Friday, July 31, 2020

হ্রদ-পাহাড়-টিলা-দ্বীপভূমি আর পাখপাখালির কোলাজ


সং ক ল্প  স র কা র

চিল্কা লেকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিং করতে গিয়ে। সেসময় অবশ্য চিল্কা লেকে বেড়াতে যাওয়ার কোন বাসনা মনের ভিতর জন্মায়নি।

এরপর একবার চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যাঙ্গলুরু যাওয়ার পথে গৌহাটি-ব্যাঙ্গলুরু এক্সপ্রেসের জানলা দিয়ে চিল্কা লেক প্রত্যক্ষ করি।পরিযায়ী পাখির ঝাঁক, আদিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি, মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপভূমি, অনুচ্চ পাহাড়-টিলা দেখে মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা জন্মায়।ঠিক করি ফুরসত পেলেই একবার চিল্কা লেক ঘুরে আসব।

এবার সেই মোক্ষম সুযোগ! পুরী ভ্রমণ শেষে ট্রেনের ফিরতি টিকিট বালুগাঁও থেকে করেছি।বালুগাঁও থেকে হাঁটা পথে চিল্কা লেক।

একটা ছিমছিমে হোটেলে উঠেছি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিই। পায়দল চলে আসি লেকের পাড়ে। হেঁটে আসতে আসতে যেটুকু স্বেদ জমেছিল শরীরে, লেকের পাড়ে দাঁড়াতেই ফিনফিনে হাওয়ায় তা উধাও।

দ্রুত একটা বোট ভাড়া করে নিই। ভেসে পড়ি আশ্চর্য এই জলদুনিয়ায়।মাছের সন্ধানে হাজারো রঙচঙে জেলে নৌকো হ্রদের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছলোভা পাখির দলও ভিড় জমিয়েছে নীল আকাশের ক্যানভাসে।

গন্তব্য কালিজাই দ্বীপ। ফিরতি পথে চণ্ডাই হেগা আইল্যান্ড ছুঁয়ে আসব।নৌকাযাত্রীরা সবাই নৌচালকের নির্দেশমাফিক লাইফ জ্যাকেট পরে নিল দ্রুত। বলা বাহুল্য, উড়িশ্যা উপকূল ঝঞ্ঝাপ্রবণ,কখন ঝড়বাদল উঠে আসবে কে জানে! এটুকু সুরক্ষা তো নিতেই হবে!

জোর শব্দ তুলে বোট এগিয়ে চলে দ্বীপপানে।ভেবেছিলাম, প্রকৃতির রূপ -সৌন্দর্য পরস্পর শেয়ার করতে করতে এই যাত্রা সম্পূর্ণ করব।কিন্তু সে গুড়ে বালি।বোটের শব্দের এত প্রাবল্য যে পারস্পারিক আলাপের সুযোগ নেই।অগত্যা, নীল জলে সুনীল আকাশে আর পরিযায়ী পাখিদের ডানায় মন মজিয়ে দেই।কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ বা ভিডিও কলে ব্যস্ত ।অনেকটা জলপথ পেরোনোর পর হঠাৎই দূরে আবছাভাবে দৃশ্যমান হয় কালিজাই দ্বীপ।ওই তো দেখা যাচ্ছে মন্দিরের চূড়া! আমার মনে পুলক জাগে। খুশিতে ঝলমল করে ওঠে সবার মুখ।

বোট কালিজাই দ্বীপে এসে ভিড়লে ভাসমান জেটিতে পা রাখি। জুতো ছেড়ে প্রবেশ করি মন্দির চত্বরে।পুজোর উপকরণ সাজিয়ে বসে থাকা দোকানিদের কাতর আহ্বান শুনি।অল্পকিছু কিনি সাধ্যমতো। মন্দিরে পুজো দেই। মানত করি।হাতজোড় করে প্রণাম করে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসি।আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখি কিছুক্ষণ।    

মন্দির চত্বরে বসে একজন প্রবীণ লোকের মুখে শুনতে পেলাম একদা নববধূ 'জাই' তার পিতার সঙ্গে নৌকো করে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল।তার শ্বশুরবাড়িটি ছিল এই চিল্কা লেকেরই কোন এক দ্বীপে। আচমকা যাত্রাপথে মারাত্মক ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে সেই ঝড়ে নৌকো উল্টে যায়।সৌভাগ্যক্রমে নৌকোর মাঝি আর জাইয়ের বাবা রক্ষা পেলেও জাই কিন্তু নিখোঁজ হয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তাকে পাওয়া গেল না।পরবর্তীতে স্থানীয় লোকের কাছে জাই কালীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে  কালিজাই মাতা নামে পূজিত হতে থাকল।

মন্দির দর্শন,পুজো সমাপন করে সবাই বোটে এসে বসলাম।বোট ছেড়ে দিল।একদল গাঙচিল উড়ে উড়ে আসছিল আমাদের নৌকোর পিছু পিছু  দুটো শুকনো বোঁদের লোভে।শুধু আমাদের না,এই বৃহৎ লেকের বুকে জেগে থাকা ছোট্ট এই দ্বীপের কালিজাই মাকে দর্শন করে ফেরার সময় সমস্ত নৌকোর পিছু পিছু অনেকদূর।ওরা আসবেই,শর্ত একটাই, লেকের জলে শুধু শুকনো বোঁদে ছড়াতে হবে।সহযাত্রী উড়িয়া বন্ধু জানাল, উড়িয়া ভাষায় নাকি এদের 'চুরিয়া' বলে।সে যাই হোক, মানুষও কী কম চিড়িয়া, দশ টাকার বোঁদেয় একশো চিড়িয়া উড়িয়ে আনে!

ক্রমে বোঁদে ফুরিয়ে এল,গাঙচিলের দল আমাদের বোটের পিছু ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে কালিজাই দ্বীপে। আমরা এগিয়ে চলেছি চণ্ডাই হেগা দ্বীপের অভিমুখে।খুবই ছোট্ট একটা দ্বীপ,কিছু পাথরের চাঁইয়ের সমষ্টি  জল থেকে জেগে উঠে এই দ্বীপটি রচনা করেছে।মূলত ফটোশুট, সেল্ফি তোলার জন্যই বোটগুলো এখানে নোঙর ফেলে।লোকবিশ্বাস এই যে দেবী কালিজাই কালিজাই দ্বীপে ডুবসাঁতার দিয়ে চণ্ডাই হেগা দ্বীপে এসে চুল শুকোন।

কিছুক্ষণ কাটানোর পরে নোঙর তুলে নৌকো এগিয়ে চলল লেককিনারে।ক্রমে ক্রমে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে।ফুরিয়ে আসছে আমাদের আজকের জলভ্রমণও।একটু বাদেই সূর্য ডুববে পাহাড়ের আড়ালে।আর ক্লান্ত আমরাও হোটেলে ফিরে গিয়ে সকাল সকাল ডুব দেব ঘুমের দেশে।


Thursday, July 30, 2020

দিঘিজল :: গৌতম মণ্ডল


দিগন্ত যেখানে আরেক দিগন্তের
মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছে
সেখানে চিৎ হয়ে
শুয়ে রয়েছে একটি দিঘি
সারা গায়ে রোদ মেখে
দিঘির জলে সাঁতার কাটছে
একঝাঁক রাজহাঁস

একঝাঁক বুনো কুকুর 
অরণ্য চিরে ঢুকে যাচ্ছে
আরও গভীর অরণ্যের দিকে

অগোচরে একটু একটু করে
লাল হয়ে উঠছে দিঘিজল

গাংচিল ঘর :: পারিজাত ব্যানার্জী


ভাগীরথীর এই পাড়টায় সন্ধ্যা পেরিয়ে
আঁধারের পথ ধরেছে এখন কালরাত্রি।
আর আমি... এইখানে, 
এই বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার তলায় বসে বসেই
প্রহর গুনতে গুনতে খালি ভাবছি;
কিভাবে এই এক আকাশজোড়া গর্ভবতী মেঘের কান্নায়
বাঁধ ভেঙে গল্পশেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে
আমার হার না মানা বুকের 
শেষ এই একরত্তি ভগ্নাংশও।

তা যাক।
যা বলছিলাম।
এই সামনের বড়রাস্তাটা পেরলেই জানি,
তোমার চৌহদ্দি শুরু।
ওই তো, এখানে বসেই
দিব্যি ঠাহর করতে পারছি
তোমার বাড়ির গলির মুখেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা
বোবা ল্যাম্পপোস্টটার আবছা অবয়ব,
যার আলো আঁধারিতেই প্রথম
সব ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম একদিন
নিজের বাড়ি ফিরব বলে।
জানতাম না তখনও অবশ্য,
তুমিও কোনোদিন বলোনি, 
এই ভাগীরথীর বানেই কবে
ভেসে গেছে আমার সেদেশের সবকিছু,
যা পরে আছে,
তাতে মাথাটুকু গোঁজবারও ঠাঁই নেই আর কোথাও।


অগত্যা,
এই নদীর কোটর উপচে পরা ভরা শ্রাবণের জল সামলে
এই গাছতলাতেই বেঁধেছি আপাতত
আমার অস্থায়ী একখানা ঠিকানা।
রোজ সকালে সাঁতার শিখছি
এইখানেরই এক বস্তির কিছু রোজ রাতে 
বরের বাপের হাতে মার খাওয়া মেয়ে-বউদের কাছে।
তারপর ঠিক করেছি, 
এই বুকজলেই নেমে একদিন ভাসতে ভাসতে
পৌঁছে যাব প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও ঔপনিবেশিক চত্বরে;
যেখানের গাংচিলেরা 
ভাষা হারানো কোনও স্বপ্নের গভীরে দাঁড়িয়ে
কথা দিয়ে গেছে আমায়,
সামান্য হলেও জায়গা করে দেবে তাদের আস্তানায়,
খড়কুটো জুটিয়ে যেখানে ছোট্ট হলেও অন্তত:
ঠিক বুনে নেব
আমার নিজের ঘর।

বেশ হবে বল?
তুমি এসব নিয়ে আবার কিন্তু বেশি ভাবতে বোসো না।
নাঃ, অনেক রাত হল, 
এবার শুতে যাও বরং।
তবে শোওয়ার আগে 
রাতের প্রেশারের ওষুধটা আবার 
খেতে ভুলে যেওনা যেন, 
কেমন?