বিজলীরাজ পাত্র
মাঝে মাঝে ইতিহাসে এমন কিছু গ্রন্থ লেখা হয় যা বিদ্যাচর্চার ধারাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভিন্ন ধারার, ভিন্ন পথের, এমনই একটি পুস্তক হল, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘ভারতে মহাভারতে’।এই বইকে আলাদা ভাবে সাহিত্য সমালোচনা, সংস্কৃতিবিদ্যা, ইতিহাস বা দর্শনের বই ভাবলে মস্ত ভুল করব আমরা। বরং এই বই আমাদের চেতনার সেই জিজ্ঞাসু কোনে প্রশ্ন তোলে, যেখানে অভিষ্ট প্রতর্কটি ঠিক খুঁজে পাবেন আপনি। এই গ্রন্থের কেন্দ্রবস্তু হিসেবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং মহাভারত বারেবারে ঘুরে ফিরে এসেছে। কেন্দ্রের শক্তিকথায় পরে আসছি। কিন্তু পরিধি অঞ্চলেও শিবাজীবাবু যে সব অতি দরকারি এবং নতুন জ্ঞানচর্চার সংকেত দিয়েছেন, তার জন্য শত প্রশংসাও কম পড়বে। এমনই একটি পরিধিকথা দিয়ে এই লেখার সূচনা করা যাক।
‘আধুনিক’ কথাটি শুনলেই আমাদের মনে সাহেব মুলুকের কথা আসবেই আসবে। কেউ হয়ত স্মরণ করবেন, উনিশ শতকের দুঁদে ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের কথা। আবার কেউ ভাবতে পারেন বরেণ্য কবি টি এস এলিয়ট এবং তার পথপ্রদর্শক কাব্যগ্রন্থ ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর (১৯২২) কথা। আর বাঙালি জীবনের প্রেক্ষিতে ‘আধুনিক’-এর কথা উঠলে যার নাম এবং কথা এক বাক্যে উচ্চারিতহয়, তিনি হলেনবুদ্ধদেব বসু। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধক’ (১৯৫২) প্রবন্ধটি লিখে বুদ্ধদেব বাঙালিকে, আধুনিক, আধুনিকতা ইত্যাদি বিষয়ে বেশ চৌখোশ করে তুলেছিলেন। আমাদের বিদ্যাচর্চামহল ‘আধুনিক’ বিষয়ে মোটের ওপর এই বিশ্বাসে স্থির যে, এর সমস্ত কৃতিত্ব এবং জ্ঞান বিলেত থেকেই আগত।
আসলে সাহেবদের ‘Modern’-এর অনুবাদ বাংলাতে ‘আধুনিক’ করতে গিয়েই আমরা যত ওলট পালট কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছি। খুব সম্ভবত আমরা, বাঙালি সংস্কৃতির নানান অলি গলিতে কেমন ভাবে বা কী কারণে ‘আধুনিক’ শব্দটির ব্যবহার হত, সেই নিয়ে খুব বেশি কিছু ভেবে দেখিনি। আরও সহজ করে বললে, ‘Modern’ এবং ‘আধুনিক’-কে গুলিয়ে আমরা এই পোড়া বঙ্গদেশে, ভাবতেই পারিনি যে, ‘আধুনিক’ শব্দটির একটি ‘দেশীয়’ উত্তরাধিকার থাকলেও থাকতে পারে। আর আমাদের সেই না ভাবার কাজটাই করেছেন, জ্ঞানচর্চার অন্যতম কাণ্ডারি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘আধুনিক’-এর পথ ঘাট খুঁজতে শিবাজী পাড়ি দিয়েছেন প্রাগাধুনিক বাংলা কাব্যের জগতে। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য মানলে, ১৬১২ সাধারণাব্দে রচনা সমাপ্ত হয়, কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখিত, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থের। আর গ্রন্থের আদি লীলা, সপ্তদশ পরিচ্ছেদে শিবাজীবাবু পেয়েছেন তার জিজ্ঞাসার খোঁজ। চৈতন্য এবং কাজির মধ্যে চলছে তর্কাতর্কি, আর সেই হুলিস্থুলে, চৈতন্য কাজির থেকে জানতে চান, ‘পিতা মাতা মারি খাও এই কোন ধর্ম’। এই ‘পিতা মাতা মেরে খাওয়া’ অর্থে চৈতন্য গোবধের কথা বলছেন। অবশ্য কাজিও কম যান না। তিনিও রীতিমত আট ঘাঁট বেঁধে পথে নেমেছেন। কাজি চৈতন্যকে বলেন, ‘তোমার বেদেতে আছে গোবধের বাণী’। কাজির এমন বার্তায় চৈতন্য বলেন, “জীয়াইতে পারে যদি তবে মারে প্রাণী।/ বেদ পুরাণে আছে হেন আজ্ঞা বাণী।।”
অগত্যা কাজির নরক থেকে আর নিস্তার নেই। চৈতন্যের অমোঘ বাণী, “গো অঙ্গে যত লোম তত সহস্র বৎসর।/গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।।’’। এরপর কাজি আর খুব বেশি উত্তর প্রত্যুত্তর চালাতে পারেননি। বরং চৈতন্যের উদ্দেশ্যে কাজি বলেন-‘আধুনিক শাস্ত্র মোর বিচারস্থ নয়’। কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখনী অনুযায়ী, কাজির শাস্ত্র ‘আধুনিক’। এই ‘আধুনিক’ অর্থে কাজির শাস্ত্রকে শুধুমাত্র নবীন বলা হচ্ছে না। এর মধ্যে একটা উচ্চ নীচের গল্পও আছে। আছে একটা জয় পরাজয়ের আখ্যান। বাংলা প্রাগাধুনিক কালে, ‘আধুনিক’ শব্দটির সঙ্গে তাই একটা রাজনৈতিক ইতিহাস জুড়ে আছে। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থিটিতে আমরা যেমন ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যবহার পাই, তেমনই মুসলমান অর্থে, ‘যবন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। চৈতন্য এবং কাজির বিরোধ, নিপাট ‘হিন্দু’ এবং ‘যবন’-এর বিরোধ নয়। এর মধ্যে একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক গ্রহণ বর্জনের ইতিহাসও আছে। যে জ্ঞানতত্ত্ব, ‘যবন’-এর জ্ঞানকে গ্রহণ করতে চায়নি। স্পষ্টস্বরে চৈতন্য বলেছেন, “তোমার যে শাস্ত্র কর্তা সেহো ভ্রান্ত হৈল।/ না জানি শাস্ত্রের মর্ম হেন আজ্ঞা দিল।।”
শিবাজীবাবু তাঁর বইতে ‘আধুনিক’ বিষয়ে পথপ্রদর্শক একটি উদাহরণই পেশ করেছেন। কিন্তু কেউ যদি শিবাজীবাবুর পথে হেঁটে ‘আধুনিক’- প্রতর্কের আরও গভীরে প্রবেশ করতে চান তাহলে নানান চমকদার গল্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটবে আমাদের। ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথাই বলা যাক না হয়। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মৃত্যুহয়েছিল ১৮০৭ সাধারণাব্দে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বেশ ভালোরকম যোগাযোগ ছিল তর্কপঞ্চাননের। সেই জগন্নাথ বিষয়ে, পরিষদে রক্ষিত রামগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কুলগ্রন্থের পুঁথিতে লেখা হয়েছে-‘ত্রিবেণী জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননস্য কন্যাবিবাহঃ, স তু আধুনিক পালধি’। প্রথিতযশা গবেষক দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের সংগ্রহে থাকা একটি ‘কারিকা’-তে আরও লেখা হয়েছে-“ ‘আধুনিক’ জগন্নাথতর্কপঞ্চানন।/ তার সুতা লইয়াছিলেন গোপাল ভাজন।।”
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিত তর্কপঞ্চাননের কন্যার বিবাহ নিয়ে বড় সমস্যার কারনে, নিন্দা অর্থে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের পরিচিতির সঙ্গে ‘আধুনিক’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘দেশীয়’ পরিসরে আধুনিকের গতিবিধি খোঁজার আশু প্রয়োজন রয়েছে, নাহলে ‘আধুনিক’ নিয়ে কোনও প্রতর্কের বিচারেই বিলাতের বাইরে পা ফেলতে পারবনা আমরা। ‘ভারতে মহাভারতে’-র পরিধি খুঁজলে এমন আরও অনেক প্রতর্কের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটবে আমাদের। সেই পরিধির খোঁজ না হয়, পাঠকের জন্য তুলে রেখে বইটির গভীরে প্রবেশ করা যাক খানিক।
মোট চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত শিবাজীবাবুর এই মহাগ্রন্থ। প্রথম অধ্যায়ের নাম, ‘অথ মা ফলেষু কদাচন’। দ্বিতীয়- ‘পিতাপুত্রদ্বৈরথ’। তৃতীয়টি হল, ‘মহাভারতঃ রণ, রক্ত, বিফলতা’। আর সর্বশেষ অধ্যায়-‘ধর্ম, আছ তুমি কোথায়?’। আর এই অধ্যায়ের পূর্বে পাঠক স্বাদ নিতে পারেন, রণবীর চক্রবর্তী লিখিত সুস্বাদু ‘কথামুখ’ অংশটির। ঐতিহাসিক মহাশয়, আরও নানা কিছুর সঙ্গে শিবাজীবাবুর মেধাজীবী হয়ে ওঠার আখ্যানও বর্ণনা করেছেন এই অংশে।
আজকাল বিদ্যাচর্চার পরিসরে জ্ঞানের বিভাজন অত্যন্ত তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। যারা উনিশ শতক চর্চা করেন, তারা প্রাগাধুনিক যুগকে বাদ রাখতে চান। যারা মুদ্রণ সংস্কৃতি এবং ছাপা বই-এর ইতিহাস চর্চা করেন তারা আবার পুঁথির জগতকে ছুঁয়ে দেখতে চাননা। এই ধরণের জ্ঞানকাণ্ডের নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। কিন্তু পাশাপাশি এমন বিদ্যাপরিক্রমার দরকার আছে যেখানে, প্রাগাধুনিক যুগ এবং উনিশ শতকের সংযোগরেখা তৈরি হবে। এই সংযোগের একটি বড় ইতিহাস রয়েছে, ‘অথ মা ফলেষু কদাচন’ অংশটির মধ্যে। মুখ্যত গীতার ২/৪৭ কে ঘিরেই এই অংশের তর্কাতর্কি। আর এই তর্কের পথে শংকর (৭৮৮-৮২০) থেকে শুরু করে অভিনবগুপ্ত (৯৪০-১০১৪), জ্ঞানদেব (১২৭৫-১২৯৬), জয়তীর্থ (১৪শতক), মধুসূদন সরস্বতী (১৬ শতক) হয়ে বিশ শতক পর্যন্ত প্রসারিত। আর এই বিশ শতকের পথপরিক্রমায়, দুঁদে রাজনৈতিক নেতা মোরারজি দেশাই-এর মতো দুঁদে রাজনৈতিক নেতার গীতা চিন্তাও বিশ্লেষণ করেছেন শিবাজী বাবু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গীতার প্রভাব প্রতিপত্তির ইতিহাসকে আমরা যেমন ভাবে দেখে থাকে, সেখানে শিবাজীবাবু এক নতুন প্রতর্কের আগমন ঘটিয়েছেন। তবে সেই নতুন প্রতর্কটি কী তা জানতে হলে, বইটি পড়ে দেখতে হবে পাঠককে।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘পিতাপুত্রদ্বৈরথ’ আমাদের চেনা পৃথিবীর অনুভূতির ইতিহাসে কিছু নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়। কাকে সম্পর্ক বলে? সেই সম্পর্কের পরিণতি কোন কোন পথে যেতে পারে, তার নানান টীকা ভাষ্য রয়েছে এই প্রবন্ধের মধ্যে। বেদ, উপনিষদ্, স্মৃতি, বৌদ্ধগ্রন্থ আরও নানান সূত্রের ভেতর দিয়ে লেখক পৌঁছে যান কখনও ব্রাহ্মণ-শ্রমণের ‘শাশ্বত বিরোধ’ থেকে ‘হিন্দু’-র ঠিকুজি নির্মাণে। তবে পিতাপুত্রের লড়াইতে নতুন মাত্রা যোগ করে, ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থী বা সন্ন্যাসী-র ইতিহাস।
খুব অল্পতে শেষ হওয়া সম্ভব নয়, এমন মহাগ্রন্থের গতিধারা। পরবর্তী দুটি অধ্যায়, ‘মহাভারত: রণ, রক্ত, বিফলতা’ এবং ‘ধর্ম, আছ তুমি কোথায়?’অধ্যায় দুটিতে যেমন মহাভরতের মান্য সংস্করণ গড়ে ওঠার গল্প পাই, তেমনি ধৃতরাষ্ট্রের সহচর, সঞ্জয়কে ঘিরে রহস্যের অন্ত নেই। আর এই সব কিছুর সঙ্গে মিলে যায়, বাংলা উপন্যাসের অন্যতমা কথাকার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। আর ‘ধর্ম’-র ঘাত প্রতিঘাত বুঝতে চণ্ডাল-বিশ্বামিত্র সংবাদের জুড়ি মেলা ভার। যে অখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ‘নতুন বামুন’ বিশ্বামিত্রের এক ‘চণ্ডাল’-এর ডেরায়, ক্ষিদের জ্বালায় কুকুরের মাংস খেতে চাওয়ার অদম্য তাগিদ।
‘ভারতে মহাভারতে’ গ্রন্থের আলোচনা এর ভাষার প্রসঙ্গ বাদ রেখে করা চলে না। ভুলে গেলে চলবে না, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার বা গল্পকার পরিচয়ের কথা। আজকের নগর পরিসরের, অভিজাত বা অনভিজাত মহলের, বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়ার লীলাখেলায় নিশ্চিত ভাবেই পাঠক এক দণ্ডের শান্তি পাবেন এই বই পড়লে। বাংলা ভাষার ‘শান্ত’, ‘বাৎসল্য’ ‘সখ্য’ এবং ‘মধুর’রূপটি ফুটে উঠেছে শিবাজীবাবুর লেখনীর মধ্যে। হয়ত কবি বলেই তিনি, ভাষাকে নিজের মতো ভেঙে গড়ে নিতে পারেন। শিবাজীবাবুর এই বই কার্যত পাঠককে গোয়েন্দা আখ্যান পাঠের আনন্দ দেবে। আমাদের ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস এবং সাহিত্যের একের পর এক রহস্য পরত ছাড়িয়েছেন শিবাজীবাবু ‘ভারতে মহাভারতে’ গ্রন্থের মধ্যে। এই বই-র ‘গ্রন্থনির্মাণশিল্পী’ সোমনাথ ঘোষ, চার্বাক প্রকাশনা এবং হরপ্পার সৈকত মুখার্জি অসংখ্য ধন্যবাদের প্রপাপক এতও সুন্দর এবং নান্দনিক একটি পুস্তক নির্মাণের জন্য। এই গ্রন্থ অবশ্যপাঠ্য।