কাব্যপ্রবাহে যেমন সংগীতের নানা রাগরাগিণী, বিভিন্ন রবীন্দ্রগানের অজস্র উল্লেখ, তেমনি আছে রোমের ধ্রুপদী স্থাপত্য, সিস্টিন চ্যাপেল বা মিকেলেঞ্জেলোর নানা শিল্পসুকৃতির কথা। রবীন্দ্রনাথ এবং অমিয় চক্রবর্তীর পরে তাঁকেই আমাদের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক কবি হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ। তাঁর কবিতায় হিন্দু মিথোলজির পাশাপাশি ইসলামীয় বা খ্রিস্টীয় মিথ এসেছে অনায়াসে। 

২০১৯ এর ১৫ এপ্রিল এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপকভাবে  ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্যারিসের শিল্পসুষমামণ্ডিত নতরে দাম (Notre Dam) গির্জা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে জোরকদমে চলছে সংস্কারের প্রকল্প। এ বইয়ের প্রথম কবিতা ‘ধ্বংস ও প্রজাপতি'তে দেখছি আমাদের আশাবাদী কবিকে। তিনি প্যারিসে এসে দেখছেন ঝলসে যাওয়া নতরে দাম চার্চ। তার সামনে অবশ্য কিশোর চারণ কবির দল গান গাইছে ধ্বংস থেকে পুনরুজ্জীবনের আশায়। ধ্বস্ত চার্চের মতো প্রবীণ কবির নিজেকেও মনে হচ্ছে এক ধ্বংসাবশেষ। তবু কিশোরদের যৌথ সংগীতের লহরীতে কবি আত্মশক্তিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান,

           'তবুও যদি শেষ কবিতা প্রলয়কালের মেঘে 

           লিখে উঠতে না পারি তবে কী হবে বেঁচে থেকে?'

আর তক্ষুনি উঠে আসছে অমোঘ এই মৃত্যুঞ্জয়ী উচ্চারণ, কবিতার শেষ দুই চরণে :

           'আমার ডান কনুই ঘেষে মৃত্যুপরোয়ানা

           খারিজ করে কাঁপতে থাকে প্রজাপতির ডানা…'

তাঁর প্রিয় জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের কথা এ বইতেও স্বভাবতই উঠে এসেছে, “কবিদের সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো/ শিখিয়েছ 'মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা'--। প্রসঙ্গত 'মার্টিন হাইডেগার' শীর্ষক এ কবিতার প্রথম পাঠক এই প্রতিবেদক, যাঁর কাছে দূরভাষে এ কবিতাটি ভেসে এসেছিল। বস্তুত হাইডেগারের এই সদুক্তি আমাদের কবির কাছে প্রায় বীজমন্ত্রের মতো। ‘দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি' (২০২৬) বইয়ের টানা গদ্যে লেখা 'অনাবাসী যদি অনুবাদ করে' কবিতাতেও এই কথাটি উঠে এসেছে। অলোকরঞ্জনের দীর্ঘ প্রবাসজীবনে মাতৃভাষার সাধনাই তাঁর আশ্রয়স্থল। বাংলাভাষায় নতুন পরিভাষা বা শব্দনির্মাণ, নতুন ধরনের বাক্যগঠন তাঁর সারাজীবনের ব্রত। 'টেলি-অপারেটর' কবিতায় অপারেটরের যান্ত্রিক হিন্দিঘেঁষা বাংলা শুনে তিনি লেখেন, 'তাঁকে বললাম আমি কিন্তু/ নতুন রকম এই বাংলায়/ অনভ্যস্ত। বিভিন্ন কবিতায় এসেছে শিলার, কাফকা থেকে দীর্ঘজীবী জার্মান কবি এনৎসেনবার্গারের কথা। এসেছে মেহগনির টেবিলে যোজনজোড়া প্রাতরাশের মধ্যেও কবির 'মহামারীর থিমটা' নিয়েই লিখে চলার কথাও। এভাবেই শাশ্বত আর নৈমিত্তিক একাকার হয়ে আসে অলোকরঞ্জনের উত্তরপর্বের কবিতায়। 

তাই বুঝি 'ধ্রুব সংশয়', 'বিষণ্ণ কৌতুক' বা 'সুভদ্র প্রতিশোধ'-এর মতো অক্সিমোরনগুলো এ বইতেও উঠে আসে আমাদের এই ক্ষুভিত সময়কে ঘিরে উদ্যত বিরোধাভাসের দ্যোতনা নিয়ে। 

এ বইয়ের উপান্ত্য কবিতার নাম তাৎপর্যপূর্ণভাবে 'বয়েসের নিকুচি'। শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্তের প্রয়াণের পর অশীতিপর অলোকরঞ্জন হির্শবার্গে তাঁর বাড়িতে একাই থাকতেন। বিদ্যাচর্চা, ছাত্রদের পঠনপাঠন আর গোটা ইয়োরোপ জুড়ে নানা সেমিনারে যোগ দিয়ে।  দোতলায় তাঁর লাইব্রেরি। সিঁড়ি ভেঙে এই লাইব্রেরিতে উঠতে গিয়ে মেরুদণ্ডে চোট পান কবি, ২০১৯ এর ডিসেম্বরে তাঁর কলকাতায় ফেরা স্থগিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গটি এ কবিতায় এসেছে, 'সিঁড়ি আমায় ভাঙতে পারে এই ভেবে আর সিঁড়ি ভাঙি না--'।  

কবি 'feedback’ কথাটার এক মজাদার প্রতিশব্দ করেছিলে, 'প্রত্যাহার' (প্রতি+আহার)। তাঁর নিজস্ব বাকশৈলীতে। আজীবন পাঠকদের এই ফিডব্যাক বা পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্যে উন্মুখ থাকতেন প্রবাসী  অলোকরঞ্জন। এ কবিতার শেষে তাই দেখতে পাচ্ছি, 

'লিখছি হাজার সংলাপিকা, তোরা যখন বোবা রইলি/… জিইয়ে রেখে দিয়েছি আমি নিজস্ব এক বাকশৈলী।'

এক বছর হল অলোকরঞ্জন লোকান্তরিত। রয়ে গেল তাঁর বাকশৈলী, সোনার তরী ভরা তাঁর মহনীয় কাব্যসম্ভার। আমাদের দৃকপাতের প্রতীক্ষায়। পুলিনবিহারী সেনের প্রয়াণে অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন 'সন্ন্যাসীর মৃত্যু হলে কাকে যাব সান্ত্বনা জানাতে?' (বইয়ের নাম 'রিখিয়া থেকে অনেক দূরে') শীর্ষক এক অনবদ্য গদ্য। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, পুলিনবিহারীর মৃত্যুশোকে ভেঙে পড়া আরব্ধ কাজগুলোকে এড়িয়ে যাবার খঞ্জ অছিলা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। একইরকম ভাবে, এখন সময় হা-হুতাশের নয়, অলোকরঞ্জনের কবিতাকে নিবিড়ভাবে পাঠের, বাংলা কবিতার এই অর্হণীয় উত্তরাধিকারকে অন্তরের অন্তঃস্থলে অভিষিক্ত করবার।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতা | ইংরেজি অনুবাদ: রন্তিদেব সরকার

তোমার কমনীয় সেন্সরগুলি


আমার মৃত্যুর পর আমাদের এই অন্তিক ডাকবাংলোর সমস্ত কোণ

থেকে থরে থরে বেরিয়ে আসবে আমার অজস্র আঁকিবুকি।

শেষ তুলির টান দিয়ে তুমি তাদের প্রকাশ করলে কার ঘাড়ে ক’টা

মাথা আছে যে বলবে তুমি মিথ্যাচরণ করো? আমিই শুধু আঁচ করে

নিতে পারব তোমার কমনীয় সেন্সরগুলির মধ্য দিয়ে কীভাবে আমার

মুখচ্ছবি সম্পুর্ণতা পেয়ে গেছে। আমাকে মহর্ষিময়তা অর্পণ করে

একরাশ পাঙাশ খসড়ার নিচে তুমি যখন শুয়ে থাকবে হে আমার অবজ্ঞাত

শিল্প সরস্বতী নির্বোধেরা কেউ তোমাকে একবার দেখতেও আসবে না।


YOUR DELICATE SENSORS

Alokeranjan Dasgupta


After my death hoards of my scribbles will exude

From every nook and corner of our last bungalow.

Just deft finishing touches with your painting brush

Followed by an aesthetic art exhibition and who would

Dare to question your integrity? Only I could visualize

How my portrait came alive through your delicate sensors.

Pampering me to a saintly stature when you would be lying

Beneath a piles of my faded doodles- Oh! my neglected

muse of art, even no dunce would frequent you there!


-----------------------------------------


চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদের মতো

(বিভাব কবিতা)


যাবার মুখে এ কোন প্রহেলিকা–

সিঁদুরে মেঘে সিঁথি ছুপিয়ে নিয়ে

সমাসন্ন হৈমবতী উমা

আমায় পরখ করবার জন্যে কি?


নৌকো ভেসে গিয়েছে বন্যায়

জরাজীর্ণ কাঠের সেঁউতি বেয়ে

এল আমার হেমন্তের শীতে

অঙ্গীকার চেয়েছে দেহলিতে–


স্পর্শে আমার ইন্দ্রিয় বিগত,

ধানদুর্বাও বাড়ন্ত, ফলত

এই নারীকে শুধুই বরণ করি

চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদের মতো


একটুখানি ঐতিহ্যের স্বাদ;

চিবুক ছুঁয়ে আমার আশীর্বাদ।


A GUEST IN MY LATE AFTERNOON

Alokeranjan Dasgupta


I wonder how is the riddle

while myself is on the

threshold of departing,

the woman, draped her forehead

In the vermillion cloud

looks irresistible with her adorns

as if goddess in a human guise

reaches my doorsteps,

whether to poise me before a test ?


The boat was swept away in floodwater,

sailing out on a worn-out donga as vessel

she is asking for my refuge

in the winter of my autumn.


My touch-instinct has frozen

neither I possess anymore-

my bliss-paraphernalia.

I can only incarnate her

by touching her chin


A bit taste of age-old custom

I bless her by caressing her chin.



Rendered into English by Rantidev Sarkar

Monday, November 15, 2021

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | দ্বিতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”


একান্ত আপনজনের মৃত্যু সম্বন্ধে লিখতে গেলে একটা দূরত্বের প্রয়োজন, সময়ের দূরত্ব। ঘটনাটা যেন অনেক পুরোনো হয়, লেখনি নিজে যতটা প্রাচীন, ততটা। তাই এ লেখার কাজে হাত দিতেই গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠল। বিষয়গুলো এক এক করে নির্দিষ্ট করে নেওয়ার কথা ভাবতেই আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম, তারপর সেগুলো লিখতে গিয়ে ভীষণ বিব্রত বোধ করছিলাম আর তাদের ফিরে পড়তে গিয়ে একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। আসলে, আমার বাবার খ্যাতিই এই লেখার ক্ষেত্রে মানসিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করছিল। লেখার প্রয়োজনীয়তার চেয়েও তখন বড় হয়ে দাঁড়াল আমার দ্বিধা। মনের মধ্যে বারবার সন্দেহ হচ্ছিল, আজকের মধ্যমেধার বাজারে নিজের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি না তো। তার চেয়ে বোধহয় খ্যাতির অন্তরালে থেকে না লেখাই ভালো ছিল। আসলে তো আমি আড়ালে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। কিন্তু লেখনির ক্ষেত্রে যা ঘটে, লেখক বিষয়কে নয় বরং বিষয় লেখককে বেছে নেয় আর তখন সমস্ত বাধাই অকৃতকার্য হয়ে যায়।

মাস কয়েক আগে এক বান্ধবী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে আমার বাবা কেমন আছেন? তাকে বললাম, তিনি শুধুমাত্র বর্তমান সময়ে বেঁচে আছেন, অতীতের বোঝা নেই, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাও নেই। অতীতের অভিজ্ঞতার উপর ভর করে বা গল্পের অন্যতম উৎসের মতো পূর্ব অভিজ্ঞতার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যে ভবিষ্যতের দর্শন, তাঁর জীবনে তার আর কোনও ভূমিকা নেই। 

-তাহলে তিনি বুঝতে পারছেন না যে মারা যাবেন, বান্ধবীটি বলল, কি সৌভাগ্যবান!

বান্ধবীকে যা বলেছিলাম তা প্রকৃত বাস্তবের একটি সরলিকৃত অংশ মাত্র। বাবার চৈতন্যে তখনও পর্যন্ত অতীতের ছাপ রয়ে গিয়েছিল। যেমন ভাবে আগে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতেন, একটার পর একটা প্রশ্ন করে, ‘কেমন আছো?’ ‘এখন কোথায় থাকো?’, ‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’, সেই অভ্যাসের প্রতিধ্বনির মতো তিনি কথা বলে যেতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে আরেকটু বেশি কিছু বলতে যেতেন, আর তখনই খেই হারিয়ে ফেলতেন মাঝপথে। ভুলে যেতেন কি নিয়ে কথা বলছিলেন আর চুপ করে যেতেন। তখন তাঁর সেই বিভ্রান্ত অবস্থা (সিগারেটের ধোঁয়ার ক্ষণিক উপস্থিতির মতোই তাঁর মুখে লজ্জার অরুণাভা মুহূর্তের জন্য খেলা করে যেত) দেখে বোঝা যেত এরকমভাবে কথা বলে যাওয়াটা একসময় তাঁর কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ছিল। রসিকতা, আনন্দ, স্মৃতিমেদুরতা আর উত্তেজনায় ভরপুর সেই সব কথোপকথন। তাঁর সব বর্ষীয়ান বন্ধুরা বলতেন যে তিনি লেখায় যেমন আলাপেও তেমন সমান প্রতিভাধর। ভবিষ্যতের ভাবনাও যে পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন এমনটা নয়। সন্ধ্যে হলে মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আজ রাতে আমরা কোথায় যাব? বেশ আনন্দ হয় তেমন একটা জায়গায় যাওয়া যাক। চলো নাচতে যাই। কেন? কেন নয়?’ প্রসঙ্গটা একটু পালটে দিলেই ভুলে যেতেন কি বলছিলেন এতক্ষণ।  

বাবা মাকে চিনতে পারতেন আর কত নামে যে তাঁকে ডাকতেন: মেচে, মেরসেদেস, জননী, লা মাদ্রে সান্তা। কিন্তু কিছু দিন আগে কয়েক মাসের জন্য পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়েছিল। তখন সারা জীবনের সঙ্গিনী নিজের স্ত্রীর কথা মনে করতে পারলেও সামনে যে মহিলাটি রয়েছেন, তিনি-ই যে তাঁর স্ত্রী, সেকথা হাজারবার বললেও বিশ্বাস করতে পারতেন না। 

-এই মেয়েটি আমার কেউ নয়, তবে কেন সে এখানে রয়েছে আর বাড়ির সব কাজ দেখাশোনা করছে?

মা তখন রেগে উঠতেন। 

-‘কি হয়েছে ওর?’ অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করতেন। 

-বাবা এটা করছে না মা, করছে ওঁর ডিমেন্সিয়া।

মা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি তাঁকে ভুল বোঝাচ্ছি। আশ্চর্যজনকভাবে এই পর্যায়টা কেটে গেল এবং বাবার স্মৃতিতে মা আবার তাঁর নিজের জায়গা ফিরে পেলেন, তাঁর সেই আজীবনের সহচরী। সেটাই ছিল তাঁদের শেষ বন্ধন। তাঁর সেক্রেটারি, গাড়ির চালক, রাঁধুনি-- যাঁরা দীর্ঘদিন এ বাড়িতে কাজ করেছেন তাঁদের সবাইকে চিনতে পারতেন। তাঁরা সবাই ছিলেন কাছের মানুষ, পছন্দের মানুষ, যাঁরা তাঁকে আগলে রাখবেন। কিন্তু কারুর নাম মনে রাখতে পারতেন না। আমি আর আমার ভাই যখন তাঁকে দেখতে যেতাম খুব সতর্কভাবে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের দেখতেন, যেন একটা প্রবল কৌতূহলের ব্যাপার। আমাদের মুখ দেখে বহুদিন আগের কিছু একটা মনে পড়ত হয়তো, কিন্তু আর আমাদের চিনতে পারতেন না। 

-পাশের ঘরে ওরা কারা? কর্মচারীদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন।

-আপনার ছেলেরা।

-সত্যি? ওই লোকগুলো? ধুর ছাই, বিশ্বাসই করা যায় না। 

বছর দুয়েক আগে একটা ভয়ংকর দুঃসময় এসেছিল আমাদের জীবনে। বাবা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন যে ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এই কথাটা বার বার বলতেন আর সমানে আমাদের সাহায্য চাইতেন। একটা মানুষকে ওই চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে দেখা এবং একই কথার বারংবার পুনরাবৃত্তি সহ্য করা যে কি ভয়ানক! বাবা বলতেন, ‘আমার কাজই হল স্মৃতিকে নিয়ে। স্মৃতি হচ্ছে আমার কাজ করার যন্ত্র ও প্রাথমিক উপাদান। সেই স্মৃতি ছাড়া আমি কাজ করতে পারব না, তোমরা আমায় দয়া করে সাহায্য করো।’ তারপর এই কথাটাই বিভিন্ন ভাবে বলে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। খুবই বিধ্বস্ত হয়ে পড়তেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পর্যায়টা চলে গেল। খানিকটা শান্ত হয়েছিলেন আর মাঝে মাঝে বলতেন:

-আমার স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে, কিন্তু তা যে হারিয়ে ফেলছি সৌভাগ্যক্রমে সেটাই আমি ভুলে যাচ্ছি।

অথবা,

-সবাই এমন করে যেন আমি একটা বাচ্চা ছেলে। তবে সেটা আমার মন্দ লাগে না।  

বাবার সেক্রেটারি আমাকে বলেছিলেন, একদিন বিকেলে তাঁকে দেখতে পান বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ বহু দূরে, গভীর কোনও ভাবনায় যেন ডুবে আছেন। 

-এখানে কি করছেন, দোন গাব্রিয়েল?

-কাঁদছি।

-কাঁদছেন? কই না তো?

-হ্যাঁ কাঁদছি, তবে চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। বুঝতে পারছ না যে আমার মাথায় আর কিছুই নেই?  

 আরেকদিন সেক্রেটারিকে বললেন:

-এটা আমার বাড়ি নয়। আমি আমার বাড়ি যাব। আমার বাবার বাড়িতে। সেখানে বাবার খাটের পাশেই আমার খাট আছে। 

 আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে উনি বাবার কথা নয়, বলছিলেন দাদামশাই কর্নেলের কথা (কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরিত্র যাঁর আদলে গঠিত)। আট বছর বয়স পর্যন্ত তিনি দাদুর সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর খাটের পাশে একটা ছোট্ট তোষকের উপর আমার বাবা ঘুমোতেন। ১৯৩৫ সালের পরে আর তাঁদের দেখা হয়নি।

-এরকমই অবস্থা হয়েছিল আপনার বাবার, তাঁর সহকারী আমায় বলেছিলেন, কি সুন্দরভাবে সব কিছু বলতেন, এমনকি ভয়ংকর ব্যাপারও। 

একদিন সকালে চিকিৎসা সঙ্ক্রান্ত জিনিষপত্র ভাড়া দেয় এমন একটি কোম্পানির এক মহিলা কর্মচারী এসে একটা খাট দিয়ে গেলেন। বাবার সেক্রেটারির নির্দেশ অনুসারে তিনি সেটাকে গেস্টরুমে রাখলেন। কিছুক্ষণ পরে, রাতের খবরে সেই মহিলা দেখলেন যে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন তিনি বুঝতে পারলেন কার জন্য ওই খাট তিনি এনেছিলেন। পরের দিন তাঁর মালিকের নাম করে একটি চিঠিতে তিনি আমাদের লেখেন, বাবার জন্য খাটটি দিতে পারায় তাঁরা গর্বিত এবং তার জন্য অবশ্যই কোনও টাকা দিতে হবে না। আমার মা প্রথমে এটা মেনে নিতে চাননি, কারণ তিনি মনে করতেন যে সমস্ত খরচ নিজেদের পকেট থেকেই করা উচিত। তবে পরে তাঁকে আমরা বোঝালাম যে এক্ষেত্রে বিরোধীতা না করাই শ্রেয়।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর বাবার ডিসচার্জ সার্টিফিকেট একটি ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত হল। সম্ভবত আমার ভায়ের হাত থেকে সার্টিফিকেটটা পড়ে গিয়েছিল এবং হাসপাতালে দেখা করতে আসা কোনও এক মহিলা সেটা কুড়িয়ে পান। তিনি সেটা দেন তাঁর মেয়েকে, যার তখন একটা অপারেশন হয়েছিল এবং সে বাবার লেখার খুব ভক্ত ছিল। কিন্তু সেখান থেকে কিভাবে যে কাগজটা খবরের কাগজের অফিস অবধি পৌঁছে গিয়েছিল সেটা এখনও একটা রহস্যই রয়ে গেছে।

যে মুহূর্ত থেকে রটে গেল যে আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গণমাধ্যমের লোকজন এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা একে একে বাড়ির বাইরে জড়ো হতে শুরু করলেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার দিন প্রায় শ’খানেক লোকের ভিড় ছিল বাড়ির সামনে। এমনকি সরকার থেকে পুলিশ পোস্টিং করা হল যাতে বাড়ির মূল ফটকের সামনের নির্দিষ্ট একটা অংশ পর্যন্ত কেউ না আসতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সটাকে গ্যারেজের মধ্যে উলটো দিকে মুখ করে ঢোকানো হল। কিন্তু সেটা এত বড় যে দরজা খোলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার ভাই, বাড়ির একজন কর্মচারী ও বাবার সেক্রেটারি একটা চাদরকে পর্দার মতো উপরে তুলে ধরলেন যাতে কেউ ছবি তুলতে না পারে আর তখনই বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সের পেছন দিক দিয়ে বের করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর যখন দেখলাম যে আমাদের সামান্য ব্যক্তিগত পরিসরটুকু রক্ষা করতে আমার ভাই যে চাদর ঝুলিয়ে রেখেছিল সেই ছবিটাও প্রকাশিত হয়ে গেছে, তখন আমি সত্যি সত্যিই রেগে উঠেছিলাম। কিন্তু তারপর নিজেকে বললাম, শান্ত হও, কারণ দরজার বাইরে এই যে এত মানুষ জড়ো হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বাবার ভক্ত পাঠককুল এবং বাকিরা কোনও ছোটখাটো পত্রিকার নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমের সব প্রতিনিধি। 

বন্ধু-বান্ধব বা চিকিৎসক যাঁরাই বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন বা বেরোচ্ছেন সাংবাদিকেরা তাঁদেরকে সঙ্গে সঙ্গে ছেঁকে ধরছেন নতুন খবর জানার জন্য। এঁদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তখন আমরা অন্য একটা গ্যারেজ ব্যবহার করতাম এবং গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিতাম। বাবার সেক্রেটারি আমায় একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। সেই সপ্তাহে একদিন আমার মা বাইরে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু ফেরার সময় গ্যারেজের দরজা খুলতে পারেননি। তখন কয়েক পা এগিয়ে মূল দরজা দিয়ে ঢোকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু যেই তিনি গাড়ি থেকে নামলেন স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা ও আবেগে সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাস্তাটা নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি মাথাটা একটু হেলিয়ে, যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন এমনভাবে সেই পথটুকু পার হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁকে খুব একটা উত্তেজিত বলে মনে হল না, এমনকি চারপাশের সবাই যে চুপ করে গেল সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ উদাসীন, যেন মনে হচ্ছিল নিজের শোবার ঘর থেকে বাথরুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। আমার বাবা প্রায়ই বলতেন মায়ের মতো এমন আশ্চর্য মানুষ তিনি আর কখনও দেখেননি।

বাবাকে আমরা তাঁদের শোবার ঘরে রাখলাম না, কেননা তাতে মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। তাঁকে রাখলাম বারান্দার প্রান্তের একটা ঘরে যেটা গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহৃত হত, আবার মাঝে মাঝে প্রোজেক্টর লাগিয়ে সিনেমাও দেখা হত। কয়েক দশক আগে ওখানে একটা বড় ছাদ ছিল আর কলেজের সব ছেলেমেয়েরা এসে সিগারেট খেত। তবে পরে জায়গাটাকে ঘিরে দেওয়া হয়।

হাসপাতালের মতো খাটে শুইয়ে দেওয়ার পর বাবার প্রথম কথা, ‘বাড়ি যাব’। বেশ বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে প্রায় অবোধ্য স্বরে বললেন। মা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি বাড়িতেই আছেন। কিন্তু অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে চারপাশে তাকালেন, মনে হল না যে কিছু চিনতে পারছেন। তিনি ডান হাতটা তুললেন, বেশ কাঁপছে, তারপর তাকে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে একটা ভঙ্গী করলেন যা একেবারেই তাঁর নিজস্ব। হাতটা প্রথমে কপালে রাখলেন, তারপর চোখের উপর ধীরে ধীরে বুলিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলেন। এরপর ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটদুটো টিপে বন্ধ করলেন। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, বা গভীর মনোযোগ দিতেন কিংবা কিছু শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতেন, তখন এই ভঙ্গীটা করতেন। সাধারণত কারুর কোনও কষ্টের কথা শুনেও এরকম করতেন। পরের কয়েক দিন এই ভঙ্গীটা ঘনঘন করতে লাগলেন।

বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য সাধারণত দুজন লোক ছিলেন। তার সঙ্গে দু’জন নার্স দিনে ও রাতে পালা করে তাঁর কাছে থাকতেন। দিনের বেলার নার্সটি ছিলেন সত্যিই অসাধারণ। হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার সময় ওখান থেকেই তাঁকে সুপারিশ করেছিল। তাঁর বয়স তখন তিরিশের কোঠার শেষের দিকে। বিবাহিতা তবে অপুত্রক, খুবই ভদ্র ও শান্ত, আত্মবিশ্বাসী এবং খুব হাসিখুশি। তিনি সমস্ত কিছু নিখুঁতভাবে, পরিষ্কার হাতের লেখায় লিখে রাখতেন। ওষুধ বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ নির্ভুলভাবে গুছিয়ে রাখতেন আর ঘরের পর্দাগুলো এমনভাবে খোলা-বন্ধ করতেন যাতে সারা দিন ঘরের মধ্যে একটা শান্ত, স্তিমিত আলো খেলা করে। তাঁর কাজের দক্ষতা ও সুমধুর ব্যক্তিত্ব তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল। সর্বোপরি রোগীর প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ ভালোবাসা। বাবাকে ডাকতেন ‘ডার্লিং’ বা ‘ছোট্ট সোনা’ বলে। শুধু একবারই তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখেছিলাম। চিকিৎসকের শেষ নির্দেশগুলো দেখতে গিয়ে একটা অসঙ্গতি তাঁর চোখে ধরা পড়ল। বাবার নির্দেশ ছিল সেই রকম সময় উপস্থিত হলে তাঁকে যেন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা নাহয়। নার্সটির মনে হয়েছিল চিকিৎসকের নির্দেশ যেন বাবার ইচ্ছার সঙ্গে মিলছে না। অন্য সমস্ত কাজ পাশে সরিয়ে রেখে টানা আধ ঘন্টা ধরে সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন ও ফোনে বিভিন্ন মেসেজ পাঠালেন। শেষ পর্যন্ত কার্ডিয়োলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে তবে নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর মা যখন তাঁর শেষ স্বাক্ষরটা করলেন এবং আমি বললাম যে সব কিছু আমাদের ইচ্ছানুযায়ী হয়েছে, তবেই তিনি আশ্বস্ত হলেন এবং নিজের কাজে ফিরে গেলেন।

কখনও কখনও বাবা জেগে উঠতেন আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে আলোড়ন পড়ে যেত। পরিবারের লোকজন, যাঁরা তাঁর দেখাশোনা করতেন এবং অনেক সময়েই একজন গৃহ চিকিৎসক সবাই সানন্দে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম। তাঁকে কত কি জিজ্ঞাসা করতাম, মন দিয়ে শুনতাম উত্তরে কি বলেন আর এভাবেই জমে উঠত আমাদের গল্প-গুজব। বাবা জাগ্রত অবস্থায় থাকলে আমাদের যে কি আনন্দ হত! আর চিকিৎসক ও নার্সরা এরকম একজন কিংবদন্তিতুল্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলায় এতই আনন্দ হত যে আমরা ভুলে যেতাম এই মানুষটা গত কয়েক বছর ধরে স্মৃতিভ্রংশের শিকার। যে মানুষটার সঙ্গে কথা বলছি তিনি আসলে হারিয়ে গেছেন, তিনি আদৌ কিছু বুঝতে পারছেন না। আসলে এই মানুষটা সেই মানুষটাই নয়। 

দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার বিছানায় তাঁর শুয়ে থাকার ভঙ্গি বদল করা হত। গায়ে মালিশ ও অঙ্গসঞ্চালন করে দেওয়া হত। তিনি জেগে থাকলে দেখতে পেতাম আরামে তাঁর চোখ বুজে আসছে। এক যুবক চিকিৎসক, যিনি হাসপাতালের প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের প্রধান এবং তাঁর বাবা ছিলেন কলোম্বিয়ার মানুষ, একদিন বিকেলে বাবাকে দেখতে এলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন। বাবা উত্তর দিলেন, ‘খোদিদো’১। তখন যে নার্সটি ছিলেন তিনি তাঁর দীর্ঘ বিবৃতির শেষে বললেন যে বাবার যৌনাঙ্গের ত্বকে সমস্যা আছে আর সেখানে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে ফেললেন আর তাতেই বোঝা গেল যে তিনি মজা করছেন। তারপর ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করার জন্য বললেনঃ ‘ও আসলে আমার বিচির কথা বলতে চেয়েছে।’ সবাই তখন হো হো করে হাসছে। মনে হত তাঁর রসবোধ তাঁর স্মৃতিভ্রংশতাকেও জয় করতে পেরেছিল। সেটা ছিল তাঁর সত্ত্বারই অংশ। নিজের শরীরের ব্যাপারে বাবা বেশ সতর্ক ছিলেন, প্রায় লাজুকই বলা চলে। তবে যেভাবে সবাই তাঁর সেবা করেছিলেন তাতে কখনই তাঁর সম্ভ্রম এতটুকু ব্যাহত হয়নি। যে সহৃদয় সেবা তিনি পেয়েছিলেন তাতে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন। 

দু’জন নার্স, দু’জন সহকারী এবং ঘরের কাজের একজন বা দুজন মেয়ে তাঁদের পালা বদল করার সময় কয়েক মিনিটের জন্য নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিতেন। বাবার সেক্রেটারি বিছানার চাদর বদল করার সময় একবার বলেছিলেন যে তিনি শুনেছিলেন বাবার পা নাকি খুব সুন্দর ছিল। অন্য মহিলারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে তাকান এবং সায় দেন। আমি জানিনা কোন চুলো থেকে এইসব কথা তাঁরা আমদানি করতেন। তবে এসব ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন না করাই শ্রেয়। 

কখনও কখনও মহিলাদের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে তিনি জেগে উঠতেন। চোখ খুলতেন আর যেই ওই মহিলারা তাঁর দিকে ফিরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করতেন সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠত। এরকমই একটি সময়ে আমি তাঁর পাশের ঘরে ছিলাম। শুনতে পেলাম যে মেয়েগুলো খুব হাসছে। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। তাঁরা আমাকে বললেন যে বাবা চোখ খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁদের দেখেছেন এবং তারপর শান্ত স্বরে বলেছেন:

-তোমাদের সবার সঙ্গে একসঙ্গে পারব না। 

একটু পরে, মা ঘরে ঢুকতেই, তাঁর গলার স্বর ও উপস্থিতি সবাইকে সম্মোহিত করে চুপ করিয়ে দিল।  


টীকাঃ

খোদিদো– ইংরাজি ভাষায় এর অর্থ ‘fucked’


আগের পর্ব: 

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায়

Thursday, November 11, 2021

দি গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর | ফিওদর দস্তয়েভস্কি

অনুবাদ | মলয় রায়চৌধুরী

"একেবারে অসম্ভব", আইভান হেসে বলল, "ভূমিকাসহ আরম্ভ করি তাহলে, আমি ষোড়শ শতাব্দীর কবিতায় বর্ণিত ঘটনা উল্লেখ করছি, সে একটা যুগ ছিল বটে-- যেমনটা তোমাদের স্কুলে বলা হয়েছিল-- যখন কবিদের মধ্যে উচ্চতর  ব্রহ্মাণ্ডের অধিবাসীদের ও ক্ষমতাধরদের মর্ত্যে নামিয়ে আনার আর মরজগতের প্রাণীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করাবার দুর্দান্ত ফ্যাশন ছিল... ফ্রান্সে  নোটারিদের কেরানিরা, আর পাঁচিল-ঘেরা মঠের যাজকরাও দুর্দান্ত অনুষ্ঠান, নাটকীয় অভিনয় করতেন, যাতে ম্যাডোনা, দেবদূতরা, সন্তরা, যিশুখ্রিস্ট, দীর্ঘ দৃশ্য গড়ে তুলতেন, এমনকি স্বয়ং ঈশ্বর আসতেন, তখন সবকিছুই ছিল শিল্পহীন আর আদিম। তার একটা উদাহরণ হতে পারে ভিক্টর হুগোর নাটক, 'নতরে দেম দে প্যারিসে যাতে', মিউনিসিপ্যাল হলে, ‘লে বোন জাজমেন্ট দে লা ট্রেস-সান্তে এত গ্রাসিউজ ভিয়ার্জ মারি’ নামে একখানা নাটক লুই একাদশের সম্মানে অভিনীত হয়েছিল, সেখানে ভার্জিন মেরি নিজে উপস্থিত হয়ে তাঁর 'শুভ আশীর্বাদ' দিয়েছিলেন। মস্কোতে, প্রিপেট্রিয়ান কালখণ্ডে, প্রায় একই চরিত্রদের অভিনয়, বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নির্বাচিত, সকলের বেশ পছন্দ ছিল। এই ধরনের নাটকগুলো ছাড়াও, পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল রহস্যময় রচনায়, 'ছন্দ-কবিতায়'-- যার নায়করা সর্বদা নির্বাচিত হত দেবদূত, সন্ত আর অন্যান্য স্বর্গীয় নাগরিকদের মধ্যে থেকে, যারা সেই কালখণ্ডের ভক্তিমূলক উদ্দেশ্যে সাড়া দিতে পারত। রোমান ক্যাথলিক যাজকদের মতন আমাদের সমাজ-বিচ্ছিন্ন মঠগুলো, নিজেদের সময় কাটাতো অনুবাদ, অনুলিপি এমনকি এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে মূল রচনা লেখায়, আর এটা মনে রেখো, ছিল তার্তারদের সময়কালে! ..এই প্রসঙ্গে, আমি কনভেন্টে সংকলিত একটা কবিতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি-- নিঃসন্দেহে গ্রীক থেকে অনুবাদ, যাকে বলা হয়, 'অভিশপ্তদের মাঝে ঈশ্বরের মায়ের পরিভ্রমণ', যার মধ্যে রয়েছে প্রসঙ্গ অনুযায়ী ছবি আর দান্তের চেয়ে নিকৃষ্ট চিন্তাভাবনা করার সাহস। 'ঈশ্বরের মা' নরক দেখতে যান, প্রধান দেবদূত মাইকেলকে সঙ্গে করে, যে ওনার পথপ্রদর্শক হিসাবে 'অভিশপ্তবাহিনী'কে দেখায়। মা তাদের সবাইকে প্রত্যক্ষ করেন এবং তাদের নানারকম নির্যাতনের সাক্ষী হন। নির্যাতনের অন্য অনেক অসাধারণ উল্লেখযোগ্য যন্ত্রণার মধ্যে— প্রত্যেক শ্রেণীর পাপীদের নির্ধারিত বিশেষ যন্ত্রণা—  লক্ষ্য করার যোগ্য, যেমন 'অভিশপ্ত' শ্রেণীর একটা দলকে ধীরে ধীরে গন্ধক ও আগুনের জ্বলন্ত হ্রদে চুবিয়ে দেওয়া হয়। যারা পাপ করে তাদের এত নীচে ডুবিয়ে দেয়া হয় যে তারা আর ওপরে উঠতে পারে না, আর ঈশ্বর তাদের চিরকালের জন্য ভুলে যান, অর্থাৎ তারা সর্বজ্ঞের স্মৃতি থেকে মুছে যায়, লেখা হয়েছে কবিতাটায়-- এক অসাধারণ চিন্তার গভীর অভিব্যক্তি, যদি তার নীবিড় বিশ্লেষণ করা হয়। ভার্জিন মেরি ভয়ঙ্করভাবে হতবাক, এবং ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে কান্নায় হাঁটু গেড়ে বসেন, এবং অনুনয় করেন যে নরকে তিনি যা দেখেছেন-- সবই, সমস্ত কিছু, ওদের শাস্তি মুকুব করে দেয়া উচিত। ঈশ্বরের সাথে তাঁর কথোপকথনটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভার্জিন মেরি বলেন, তিনি কখনও ঈশ্বরকে ছেড়ে যাবেন না। ঈশ্বর তখন ভার্জিন মেরির ছেলের বিদ্ধ হাত ও পায়ের দিকে ইঙ্গিত করে চেঁচিয়ে ওঠেন, 'আমি কীভাবে ওনার জল্লাদদের ক্ষমা করতে পারি?' তিনি তখন আদেশ দেন যে সমস্ত সন্ত, শহিদ, দেবদূত এবং প্রধান দেবদূত, তাঁকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করবে যিনি একমেব ও অপরিবর্তনীয় এবং তাঁর ক্রোধকে দয়ায় পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করবে-- ওদের সবাইকে ক্ষমা করুন। ঈশ্বরের সঙ্গে সমঝোতার পর কবিতাটি শেষ হয়, অনেকটা গুড ফ্রাইডে আর ট্রিনিটির মাঝের সময়টায় অত্যাচারের বার্ষিক অবকাশ, 'অতল গহ্বর' থেকে অভিশপ্তদের কন্ঠে ঈশ্বরের উচ্চ প্রশংসায় সমবেত গান, তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া আর এই কথা বলা:

আপনিই ঠিক, হে প্রভু, খুব সঠিক, 

ন্যায় বিচার করে আপনি আমাদের অভিশপ্ত করেছেন।

"আমার কবিতা একই চরিত্রের।" 

"এই দৃশ্যে, যিশুখ্রিষ্ট নিজে আবির্ভূত হন। সত্য, তিনি কিছুই বলেন না, কেবল উপস্থিত হন এবং দৃষ্টির বাইরে চলে যান। ক্ষমতা এবং মহান গৌরব নিয়ে আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর পনেরোটা শতক কেটে গেছে; তাঁর ভবিষ্যবক্তা চিৎকার করে একথা বলার পর, যে, 'প্রভুর পথ প্রস্তুত করো', পনেরোটা দীর্ঘ শতক কেটে গেছে!" যেহেতু তিনি  পৃথিবীতে থাকাকালীনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, 'সেই দিন ও সময় কেউ জানে না, না, স্বর্গের দেবদূতরা নয়, জানেন কেবল আমার পিতা।' কিন্তু খ্রিস্টিয়জগৎ এখনও তাঁর আগমনের আশায় অপেক্ষা করে আছে। 

"একই পুরোনো বিশ্বাস আঁকড়ে আর একই আবেগে জগত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে; হ্যাঁ, আরও বেশি বিশ্বাসের সাথে, স্বর্গ থেকে মানুষের কাছে শেষ ইশারা আসার পর পনেরো শতক কেটে গেছে,

আর অন্ধ বিশ্বাস একা থেকে গেল 

আস্থাশীল হৃদয়কে শান্ত করার জন্য, 

যেহেতু স্বর্গ আর কোনও ইশারা পাঠাবে না। 

"একথা সত্যি, আবার, আমরা সকলেই অলৌকিক ঘটনা ঘটার কথা শুনেছি, যদিও 'অলৌকিক যুগ' চলে যাবার পর আর ফিরে আসে না। আমাদের ছিল আর এখনও আছে, আমদের সন্তরা, যাঁরা অলৌকিকভাবে নিরাময় করতে পারতেন; এবং যদি আমরা  তাঁদের জীবনী লেখকদের বিশ্বাস করতে পারি, তাঁদের মধ্যে এমন লোকও ছিল যাঁদের কাছে স্বর্গের রানী নিজে এসেছিলেন। কিন্তু শয়তান তো ঘুমোয় না, আর সন্দেহের প্রথম বীজ, আর সেই সমস্ত বিস্ময়কর ব্যাপারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে খ্রিষ্টিয়জগতে উঁকি দিতে আরম্ভ করেছিল। ঠিক সেই সময়েই জার্মানির উত্তরে এক নতুন এবং ভয়ঙ্কর ধর্মদ্রোহী প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল। [লুথারের সংস্কার] ...একটি বিশাল নক্ষত্র 'যেন তা প্রদীপের আলোর মতন ঝিকমিকে... ঝর্ণার জলে পড়ল'... এবং 'তা  তেতো হয়ে গেল।' সেই ‘ধর্মদ্রোহী’ নিন্দার সাথে 'অলৌকিক ঘটনা' অস্বীকার করল। কিন্তু যারা বিশ্বস্ত ছিল তারা আরও বেশি উৎসাহভরে বিশ্বাস করতে লাগল, মানবজাতির অশ্রুজল ঈশ্বরের কাছে আগের মতোই পৌঁছোচ্ছিল, এবং খ্রিস্টানবিশ্ব আগের মতোই আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল; লোকেরা তাঁকে ভালবাসতো এবং তাঁর উপর তাদের আস্থা ছিল, আগে যেমন লোকেরা তাঁর জন্য নিজেদের নিরম্বু ও ক্ষুধার্ত উপবাসী রেখে, দুঃখ আর যন্ত্রণাভোগ করত, ঠিক তেমনই করতো এই সময়ে... কত শতাব্দী যাবত দুর্বল আর বিশ্বাসী মানুষেরা তাঁর কাছে অনুনয়-বিনয় করেছে, বিশ্বাসভরে কেঁদেছে, বলেছে: ‘আর কতোকাল হে প্রভু, পবিত্র ও সত্য, তুমি কি আর আসবে না?’ কত দীর্ঘ শতাব্দী তাঁর কাছে নিরর্থক আবেদন করেছে যে, অবশেষে, তাঁর অপার করুণায়, তিনি প্রার্থনায় সাড়া দিতে সম্মত হলেন ...উনি নির্ণয় নিলেন যে আরেকবার, তা যদি এক ঘণ্টার জন্যেও হয়, জনগণের জন্য-- তাঁর যন্ত্রণাক্ত, অত্যাচারিত, মারাত্মক পাপী, তাঁর আদরের শিশুসন্তানের মতো, বিশ্বাসী মানুষেরা-- তাঁকে আবার দেখতে পাবে। এই ঘটনার দৃশ্যটি আমি স্পেনে নিয়ে গেছি, সেভাইলেতে, ইনকুইজিশনের ভয়ঙ্কর সময়ে, যখন, ঈশ্বরের মহিমাময় গৌরবের জন্য, সারা দেশ জুড়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। 

দুষ্ট অবিশ্বাসীদের খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল, 

যাজকদের বিচারের জাঁকজমকের পর। 

"এই বিশেষ সফরের, অবশ্যই, প্রতিশ্রুত আগমনের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই, যখন, নির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী, 'সেই দিনগুলির দুর্দশার পরে,' তিনি আবিভূত হবেন 'স্বর্গের মেঘের ভেতর দিয়ে'। কারণ, 'ঈশ্বরপুত্রের আগমন', যেমনটি আমাদের জানানো হয়েছে, হঠাৎ করেই ঘটবে, 'যেমন বিদ্যুৎ পূর্ব দিক থেকে চকিতে আসে এবং পশ্চিম দিকে ঝলকানি দেয়।' না; এই একবার, তিনি অপরিচিত হয়ে আসতে চেয়েছিলেন, এবং তাঁর সন্তানদের মধ্যে উপস্থিত হতে চেয়েছিলেন। ঠিক তখনই, যখন বিধর্মীদের হাড়গুলো, যাদের জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলার দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, আগুনে ফাটার আওয়াজ শুরু করেছিল। তাঁর অপার করুণার দরুণ, তিনি আরেকবার সেই ভাবেই দেখা দিতে চেয়েছিলেন যে-রূপে পনেরো শতাব্দী আগে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন। তিনি ঠিক সেই সময়েই নেমে আসেন যখন রাজা, দরবারের সদস্যরা, সেনানীরা, যাজকরা, আর রাজদরবারের সুন্দরীরা, সেভাইলের সমস্ত মানুষের সামনে, একশোর বেশি বিধর্মী বজ্জাতকে ভয়াবহ ‘অটো-দা-ফে অ্যাড মেজরমে দেই গ্লোরিয়ামে’ জ্যান্ত পোড়ানো হচ্ছে, কার্ডিনাল গ্র্যান্ড ইনকুইজিটরের আদেশে। তিনি চুপচাপ এবং অঘোষিত এসেছেন; তবুও সবাই-- কত অদ্ভুত-- হ্যাঁ, সবাই তাঁকে তক্ষুনি চিনতে পারে! জনগণ তাঁর দিকে ছুটে যায়, যেন তারা কোনও অপ্রতিরোধ্য শক্তি দ্বারা আকর্ষিত; তারা তাঁকে ঘিরে ধরে, তাঁর চারপাশে ঠেলাঠেলি ভিড় করে, তারা তাঁকে অনুসরণ করে... নিঃশব্দে, তাঁর ঠোঁটে অসীম মমতার মৃদু হাসি, তিনি ঘন ভিড় অতিক্রম করেন, এবং হালকা পায়ে এগিয়ে যান। প্রেমের সূর্য তার হৃদয়ে উদ্ভাসিত, এবং তাঁর চোখ থেকে আলো, প্রজ্ঞা ও শক্তির উজ্জ্বল রশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, এবং তাঁকে ঘিরে জড়ো হওয়া জনগণের ওপর ঝরে পড়ছিল, তাদের হৃদয়কে ভালোবাসায় স্পন্দিত করে তুলছিল। তিনি তাঁর হাত তাদের মাথায় বুলিয়ে দিলেন, আশীর্বাদ করলেন, আর তাঁর সামান্য ছোঁয়ায়, এমনকি তাঁর পোশাক থেকে, একটি নিরাময়কারী শক্তিপ্রবাহ বইতে থাকে। একজন বৃদ্ধ, জন্ম থেকে অন্ধ, কাকিয়ে ওঠে, 'প্রভু, আমাকে সুস্থ করুন, যাতে আমি আপনাকে দেখতে পারি!' আর তার অন্ধ চোখ থেকে আবরণ খসে পড়ে, এবং অন্ধ লোকটি তাঁকে দেখতে পায়... জনগণ আনন্দে কাঁদতে আরম্ভ করে, এবং যে মাটিতে তিনি পা রাখছিলেন সেখানটায় সবাই চুমু খেতে থাকে। শিশুরা তাঁর চলার পথে ফুল ছিটিয়ে আশীর্বাদ পাওয়ার গান গায়! এ তো তিনিই, তিনি নিজেই, তারা একে অপরকে বলে, ইনি অবশ্যই ঈশ্বরপুত্র স্বয়ং, তিনি ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না! পুরানো গির্জার প্রবেশপথে তিনি থামেন, ঠিক তখনই একটি সাদা রঙের কফিন ভেতরে নিয়ে আসা হচ্ছিল, বহনকারীরা বিলাপ করে জোরে-জোরে কাঁদছিল। কফিনের ঢাকনা খোলা, আর তাতে শয়ানো একটি ফর্সা শিশু, সাত বছর বয়সী, শহরের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের একমাত্র সন্তান। ছোট্ট শবটি ফুলের তলায় চাপা পড়ে আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত যাজক, যিনি শবযাত্রীদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল এবং যাজক ভ্রূকুটি করলেন। হঠাৎ একটি ক্রন্দনরত চিৎকার শোনা যায়, এবং শোকাহত মা ঈশ্বরপুত্রের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। 'যদি তুমিই সেই হও, তাহলে আমার সন্তানকে জীবিত করে তোলো!' শবযাত্রীদের মিছিল থেমে যায়, এবং ছোট্ট কফিনটি আলতো করে তাঁর পায়ের কাছে নামানো হয়। ঐশ্বরিক করুণা তাঁর দৃষ্টি থেকে প্রবাহিত হয়, এবং যখন তিনি শিশুটির দিকে তাকান, ঈশ্বরপুত্রের ঠোঁট দু'টিকে ফিসফিস করতে শোনা যায়, 'তালিথা কুমি' (ছোট্ট খুকি, আমি তোমাকে বলছি, উঠে পড়ো) এবং শিশুর মা শুনে থমকে যায়।' শিশুটি তার কফিনে উঠে দাঁড়ায়। তার ছোট্ট হাতদুটিতে তখনও সাদা গোলাপের গোছা, যা তার মৃত্যুর পর রাখা হয়েছিল এবং বড়-বড় বিস্মিত চোখে চারদিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি হাসতে লাগলো... জনতা অত্যন্ত উত্তেজিত। তাদের মধ্যে ভয়ানক হইচই আরম্ভ হয়ে গেল, জনসাধারণ চিৎকার করে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল, তখনই হঠাৎ, গির্জার দরজার সামনে, কার্ডিনাল গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর নিজেই হাজির হলেন... তিনি দীর্ঘদেহী, প্রায় নব্বুই বছর বয়সের শুকনো-মুখ বুড়ো, ভেতরে ঢোকা চোখ, যার গহ্বর থেকে দুটি জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ চমকাচ্ছিল। রোমান ক্যাথলিক চার্চের শত্রুদের ‘অটো দা-ফে’ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সময়ে জনগণের সামনে যে আড়ম্বরপূর্ণ কার্ডিনালের পোশাক পরেছিলেন, তা খুলে রেখে এসেছেন, আর এখন পরে আছেন পুরানো, রুক্ষ, যাজকদের ঢোলা আলখাল্লা। তাঁর নিষ্ঠুর সহকারী আর 'পবিত্র রক্ষীদলের' ক্রীতদাসরা দূর থেকে ইনকুইজিটরকে অনুসরণ করছিল। তিনি ভিড়ের সামনে থামলেন এবং এদিক-ওদিক তাকালেন। তিনি সবই দেখেছেন। তিনি ঈশ্বরের পায়ের কাছে ছোট্ট কফিন রাখার দৃশ্য দেখেছেন, জীবন ফিরে পাওয়ার সাক্ষী হয়েছেন। আর এখন, তাঁর কালো হয়ে-যাওয়া, বিষণ্ণ মুখ আরও কালো হয়ে গেছে; তাঁর লোমশ ধূসর ভ্রু একের সঙ্গে আরেক মিশে আছে, এবং তাঁর গর্তে-ঢোকা চোখে ভয়াবহ আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। আস্তে আস্তে আঙুল তুলে, তিনি তাঁর চাকরদের নির্দেশ দেন ঈশ্বরপুত্রকে গ্রেপ্তার করতে... "সুশৃঙ্খল, বশীভূত আর এখন হাড়হিম মানুষের উপর ইনকুইজিটরের ক্ষমতা এমন, যে বিশাল ভিড় তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দেয়, এবং প্রহরীদের সামনে থেকে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়, শীতল নীরবতার মধ্যে প্রতিবাদের টুঁ শব্দটুকুও না করে, ঈশ্বরপুত্রের গায়ে তাদের অপবিত্র হাত রাখার অনুমতি পায় এবং অপরিচিত ঈশ্বরপুত্রকে দূরে নিয়ে যায়... সেই একই লোকজন, যেন তারা একটি-মাত্র মানুষ, বৃদ্ধ ইনকুইজিটর তাদের আশীর্বাদ করার পর, সামনের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। প্রহরীরা তাদের বন্দিকে পবিত্র বিচারের বেশ পুরোনো অট্টালিকায় নিয়ে যায়; ঈশ্বরপুত্রকে  সংকীর্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকরা কারাগারের ঘরে ঠেলে দিয়ে, তালাবন্ধ করে এবং বিদায় নেয়... "দিন শেষ হয়, এবং রাত নামে-- একটি অন্ধকার, গরম, দমবন্ধ স্প্যানিশ রাত-- সেভিল শহরে চুপি-চুপি ঢুকে পড়ে গ্যাঁট হয়ে বসে। বাতাসে চাঁপা আর কমলা ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। বিচারসভার পুরোনো হলঘরের আদিম অন্ধকারে লোহার দরজা হঠাৎ খুলে দেওয়া হয়, এবং গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর, একটা টিমটিমে লণ্ঠন হাতে ঝুলিয়ে, আস্তে আস্তে অন্ধকূপের মধ্যে প্রবেশ করে। লোকটা একা, এবং, তার পেছনে ভারী দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সে চৌকাঠে থেমে যায়, আর এক বা দুই মিনিটের জন্য গোমড়ামুখে আর চুপচাপ  তার সামনে ঈশ্বরপুত্রের মুখমণ্ডল খুঁটিয়ে দ্যাখে। গুনে-গুনে কয়েক পা এগিয়ে, শেষ পর্যন্ত, বুড়ো ইনকুইজিটর তার লণ্ঠন টেবিলে রেখে দেয় আর এইভাবে ঈশ্বরপুত্রকে সম্বোধন করে:

"তাহলে তুমিই!... তুমি !" ... কোনও উত্তর না পেয়ে, ইনকুইজিটর দ্রুত কথা চালিয়ে যায়: "না, উত্তর দিতে হবে না; চুপ করেই থাকো!... আর তুমি কীই বা বলতে পারো?.. আমি ভালোভাবেই তোমার উত্তর জানি... তাছাড়া, তুমি এর আগে যে উক্তি করেছিলে তার সাথে একটি অক্ষরও যোগ করার অধিকার নেই তোমার... কেন তুমি এখন ফিরে এলে, আমাদের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য? তুমি নির্ঘাৎ সেই কাজের জন্যই এসেছ, আর তুমি তা ভালো করে জানো। কিন্তু তুমি কি জানো, আগামীকাল  সকালে তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে? আমি জানি না, আর জানতেও চাই না যে তুমি কে: তুমি নিজেই এসেছ নাকি নিজের প্রতিকৃতি পাঠিয়েছ, আগামীকাল আমি তোমাকে দণ্ডদান করে খুঁটিতে বেঁধে পোড়াব, যেন তুমি সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাসী; আর সেই একই লোকেরা, যারা আজকে তোমার পায়ে চুমু খাচ্ছিল, কালকে আমার একটা আঙুলের ইশারায়, তারা তোমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিতায় আগুন দিতে ছুটে আসবে... তুমি কি এই বিষয়ে সচেতন? "লোকটা বলতে থাকে, যেন একান্ত চিন্তায় কথা বলছে, এবং একবারের জন্যও তার সামনেকার নম্র মুখ থেকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি।"

“যা বর্ণনা করা হল আমি অমন পরিস্থিতি বিশেষ উপলব্ধি করতে পারছি না-- এসব কী, আইভান?" হঠাৎ বাধা দিল অ্যালিয়োশা, যে  এতক্ষণ তার ভাইয়ের কথা চুপচাপ শুনছিল, বলে উঠল। "এটা কি এক অভিনব কল্পনা, নাকি বুড়ো লোকটার কিছু ভুল, একটা অসম্ভব লেনদেন?"  "তুমি যদি চাও তাহলে পরেরটাই হোক", আইভান হেসে বলল, "তাহলে আধুনিক বাস্তববাদ তোমার রুচিকে এতটাই বিকৃত করে দিয়েছে যে, তুমি অভিনব জগতের কোনও কিছু উপলব্ধি করতে অক্ষম বোধ করছ... তাহলে লেনদেনই মনে করা হোক, যদি তুমি তাই মনে করো। তাছাড়া, ইনকুইজিটরের বয়স নব্বুই বছর, আর ক্ষমতার আদর্শ নিরূপণ করতে-করতে পাগল হয়ে গিয়ে থাকবে; কিংবা, এটা তার দৃষ্টির বিভ্রম হতে পারে, মৃত্যুর কল্পনায় জারিত, দুপুরের শতাধিক অবিশ্বাসীকে পুড়িয়ে মারার তাপে মাথা গরম... কিন্তু কবিতাটির জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এই যে, এটা কি লেনদেন নাকি অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা? প্রশ্ন হল, ইনকুইজিটরকে নিজের হৃদয়কে মুক্ত করতে হবে; শেষ পর্যন্ত তাকে তার ভাবনা প্রকাশ করতে হবে; আর নব্বুই বছর যাবত যে রহস্য মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছে, তা জোরে-জোরে বলতে শুরু করে।” 

"এবং তার বন্দি, তিনি কি কখনও উত্তর দেন না? তিনি কি কোনও কথা না বলে, তার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে থাকেন?" 

"অবশ্যই; আর তাছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না," আইভান উত্তরে বলে। "গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলোই আবার বলে, যে, ঈশ্বরপুত্রের বলা আগের কথার সাথে একটি অক্ষরও যোগ করার অধিকার নেই। পরিস্থিতি তক্ষুনি স্পষ্ট করার জন্য, ওপরের প্রাথমিক স্বগতসংলাপ ছিল রোমান ক্যাথলিক ধর্মের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ বোঝানোর খাতিরে-- যেমন আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারি, লোকটার কথার মানে, সংক্ষেপে: 'তুমি পোপের কাছে সবকিছু দিয়েছিলে, এবং সবকিছুই এখন তার একার উপর নির্ভর করে; আমাদের কাজে বাধা দিতে তোমার ফিরে আসার কোনও কারণই থাকতে পারে না।' এই বিষয়ে জেসুইটরা শুধু কথাই বলে না, লেখেও একইভাবে। "তুমি কি আমাদের কাছে সেই পৃথিবীর অন্তত একটি রহস্যের কথা ফাঁস করতে পারো, যেখান থেকে তুমি এসেছ?' বুড়ো ইনকুইজিটর জিগ্যেস করে ঈশ্বরপুত্রকে, আর নিজেই তাড়াতাড়ি তার উত্তর দেয়। “না, তোমার কোনও অধিকার নেই তা বলার, কেননা তা হবে সেই একই কথা যা তুমি এর আগে বলেছিলে, যখন তুমি পৃথিবীতে ছিলে, তখন সাধারণ মানুষের জন্য যে-উদ্দেশে লড়াই করেছিলে, তাদের তা থেকে বঞ্চিত করছ... তুমি এখন নতুন যা-কিছু ঘোষণা করবে তা  পছন্দের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবে, কারণ এটি একটি নতুন এবং অলৌকিক ব্যাপার হিসাবে প্রকাশিত হবে, যা পনেরোশো বছরের পুরানো ঘোষণাকে অতিক্রম করে যাবে, যখন তুমি বারবার জনগণকে বলেছিলে: "সত্য তোমাদের মুক্ত করবে।" তাহলে তাকিয়ে দেখো, তোমার এখনকার 'মুক্ত' মানুষদের দিকে! 'বুড়ো লোকটা টিটকিরি মেরে বলে। ‘হ্যাঁ…! তাতে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।’ নিজের শিকারের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকে সে। 'কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজ সম্পন্ন করেছি, এবং তা  তোমার নাম করে... কেননা দীর্ঘ পনেরো শতাব্দী ধরে সেই 'স্বাধীনতার' জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে: কিন্তু এখন আমরা জয়ী হয়েছি আর আমাদের কাজ মিটে গেছে, আর তা বেশ ভালো এবং দৃঢ়ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।... বিশ্বাস কোরো না যে তুমি এত শক্তিশালী!... এবং কেনই বা তুমি আমার দিকে ভিরু চোখে তাকাচ্ছ, যেন আমি তোমার ধিক্কারেরও যোগ্য নই?... তাহলে জেনে রাখো, লোকেরা তাদের মুক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত এবং সন্তুষ্ট বোধ করে; এবং সেকারণেই তারা নিজেদের এবং তাদের নিজস্ব ইচ্ছায়, সেই স্বাধীনতাকে, আমাদের পায়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যাই হোক, সেটাই আমরা করেছি। তুমি কি সেই জন্যই কষ্ট করেছিলে? এটা কি সেই ধরনের 'মুক্তি' যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দিয়েছ?” 

"এখন, আরেকবার, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না," অ্যালিয়োশা বাধা দিয়ে বলল। "বুড়ো কি উপহাস করছিল এবং হাসছিল?"

"একেবারেই নয়। উনি এটাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন, উনি মনে করেন যেন নিজে অনন্য সাধারণ মানবসেবা করেছেন, ওনার যাজকভাইরা এবং জেসুইটরা, লোকেদের স্বাধীনতাকে জয় করে এবং নিজেদের কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে এসে, একটি মহান কাজ করেছেন, এবং গর্বভরে মনে করেন যে তা করা হয়েছে বিশ্বের মঙ্গলের জন্য।... ‘এবার এখন’, উনি বলেন (ইনকুইজিশন সম্পর্কে), ‘আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, প্রথমবার, মানবজাতিকে খুশি করার বিষয়ে ঐকান্তিক চিন্তা করার। মানুষ জন্মায় দ্রোহী হয়ে, আর দ্রোহীরা কি কখনও সুখী হতে পারে?... তোমাকে এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা কোনও কাজে লাগেনি, কেননা তুমি মানবজাতিকে খুশি করতে পারে এমন একটিমাত্র উপায়কে প্রত্যাখ্যান করেছ; সৌভাগ্যবশত তোমার যাবার সময়ে তুমি আমাদের দায়িত্বে কাজটি দিয়ে গেছ... তুমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, নিজের উক্তির অঙ্গীকারের মাধ্যমে, আমাদের বন্ধন ও মোচনের অধিকার দিচ্ছো... এবং নিঃসন্দেহে, এখন তুমি  আমাদের তা থেকে বঞ্চিত করার কথা ভাবতে পারো না!"

"কিন্তু 'তোমাকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হয়েছিল" কথাগুলো বলতে উনি কী বোঝাতে চাইছেন?" জানতে চাইল অ্যালেক্সিস।

"এই কথাগুলো বুড়োটাকে তার কথার ন্যায্যতার চাবিকাঠি ধরিয়ে দেয়... কিন্তু শোনো--

"ভয়ঙ্কর এবং জ্ঞানী আত্মা, আত্ম-বিনাশকারী এবং অ-সত্তার আত্মা," বলা বজায় রাখে ইনকুইজিটর, "অস্বীকৃতির মহান আত্মা তোমার সাথে বিজনপ্রদেশে কথাবার্তা বলেছিল, এবং আমাদের বলা হয়েছে যে সে তোমাকে" প্রলুব্ধ করেছিল "...এটা কি সত্যি ঘটনা? আর যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে, তাহলে সেই তিনটি প্রলোভনে যা ছিল, যেগুলো তুমি প্রত্যাখ্যান করেছিলে, এবং যেগুলোকে বলা হয় 'প্রলোভন', তার চেয়ে আলাদা একটিও উক্তি করা চলে না। হ্যাঁ; পৃথিবীতে যদি কোনও সত্যিকার অবাককরা অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা সেই দিনকার তোমার তিনটি প্রলোভন আর মূলতঃ এই তিনটি ছোট বাক্যে রয়েছে অনন্যসাধারণ অলৌকিকতা। যদি সম্ভব হতো যে ওগুলো চিরকালের জন্য উবে গিয়ে লোপাট হয়ে যাক, কোনও রেশ না রেখে, রেকর্ড থেকে এবং মানুষের স্মৃতি থেকে, এবং তা তোমার ইতিহাসে আরেকবার জরুরি হয়ে উঠত উদ্ভাবন করার, আবিষ্কারের,  তুমি কি মনে করো যে বিশ্বের সমস্ত ঋষি, বিধায়ক, দীক্ষাদাতা, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ প্রমুখদের ডেকে যদি বলা হত এইরকম তিনটি প্রশ্ন তৈরি করতে, ঘটনার বিশালত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, যেগুলো তিনটি ছোটো বাক্যে আমাদের জগতের ভবিষ্যতের সমগ্র ইতিহাস ও মানবতাকে-- তুমি কি বিশ্বাস করো, আমি জিগ্যেস করছি তোমাকে, শক্তিশালী এবং সর্বজ্ঞ বুদ্ধির আত্মার দ্বারা বিজনপ্রদেশে তোমাকে দেওয়া তিনটি প্রস্তাবের শক্তি এবং চিন্তার গভীরতা তাঁদের সমস্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টা কখনও অমন কিছু তৈরি করতে পারতো? শুধুমাত্র তাদের বিস্ময়কর যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করে, যে কেউ  বুঝতে পারে যে তারা একটি সসীম, পার্থিব বুদ্ধি থেকে উদ্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতপক্ষে, চিরন্তন এবং পরম-শাশ্বত থেকে হয়েছে। এই তিনটি প্রস্তাবে আমরা যা  খুঁজে পাই, তারা একটিমাত্র হয়ে গিয়ে আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছে, মানুষের সম্পূর্ণ পরবর্তী ইতিহাস; বলতে গেলে, আমাদের তিনটি চিত্রকল্প দেখানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতের সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত, অদ্রবণীয় সমস্যা এবং বিশ্বজুড়ে মানবপ্রকৃতির পরস্পরবিরোধিতা তুলে ধরা হয়েছে। সেই কালখণ্ডে, তাদের অন্তর্গত বিস্ময়কর প্রজ্ঞা এতটা সহজবোধ্য ছিল না, যা এখন মনে হয়, কেননা ভবিষ্যত ব্যাপারটা তখন ছিল আবরণের আড়ালে ঢাকা; কিন্তু এখন, যখন পনেরো শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই তিনটি প্রশ্নে সব কিছুরই এত বিস্ময়করভাবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যে তাতে বাড়তি কিছু যোগ করা বা তা থেকে বাদ দেওয়া একেবারে অসম্ভব! "তাহলে নিজেই সিদ্ধান্ত নাও," ইনকুইজিটর কঠোরভাবে এগিয়ে গেল, 'দুজনের মধ্যে কোনজন সঠিক ছিলেন: যিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, নাকি যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন? প্রথম প্রশ্নটির সূক্ষ্ম অর্থটি মনে রেখো, যা এইকথা বলে: তুমি কি খালি হাতে পৃথিবীতে যাবে? তুমি কি সেখানে মুক্তি সম্পর্কিত তোমার অস্পষ্ট এবং অনির্ধারিত প্রতিশ্রুতিসহ যেতে চাও, যা মানুষেরা, যারা প্রকৃতিগতভাবে নিস্তেজ এবং বেয়াড়া, যারা বুঝতে এতোই অক্ষম, যে তারা ভয়ে এড়িয়ে যায়? কেননা মানবজাতির কাছে ব্যক্তি-স্বাধীনতার চেয়ে অসহ্য আর কিছু ছিল না। তুমি কি এই পাথরগুলোকে নির্জন এবং উজ্জ্বল বিজনপ্রদেশে দেখেছ? এই পাথরগুলোকে রুটি বানানোর নির্দেশ দাও-- মানবজাতি তাহলে তোমার পেছনে ছুটবে, এক পাল গবাদি পশুর মতন বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ হয়ে। কিন্তু এতোকিছু সত্ত্বেও তা হবে সর্বদা ভিন্ন আর কাঁপুনি দেবে, পাছে তুমি নিজের হাত সরিয়ে নাও এবং তারা তাদের রুটি হারায়! মানুষকে তাদের স্বাধীন ইচ্ছের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ভয়ে তুমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলে; কেননা বেছে নেবার স্বাধীনতা কোথায়ই বা থাকে যদি মানুষকে রুটির ঘুষ দেওয়া হয়? মানুষের জীবন শুধু রুটি খেয়ে বেঁচে থাকার নয়— তুমিই তা বলেছিলে। তুমি জানো না, সম্ভবত, ঠিক সেই পার্থিব রুটির নামেই একদিন জাগতিক আত্মা জেগে উঠবে, সংগ্রাম করবে এবং অবশেষে তোমাকে বশীভূত করবে, তার পরে ক্ষুধার্ত জনতা চিৎকার করে বলবে: "কে সেই পশু, যে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আগুন নামিয়ে এনেছিল!" তুমি কি তা জানো না, কিন্তু কয়েক শতাব্দী পরে, এবং সমগ্র মানবজাতি তার প্রজ্ঞার জোরে এবং তার মুখপত্র ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ঘোষণা করবে, যে, জগতে আর কোনও অপরাধ ঘটে না, তাই পৃথিবীতে আর কোনও পাপ নেই, তাহলে কেবল ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে? "আগে আমাদের খেতে দাও আর তারপর আমাদের সৎ হতে বল!" তোমার বিরুদ্ধে তোলা পতাকায় এই কথাগুলো লেখা থাকবে -- এমন একটি পতাকা যা তোমার গির্জাকে তার ভিত্তি পর্যন্ত ধ্বংস করে দেবে এবং তোমার বিগ্রহের জায়গায় আরও একবার বাবেলের ভয়ঙ্কর মিনার উঠে দাঁড়াবে; আর যদিও ভবনটি অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়া হবে, প্রথমটির মতন, তবুও এই তথ্য খোদাই করা থাকবে যে তুমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারতে, কিন্তু করোনি, তা হল এই যে সেই নতুন মিনার নির্মাণের প্রচেষ্টা রোধ তুমি করোনি এবং এইভাবে মানবজাতিকে হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে অনর্থক কষ্ট থেকে রক্ষা করোনি। এবং জনগণ আবার আমাদের কাছেই ফিরে আসবে। তারা আমাদের খুঁজে বেড়াবে ভূগর্ভস্হ সমাধিতে, কারণ আমরা আরও একবার নির্যাতিত ও শহিদ হব— এবং তারা আমাদের কাছে এসে কাঁদতে থাকবে: "আমাদের খেতে দিন, কারণ যারা আমাদের স্বর্গ থেকে আগুন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা আমাদের ঠকিয়েছে!" তখনই আমরা তাদের জন্য তাদের মিনার নির্মাণ শেষ করব। কারণ যারা একা তাদের খাওয়াবে তারাই মিনারটা সম্পূর্ণ করবে, আর আমরা তাদের তোমার নামে খাবার খাওয়াব এবং তাদের কাছে মিথ্যা বলব যে এটি তোমার নামে করা হচ্ছে। ওহ, আমাদের সাহায্য ছাড়া তারা কখনই, কখনই, নিজেদের খাওয়াতে শিখবে না! যতক্ষণ তারা মুক্ত থাকবে ততক্ষণ কোনও বিজ্ঞান তাদের রুটি দেবে না, যতদিন তারা মুক্ত থাকবে, যতদিন না তারা সেই মুক্তিবোধকে আমাদের পায়ের কাছে রেখে বলবে: "আমাদের দাস করে তুলুন, কিন্তু আমাদের খেতে দিন!" সেই দিনটি অবশ্যই আসবে যখন মানুষ বুঝতে পারবে যে মানবমুক্তি এবং সকলের সন্তুষ্টির জন্য দৈনন্দিন রুটির যোগান দেওয়া একই সঙ্গে অচিন্তনীয়, কেননা মানুষ কখনওই নিজেদের মধ্যে ওই দুটো ব্যাপারকে সমানভাবে ভাগ করতে পারবে না। এবং তারা এটাও বুঝতে পারবে যে তারা কখনই মুক্ত হতে পারে না, কারণ তারা দুর্বল, দুষ্ট, দুঃখভোগী এবং জন্মগতভাবে বজ্জাত এবং দ্রোহী। তুমি তাদের জীবনের রুটি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ , স্বর্গের রুটি; কিন্তু আমি তোমাকে আবার জিজ্ঞাসা করছি, সেই রুটি কি কখনও দুর্বল ও দুষ্ট, চির-অকৃতজ্ঞ মানবজাতির কাছে, পৃথিবীতে তাদের প্রতিদিনের রুটির সমান হতে পারে? এবং এমনকি ধরে নিচ্ছি যে হাজার হাজার এবং লক্ষ-লক্ষ মানুষ তোমাকে অনুসরণ করে, তোমার স্বর্গীয় রুটি পাবার জন্য, তাহলে কোটি কোটি মানুষের কী হবে যারা জাগতিক রুটিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য দুর্বলচিত্ত, তারা তোমার  স্বর্গীয় রুটি নিয়ে কী করবে? অথবা এটা কি তবে হাজার হাজার বীর এবং পরাক্রমশালীদের মধ্যে নির্বাচিত লোকজন, যারা তোমার কাছে খুব প্রিয়, যখন কি না বাকি লক্ষ লক্ষ, সমুদ্রের বালির দানার মতন অসংখ্য, দুর্বল এবং স্নেহময়, তাদের মাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ওই লোকদের জন্য? না না! আমাদের দৃষ্টিতে এবং আমাদের কাজের উদ্দেশ্যে দুর্বল এবং নিম্নবর্গের মানুষ আমাদের কাছে বেশি প্রিয়। একথা সত্য যে তারা দুষ্ট এবং দ্রোহী, কিন্তু আমরা তাদের অনুগত হতে বাধ্য করব, এবং তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি গুণগান করবে। তারা আমাদের দেবতা হিসেবে গণ্য করবে এবং সেই সব লোকেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে যারা শাসনের মাধ্যমে জনসাধারণকে নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয়েছে আর তাদের স্বাধীনতার বোঝা বইছে-- শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে সেই মুক্তি কি ভয়ঙ্করই না হবে! তারপর আমরা তাদের বলব যে এটা তোমার ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য এবং তোমার নামে আমরা তাদের উপর শাসন করছি। আমরা তাদের আরও একবার ঠকাব এবং তাদের মিথ্যাকথা বলব-- কেননা আর কখনও, আমরা তোমাকে আর আমাদের মাঝে আসতে দেব না। এই প্রতারণার মধ্যে আমরা নিজেদের যন্ত্রণা খুঁজে পাব, কারণ আমাদের অনন্তকাল মিথ্যাকথা বলতে হবে, এবং কখনও মিথ্যাকথা বলা বন্ধ করা চলবে না! 'প্রথম' প্রলোভন "এর গোপন মর্ম এটাই, এবং তুমি  স্বাধীনতার স্বার্থে বিজনপ্রান্তরে সেটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে যেটিকে তুমি সর্বোত্তম মনে করেছিলে। এদিকে তোমাকে যিনি লোভ দেখাচ্ছিলেন, তাঁর প্রস্তাবটিতে আরও একটি ঘোর বিশ্ব-রহস্য আছে। 'রুটিকে' গ্রহণ করলে, তুমি সন্তুষ্ট করতে পারতে এবং একটি সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার উত্তর দিতে পারতে, যা রয়েছে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে নিরন্তর আকাঙ্ক্ষা হিসেবে, ঘাপটি মেরে আছে মানব-সমষ্টির বুকে লুকিয়ে, সেই সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর সমস্যা-- "কাকে বা কী আমরা  পুজো করব?" পুজো করার জন্য তাড়াতাড়ি একটা নতুন বস্তু বা ধারণা খুঁজে পাবার তুলনায় যে ব্যক্তি সব ধর্মীয় পক্ষপাত থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে তার জন্য এর চেয়ে বড় বা বেশি বেদনাদায়ক উদ্বেগ আর নেই। কিন্তু মানুষ তাঁরই সামনে নতজানু হতে চায়, যে কেবলমাত্র বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা স্বীকৃত, তার সমস্ত সহগামীদের দ্বারা যদি নাও হয়, পূজিত হবার অধিকার তার আছে; তার অধিকার এতই প্রশ্নাতীত যে, মানুষ সর্বসম্মতভাবে তার কাছে মাথা নোয়াতে রাজি হয়। এই দুঃখী প্রাণীদের প্রধান উদ্বেগের কারণ তাদের নিজের পছন্দের মূর্তি খুঁজে তাকে পুজো করা নয়, বরং অন্যরা যাতে বিশ্বাস করবে তা আবিষ্কার করা, আর সমবেত হয়ে মাথা নত করার সম্মতি দেওয়া। এটা প্রতিটি মানুষের এমন এক প্রবৃত্তি যা সবাই মিলে একসঙ্গে করে, আর সেটাই প্রত্যেক মানুষের প্রধান যন্ত্রণা, যা সময়ের আরম্ভ থেকে মানবজাতির প্রধান উদ্বেগ হয়ে রয়েছে। ধর্মীয় উপাসনার সেই সর্বজনীনতার জন্যই মানুষ একে অপরকে তলোয়ার দিয়ে ধ্বংস করেছে। নিজেদের জন্য দেবতা গড়ে নিয়ে, তারা একে অপরের কাছে আবেদন করতে শুরু করেছিল: "আপনার দেবতাদের পরিত্যাগ করুন, আসুন এবং আমাদের দেবতাকে প্রণাম করুন, নয়তো আপনাদের সবায়ের এবং আপনাদের মূর্তির মৃত্যু অবধারিত!" এবং  এই পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত  তারা তা করে যাবে; যখন সমস্ত দেবতা নিজেরাই অদৃশ্য হয়ে যাবে, তখনও তারা তা চালিয়ে যাবে, তারপর মানুষ কোনও ধারণার সামনে নতজানু হয়ে তার পুজো করবে। তুমি তো জানতে, তুমি মানব প্রকৃতির সেই রহস্যময় মৌলিক গুণ সম্পর্কে মোটেই অজ্ঞ নও, এবং তবুও তুমি তোমাকে দেওয়া  পরম পতাকাটি প্রত্যাখ্যান করলে, যার প্রতি সমস্ত জাতি সমর্পিত থাকবে এবং যার সামনে সকলেই মাথা নোয়াবে-- পার্থিব রুটির পতাকা, মুক্তির নামে প্রত্যাখ্যাত এবং 'ঈশ্বরের রাজ্যে রুটি' পাবার প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন! তাহলে দেখো, সেই 'মুক্তির' জন্য তুমি আরও কী করেছ! আমি তোমাকে আবার বলছি, মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় কোনও উদ্বেগ নেই যে সে এমন কাউকে খুঁজে পাক যাকে সে নিজের স্বাধীনতা উপহার দিয়ে দেবে, যা নিয়ে ওই দুর্ভাগা প্রাণীদের জন্ম হয়। কিন্তু সেই একজন লোকই তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারে আর তাদের বিবেককে নীরব ও শান্ত করার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, যে বাদবাকি সমস্ত মানুষের স্বাধীনতার মালিক হবে। 'দৈনন্দিন রুটি' দিয়ে তোমাকে একটি অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা উপহার দেওয়া হয়েছিল: একজন মানুষকে 'রুটি' দেখাও আর সে তোমাকে অনুসরণ করবে, কেননা রুটির আকর্ষণের চেয়ে আর কীই বা চাহিদা তার থাকতে পারে? কিন্তু যদি, একই সাথে, অন্য একজন তার বিবেকের মালিক হতে সফল হয়-- ওহ! তাহলে তোমার রুটির কথাও ভুলে যাবে, আর মানুষ সেই লোকটাকে অনুসরণ করবে যে তার বিবেককে প্রলুব্ধ করেছে। এ-পর্যন্ত তুমি ঠিকই ছিলে। কেননা মানুষের রহস্য কেবল তার বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই সীমিত নয়, বরং সমস্যায়-- কীসের জন্য আদৌ বেঁচে থাকা উচিত, এই বোধে? তার বেঁচে থাকার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে, মানুষ কখনও বেঁচে থাকতে রাজি হবে না, এবং পৃথিবীতে টিকে থাকার বদলে বরং নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে, যদিও তাকে চারিপাশে রুটি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এটাই সত্য। কিন্তু কী ঘটেছে? মানুষের স্বাধীনতাকে কব্জা করার বদলে, তুমি তাকে আরও বিশাল করে তুলেছ! তুমি কি আবার ভুলে গেছো যে, মানুষের কাছে শুভ এবং অশুভ সম্পর্কে জ্ঞানের তুলনায় আরাম, এমনকি মৃত্যুও, গ্রহণযোগ্য? বিবেকের স্বাধীনতার চেয়ে কিছুই তার চোখে বেশি প্রলোভনযুক্ত বলে মনে হয় না, এবং তার চেয়ে কিছুই বেশি বেদনাদায়ক নয়। আর দেখো! সমস্ত মানুষের বিবেকের চিরকালীন দৃঢ় বনেদ গড়ার বদলে, তুমি তাদের আলোড়িত করতে বেছে নিয়েছ তাদের ভেতরকার অস্বাভাবিক, রহস্যময় এবং অনির্দিষ্ট, যা-কিছু মানুষের ক্ষমতার বাইরে, আর এমনভাবে তা করেছ যেন কোনও কালে তোমার প্রতি তাদের ভক্তি ছিল না, এবং তবুও তুমি নাকি "ঈশ্বরপুত্র যিনি তার বন্ধুদের জন্য তাঁর জীবন দিতে!" আবির্ভূত হয়েছ। মানুষের কাছে যে উদ্বেগ অজানা ছিল তাই দিয়ে তাদের আত্মাকে বোঝাই করে দিয়েছ। অবাধে দেওয়া মানুষের ভালবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত, মানুষকে প্রলুব্ধ করে এবং তোমার দ্বারা মোহিত ও বশীভূত করে, যাতে তারা তোমার দেখানো পথ অনুসরণ করে, সেই পুরানো এবং দূরদর্শী নিয়মের বদলে, তাদের হৃদয়ে তোমার প্রতিচ্ছবির পথনির্দেশে, তুমি তাদের স্বেচ্ছায় শুভ ও অশুভ বেছে নেবার অধিকার দিয়েছ। কিন্তু তুমি কখনও স্বপ্নেও তেমন সম্ভাবনার কথা ভাবোনি, না, সেই নিশ্চয়তার, যে, সেই একই মানুষেরা একদিন তোমার মূর্তি আর তোমার সত্যকেও পালটে দেবে, একথা জানার পর যে, তাদের ওপর স্বাধীনতা বেছে নেবার মতো ভয়ঙ্কর বোঝা চাপিয়ে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে? একটা সময় নিশ্চয় আসবে যখন মানুষ বলে উঠবে যে সত্য এবং আলো তোমার মধ্যে থাকতে পারে না, কেননা  কর্মকাণ্ড এবং অসাধ্য সমস্যার বোঝা চাপিয়ে তোমার চেয়ে তাদের অমন বিভ্রান্তি আর মানসিক যন্ত্রণায় আর কেউ  ফেলে যেতে পারত না। সুতরাং, তুমি নিজের রাজ্যের ধ্বংসের ভিত্তি স্থাপন করেছ এবং এর জন্য তুমি ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। "ইতিমধ্যে, সাফল্যের সমস্ত সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছিল।" পৃথিবীতে তিনটি ক্ষমতাশক্তি আছে, এই দুর্বল বিদ্রোহীদের বিবেককে ফুসলিয়ে চিরকালের জন্য বিজয় পাবার-- মানুষকে-- তাদের নিজেদের ভালোর জন্য; এবং এই ক্ষমতাশক্তি হল: অলৌকিকতা, রহস্য এবং কর্তৃত্ব। তুমি তিনটিকেই প্রত্যাখ্যান করেছ। আর তুমিই প্রথম উদাহরণ স্থাপন করলে। যখন মহান ও জ্ঞানী আত্মা তোমাকে মন্দিরের চূড়ায় বসিয়েছিল এবং তোমাকে বলেছিল, "আপনি যদি ঈশ্বরের পুত্র হন, তাহলে নিজেকে নামিয়ে আনুন, কারণ এটি ইতিমধ্যে লিখিত যে, ঈশ্বর আপনার দেবদূতদের আপনার দায়িত্ব দেবেন: এবং  তারা হাতে করে তুলে ধরে আপনাকে বয়ে নিয়ে যাবে, যাতে না আপনি পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান।” এইভাবে তোমার পিতার প্রতি বিশ্বাস স্পষ্ট হত, কিন্তু তুমি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে এবং তাকে মান্যতা দিলে না। ওহ, নিঃসন্দেহে, তুমি এই সমস্ত অভাবনীয় ব্যাপার সম্পর্কে গর্বের সাথে একজন ভগবানের মতন আচরণ করেছিলে, কিন্তু তারপর মানুষর-- সেই দুর্বল আর দ্রোহী জাতি-- তারাও কি ভগবান, যে তোমার প্রত্যাখ্যান বুঝতে পারেনি? অবশ্যই, তুমি ভালভাবেই জানতে যে, এক ধাপ এগিয়ে গেলে, নিজেকে নামিয়ে আনার সামান্যতম প্রয়াস করলে, তুমি "নিজের প্রভু নিজের ঈশ্বরকে" প্রলুব্ধ করতে, হঠাৎ তার প্রতি অবাধ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে, এবং নিজেকে পৃথিবীর ধুলোর পরমাণুতে পালটে ফেলতে, সেই একই পৃথিবী, যাকে তুমি বাঁচাতে এসেছিলে, এবং এইভাবে সেই জ্ঞানী আত্মাকে অনুমতি দিতে যে তোমাকে জয়ী ও আনন্দিত করতে প্রলুব্ধ করেছিল। যাই হোক, তাহলে, এই পৃথিবীতে তোমার মতো কতজনকে পাওয়া যাবে, আমি তোমার কাছে জানতে চাইছি? তুমি কি কখনও এক মুহূর্তের জন্যও ভেবে দেখেছ যে মানুষেরও অমন প্রলোভন প্রতিরোধ করার শক্তি আছে? জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্তে, যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বেদনাদায়ক এবং বিভ্রান্তিকর সমস্যাগুলি মানুষের আত্মার মধ্যে লড়াই করে, সত্যিকারের সমাধানের জন্য তার হৃদয়ের মুক্ত সিদ্ধান্তের জন্য অলৌকিকতা এবং বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করার মতন মানুষের প্রকৃতি কি গড়া হয়েছে? ওহ, তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার সেই কর্মকাণ্ড যুগ যুগ ধরে বইতে লিখে রাখা থাকবে, পৃথিবীর শেষ সীমায় তা পৌঁছে যাবে, আর তোমার আশা ছিল যে, তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, মানুষ তার ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, কোনও রকম অলৌকিকতা ছাড়াই তার বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখবে! কিন্তু তুমি জানতে না, মনে হয়, মানুষ যত তাড়াতাড়ি অলৌকিকতাকে প্রত্যাখ্যান করবে ঠিক ততো তাড়াতাড়িই ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করবে, কেননা মানুষ ঈশ্বরকে ততোটা চায় না, যতটা তাঁর কাছে তাঁরই 'একটি প্রতীক' মানুষ চায়। এবং এইভাবে, যেমন অলৌকিক ঘটনা ছাড়া মানুষ থাকতে পারে না, তাই, অলৌকিকতা ছাড়া বেঁচে থাকার বদলে, সে নিজের জন্য নিজেই নতুন বিস্ময় তৈরি করবে; এবং সে একজন দ্রোহী, একজন বিদ্বেষী, এবং একশো বার নাস্তিক হয়ে, গণৎকারের হাতসাফাই, বুড়ি ডাইনির জাদুর কাছে মাথা নত করবে এবং পুজো করবে। যখন মানুষ ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং মাথা নাড়িয়ে তোমাকে বলছিল-- "তুমি যদি নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র মনে করো, তাহলে নিজেকে বাঁচাও, আর আমরা তাহলে তোমাকে বিশ্বাস করব," তখন ক্রুশকাঠ থেকে নামতে তোমার অস্বীকৃতি, সেই একই দৃঢ় সঙ্কল্পের কারণে-- অলৌকিকতার মাধ্যমে মানুষকে দাসানুদাস করতে অস্বীকার করেছিলে, অথচ তোমার প্রতি বিশ্বাস অর্জন করেছ কোনও রকম জাদুকরি প্রভাব ছাড়াই। তুমি মুক্তমনা এবং অপ্রভাবিত প্রেমের জন্য আকুল ছিলে, এবং দাসদের আবেগপ্রবণ শ্রদ্ধা প্রত্যাখ্যান করেছিলে যাতে তাদের ইচ্ছাবোধ একটি ক্ষমতাশক্তির কাছে চিরকালের জন্য অধীন হয়ে যায়। তুমি মানুষকে উঁচুতে বসিয়ে বিচার করো, অথচ, তারা দ্রোহীও, তারা জন্মগত দাস এবং তার বেশি কিছু নয়। ভাবো, আরেকবার তাদের বিচার করো, আজ যখন সেই মুহূর্ত থেকে পনেরো শতক কেটে গেছে। তাদের দিকে তাকাও, যাদের তুমি নিজের স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা করেছিলে! আমি শপথ করে বলতে পারি যে মানুষ তোমার চেয়ে দুর্বল আর নিচুস্তরের যা তুমি কখনও কল্পনা করোনো। তুমি যা আশা করেছিলে তা কি পেয়েছ? তাকে এত দামি করে তুলে এমন আচরণ করেছো যেন তোমার হৃদয়ে তাদের জন্য কোনও ভালবাসা নেই, কারণ মানুষ তা দিতে না পারলেও তুমি তার কাছ থেকে বেশি কিছু চেয়েছো— হ্যাঁ তুমি, যে কিনা মানুষকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে! তুমি যদি মানুষকে কম সম্মান করতে, তাহলে তুমি তার কাছে কম দাবি করতে, এবং এটি ভালবাসার মতোই হত, কারণ তার বোঝা হালকা করা হত। মানুষ দুর্বল এবং কাপুরুষ।  ব্যাপারটা কেমন হবে, যদি সে এখন আমাদের ইচ্ছা ও শক্তির বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে দাঙ্গা এবং দ্রোহ বাধায়, এবং সেই দ্রোহের কারণে গর্ববোধ করে? এটি একটি স্কুল-বালকের ক্ষুদ্র অহংকার এবং অসার। এটা ছোট বাচ্চাদের তাণ্ডব, যেন ক্লাসে বিদ্রোহ করা আর শিক্ষককে বাইরে বের করে দেওয়া। কিন্তু এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না, এবং যখন তাদের বিজয়ের দিন শেষ হবে, তখন তাদের এর জন্য বড়ো দাম চোকাতে হবে। তারা মন্দির ধ্বংস করবে এবং গুঁড়িয়ে দেবে, পৃথিবীকে রক্তে প্লাবিত করবে। কিন্তু নির্বোধ শিশুদের মতন একদিন শিখতে পারবে যে, তারা দ্রোহী আর প্রবৃত্তিগত কারণে বিদ্রোহী হলেও, তারা দীর্ঘ সময় বিদ্রোহের মনোভাব বজায় রাখার পক্ষে খুব দুর্বল। মূর্খের কান্নায় ভুগে তারা স্বীকার করবে যে, যিনি তাদের বিদ্রোহী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে তাদের ব্যঙ্গ করার জন্য তা করেছেন। তারা হতাশ হয়ে কথাগুলো ঘোষণা করবে, এবং এই ধরনের নিন্দনীয় উক্তি তাদের দুঃখ-কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দেবে— কারণ মানুষের স্বভাব নিন্দা সহ্য করতে পারে না, এবং শেষ পর্যন্ত  প্রতিশোধ নেয়। "আর এইভাবে, মানবজাতি এবং তার মুক্তির জন্য তোমার ভোগান্তির পরেও, মানুষের বর্তমান অবস্থাকে তিনটি সারশব্দে বলা যেতে পারে: অশান্তি, বিভ্রান্তি, দুর্দশা! তোমার মহান ভবিষ্যবক্তা সন্তজন তার দিব্যদৃষ্টি নথিভূক্ত করে গেছে যে সে দেখেছিল—ঈশ্বরের নির্বাচিত সেবকদের প্রথম পুনরুত্থানের সময়ে-- তাদের কপালে "তাদের যে সংখ্যাচিহ্ণ খোদাই করা ছিল", তা প্রতিটি গোত্রের 'বারো হাজার' লোকের । কিন্তু সত্যিই কি তারা এতোজন? সেক্ষেত্রে তারা মানুষ নয়, তারা দেবতা। সুদীর্ঘ বছর তারা তোমার ক্রুশকাঠ বয়েছিল, বছরের পর বছর ধরে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত দেহে, ভয়াবহ বিজনপ্রান্তর এবং মরুভূমিতে, পঙ্গপাল এবং শেকড় খেয়ে-- এবং তোমার প্রতি অবাধ ভালোবাসার এই শিশুর দল, এবং তোমার নামে আত্মত্যাগকারী, তুমি তো নিশ্চয়ই গর্ব  অনুভব করেছিলে, না কি? কিন্তু মনে রেখো, এরা মাত্র কয়েক হাজার-- দেবতাই, মানুষ নয়; এবং বাদবাকিরা? আর শক্তিমানরা যা সহ্য করতে পেরেছে তা দুর্বলরা সহ্য করতে পারছে না বলে কেন তার জন্য দুর্বলকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে? কেন এমন ভয়ঙ্কর ক্ষমতা ধারণ করতে অক্ষম এক আত্মাকে তার দুর্বলতার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে? তুমি কি সত্যিই  একা এসেছিলে, যারা 'নির্বাচিত', তাদের জন্য? যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের সীমাবদ্ধ মনে রহস্যখানা চির-রহস্যময় থেকে যাবে। এবং যদি তা রহস্যই হয়, তাহলে কি আমরা একে সেই হিসাবে ঘোষণা এবং প্রচার করে ঠিক কাজ করেছিলুম, তাদের শিক্ষা দিয়েছিলুম যে, তোমাকে দেওয়া তাদের অপরিসীম ভালোবাসা বা বিবেকের স্বাধীনতা যা-ই হোক, তা মোটেই জরুরি নয়, বরং কেবল সেই অজ্ঞাত রহস্য, যা তাদের অন্ধভাবে মেনে চলতে হবে, এমনকি তা  তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে হলেও তাকে মেনে চলতে হবে। আমরা সেটাই শিখিয়েছি। আমরা তোমার শিক্ষাকে সংশোধন করে উন্নত করেছি এবং তাকে "অলৌকিকতা, রহস্য এবং কর্তৃত্ব"-র উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছি। আর মানুষ আরেকবার গোরুর পালের মতন নিজেদের জন্য হুকুম পেয়ে তা তামিল করতে উল্লসিত বোধ করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত তোমার চাপানো ভয়াবহ বোঝা থেকে নিজেদের হৃদয়কে মুক্ত করতে পেরেছে, যা তাদের কষ্টের কারণ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে বলো তো, আমরা কি ঠিক কাজ করিনি? আমরা কি মানবতার প্রতি আমাদের মহৎ ভালোবাসা দেখাইনি, তাদের নম্র চেতনার  অসহায়তাকে অনুধাবন করে, দয়াশীলতায় তাদের ভারি বোঝা হালকা করে, এবং তার দুর্বল স্বভাবের জন্য প্রতিটি পাপের অনুমতি প্রদান করে এবং ক্ষমাশীল হয়ে আমরা কি তাদের মঙ্গল করিনি, যদি তারা তা আমাদের অনুমোদন অনুযায়ী করে থাকে? তাহলে, কেন তুমি আবার আমাদের কাজে বাগড়া দিতে এসেছ? আর  কেনই বা তুমি আমার দিকে এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নম্র চোখে তাকিয়ে আছ, আর এমন চুপচাপ? বরং তোমার তো ক্রুদ্ধ হওয়া  উচিত, কারণ আমি তোমার ভালোবাসা চাই না, আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি, আর আমি তোমাকে নয়, নিজেকে ভালোবাসি। আমি কেন তোমার কাছে সত্য গোপন করব? আমি বেশ ভালোভাবেই জানি কার সাথে আমি এখন কথা বলছি! আমার যা বলবার ছিল তা তুমি আগে থেকে জানতে, আমি তা তোমার চোখের ভাষা থেকে বুঝতে পেরেছি। আমি কেনই বা তোমার কাছ থেকে আমাদের রহস্য গোপন করব? তুমি যদি আমার মুখ থেকে শুনতে চাও, তাহলে শোনো: তুমি ঈশ্বরপুত্র হলেও তোমার  সঙ্গে আমরা নেই, বরং ওনার সঙ্গে আছি, আর সেটাই আমাদের গোপন রহস্য! বহু শতাব্দী ধরে আমরা তোমাকে পরিত্যাগ করে ওনাকে অনুসরণ করেছি, হ্যাঁ-- আট শতক। আজ থেকে আটশো বছর হল যখন আমরা তাঁর কাছ থেকে তোমার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত উপহারটি ধিক্কার দিয়ে গ্রহণ করেছি; সেই শেষ উপহার যা উনি তোমাকে পাহাড়ের চূড়ায় উপহার দিয়েছিলেন, যখন পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য এবং তাদের গৌরব দেখিয়ে তিনি তোমাকে বলেছিলেন: "যদি তুমি নিচে নেমে আমার পুজো করো তবে এই সবকিছু আমি তোমাকে দিয়ে দেব!" আমরা তাঁর কাছ থেকে নিয়েছিলাম রোম সাম্রাজ্য, আর সম্রাট সিজারের তরোয়াল, আর  নিজেদের এই পৃথিবীর একমাত্র রাজা হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম, যদিও আমাদের কাজ এখনও পুরো সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু এর জন্য কাকে দোষী করা হবে? আমাদের কাজ এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু  শুরু তো করা গেছে। এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হয়ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, এবং ততদিন মানবজাতিকে অনেক কষ্ট পেতে হবে, কিন্তু আমরা একদিন নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছব, এবং জগতের একমাত্র কর্তা হবো, এবং তারপর মানুষের সার্বজনীন সুখের কথা ভাববার সময় পাওয়া যাবে। "তুমি নিজে সম্রাট সিজারের তরোয়াল তুলে নিতে পারতে; কেন তুমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলে? শক্তিশালী আত্মার দেয়া তৃতীয় প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে তুমি জগতের প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতে, যা মানুষ নিজের জন্য চায়; মানুষ পুজো করার জন্য একটা অটল বস্তু খুঁজে পেত; যা তার বিবেককে উপস্থাপিত করতে পারত, এবং অপরটি সবাইকে একত্রিত করে  সর্বজনীন এবং সমন্বয়পূর্ণ পিঁপড়ে-পাহাড়ে পরিণত করতে পারত; কেননা ভূবনব্যাপী মিলনের জন্য একটি সহজাত প্রয়োজন হল মানবজাতির জন্য তৃতীয় এবং চূড়ান্ত দুর্বিপাক; যা সমগ্রভাবে মানুষ নিজেদের একত্রিত করার জন্য করেনি। অনেক তো ছিল, মহান ইতিহাসের মহান জাতি, কিন্তু তারা যতো বড়ো ছিল, তারা ততো অসন্তুষ্ট বোধ করেছে, কেননা তারা মানুষের  একটি সার্বজনীন একীকরণের প্রবল প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। তৈমুর আর চেঙ্গিজ খানের মতো মহান বিজেতারা, জয় করার প্রচেষ্টায় পৃথিবীর মুখে ঘূর্ণিঝড়ের মতন আছড়ে পড়েছে, কিন্তু তারাও, হয়তো অসচেতনভাবে, সর্বজনীন এবং সাধারণ একীকরণের জন্য একই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। জগতের রাজত্ব এবং সিজারের রাজসিক বেগুনি পোশাক গ্রহণ করে, যে-কেউ সার্বজনীন রাজ্য খুঁজে পেত, এবং মানবজাতির কাছে অনন্ত শান্তি আনতে পারত। আর যিনি মানবজাতির বিবেকের অধিকারী হয়েছেন এবং তাদের হাতে মানুষের দৈনন্দিন রুটি দিতে পেরেছেন তাঁর চেয়ে ভালো আর কে-ই বা মানবজাতিকে শাসন করতে পারেন? সিজারের তরোয়াল এবং বেগুনি পোশাক গ্রহণ করে, আমরা নিঃসন্দেহে, তোমাকে বঞ্চিত করেছি, এখন থেকে তাঁকে একাই তুমি অনুসরণ করবে। ওহ, বহু শতাব্দীর বুদ্ধিবৃত্তিক হাতাহাতি এবং বিদ্রোহের মুক্ত চিন্তাধারা এখনও আমাদের সামনে রয়েছে, এবং তাদের বিজ্ঞান ফুরিয়ে যাবে নরমাংসভক্ষণে, কেননা আমাদের সাহায্য ছাড়াই ব্যাবিলনের মিনার গড়া শুরু করার পর, ওদের তা শেষ করতে হবে নরমাংসভক্ষণে। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই নৈরাজ্যবাদী দৈত্যটা আমাদের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করবে, আর আমাদের পায়ের তলা চাটবে, এবং তাতে রক্তের অশ্রু ছিটিয়ে দেবে আর আমরা রক্তবর্ণ দৈত্যটার ওপর বসে থাকব, আর 'জঘন্য ও নোংরামিতে পরিপূর্ণ' সোনার পেয়ালাটা উঁচুতে তুলে ধরে দেখাবো যে তার উপরে  'রহস্য' শব্দটি লেখা রয়েছে! কিন্তু কেবল তারপরই মানুষ শান্তি ও সুখের রাজ্যের সূচনা দেখতে পাবে। তুমি তোমার নিজের নির্বাচিতদের নিয়ে গর্বিত, কিন্তু এই নির্বাচিতরা ছাড়া তোমার আর কেউ নেই, এবং আমরা-- আমরা বাদবাকি সবাইকে বিশ্রাম দেব। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। তোমার নির্বাচিতরা এবং তোমার আঙুর ক্ষেতের শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই, যারা তোমার আরেকবার আসার অপেক্ষায় ক্লান্ত, তারা তাদের হৃদয়ের দুর্দান্ত উদ্দীপনা এবং তাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে ইতিমধ্যে অন্য ব্যাপারে নিয়ে গেছে, আর আজও নিয়ে যাচ্ছে, এবং শেষ পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে তোমারই মুক্তির পতাকা তুলবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিজেকেই ধন্যবাদ দিতে হবে। আমাদের শাসনের অধীনে এবং দাপটে সকলেই আনন্দে থাকবে, এবং তোমার মুক্ত পতাকার অধীনে তারা যেমন বিদ্রোহ করত, বা একে অপরকে ধ্বংস করত, তা আর করবে না। ওহ, আমরা যত্ন নিয়ে তাদের কাছে প্রমাণ করব যে তারা যদি সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে চায়, তাহলে তাদের  আমাদের খাতিরে নিজেদের স্বাধীনতাকে বাতিল করতে হবে আর পুরোপুরি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তুমি কী ভাবছ যে আমরা ধ্রুব কথাবর্তা বলছি নাকি মিথ্যা আওড়াচ্ছি? ওরা সবাই নিজেদের কাছে আমাদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে, কেননা ওরা দেখবে যে, তোমার দেওয়া মুক্তি ওদের কতটা অবমাননাকর দাসত্ব এবং সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে। মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা এবং বিবেকের স্বাধীনতা এবং বিজ্ঞান তাদের এমন দুর্গম বাধাবিপত্তির মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলবে, এমন সমস্ত বিস্ময় ও সমাধানের অতীত রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে, যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ-- যারা বাকিদের চেয়ে বেশি বিদ্রোহী এবং বেপরোয়া-- নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবে; অন্যরা-- বিদ্রোহী হলেও দুর্বল-- একে অপরকে ধ্বংস করবে; বাদবাকিরা, দুর্বল, অসহায় এবং দুঃখী, ফিরে এসে আমাদের পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে পড়বে আর কেঁদেকেঁদে বলবে: "হ্যাঁ, যিশুর পিতা, আপনিই যথার্থ ছিলেন; আপনি একা ঈশ্বরের রহস্যের অধিকারী, এবং আমরা আপনার কাছে ফিরে এসেছি, প্রার্থনা করছি যে আমাদের নিজের কাছ থেকে আপনি আমাদের রক্ষা করুন!" আমাদের কাছ থেকে খাবার রুটি পেয়ে,  তারা স্পষ্টভাবে টের পাবে যে আমরা তাদের কাছ থেকেই রুটি নিই, যে রুটি তাদের নিজের হাতে তৈরি, কিন্তু সমানভাবে কোন অলৌকিকতা  ছাড়াই তাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়; আর তা উপলব্ধি করার পর, যদিও আমরা পাথরকে রুটিতে রূপান্তরিত করিনি, তবুও রুটি তারা পেয়েছে, যখন কিনা অন্য প্রতিটি রুটি সত্যই তাদের নিজের হাতে পাথরে পরিণত হয়েছে, তারা তা পেয়ে বরং অত্যন্ত আনন্দিত হবে। ততদিন পর্যন্ত, তারা কখনও সুখী হবে না। আর কে তাদের অন্ধ করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, বলো তুমি? তুমি ছাড়া আর কে-ই বা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে  অজানা পথে পরিচালিত করেছে? কিন্তু আমরা আরও একবার ভেড়াগুলোকে খেদিয়ে আনবো আর চিরকালের জন্য আমাদের হুকুমের অধীনে রাখব। আমরা তাদের নিজস্ব দুর্বলতা প্রমাণ করে দেবো, এবং তাদের আবার হৃতমান করে রাখব, যদিও তারা তোমার কাছে শুধুমাত্র গর্ব করতে শিখেছে, কেননা তাদের যোগ্যতার চেয়ে বেশি তুমি তাদের গুরুত্ব দিয়েছ। আমরা তাদের সেই শান্ত, নিরহঙ্কার সুখ দেব, যা অমন দুর্বল, মূর্খ প্রাণীদের উপকার করে, এবং একবার তাদের দৃষ্টিতে তাদেরই দুর্বলতা প্রমাণ করার পর, তারা হয়ে উঠবে ভীরু এবং অনুগত, এবং মুরগির বাচ্চারা যেমন মুরগির চারপাশে জড়ো হয়, তেমন আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করবে। তারা অবাক হয়ে আমাদের কুসংস্কারের প্রশংসা করবে আর এত গৌরবময় ও জ্ঞানী মানুষের নেতৃত্ব দেখে তাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন মিলে লক্ষ-কোটি মানুষের দলকে বশীভূত করতে পারবে। মানুষ ক্রমে আমাদের ভয় পেতে শুরু করবে। আমাদের সামান্যতম ক্রোধে তারা ঘাবড়ে যাবে, তাদের বুদ্ধি দুর্বল হয়ে যাবে, তাদের চোখ শিশু এবং মহিলাদের মতো সহজেই কান্নায় ভেসে যাবে; কিন্তু আমরা তাদের দুঃখ এবং কান্না থেকে হাসি, শিশুসুলভ আনন্দ এবং আনন্দময় গানের সহজ অবস্থান্তর শেখাব। হ্যাঁ; আমরা তাদের ক্রীতদাসের মতো কাজ করতে বাধ্য করব, কিন্তু তাদের বিনোদনের সময় তাদের একটি নিষ্পাপ শিশুর মতো জীবন থাকবে, খেলাধুলা এবং আনন্দময় উল্লাসে ভরপুর। এমনকি আমরা তাদের পাপ করার অনুমতি দেব, কেননা দুর্বল এবং অসহায়, তার দরুণ তারা আমাদের  প্রতি আরও বেশি ভালবাসা অনুভব করবে, যাতে তারা এতে লিপ্ত হতে পারে। আমরা তাদের বলব যে, সব ধরনের পাপ থেকে তারা পরিত্রাণ পাবে, যদি সেগুলো আমাদের অনুমতি নিয়ে করা হয়; যাতে এই সমস্ত পাপের দায় আমরা নিজেদের উপর নিয়ে নিই, কারণ আমরা জগতকে এতই ভালবাসি যে, আমরা তার সন্তুষ্টির জন্য আমাদের আত্মাকে উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। আর, তাদের সামনে বলির পাঁঠা এবং উদ্ধারকারীর আলোয় হাজির হলে, আমদের আরও বেশি শ্রদ্ধা করা হবে। আমাদের কাছে তাদের কোনও গোপনীয়তা থাকবে না। তাদের স্ত্রী আর রক্ষিতাদের সঙ্গে বসবাসের অনুমতি দেওয়া, অথবা তা নিষিদ্ধ করা, সন্তান বিয়োনো বা নিঃসন্তান থাকা, নির্ভর করবে আমাদের প্রতি তাদের আনুগত্যের মাত্রার ওপর; এবং তারা তাদের আত্মার সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক রহস্য আমাদের কাছে আনন্দের সাথে খোলাখুলি বলবে— সবাই, তারা সবাই আমাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকবে, এবং আমরা তাদের কাণ্ড-কারখানা তোমার নাম নিয়ে অনুমোদন করব, এবং মাফ করে দেব, আর তারা আমাদের বিশ্বাস করবে এবং উল্লসিত হয়ে আমাদের মধ্যস্থতা স্বীকার করবে, কেননা এটি তাদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা এবং নির্যাতন থেকে মুক্তি দেবে— নিজেদের জন্য স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সিদ্ধান্তের বোঝা থেকে বাঁচবে। এবং সকলেই খুশি হবে, সবাই, তাদের দু-এক দল শাসক ছাড়া বাকি সবাই। কারণ আমরা, আমরা যারা  মহান রহস্যের রক্ষক তারাই হব দুর্দশাগ্রস্ত। সেখানে থাকবে লক্ষ লক্ষ সুখী খোকাখুকু, এবং এক লক্ষ শহীদ যারা নিজেদের উপর শুভ ও অশুভ জ্ঞানের অভিশাপ চাপিয়ে নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ হবে তাদের অন্তিমযাত্রা, এবং শান্তিপূর্ণভাবে তারা মারা যাবে, তোমার নামে, কবরের চবুতরাগুলোর পেছনে-- সেখানে মরে পড়ে থাকবে। কিন্তু আমরা গোপনীয়তাকে পবিত্র রাখব, এবং তাদের ভালোর জন্য তোমার রাজ্যে অনন্তকালীন জীবনের মরীচিকা দেখিয়ে ঠকাব। কেননা, কবরের ওপারে সত্যিই কি জীবনের মতো কিছু আছে, নিঃসন্দেহে তাদের মতন বোকাদের মগজে তা ঢুকবে না! লোকেরা আমাদের বলে আর তোমার পুনরাগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করি, যে, পৃথিবীতে আরও একবার তুমি বিজয় লাভ করবে; সঙ্গে থাকবে তোমার  নির্বাচিত সেনাবাহিনী, গর্বিত এবং শক্তিশালী; কিন্তু আমরা তোমাকে বোঝাবো যে, তারা নিজেদের বাঁচিয়েছে বটে কিন্তু আমরা সবাইকে রক্ষা করেছি। আমাদের সেই বড় অসম্মানেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, সেই বেশ্যারমণী অপেক্ষা করছে, "মহান ব্যাবিলন, যে কিনা বেশ্যাদের মাতা-ঠাকরুন"-- যিনি বাইবেল-কথিত দানবের ওপর বসে আছেন, তার হাতে রয়েছে ‘রহস্য’, শব্দটা খোদাই করা তার কপালে; এবং আমাদের বলা হয়েছে যে দুর্বলরা, মেষশাবকগুলো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং তাঁকে নিঃসঙ্গ ও নগ্ন করবে। কিন্তু তারপর আমি উঠে দাঁড়াব, এবং আঙুল তুলে তোমাকে দেখাব পাপমুক্ত সেই লক্ষ লক্ষ সুখী শিশু। এবং আমরা যারা নিজেদের পাপ নিজেদের উপর নিয়েছি, নিজেদের ভালোর জন্য, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করব: "আপনি যদি পারেন এবং সাহস থাকে, তবে আমাদের বিচার করে দেখান!" তাহলে জেনে রাখো যে আমি তোমাকে মোটেই ভয় পাই না। জেনে রেখো যে আমিও ভয়াবহ বিজনভূমিতে বাস করেছি, যেখানে আমি পঙ্গপাল এবং শেকড় খেয়ে বেঁচেছিলুম, আমারও আছে পূতস্বাধীনতা, যা দিয়ে তুমি মানুষকে আশীর্বাদ করেছ এবং আমিও একবার তোমার নির্বাচিত, গর্বিতদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলুম। কিন্তু আমি আমার বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠেছিলুম আর তখন থেকে উন্মাদনার সেবা করতে অস্বীকার করেছি। যারা তোমার ভুল সংশোধন করেছে তাদের সৈন্যদলে যোগ দিতে আমি ফিরে এসেছি। আমি গর্বিতদের ছেড়ে সত্যকার নম্রদের কাছে ফিরে এসেছি, আর তা স্রেফ তাদের নিজেদের সুখের জন্য। এখন আমি তোমাকে যা বলছি তা মুছে যাবে, এবং আমাদের রাজ্য ঠিকই গড়ে উঠবে, আমি তোমাকে বলছি, আগামীকালের পরই তুমি সেই অনুগত মানুষের দল দেখতে পাবে, যারা আমার হাতের একটি ইশারায় ছুটে গিয়ে তোমার খুঁটিতে জ্বলন্ত কয়লা ফেলবে, যার ওপর দাঁড় করিয়ে আমি তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারব, আমাদের কাজে গোলমাল বাধাবার সাহস করার জন্য। কারণ, যদি কখনও কেউ থেকে থাকে যে আমাদের ইনকুইজিশনের অগ্নিকুণ্ডে পুড়ে মরার যোগ্য-- তাহলে সে তুমি! আগামীকাল আমি তোমাকে পুড়িয়ে মারব। যা বলার ছিল তা বলে দিলুম।" 

আইভান থামল। ও ঘটনার মধ্যে সেঁদিয়ে গিয়েছিল আর প্রবল উত্তেজনায় কথা বলছিল, কিন্তু  হঠাৎ ফেটে পড়ল হাসতে হাসতে। 

"কিন্তু এ-সবকিছুই অযৌক্তিক!" অ্যালিয়োশা আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, যে ততক্ষণ পর্যন্ত বিভ্রান্ত এবং উত্তেজিত হয়ে চুপচাপ শুনছিল। "তোমার কবিতাটা খ্রিষ্টের মহিমা, মোটেই অভিযোগ নয়, যেমনটা তুমি, সম্ভবত, বোঝাতে চাইছিলে। আর কে-ই বা তোমাকে বিশ্বাস করবে যখন তুমি ‘মুক্তির’ কথা বলছ? ব্যাপারটা তাহলে কি আমাদের খ্রিস্টানদের বোঝা উচিত? তাহলে কি রোম (সমস্ত রোম নয়, সেকথা বলা অন্যায় হবে), কিন্তু রোমান ক্যাথলিকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে খারাপ, ইনকুইজিটর আর জেসুইটরা, তাদের তুমি ফাঁস করতে চাইছিলে! তোমার ইনকুইজিটর তো একখানা বিদকুটে চরিত্র। কোন পাপগুলোর দায় তারা নিজেদের উপর নিচ্ছে? ওই সমস্ত রহস্যের রক্ষক কারা, যারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য নিজেদের উপর অভিশাপ চাপিয়ে নিয়েছিল? তাদের সাথে কারোর কখনও দেখা হয়েছে? আমরা সবাই জেসুইটদের জানি, এবং তাদের পক্ষে ভালো কথা বলার কেউ নেই; কিন্তু তুমি তাদের যেমনভাবে তুলে ধরলে, তেমনটা কবে ছিল তারা? কক্ষনো ছিল না, কক্ষনো নয়! জেসুইটরা কেবল রোমান ক্যাথলিকদের একটা সেনাবাহিনী, যারা নিজেদের পার্থিব ভবিষ্যতের সাম্রাজ্যের জন্য তৈরি করছে, চাইছে একজন মুকুটপরা সম্রাট-- তাদের মাথার ওপর একজন রোমান প্রধান যাজক। সেটাই তাদের আদর্শ আর উদ্দেশ্য, যার মধ্যে কোনও রকম রহস্য বা অসহ্য যন্ত্রণা নেই। ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে প্ররোচিত চাহিদা, জীবনের মামুলি আর পার্থিব সুখের জন্য, নিজেদের লোকেদের দাস বানিয়ে রাখার আকাঙ্ক্ষা, অনেকটা আমাদের দেশের কেনা গোলামের ব্যবস্থার মতন কিছু, নিজেদের ভূমি মালিক হিসাবে বজায় রাখা-- তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা যেতে পারে। তারা হয়তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, এমনটাও সম্ভব, কিন্তু তোমার ওই যন্ত্রণাভোগী ইনকুইজিটর একেবারে ফালতু-- নিছক কষ্টকল্পনা!" 

"থামো! থামো!" আইভান বাধা দিয়ে হাসতে থাকে। "এত উত্তেজিত হয়ো না। তুমি বলছ এটা কষ্টকল্পনা, না-হয় তাই হোক! কিন্তু দাঁড়াও। অবশ্যই, এটা অভিনব। নিছক 'আনন্দ' কি এর উদ্দেশ্য? এটা কি যাজক প্যাসি তোমাকে শিখিয়েছেন?"

"না, না, একদম উল্টো, কারণ ফাদার প্যাসি একবার আমাকে নিজে যা বলেছিলেন, তার মতন কথাই তুমি বলছ, যদিও, হুবহু তা নয়-- একেবারে অন্যরকম কিছু" বলল আলেক্সিস, বেশ লজ্জায় পড়ে। 

"একটা দামি তথ্য, যদিও তোমার 'তা নয়' বলার পরও। আচ্ছা, আমাকে তুমি বল, তোমার কল্পনার ইনকুইজিটর আর জেসুইটরা 'মামুলি বস্তুগত সুখ' অর্জনের কারণ ছাড়া আর কেনই বা বেঁচে থাকতে চাইবে? কেন তাদের মধ্যে একজন সত্যিকারের শহিদকে পাওয়া যাবে না, যে একটা মহান এবং পবিত্র ধারণার নিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করছে এবং হৃদয় দিয়ে মানবতাকে ভালোবেসেছে? এখন ধরে নিই যে এই 'মামুলি বস্তুগত সুখ' এর জন্যে হাঘরের মতন পড়ে থাকা সত্ত্বেও এই জেসুইটদের মধ্যে অন্তত একজন থাকতে পারে, আমার বুড়ো ইনকুইজিটরের মতন একজন, যিনি নিজে বিজনপ্রদেশে শেকড় খেয়ে বেঁচেছিলেন, মুক্ত ও নিখুঁত হওয়ার প্রয়াসে দেহের কষ্টকে সহ্য করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যিনি মানবতাকে ভালবাসায় ঢিলে দেননি কখনও, এবং যিনি একদিন ভবিষ্যদ্বাণীর  সত্য’র সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন; যিনি যতোটা পারেন বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরোনো ব্যবস্থায় মানবতার বড় অংশ কখনওই সুখী হতে পারবে না, ব্যাপারটা সেই লোকগুলোর জন্য নয় যারা ভাবে যে একজন মহান আদর্শবাদী এসেছিলেন এবং মৃত্যু স্বীকার করেছিলেন আর ঈশ্বরপুত্রের সর্বজনীন সম্প্রীতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই সত্য উপলব্ধি করে, তিনি পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন আর যোগ দিয়েছিলেন-- বুদ্ধিমান এবং ব্যবহারিক মানুষদের সাথে। এটা কি অত অসম্ভব মনে হয়?" 

"কার সাথে যোগ দিয়েছেন? কোন বুদ্ধিমান আর ব্যবহারিক মানুষ?" অ্যালিয়োশা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল। "তারা কেনই বা অন্য লোকেদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হবে, আর  তাদের কাছে কোন রহস্য এবং গোপনীয়তা থাকতে পারে? তাদের কোনওটাই নেই। তাদের যা আছে তা হলো নাস্তিকতা এবং অবিশ্বাস। তোমার ইনকুইজিটর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, এবং এটাতেই যা কিছু রহস্য থাকতে পারে তা আছে!" 

"হয়তো তাই। তুমি ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছ। আর সত্যিই এটা তাই, এবং সেটাই লোকটার পুরো রহস্য; কিন্তু এটা কি তাঁর মতো একজন মানুষের কাছে তীব্র যন্ত্রণা নয়, যিনি মরুভূমিতে তপস্যা করে নিজের সমস্ত জীবনযৌবন নষ্ট করেছিলেন, এবং তা সত্ত্বেও সহকর্মীদের প্রতি তাঁর ভালবাসা থেকে নিজেকে নিরাময় করতে পারেননি? তাঁর জীবনের শেষ দিকে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন যে মহান এবং ভয়ানক আত্মার পরামর্শ মেনে নিলে তবেই এই লক্ষ লক্ষ দুর্বল বিদ্রোহীদের ভাগ্য, 'বিদ্রূপে গড়া অর্ধ-সমাপ্ত মানুষের নমুনাগুলোকে', সহনীয় করে তোলা যায়। আর, একবার ব্যাপারটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলে, তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন যে সেই উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য, একজনকে জ্ঞানী আত্মার নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে, যিনি মৃত্যু এবং ধ্বংসের সেই ভয়ঙ্কর আত্মা, অতএব মিথ্যা এবং প্রতারণার একটি পদ্ধতি গ্রহণ করে মানবতাকে সচেতনভাবে মৃত্যু এবং ধ্বংসের দিকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যেতে হবে, আর তাছাড়া, সব সময় তাদের ঠকাতে হবে, যাতে তারা বুঝতে না পারে যে তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এবং তাই দুঃখী অন্ধ লোকগুলোকে, অন্তত এই পৃথিবীতে তারা যতদিন আছে, আনন্দের বোধে ফুসলিয়ে রাখতে হবে। এবং এটা লিখে নিতে পারো: ঈশ্বরপুত্রের নামে একটি পাইকারি প্রতারণা, যাঁর আদর্শ নিয়ে বুড়োটা এত আবেগপ্রবণ ছিল, এত উদার, তার প্রায় সারা জীবন ধরে বিশ্বাস করেছিল! এটা কি কষ্ট নয়? 

আর এমন একটা একক ব্যতিক্রম যদি পাওয়া যেত, সেই সেনাবাহিনীর মধ্যে এবং শীর্ষে, 'যে কিনা ক্ষমতা ভোগ করার জন্য অথচ জীবনের নীচ সুখের জন্য লালায়িত, 'তুমি কি মনে করো যে অমন একজন মানুষ একটি ট্র্যাজেডি ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট? তাছাড়া, প্রধান নেতা হিসেবে আমার ইনকুইজিটর মশায়ের মতো একজন একক ব্যক্তি, সমগ্র রোমান ক্যাথলিক ব্যবস্থার বাস্তব ধারণাটি জেসুইট লোকজনদের দিকনির্দেশ করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হবে, আমার কবিতায় বর্ণিত একাকীত্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রধানতম বিশ্বাস কোনও সময়েও আন্দোলনের মূল পরিচালকদের মাথা থেকে উবে যায়নি। কে জানে, সেই ভয়ঙ্কর বুড়ো ছাড়া, মানবতাকে এত দৃঢ়ভাবে, আর আদি উপায়ে ভালবেসেছে, এমনকি আমাদের দিনকালেও তিনি একাকী ব্যতিক্রমের আকারে বজায় রয়েছেন, যার অস্তিত্ব কেবল আকস্মিকতার কারণে নয়, বরং একটি স্পষ্ট পরস্পরনির্ভর সমঝোতা থেকে উঠে এসেছে, এক গোপন সঙ্গঠনের আকারে, যার উন্মেষ হয়েছিল বহু শতক আগে, যাতে রহস্যটিকে দুর্বল ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের  হঠকারী দৃষ্টি থেকে রক্ষা করা যায়, এবং তা কেবল কি তাদের নিজেদের আনন্দের জন্য? সুতরাং ব্যাপারটা তেমনই দাঁড়াল; এর অন্যথা হতে পারে না। আমার সন্দেহ হয় যে খ্রিস্টধর্মীর গোপন সংস্হা ফ্রিম্যাসনদের সংগঠনের ভিত্তিতে এ রকমই কোনও না কোনও রহস্য আছে, এবং রোমান ক্যাথলিক পাদ্রিরা যে তাদের ঘৃণা করে, তার কারণ এটাই, তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিযোগী, বিশ্বাসের  বিভেদ খুঁজে পাবার ভয়, যা উপলব্ধি করার জন্য গরুর পাল আর একজন রাখাল প্রয়োজন। যাই হোক, আমার ধারণা সমর্থনের উদ্দেশ্যে, আমাকে এমন একজন লেখকের মতন দেখতে লাগছে যে তার লেখালিখির সমালোচনা সহ্য করতে অক্ষম। এটাই যথেষ্ট।"

"তুমি সম্ভবত নিজেই একজন ফ্রিম্যাসন!" বলে উঠল অ্যালিয়োশা। "তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না," ও যোগ করল, কণ্ঠস্বরে গভীর দুঃখ নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে মন্তব্য করার দরুণ দেখল যে তার ভাই তার দিকে ঠাট্টার চোখে তাকিয়ে আছে, "তাহলে তুমি কীভাবে তোমার কবিতা শেষ করতে চাও?" ও অপ্রত্যাশিতভাবে জানতে চাইল, চোখ নামিয়ে, "নাকি, এটি এখানেই খতম?"

"আমার উদ্দেশ্য এরকম একটা দৃশ্য দিয়ে শেষ করা: নিজের হৃদয়কে হালকা করে, ইনকুইজিটর মশায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন ঈশ্বরপুত্রের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য, নৈঃশব্দের বদলে তিক্ত ও তীক্ষ্ণ কথা শুনতে চাইছিলেন। ঈশ্বরপুত্রের স্তব্ধতা ইনকুইজিটরের ওপর বোঝার ভার হয়ে দাঁড়ায়। ইনকুইজিটর এতক্ষণ লক্ষ্য করছিলেন যে তাঁর ঈশ্বরপুত্র মহাআগ্রহে চুপচাপ তাঁর কথা শুনছেন, ইনকুইজিটরের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এবং বন্দির চোখ দু'টি মৃদুভাবে স্থির, এবং তা থেকে বোঝা যায় যে বন্দির উত্তর দেবার আগ্রহ নেই। ঈশ্বরপুত্র হঠাৎ উঠে দাঁড়ান; আস্তে আস্তে এবং নীরবে প্রশ্নকর্তার কাছে আসেন, তিনি তাঁর দিকে ঝুঁকে আলতোভাবে রক্তহীন, নব্বুই বছরের ঠোঁটজোড়ায় চুমু খান। এটাই ছিল যাবতীয় উত্তর। থরথর করে কাঁপতে থাকে গ্র্যাণ্ড ইনকুইজিটর; তার মুখের কোনায় দেখা দেয় আক্ষেপ-পীড়িত খিঁচুনি। ইনকুইজিটর দরজার কাছে গিয়ে কপাট খুলে দেয়, এবং ঈশ্বরপুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'যান,' বলে ইনকুইজিটর, 'চলে যান, আর কখনও ফিরে আসবেন না ...আবার আসবেন না ...কখনও না, কখনও না!' এবং ঈশ্বরপুত্রকে অন্ধকার রাতে বেরিয়ে যেতে দেয়। বন্দি অদৃশ্য হয়ে যায়।"

"আর বুড়ো ইনকুইজিটর?"

"চুম্বন তার হৃদয়কে জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু বুড়ো তার নিজের ধারণা এবং অবিশ্বাসে অটল ছিল।"

"আর তুমি, তার সাথে? তুমিও!" হতাশ হয়ে অ্যালিয়োশা বলে ওঠে। শুনে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আইভান।