উৎসার
শুধু যে শান্তিনিকেতন তাই নয়, কয়েক প্রজন্ম জুড়ে কোনও না কোনও ভাবে এঁরা সকলেই, বিশ্বভারতীতেই পড়াশোনা করেছেন বা চাকরি করেছেন। তাতেও অবশ্য সবাইকে যে খুব মনে ধরে তা নয়। কিন্তু এই পরিবারটি বড় অদ্ভুত রকমের স্বাধীন, আবার একই সঙ্গে, সর্বত ভাবেই রবীন্দ্রনাথেই স্থিত; কিন্তু সে তাঁদের নিজস্ব অভিধান ও নিয়মে; ফলে এ বাড়ির দুই বোনের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব তাড়াতাড়িই নিকট হয়ে গেলাম। ষাটের দশকে দেখা শান্তিনিকেতন যেন ফিরে এল নব্বইয়ের সীমানায়। ইতিমধ্যে বসন্ত উৎসবে এসে, অনুষ্ঠানের পর দুম করে আলাপ হল, এ বাড়ির বড় ছেলে, মানে ওই দুই বোনের দাদার সঙ্গে। মস্ত এক জোড়া গোঁফের সঙ্গে মানান সই পরিশিলীত ইংরেজি, হিন্দি এবং বাংলা উচ্চারণ ও শব্দ চয়ন। দোহারা দীর্ঘ চেহারায় যে নিপুণতায় ধুতি পাঞ্জাবি, সেই একই রকম অনায়াস স্বাচ্ছন্দে শর্ট স্লিভ ট্রাউজার, ফেডেড জিন্স এবং ঝকঝকে পালিশের বুট। স্মার্টনেসটা এতোটাই আটপৌরে! বেশি কথা বলেন না। তীক্ষ্ণ চোখে একভাবে চেয়ে থাকেন। আমার থেকে প্রায় পনের বছরের বড়, কিন্তু দৃষ্টিপাতে না কোনও কপট স্নেহ, না সঙ্কোচ। অথচ মানুষটি জড়সড়ো; কুন্ঠিত। স্ত্রী ধমক দিলেই শুধু মাথা নয়, গলা শুদ্ধু নিজের মাথাখানি নিজের বুকের কাছে ঝুলিয়ে, অপরাধী বালকের মতো বকুনি খান। সেই উজ্জ্বল হাসি মুহূর্তে বদলে যায় বিষাদে। তাঁর স্ত্রীও বিশ্বভারতী থেকেই পাশ দেওয়া এবং সুকন্ঠি। স্ত্রীর পছন্দেরই একের পর এক গান শোনাচ্ছেন দুজনে; কিন্তু আমার কানে কী যেন কম বাজছে। আগের সন্ধেতে যখন উনি একা কিছু গান শুনিয়েছিলেন, সেই গলার বলিষ্ঠ মাদকতা, যেন ওই দুজনে গাওয়া গানে নেই। আমি তো গান গাইতে জানি না, ফলে কারণটা ধরতে পারলাম না। কিন্তু মানুষটির অপরাধী ভঙ্গি আমার মনে কেন জানিনা গাঁথা হয়ে গেল। আসলে সংশয়ের একটা কাঁটা যেন বিঁধে রইল কোথাও; কোথায় বেমানান ইনি?
কলকাতায় ফিরে হঠাৎই একদিন দেখি, আমার সামনে থেমে যাওয়া গাড়ির কাচ নামিয়ে, উনি আমাকে জলদি উঠে পড়তে বলছেন। ওঁর পাশের সিটে চড়ে বসতেই, সিগন্যাল ছেড়ে দিল। আর রাসবিহারী ক্রশিং, যেখানে আমার নেমে যাওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছনোর আগেই শুরু হয়ে গেল ঝম ঝম বৃষ্টি। কোনও অনুরোধ ছাড়াই দুম করে শুরু করে দিলেন, ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা...’। আমার হাতে ভাগ্যিস স্টিয়ারিং নেই; কী যে থানা পুলিশ হয়ে যেত কে জানে! মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন গেল নেমে যাওয়ার চেনা পথ।
নেশাগ্রস্তের মতো চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি, তার সপ্তকে গান ধরে, প্রবল আনন্দে মুগ্ধ তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে; চোখের ওপর যেন আর কালো পিচ রাস্তা ও কংক্রিট জঙ্গলে ঘেরা শহর কলকাতা নয়; শান্তিনিকেতনের মাঠঘাট, গাছপালা আর রাঙামাটির পথ; বৃষ্টি আর তুফান দেখছেন। দেখছেন গানের সেই অবাধ মুক্তি, সঙ্গতে যখন নিজের গলায় মন্দ্র সপ্তকে বাজ আর বিদ্যুৎ। তাঁর ওই চেয়ে থাকায় দেখেছিলাম, গান; দেখেছিলাম মুক্তি। বুঝেছিলাম যে এই তাঁর নিজের স্কেল, দ্বৈত গানে যা সমঝোতা করে বামন হয়ে যায়। আজ তা নিজের গহন থেকে উৎসারিত এবং অবাধ।
তাঁর ওই দৃষ্টিতে তাই বৃষ্টির অবিশ্রাম ঝরে পড়া আর তীব্র আনন্দ। এক আকাশ থেকে আর আকাশে ছুটে বেড়ানো; এবং আমার সংশয়ের অবসানে অসামান্য উপহার ওই মুক্ত কন্ঠের গান।
দেখলাম, শূন্যে দৃষ্টি বিছিয়েও মানুষ কেমন উৎসারিত হয়ে আসে তার স্বমহিমায়।
ওই দৃষ্টির অর্থ কি তবে,
‘যায় নিয়ে যায়, আমায় নিয়ে যায় আপন গানের টানে…ঘর ছাড়া কোন পথের পানে’।
আগের পর্ব