Tuesday, November 16, 2021

প্রহরশেষের অলোকরঞ্জন | রজতকান্তি সিংহচৌধুরী

'সভামিছিল এবং শায়াশেমিজের পিছনে ছোটাই সকল কালের সব যুবকের স্বধর্ম হতে পারে না।' পঞ্চাশের সেই শুরুর দিনগুলোতে লিখেছিলেন নানা অর্থেই অগ্রজ কবি অরুণকুমার সরকার। সেদিন পঞ্চাশের তরুণ কবিদের মুখপত্র 'শতভিষা'র (অষ্টাদশ সংকলন, ১৩৬৩) পাতায় 'বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা' নামের এক নির্ণায়ক নিবন্ধে। কী ছিল এ লেখার পটভূমি? পঞ্চাশের সূচনার দিনে একদিকে ছিল 'জনগণের কবিতা চাই', 'বিপ্লবী কবিতা লেখো' ধরনের ফতোয়া। অন্যদিকে ছিল যৌন কবিতার দাবি, 'সকল কবি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে কামুক হয়ে উঠতে পারেননি' ধরনের আক্ষেপ। তার মধ্যেই 'শতভিষা'র (১৯৫১) অঙ্গীকার ছিল, আমরা কবিতাকে আবার কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনব।' অনেকটা ডব্লিউ বি ইয়েটসের ধরনে উচ্চারণ, 'যা-কিছু কবিতা নয়, তাকে কবিতা থেকে বাদ দিতে হবে একেবারে।' কবিতার অন্তর্মুখীনতা এবং শুদ্ধতার কাছে ফিরে আসাটাই ছিল 'শতভিষা'র শপথ। বছর দুয়েকের ভেতরে বেরুল ‘কৃত্তিবাস' (১৯৫৩)। 'শতভিষা'র ঝোঁক যদি ছিল 'ব্যক্তিত্বচিহ্নিত' কবিতার দিকে, ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রবণতা 'স্বীকারোক্তিমূলক' কবিতায়। 

বাংলা কবিতার মৌলিক লিরিক্যাল স্বর, যা পঞ্চাশের অব্যবহিত আগে কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিল, তা ফিরে এল ‘শতভিষা’য়, ‘কৃত্তিবাস’-এ, পঞ্চাশের নতুন কবিতায়। গত শতকের পাঁচের দশকটি ছিল পুনরধিকারের, পুনরাবিষ্কারের, পুনর্জন্মের, পুনরুজ্জীবনের প্রাচুর্যে, প্রত্যয়ে, সামর্থ্যে স্পন্দমান। পঞ্চাশের কবিদের মেধায়, অনায়াস শব্দছন্দদক্ষতায়। এঁদের জন্ম বিশ্বব্যাপী মন্দার ভেতরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে, বয়ঃসন্ধি স্বাধীনতালগ্ন দেশদ্বিখণ্ডনের ছিন্নভিন্নতার মধ্যে। তবু এঁদের লেখালেখিতে টি এস এলিয়ট-কথিত 'পোড়ো জমি' পেরিয়ে দিকপ্রান্তে ক্ষীণ নীলাঞ্জনরেখার অনুসন্ধান দুর্নিরীক্ষ্য নয়। রবীন্দ্রকবিতা থেকে স্বরের স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পেতে তিরিশের কবিতা যেমন মনীষিতা আর শিল্পিতাকে আশ্রয় করেছিল, চল্লিশের কবিতার একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছিল জনসংহতির লড়াকুপনায়, পঞ্চাশের কবিদের ফিরে যাওয়া ছিল কবিতার বিশুদ্ধতায়, সহজ শুশ্রূষায়। আলোক সরকারের কবিতায় বাংলা কবিতার বিশুদ্ধতম রূপ আমরা খুঁজে পাই। (সেই শুদ্ধস্বরের উত্তরাধিকার এই শতকে গত দুই দশকে যেসব তরুণ লিখতে এসেছেন, তাঁদের কবিতায় প্রগাঢ় আর এটাই হয়তো তাঁদের ভেতরে আলোক সরকারের কবিতার প্রতি ভালোবাসার কারণ।) অলোকরঞ্জনও বিশুদ্ধতারই কবি, তবে অসংখ্য বাঁকবদল আর স্পন্দিত আঙ্গিকে ওঠানামা তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। ছেচল্লিশটি কবিতার বই নিয়ে তাঁর কাব্যপ্রবাহে শাশ্বত হতে চাওয়া কবিতার পাশাপাশি সমকালের রক্তক্লেদে লগ্ন কবিতাও দেখতে পাব। পঞ্চাশের সেই সূচনার দিনগুলি শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু সহ অতজন প্রধান প্রধান কবির ভেতরেও তিনি ছিলেন নিজভূমে স্বরাট। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের সেই ঐতিহাসিক কবিসম্মেলনে জীবনানন্দ থেকে তরুণতম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবধি বাহাত্তর জন কবির ভেতরেও কুড়ি বছরের তরুণ অলোকরঞ্জনের 'আমার ঠাকুমা' কবিতাটি কীভাবে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তা লিখেছেন কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ, 'একটি নতুন আবিষ্কার ওই সন্ধ্যার যাবতীয় যাদুস্পর্শ ছাপিয়ে গিয়েছিল: অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সে সময়ে যাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর, একটি কবিতাপাঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন আপ্লুত করে দিয়েছিলেন, কবিতাটি ছিল “আমার ঠাকুমা”।' ('আধুনিক কলকাতার সাহিত্যলোক : ১৯৪১ থেকে ১৯৮০', শঙ্খ ঘোষ)। এই কবিতাটি দিয়েই 'শতভিষা'য় অলোকরঞ্জনের আত্মপ্রকাশ, পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগে অন্যতম সম্পাদক দীপঙ্কর দাশগুপ্ত কবিতা চেয়ে চিঠি দেন অলোকরঞ্জনকে। পরে ‘যৌবনবাউল’-এ অন্তর্ভুক্ত এ কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন অরুণকুমার সরকার, এ লেখার গোড়ায় উদ্ধৃত সেই নিবন্ধটিতে। আর তাঁর কবিতা সম্পর্কে অনেক পরে  কবিবন্ধু আলোক সরকারের নিরীক্ষা, 'রূপদক্ষ, ভাষাভূষণপ্রিয় কবি অলোকরঞ্জন। শব্দ তাঁর হাতে পালিত সারমেয়ের মতো ওঠে বসে।' 

অলোকরঞ্জন তাঁর কবিতাযাত্রায় প্রসন্নতার সম্বুদ্ধ স্বরূপ থেকে সরে এসেছেন রক্তক্ষরণের মরপৃথিবীতে। তাঁর চলতে থাকার চালচিত্তিরে 'যুদ্ধ' তাঁর কাছে দুই সিলেবলের অশ্লীলতম শব্দ হয়ে উঠেছে। তাঁর দেশজ দোতারাতে বেজেছে ভুবনতল্লাটের সুর। বাংলা ভাষাই হয়ে উঠেছে দীর্ঘ  প্রবাসে তাঁর অনন্য আবাসন। তাঁর কবিতায় বারেবারেই এসেছে বাঁকবদল। বারেবারে হারানোর মধ্যে ফুটেছে নতুন করে পাবার আকুতি। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাযাত্রায় তত-আলোচিত-নয় যে-শেষ দশকটি সেখানে আমরা দেখব, তাঁর কবিতা নব নব উন্মেষশালিনী কল্পনামনীষার দৌলতে নতুন নতুন দিগন্তের অভিসারী। বাংলা কবিতার প্রথানুগ সীমান্তরেখাকে অতিক্রম করে গেছে অনায়াস শৈলীতেই। 

আমাদের এই মিতকথনে, আমরা তাঁর শেষ পাঁচ বছরের অসামান্য কবিকৃতি থেকে কয়েকটি কণিকা মাত্র দেখবার চেষ্টা করি?

দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি

প্রথম বই ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) থেকে দ্বিতীয় বই 'নিষিদ্ধ কোজাগরী'র (১৯৬৭) আট বছরের ব্যবধান ছিল। পরে পরপর প্রকাশিত দুটি বইয়ের ভেতরে ব্যবধান কমে আসে। আর ২০১৬ থেকে ২০২০ তাঁর জীবনের এই শেষ পাঁচ বছরে প্রতি বছর একটি করে কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে অলোকরঞ্জনের। অশীতিপর বয়সে এই সৃষ্টিশীলতা বিস্ময়কর। 

২০১৩ সালে কবি আশি বছর পেরিয়েছেন। চলে গেছেন জীবনসঙ্গিনী শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত (২০০৫)। বিধ্বংসী শোক পেরিয়ে কবি উপনীত হলেন উত্তরপর্বে। রবীন্দ্রনাথ এক অর্থে তাঁর জীবনদেবতা। তাঁর অন্ত্য পর্বের সৃজনশীলতা শেষ দশকের রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ায়।

দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি'। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের উত্তরপর্বের কবিতায় এক উজ্জ্বল মাইলফলক। সদ্যপ্রয়াত কবির ছ'দশক জোড়া  দীর্ঘ কবিতাযাত্রার শিখরে 'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি'(২০১৬), 'তোমরা কি চাও, শিউলি না টিউলিপ' (২০১৭), 'শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮), 'ঝাউ-শিরীষের শীর্ষসম্মেলনে (২০১৯), 'বাস্তুহারার পাহাড়তলি' (২০২০) নিয়ে শেষ পঞ্চকের সূচনা এই অন্তময়তার রেশ মাখানো কবিতার বইটি দিয়েই। লক্ষ করবেন, তাঁর অধিকাংশ কবিতার বইয়ের নামও ছন্দোময়, তাঁর কবিতার মতোই। মালার্মের মতো তিনি বিশ্বাস করেন, সরকার আসবে যাবে, কিন্তু ছন্দ থেকে যাবে। এ বইটির নামে এসে গেছে একেবারে লোকায়ত, প্রায়  সবার জানা এক ছেলেভুলানো ছড়ার চরণ এবং ছন্দ, শ্বাসাঘাতপ্রধান স্বরবৃত্তে। বইয়ের নামকরণে এবং অনেক কবিতায় বেলাশেষের বা বিদায়ের ছবি, কিন্তু সে বিদায়সুর কোনো নিরাশায় তলিয়ে যায় না। সে-সুর মধুর, কৃতজ্ঞতার,মুগ্ধতার। এই আলো এই সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর মাঝখানে তিনি  হয়ত থাকবেন না, কিন্তু কীই বা আসে যায় তাতে!  এইখানে তাঁর জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের সুরে সুরে গেয়ে উঠতেই পারেন সুধাকণ্ঠ  অলোকরঞ্জন 'নাই যদি রোস নাই রবি'। 'অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ' ভরিয়ে তোলবার নেশায়, হলই বা সেটা সায়ন্তনের 'ক্লান্ত' ফুলের গন্ধ।

মূলত 'যৌবনবাউল' এবং অংশত তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের কবিতা নিয়েই তাঁর কবিতার অনেক আলোচনা শেষ হয়, 'মরমী করাত' (১৯৯০) বা 'রক্তমেঘের স্কন্দপুরাণ'(১৯৯৩) অবধি যার শেষ সীমা। এর একটা কারণ হয়তো, ছোট ছোট প্রকাশন থেকে বের হওয়া তাঁর অনেক বইয়ের অলভ্যতা, দে'জ-কৃত কবিতা সংগ্রহের এ তাবৎ তিনটি খণ্ডই প্রকাশিত। 

'শ্রেষ্ঠ কবিতা' নিঃশেষিত। এইসব কারণে এরপর থেকেই বুঝি শুরু হয়ে যায় পূর্বজ আর এক দাশগুপ্ত কবির মতো পাঠক হারানোর বৃত্তান্ত। উত্তরপর্বের জীবনানন্দ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর অনাগ্রহ কি একই ধাঁচের নয়? 

এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। ছোটোবেলায় ঠাকুর্দার মুখে শোনা  গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের এই বীক্ষা মেনে  কবিতা থেকে কবিতার সঞ্চারপথে পুনরুক্তিপ্রবণতা খারিজ করে চলা অলোকরঞ্জনের নানা পর্যায়ের কবিতার ধরতাই এখনও অনেক কবিতাপ্রেমী পাঠকের অধরা।

এ শতকে তাঁর  লেখালেখি নিয়ে আলোচনা নজরে পড়ে কম। শুধুমাত্র শেষ পাঁচটি কবিতার বইয়ের ঋদ্ধিঋণ বাংলাভাষাভাষী হিসেবে  বর্তমান বিনীত প্রতিবেদককে কৃতজ্ঞ করে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গাল্ফ যুদ্ধ ‘যৌবনবাউল’ -এর এই প্রতীতির জায়গাটাকে আরোই দীর্ণ করে দিল, লেখা হল 'আয়না যখন নিঃশ্বাস নেয়' (১৯৯২), 'রক্তমেঘের স্কন্দপুরাণ' (১৯৯৩)-এর মতো বই, যুধ্যমান বিশ্বে কবির বিমূঢ়তা, বিবমিষা। 'যুদ্ধ' হয়ে ওঠে তাঁর কাছে দুই সিলেবলের অশ্লীলতম শব্দ। মানুষের মুখ উৎকীর্ণ হয়, এমন কবিতার প্রতি অকুণ্ঠ আসক্তি প্রকাশ করছেন তাঁর বয়ানে। অবশ্য সেই  মানুষের মাঝখানে 'আলোকতোয়া' নদী আর 'জ্যোতিগৃহ সম্পন্ন' করবার স্বপ্ন ও প্রস্তুতি তাঁকে ছেড়ে যায়নি।  

নতুন শতকে  দ্বিতীয় যন্ত্রবিপ্লব সাধিত হল। মোবাইল, কম্প্যুটার, ইন্টারনেট, আই ফোন, সোশ্যাল  মিডিয়া -শাসিত বিশ্বে কবি অনুসন্ধান করতে লাগলেন প্রাথমিক মানবিক সম্পর্কগুলোকে। পারস্যের কবি হাফিজের অনুরণনে লেখা জার্মান মহাকবি গ্যোয়েটের 'ডিভান' কাব্যের বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে বাউল-সুফি-মরমিয়া-দরবেশদের ভাবলোককে পুনরাবিষ্কার করলেন ‘যৌবনবাউল’। মোবাইলে মুখ-গোঁজা, শপিং মলে কথাহারা ইঙ্গিতে বাজার-করা ভাষাহীনতার যান্ত্রিক পৃথিবীতে আমরা দেখব ‘যৌবনবাউল’ ক্রমশ তাঁর অনাহত প্রতীতির বিদীর্ণ জায়গাটার শুশ্রূষায় নিবিষ্ট। ভোগবাদের মহামারীর বিপরীতে বহিরঙ্গ ছেড়ে চিদঘন অন্তর্লোকের অনুসন্ধানী অলোকরঞ্জন। ‘দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি' (২০১৬) তাঁর এই পর্বের উল্লেখ্য ফসল।

পার্থপ্রতিম দাসের অসামান্য প্রচ্ছদে শোভিত পাঁচ ফর্মা-ছাপানো এই 'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি' বইয়ের বিভাব কবিতায় কবি লিখছেন,

মনের ভেতর গুমরে ওঠে 

ধাই-মার সেই দাবি

'মাছের কাঁটা পায়ে বিঁধলে

দোলায় চেপে যাবি


দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি 

    গুনতে গুনতে যাবি'... 

প্রথম কবিতার নাম '২০২'।  বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিবিজড়িত ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ ঘিরে  "আমাদের তারুণ্যের শেষ তীর্থ 'কবিতা ভবন'।" শ্মশানের অন্য নাম 'পিতৃবন'। এ বইয়ের 'পিতৃবন' কবিতায় তাই পেয়ে যাই তাঁর স্নেহাপ্লুত বাবা বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্তকে, শ্রীমান অলোকরঞ্জনকেই যেন  তিনি চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁর 'ক্ষমাহীন দুর্বলতায়'। দূরান্বয়ে স্মরণে আসে, কবি শ্রীমধুসূদনের 'মেঘনাদবধকাব্যে'র 'প্রেতপুরী' নামধেয় অষ্টম সর্গে লক্ষ্মণের শক্তিশেলের প্রতিকারকামনায় সশরীরে স্বর্গলোকগামী রামের দর্শন পেয়ে ঊর্ধ্বলোকবাসী পুত্রশোকে লোকান্তরিত দশরথের স্নেহাকুল মুখচ্ছবি, যিনি রামকে দেখে বলে উঠছেন, 'আইলি কি রে এ দুর্গম দেশে / এতদিনে, প্রাণাধিক, দেবের প্রসাদে,/ জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়?'।  'পিতৃবন' কবিতায় অলোকরঞ্জন দেখেন, তাঁর পিতার পিছনেই দাঁড়িয়ে পিতামহ দক্ষিণারঞ্জন, 'যৌবনবাউল'-এর সুখ্যাত 'আমার ঠাকুমা' কবিতার সেই 'শহরবিদ্বেষী' মানুষটি,  যিনি সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় ভিটেপত্তন করে  তাঁর বড়ো নাতি অলোকরঞ্জনের বয়স যখন 'বড়োজোর পনেরো', তখনই সেই জ্যেষ্ঠ পৌত্রের হাতে 'তবু আমায় পারিবারিক দুর্গাপূজার ভার তুলে দিয়েছিলেন'। এভাবেই পরিজনেরা ঘুরে ঘুরে আসেন অলোকরঞ্জনের কবিতায়, যেমন অনুধাবন করেছেন  শঙ্খ ঘোষ ('আমার বন্ধু অলোকরঞ্জন')। আর সেই পরিজনদের সীমা বিস্তারিত হতে হতে চলে দুনিয়াভর, রক্তসম্পর্কহীন  দীনতম বৃদ্ধ মানুষটিও কবির আত্মীয়। 

আর, এ বইতেই টানা গদ্যে লেখা 'অনাবাসী যদি অনুবাদ করে' কবিতায় লিখলেন, 'তুলসীতলার আজলকাজল মায়ামদির নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে ইহমানুষের কপাল থেকে বাস্তুদেবতার আশীর্বাদ চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে যায়, তার বরাতে তখন চলতে থাকার চালচিত্তির ছাড়া অন্যতর কোনো বিধিলিপি অবশিষ্ট থাকে না। তখন থেকেই সম্ভবত ভাষাই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র আবাসন।' হাইডেগার-অনুরণিত এই আভাষণ অলোকরঞ্জনেরই সিলমোহর হয়ে ওঠে আজকের  ভুবনজোড়া শরণার্থীর মেলায়।

অলোকরঞ্জনের কবিতা-বইয়ে শতেক যুগের কবিদলের আনাগোনা, শতেক যুগের গীতিকা হাতে। এ বইয়ের 'স্বরশয্যায়' কবিতায় স্বভাবসম্মিত সৌজন্যেই উপস্থিত শিল্পাচার্য শিলার ও শিষ্য নোভালিস।

'দাহ' কবিতার শেষ দুই চরণ এক মুগ্ধ বিস্ময়ের সামনে আমাদের উপনীত করে: 

      অর্থাৎ কিনা আমার মৃত্যু হয়নি সুচারুভাবে, 

      অর্থাৎ কিনা আমাকে নিয়েই তোমরা দিন কাটাবে..


তাই হোক, তবে তাই হোক, অলোকদা!

'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি' বইয়ের উপান্ত্য কবিতা 'পালকি করে যারা আমায় নিয়ে চলেছে'তে পাই, তাঁর পালকির বাহকেরাই কখন নিজেদের অজান্তেই তাঁর শববাহক হয়ে উঠেছে। 'আমার হাতে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি', একটি বাহক, যার নাম হয়ত নিখিল, সে চায়, শেষ বইটির 'অপূর্ণতা পূরণ' করে ছাপতে দিতে, পুঁথি বিষয়ে গবেষণায় যার নাকি ডি. ফিল.'..

আহা, সত্যিই আজ যদি আমরা এমন 'অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি' খুঁজে পেতাম। 'কবিসম্মেলন', 'কবিতা আশ্রম'-সমেত নানা পত্রপত্রিকায় তাঁর  সাম্প্রত শারদ অঞ্জলি এখনও তো গ্রন্থভুক্ত হতে বাকি। দৈববাণীর মতো দূরভাষে ভেসে আসা কিছু কবিতার শ্রুতিলিপিকর তো এই প্রতিবেদকও। 

এ বইয়ের উপান্ত্য কবিতা 'পালকি করে যারা আমায় নিয়ে চলেছে' পড়ে যেই না পাঠক সজলচক্ষু হতে যাবেন, অমনি আসে অলৌকিক শৈলীতে অমোঘ আশ্বাস, বইটির সবশেষ কবিতায়:

আমার জন্য  হা-হুতাশন কোরো না, অরুণাভ,

উত্তরাধিকার সূত্রে পুণ্য পারমিতার 

ছ'পণ কড়ি সঞ্চয়িত আছে আমার দোলায়, 

বাকিটা পথ গুনতে গুনতে যাব!

এ বই কবি উৎসর্গ করেছেন কবি নাসের হোসেন আর বর্তমান প্রতিবেদককে। এ তাঁর উদার কবিচারিত্র‍্যেরই এক মুদ্রা।

৩      

'তোমরা কী চাও, শিউলি না টিউলিপ?' (২০১৭) পরবর্তী বই। উৎসর্গ করা হয়েছে অমিয় দেব এবং সৌরীন ভট্টাচার্যকে। কবির প্রথম পর্বের কবিতা ছিল দেশজ নিসর্গকে নিয়ে, লোকজীবন, আস্তিক্যবোধকে জড়িয়ে। তাকে তিনি শিউলি বলে অভিহিত করছেন। আর উত্তরপর্বের আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লাগা কবিতা তাঁর টিউলিপ ফুল। পাঠকের কাছে প্রশ্নময় শিরোনাম তাই, 'তোমরা কী চাও, শিউলি না টিউলিপ?' আমরা অবশ্য দুটোই চ্চাই। এক সভায় এমন কথাই জানিয়েছিল এই প্রতিবেদক।

কবির ঠাকুর্দা দিনাজপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধান শিক্ষক দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত অবসর গ্রহণের পর সাঁওতাল পরগনার রিখিয়া গ্রামে নতুন করে ভিটে পত্তন করে  বাস করতে শুরু করেন। পশ্চিমের নিসর্গনন্দিত রিখিয়ায় তিনি যৌথ পরিবারের বসবাসোপযোগী একটি মনোরম পরিসরও নির্মাণ করেন। বড়ো নাতি অলোকের জন্মের পর তিনি সেখানে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন, অলোকরঞ্জনের ওপর এই পুজোর ভারও দিয়ে যান তিনি। পুজো উপলক্ষ্যে বৃহৎ যৌথ পরিবারের সবাই সেখানে জড়ো হত। অলোকরঞ্জনের শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি রিখিয়ার সঙ্গে যুক্ত, ‘যৌবনবাউল’-এর বহু কবিতায় রিখিয়া, বাবুডি, আমরুয়া, চানন নদী,  হিরনা টিলা, ত্রিকূট পাহাড় সহ এখানকার নিসর্গ ও লোকজীবনের ছবি। প্রায় চল্লিশ বছর চলেছিল এই বসতবাড়ির পুজো। বইটির বিভাব কবিতাতেই আমরা তাই দেখব,  'বসত বাড়ির শেষ বারকার পুজোয়/ শেফালিকার শুভ্র আগুনটাকে/ চয়ন করে বেরিয়ে পড়লাম/ প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে'। এই বেরিয়ে পড়া থামল এক ভিনদেশের গাঁয়ে, 'সেখানে দেখি অজস্র টিউলিপ/ যা শুধু লাগে নশ্বরের কাজে'। শিউলি পূজার উপচার, অন্যদিকে টিউলিপের তেমন কোনো আধ্যাত্মিক গরিমা নেই, নশ্বরের কাজেই তার ব্যবহার। মরমী কবির প্রথম পর্বের কবিতা যদি অতীন্দ্রিয়তায় লগ্ন, পরবর্তীতে তাঁর কবিতায় নৈমিত্তিকের নশ্বর সৌন্দর্য ও কদর্যতার অভিক্ষেপ। 

উত্তরপর্বে তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লাগলেও কবি স্বদেশের সঙ্গে নিরন্তর সংলাপরত। বাংলা ভাষাই হয়ে ওঠে তাঁর আবাসন। দেশজ আচার, পার্বণ আরো নতুন তাৎপর্য পায় তাঁর কবিতায়। 

'ভাইফোঁটার দেয়ালটা' কবিতায় বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে প্রয়াত মেজদির জন্য প্রবাসী ভাইদের বেদনা এক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে ওঠে কবির অননুকরণীয় শৈলীতে: 'মেজদি মারা গেলে আমরা ছ-ভাই যথারীতি প্রথানুগত সম্ভ্রমে টালিগঞ্জের/ পোড়ো সেই বাড়িটায় জড়ো হয়েছিলাম। বাপুয়া এসেছিল ব্রেজিল থেকে/ বিবদমান দুই শিবিরের মধ্যে সাময়িক মোকাবিলা/ স্থগিত রেখে ৷ লিবিয়ায় ভ্রাতযুদ্ধে শামিল হয়ে ডানচক্ষু/ জখম হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং পিন্টু এসে হাজির, তাকে আগলিয়ে/ ধরে ধরে এনেছিল বাদল আর বুলবুল ৷ গোরা আজকাল কানে/ শুনতেই পায় না, তবু একে-ওকে জিগ্‌গেস করে শেষ মুহূর্তে কী করে জানি হাজিরা দিল।/ পাশের বাড়ির মালি তালা খুলে আমাদের নিয়ে গেল চোরাগোপ্তা/ একটি কুঠুরিতে যার একটাই মাত্র দেয়াল । যে সব ভাই ভাইফোঁটার দিন/ আসতে পারেনি সেই দেয়াল জুড়ে তাদের জন্য মেজদির দেওয়া চন্দনের ফোঁটা থরে থরে বিকীর্ণ রয়েছে!/প্রথমে অনপনেয় যুদ্ধাপরাধীর মতো নিজেকে মনে হলেও পরক্ষণে মনে হল/এ আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রপ্রদর্শনী'। 

লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বরাবরই আশাবাদী অলোকরঞ্জন। শেষ দিকে মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন। 'অমৃতলোক' পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক সমীরণ মজুমদারকে নিয়ে একটি কবিতা আছে এ বইতে।  শেষ দু-লাইন, 

'পরবর্তী বিশেষ সংখ্যার জন্য অভিমন্যুতার     অভিমানে

সে যেন আমৃত্যু লেখে লিটল ম্যাগাজিনের      টানে।'

                                                             ('সমীরণ মজুমদার')

অভিমন্যুর পুরাণপ্রতিমা শেষ দশকে তাঁর খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, জয়-পরাজয় বলে কিছু হয় না, নিজের সত্যের কাছে সত্যবান থাকাটাই জয়। অভিমন্যুর মতো তিনি নিজেকে দ্বিতীয় বিজয়ী বলে দেখতে চান। শেষ দিকে তাঁর ভয়, কলকাতায় এলে আমি বাংলা ভুলে যাব।…আমি যদি কলকাতা থেকে দূরে কোথাও প্রয়াত হই, আমার স্মৃতির কলকাতা বুকে নিয়ে সানন্দে মরে যাব।' ('সন্ধিক্ষণের সাক্ষাৎকার', নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে ছায়ানট?, ২০১৬)

এ বইয়ের শেষ কবিতা সদ্যপ্রয়াত কবিবন্ধু আলোক সরকারের স্মৃতিতে অনুস্যূত:

না-দেখা সে-ও আরেক দেখা

আসন্ন বই মেলার মুখে 

শরৎমেঘের সিংহদুয়ার 

তীর্ণ হয়ে চলে গেলেন আলোক সরকার;


লিটল ম্যাগাজিনের মুখে 

আজ নিদারুণ উত্তেজনা: 

এই তো সময় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবার


বস্টনের দিক থেকে 

যেই নায়েগ্রা দেখছিল আলোক 

কানাডা থেকে একই প্রপাত দেখতে গিয়ে পুষ্পস্তবক


বন্ধুকে দিই কৃতাঞ্জলি-

ক্ষীণ সাহসে তাই তো বলি:

না-দেখা সে-ও আরেক দেখা, আমার এ শোক হোক-না শোলোক!

এ কবিতা আমাদের অনিবার্যত মনে পড়ায় অনেক আগে লেখা ‘আলোক সরকার' নামের কবিতাকে। নায়েগ্রা জলপ্রপাতের  নিসর্গ দেখে উচ্ছ্বসিত আলোক সরকার বন্ধু অলোকরঞ্জনকে ফোন করেন, তারই পটভূমিতে লেখা হয়েছিল কবিতাটি।

'শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮) তাঁর পরবর্তী বই। 'গিলোটিনে আলপনা' বা 'মরমী করাতে'র মতো এ বইয়ের নামকরণেও বিরোধাভাস ।  আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যই যার মূলসূত্র। এই বিপর্যাসের টানে আশাবাদও ধূসরিম হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায় :

কারুক্কে বলিনি তা:

আমার ভিতরে

এক ধরনের ধূসরিম আশাবাদ 

তৈরি হতে চলেছে


ধূর্ত অতনু আকাশে-বাতাসে 

এই খবরটা রটিয়ে দেওয়ার আগে 

স্বর্ণিল আশাবাদের ওপর লিখে চলি আমি 

কবিতা কবিতা কবিতা              ('বিপর্যাস')

তাঁর শিকড়চেতনা সংলগ্ন হয় বিশ্বজোড়া শরণার্থীচেতনার সঙ্গে।  সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী-সংকটে তিনি স্মরণ করেন  আরাকান রাজসভায় মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের কথা, 'যেমন কিনা সৈয়দ আলাওল/ পেরিয়েছিলেন পথের ডামাডোল' ('রোহিঙ্গা! রোহিঙ্গা!')

তবু বিশ্বসংকট ও বিপর্যয়েও তিনি শুদ্ধ কবিতার শুকতারার আলোকে ভুলতে পারেন না। প্রাচীন গ্রিসের মাউন্ট হেলিকনের আবহমান ধারায় অভিস্নাত হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেসের অনুগামী কবি :

    আবহমান

    কোথায় কবে শুনেছিলাম মাউন্ট হেলিকন

     রয়েছে গ্রিসে, তারি হৃদয় থেকে 

     ঝরনা হয়ে কবিতা নামে যার শ্রুতিলিখন


            করে গেছেন হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেস; 

            আরও আমার অনেক শতেক পূর্বসূরি,

             আমার যতেক পদ্য লেখা তাঁদের কাছেই চুরি।


              হেলিকনের মুক্তধারা একটু আগেই আমায় 

               বিসর্পিল বলল এঁকেবেঁকে :

           ‘একটি নতুন কবিতা চাই তোমার হাত থেকে।'

গ্রিসের মিথসঞ্জাত হেলিকন অনায়াসেই মিশে যায় কবির নিজস্ব রাবীন্দ্রিক মুক্তধারার মুক্তিস্রোতে।

'নিজেকে খুঁজতে গিয়ে' কবিতায় পাচ্ছি পূর্বসূরি গ্যোয়েটেকে, মিকেলেঞ্জেলো বা রাফায়েল নয়, 'নিছক রক্তের টানে'ই তাঁর গ্যোয়েটের সন্ধান রোমে। প্রসঙ্গত, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'গ্যোয়েটে ও রবীন্দ্রনাথ', জার্মানির সর্বোচ্চ গ্যোয়েটে পুরস্কারেও তিনি বৃত। হাইনে, রিলকে, হ্যোল্ডারলিনের মতো গ্যোয়েটের কবিকৃতির তিনি মূল জার্মান থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন।

ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৯) অলোকরঞ্জনের উপান্ত্য বই। অনুজ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য এবং পার্থপ্রিয় বসুকে উৎসর্গ করা। 'বিভাব কবিতা' বিষয়টি বাংলা কবিতায় তাঁরই সংযোজন। অনুজ অনেক প্রধান কবি তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাঁদের বইয়ে বিভাব কবিতা যোগ করেছেন। এ বইয়ের বিভাব কবিতায় আমরা দেখব, পরিবেশ-সচেতন অলোকরঞ্জনকে, যিনি ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে দেখছেন একটিও গাছ নেই!  আমরা জানি, ইতিমধ্যেই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন পরিবেশবাদী জার্মান কবি সারা কীর্শের কবিতা।  আর ‘যৌবনবাউল’-এর দিন থেকেই তাঁর দর্শনে, 'বৃক্ষের বিষাদনেত্রে আয়ত পত্রের অশ্রু ঝরে।' উল্লিখিত এই বিভাব কবিতার শেষে দেখছি অবশ্য, 

             এক হাজার কবিতার স্পন্দনে 

             আচম্বিতে লক্ষ করা গেল 

             চোখের সামনে অমূর্ত গোলাপ

              আত্মসমালোচনার ঢঙে কবিদের নার্সিসাসবৃত্তিকেও দায়বিদ্ধ হতে হয়,

                     আর নার্সিসাস আমরা এখনও পদ্যের চর্চা করি, 

                     তবে কিনা প্রত্যেকেই পড়ি শুধু নিজের কবিতা!

এ বইয়ের শেষে অনুস্যূত হয়েছে রাজেশ্বরী দত্তের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে একটি অসামান্য দীর্ঘ কবিতা 'রাজেশ্বরী : একটি শোকগাথা'। কবি উপনীত এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউ-টিউব, স্মার্ট ফোনের তড়িঘড়ি সংযোগময়তার দৌলতে বসুন্ধরা থেকে 'নির্বাসিত নিভৃত পৃথিবী' :

            তখন তো হোয়াট্স-অ্যাপ ইউ-টিউব কিংবা স্মার্ট ফোন 

            ইত্যাদি ছিল না, আজ ঘরে ঘরে এসেছে ডিভিডি, 

           কারুরই দরকার নেই, ধরিত্রীর সঙ্গে সরাসরি 

           বনিবনা ঘটে যায় মুহূর্তেই আর যার ফলে 

           বসুন্ধরা থেকে আজ নির্বাসিত নিভৃত পৃথিবী।       


     এ কবিতা শেষ হচ্ছে, 

              আমার গহন কুলুঙ্গিতে রাত্রিদিন কয়েকটি মোম জ্বলে 


উদযাপনের উল্লাসে নয়, নিছক বেঁচে থাকার কৌতূহলে।

দ্বিতীয় পাঠে এই শেষ দু লাইনের প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়তে বাধ্য। দুটি চরণেই ১০+১২ বাইশ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । উদ্ধৃত প্রথম লাইনে ৩+৩+৪ এবং ৪+৪+২+২ এর সরল, প্রথানুগত বিন্যাস। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে তা ভেঙে যাচ্ছে ৫+৩+২ আর ৩+২+৩+৪ এর বিপ্লবে।

সেই কারণেই হয়তো অপ্রেম আর সংকটের পৃথিবীতে বসেও এ বইয়ে বলেন, 'অপ্রেমে ধরণী/ ক্লিন্ন হয়ে যাবে, তবু ছন্দ লিখতে হবে।' অবশ্য এই অন্ত্য পর্বে গদ্যে লেখা কবিতাও তাঁর কম নয়। কবির কাজ গোষ্ঠীর ভাষাকে অমলিন রাখা। গত ষাট-সত্তর বছরে যে-স্বল্পসংখ্যক গুণিজন বাংলাভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে ব্রতী, অলোকরঞ্জন তাঁদের অন্যতম। নতুন নতুন সমাসবদ্ধ পদ বা প্রতিশব্দ নির্মাণই শুধু নয়, কবি ব্যবহার করেন মান্য বাংলায় অধুনা-অপ্রচলিত মধ্যযুগীয় শব্দ অথবা লোকভাষার শব্দ। এ বইতে যেমন এসেছে মাস্তুল শব্দের প্রতিশব্দ 'মালুমকাঠ' ( 'প্রতিশব্দেরা')। বাংলাভাষার মালুমকাঠগুলিকে এইভাবে চিনে নেন কবি। 'ভিসা ও ভবিষ্যৎ' কবিতায় এক অবিস্মরণীয় চিত্রকল্পে দেখি, তাঁর লুপ্ত ভিটের লাইব্রেরিতে রেখে যাওয়া দ্বিজ মাধবের পুঁথি এক কামিনী ফুলের ঝাড় হয়ে ফুটে আছে। 

বাস্তুহারার পাহাড়তলি (২০২০) আপাতত তাঁর শেষ বই। ইতিমধ্যে অভূতপূর্ব এক অতিমারির কবলে পৃথিবী কম্পমান। সংবেদনশীল কবির অনুভূতিকে তা স্পর্শ করে স্বভাবতই। তার ছাপ এ বইয়ে।

আজীবন ভারতীয় নাগরিকতা এবং পাশপোর্ট বজায় রাখা কবি শেষ ক’বছরে দেশে ফিরতেন বছরের শেষে ডিসেম্বরে, আর জার্মানির হির্শবার্গে তাঁর আবাসনে ফিরে যেতেন পরের বছরের শুরুতে, কলকাতা বইমেলার পরে। শেষ ফিরে যাওয়া ২০১৯ এর গোড়ায়। ২০১৯ এর শেষে মেরুদণ্ডের অপারেশনের কারণে তাঁর আসা নিষেধ ছিল। ২০২০ তে তো বিশ্ব পড়ল অতিমারির কবলে। তার মাঝখানেই ১৭ নভেম্বর, ২০২০ তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ। মাসখানিক আগে ৬ অক্টোবর তিনি অষ্টআশি বছরে পা দিয়েছিলেন। যদিও লেখালেখি বা চল্যাবলায় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ  সৃজনশীল ও সুস্থ। জন্মদিনের ঠিক আগে চলে গেলেন তাঁর আদরের ছোট বোন ছন্দা ( ৫ অক্টোবর, ২০২০ )।  একটি বৃহৎ পরিবারের 'বড়দা' অলোকরঞ্জন হয়তো তাঁর সবচেয়ে ছোটো বোন ছন্দার মৃত্যুশোক সামলাতে পারেননি। শেষবার ফোন করেছিলেন বোনের চলে যাওয়ার সংবাদ দিয়েই।

এই বই উৎসর্গ করা হয়েছে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্য ভারততত্ত্ব বিভাগে তাঁর উত্তরসুরি এবং প্রিয়শিষ্য হান্স হার্ডার এবং তাঁর স্ত্রী আন্দ্রেয়াকে। 

অলোকরঞ্জনের পারিবারিক শিকড় ঢাকা বিক্রমপুরের তেলিরবাগে। আমরা আগেই দেখেছি, তাঁর ঠাকুর্দা দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত পশ্চিমের সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় নতুন করে ভিটেপত্তন করেন। অলোকরঞ্জনের জন্ম অবশ্য কলকাতায়, যদিও রিখিয়া-শান্তিনিকেতনে তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা কেটেছে। তাঁর শিকড়চেতনা ক্রমশ মিশেছে বিশ্বজোড়া বাস্তুহারা মানুষের শরণার্থীচেতনায়।

গদ্যে লেখা এ বইয়ের বিভাব কবিতায় দেখব, 'এতদিন ধরে অন্তরঙ্গ যে সমস্ত আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে পথ চলছিলাম একে একে তাদের নিজস্ব জন্মভিটেয় নামিয়ে দিয়ে ভ্যানুইবের সৈকত ঘেঁষে বাসটা আমায় পৌছিয়ে দিল অস্তাচলে বাভারিয়া জঙ্গলের মনঃপূত একটি পরিসরে। পাহাড়তলির পর পাহাড়তলি দিয়ে গাঁথা এই জায়গাটা যেন আমার জন্যেই নির্বাচিত হয়েছিল।' প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রগবেষক অলোকরঞ্জন আগে দেখিয়েছেন, এই বাভারিয়ার জঙ্গলেই ১৯২৬ সালে 'ছোটো কথার ঝাঁকে' আক্রান্ত জার্মানপ্রবাসী রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আত্ম-উদ্বোধনের সেই আলোকিত গানটি, 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে'। 

বিভাব কবিতায় আমরা আরো দেখব, তাঁর যত্ন-আত্তির একবিন্দু বিরাম নেই। ক্ষণে ক্ষণে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখা হচ্ছে । দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত এক নার্স বৌদ্ধ হবে বলে কবির কাছে  শিখছে পালি ভাষা। কবি বলছেন, 'না, এখন থেকে প্রকাশ্য কোনো আলোচনাচক্রে যোগ দিতে আমি যাব না আর। মাত্র ন-দশটি পুথি-পত্তরসুদ্ধু একটিমাত্র নৌকো নোঙরে বেঁধে রেখে দিয়েছি, এইমাত্র। ধরিত্রী আমার ভঙ্গুর ভ্রূযুগ সন্ধিক্ষণে তার বরণডালা ছুইয়ে দিয়ে এক লহমা তাকাতেই আমার শিরা-উপশিরায় বেজে উঠল আমার সমগ্র বাঁচার সজল পিছুটান।' এমনতরো প্রসন্ন বিশ্রাম বা বিদায়ের প্রস্তাবনা দিয়েই সূচিত হয় বইটি। 

সংগীতের মতো শিল্পস্থাপত্যকলারও তিনি ভিতরমহলের বাসিন্দা কবি। তাঁর কাব্যপ্রবাহে যেমন সংগীতের নানা রাগরাগিণী, বিভিন্ন রবীন্দ্রগানের অজস্র উল্লেখ, তেমনি আছে রোমের ধ্রুপদী স্থাপত্য, সিস্টিন চ্যাপেল বা মিকেলেঞ্জেলোর নানা শিল্পসুকৃতির কথা। রবীন্দ্রনাথ এবং অমিয় চক্রবর্তীর পরে তাঁকেই আমাদের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক কবি হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ। তাঁর কবিতায় হিন্দু মিথোলজির পাশাপাশি ইসলামীয় বা খ্রিস্টীয় মিথ এসেছে অনায়াসে। 

২০১৯ এর ১৫ এপ্রিল এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপকভাবে  ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্যারিসের শিল্পসুষমামণ্ডিত নতরে দাম (Notre Dam) গির্জা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে জোরকদমে চলছে সংস্কারের প্রকল্প। এ বইয়ের প্রথম কবিতা ‘ধ্বংস ও প্রজাপতি'তে দেখছি আমাদের আশাবাদী কবিকে। তিনি প্যারিসে এসে দেখছেন ঝলসে যাওয়া নতরে দাম চার্চ। তার সামনে অবশ্য কিশোর চারণ কবির দল গান গাইছে ধ্বংস থেকে পুনরুজ্জীবনের আশায়। ধ্বস্ত চার্চের মতো প্রবীণ কবির নিজেকেও মনে হচ্ছে এক ধ্বংসাবশেষ। তবু কিশোরদের যৌথ সংগীতের লহরীতে কবি আত্মশক্তিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান,

           'তবুও যদি শেষ কবিতা প্রলয়কালের মেঘে 

           লিখে উঠতে না পারি তবে কী হবে বেঁচে থেকে?'

আর তক্ষুনি উঠে আসছে অমোঘ এই মৃত্যুঞ্জয়ী উচ্চারণ, কবিতার শেষ দুই চরণে :

           'আমার ডান কনুই ঘেষে মৃত্যুপরোয়ানা

           খারিজ করে কাঁপতে থাকে প্রজাপতির ডানা…'

তাঁর প্রিয় জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের কথা এ বইতেও স্বভাবতই উঠে এসেছে, “কবিদের সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো/ শিখিয়েছ 'মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা'--। প্রসঙ্গত 'মার্টিন হাইডেগার' শীর্ষক এ কবিতার প্রথম পাঠক এই প্রতিবেদক, যাঁর কাছে দূরভাষে এ কবিতাটি ভেসে এসেছিল। বস্তুত হাইডেগারের এই সদুক্তি আমাদের কবির কাছে প্রায় বীজমন্ত্রের মতো। ‘দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি' (২০২৬) বইয়ের টানা গদ্যে লেখা 'অনাবাসী যদি অনুবাদ করে' কবিতাতেও এই কথাটি উঠে এসেছে। অলোকরঞ্জনের দীর্ঘ প্রবাসজীবনে মাতৃভাষার সাধনাই তাঁর আশ্রয়স্থল। বাংলাভাষায় নতুন পরিভাষা বা শব্দনির্মাণ, নতুন ধরনের বাক্যগঠন তাঁর সারাজীবনের ব্রত। 'টেলি-অপারেটর' কবিতায় অপারেটরের যান্ত্রিক হিন্দিঘেঁষা বাংলা শুনে তিনি লেখেন, 'তাঁকে বললাম আমি কিন্তু/ নতুন রকম এই বাংলায়/ অনভ্যস্ত। বিভিন্ন কবিতায় এসেছে শিলার, কাফকা থেকে দীর্ঘজীবী জার্মান কবি এনৎসেনবার্গারের কথা। এসেছে মেহগনির টেবিলে যোজনজোড়া প্রাতরাশের মধ্যেও কবির 'মহামারীর থিমটা' নিয়েই লিখে চলার কথাও। এভাবেই শাশ্বত আর নৈমিত্তিক একাকার হয়ে আসে অলোকরঞ্জনের উত্তরপর্বের কবিতায়। 

তাই বুঝি 'ধ্রুব সংশয়', 'বিষণ্ণ কৌতুক' বা 'সুভদ্র প্রতিশোধ'-এর মতো অক্সিমোরনগুলো এ বইতেও উঠে আসে আমাদের এই ক্ষুভিত সময়কে ঘিরে উদ্যত বিরোধাভাসের দ্যোতনা নিয়ে। 

এ বইয়ের উপান্ত্য কবিতার নাম তাৎপর্যপূর্ণভাবে 'বয়েসের নিকুচি'। শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্তের প্রয়াণের পর অশীতিপর অলোকরঞ্জন হির্শবার্গে তাঁর বাড়িতে একাই থাকতেন। বিদ্যাচর্চা, ছাত্রদের পঠনপাঠন আর গোটা ইয়োরোপ জুড়ে নানা সেমিনারে যোগ দিয়ে।  দোতলায় তাঁর লাইব্রেরি। সিঁড়ি ভেঙে এই লাইব্রেরিতে উঠতে গিয়ে মেরুদণ্ডে চোট পান কবি, ২০১৯ এর ডিসেম্বরে তাঁর কলকাতায় ফেরা স্থগিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গটি এ কবিতায় এসেছে, 'সিঁড়ি আমায় ভাঙতে পারে এই ভেবে আর সিঁড়ি ভাঙি না--'।  

কবি 'feedback’ কথাটার এক মজাদার প্রতিশব্দ করেছিলে, 'প্রত্যাহার' (প্রতি+আহার)। তাঁর নিজস্ব বাকশৈলীতে। আজীবন পাঠকদের এই ফিডব্যাক বা পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্যে উন্মুখ থাকতেন প্রবাসী  অলোকরঞ্জন। এ কবিতার শেষে তাই দেখতে পাচ্ছি, 

'লিখছি হাজার সংলাপিকা, তোরা যখন বোবা রইলি/… জিইয়ে রেখে দিয়েছি আমি নিজস্ব এক বাকশৈলী।'

এক বছর হল অলোকরঞ্জন লোকান্তরিত। রয়ে গেল তাঁর বাকশৈলী, সোনার তরী ভরা তাঁর মহনীয় কাব্যসম্ভার। আমাদের দৃকপাতের প্রতীক্ষায়। পুলিনবিহারী সেনের প্রয়াণে অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন 'সন্ন্যাসীর মৃত্যু হলে কাকে যাব সান্ত্বনা জানাতে?' (বইয়ের নাম 'রিখিয়া থেকে অনেক দূরে') শীর্ষক এক অনবদ্য গদ্য। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, পুলিনবিহারীর মৃত্যুশোকে ভেঙে পড়া আরব্ধ কাজগুলোকে এড়িয়ে যাবার খঞ্জ অছিলা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। একইরকম ভাবে, এখন সময় হা-হুতাশের নয়, অলোকরঞ্জনের কবিতাকে নিবিড়ভাবে পাঠের, বাংলা কবিতার এই অর্হণীয় উত্তরাধিকারকে অন্তরের অন্তঃস্থলে অভিষিক্ত করবার।

No comments:

Post a Comment