Wednesday, December 16, 2020

কালীঘাটের মেয়ে পরিণীতা

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়: তখনও বেশি রাত হয়নি। দুর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে ফিরছি। আমরা জনা চারেক। একটা ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম। এখানে বেশ ভিড়। তবে বাইরে খোলা আকাশের নীচে চেয়ার-টেবিল পেতে বেশ গুছিয়ে রেখেছে ধাবা মালিক। চারটে চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরা গল্পগুজব করছি। আমাদের লাগোয়া টেবিলে এক দম্পতি বসে। সঙ্গে আট-দশ বছরের একটি কন্যা। সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষ করি কন্যাটির মা আমার দিকে তাকাচ্ছে– যেন কিছু বলতে চায়! আমারও চোখটা ক্ষণে ক্ষণেই সেই মহিলার দিকে অজান্তে চলে যাচ্ছে। বলতে গেলে একটু অস্বস্তিই হচ্ছে। এইভাবে চলে কিছুকাল। তারপর ওই ভদ্রলোক ধাবার ভিতরে ঢোকে, হয়তো কিছু নতুন অর্ডার করতে, তখন হঠাৎই সেই মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বোঝার আগেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, ‘স্যার ভালো আছেন?’ আমি তো যাকে বলে হতভম্ব! কে এই মেয়ে, কীভাবেই বা আমি তার স্যার হলাম তা কোনও অনুমানেই বুঝতে পারছি না। কোনও ভাবেই মেলাতে পারছি না। একবার মনে হল, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের ছাত্রী ছিল কিনা। তা-ও হতে পারে না। কেননা গত দশ বছর যে সব ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি তাদের প্রত্যেকের মনে আছে– যাদের আমি নামে চিনি। এখনও আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হইনি। তবে কে এই ছাত্রী?

এরপর আমার অবস্থা মালুম পেয়ে মেয়েটি বলে, ‘চিনতে পারছেন না স্যার? আমার নাম নীতা। আপনি আমাকে পরিণীতা বলে ডাকতেন– কালীঘাট। এই ‘কালীঘাট’ শব্দটির সঙ্গে যেন কয়েক কোটি ক্যালেন্ডারের পাতা আমার চোখের সামনে ঝরে পড়ল। আমি যেন ফিরে গেলাম সাতাশ-আঠাশ বছর পিছনে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার উপান্তে। বস্তি সংগঠনের এক নেতা সেই সময় আমাকে পটিয়ে ফেলেন যে, সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, যারা সমাজে পিছিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাদের জন্য কাজ করার লোক নেই। তো কী সেই কাজ? ঠিক হল কালীঘাটের নিষিদ্ধ পল্লিতে যে শিশু-কিশোররা আছে তাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এদের মধ্যে কিছু ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় বটে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। এদের উৎসাহিত করতে হবে। আমার সেই বয়সে এমন ধরনের কাজে নিযুক্ত হওয়াকে বেশ গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। সপ্তাহে দুদিন পড়াতে হবে। ফলে তেমন কোনও চাপ নেই ভেবে শুরু করে দিলাম।

চাপ কি আর ছিল না? টালিনালার ধারে যাকে বলা যায় আদি গঙ্গা, তার দূষিত জলে, পচা গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে, একটা চালাঘরের মাটির দাওয়ায় প্রাথমিক ভাবে প্রায় জনা আটেক বাচ্চাকে নিয়ে আমার ক্লাস শুরু হল। চারদিকে মাছি ভন ভন করছে। দুর্গন্ধে প্রথম প্রথম বমি পেত। চারদিকের আবহ যাকে বলে মদোমাতাল আর কাঁচা খিস্তির বন্যায় রচিত হয়েছে। এখানে কেউ সোজা বা যাকে বলে সাধারণ ভাষায় কথা বলে না। সবাই উদমার্গের খিস্তি সম্বলিত ভাষাতেই অভ্যস্ত। এমনকী বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে সেই একই ভাষায় কথা বলছে বড়োরা। প্রথম দিকে মনে হত এসব বন্ধ করতে হবে। মাথা গরম হয়ে যেত। কিন্তু ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যাই। সেই দাদা নেতাটি আমায় বুঝিয়েছিলেন, ‘আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার তাবৎ পরিবেশ পালটানো তোমার কাজ নয়। আর তা পারবেও না। আমরা যদি এই বাচ্চাগুলোকে একটু লেখাপড়া শেখতে পারি তো জানবে বিরাট কাজ করা গেল।’ কথাটার যৌক্তিকতা আমার মনে ধরেছিল। ফলে বছর খানেক টানা টালিনালার পাশে এইসব বাচ্চাকাচ্চাদের পড়িয়ে গেছি। এদের লোক না হয়েও। কোথাও পুলিশ ঝামেলা করছে, কোনও খদ্দের মদ খেয়ে এসে হুজ্জুতি করছে, কার পালিয়ে যাওয়া বর এসে হুজ্জুতি করছে তার গতর খাটিয়ে বউ-এর কাছে, কে কাকে মারল ধরল, সব কিছুর মধ্যে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকলাম। কিন্তু আমার মূল কাজ ছিল সপ্তাহে দুদিন এই তথাকথিত বাপহারা ছেলে মেয়েদের পড়ানো। ‘বাপহারা’ কথাটা লিখলাম এই কারণে যে, প্রায় প্রত্যেকটি ছেলে মেয়ে জানে না বা তাদের জানানো হয় না যে কে তার বাবা, কী তার নাম। কখনও কখনও মায়েরা মিথ্যে নাম বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে যখন এরা স্কুলে ভরতি হতে গেছে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব সময়েই বাপের নামটাই প্রধানত গ্রাহ্য করা হয়, ফলে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। আর তখন তো আইন-কানুনও এখনকার মতো হয়নি।

এখানে এইসব শিশুকিশোরদের পড়াতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, বিশেষ করে এই স্কুলে ভরতি করার সময়। আজকে প্রচুর না হলেও অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকলেও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এদের জন্য লাগাতার কাজ করে যাচ্ছে। সে-সময় এই ধরনের কিছু সংগঠন থাকলেও তা যে খুব উচ্চকিত ছিল তা নয়। হয়তো সম্ভবও ছিল না। সে যাই হোক, এই ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার মধ্যে ধরে রাখাই ছিল একটা বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ। কেননা মায়ের খদ্দের এলে তার মদটা, সিগারেটটা, খাবার-দারারটা নিয়ে এলেই কাঁচা পয়সা পাওয়া যায়। আর ওদের পড়াশোনা করার সময় ছিল সন্ধেবেলা। সে সময় তো এই অঞ্চল গমগম করছে।তখন কি আর পড়াশোনায় মন বসে! এদের মধ্যে অনেকেই ছিল লেখাপড়ায় বেশ ভালো, চটপট বুঝতে পারতো। কেউ কেউ একটু পিছিয়ে থাকা। তার করণটাও সহজেই বুঝে ফেলি। যে অবহেলায় ও মানসিক নিপীড়নের মধ্যে এরা জন্মায়, বড়ো হয়ে ওঠে– তাতে এই ধরণের সমস্যা খুব স্বাভাবিক। যেমন, আগেই বলেছি যে, একমাত্র মা-ই এদের ভরসা। তথাপি সেই মা যে তার ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য খুব একটা কিছু করতে পারে তা নয়। নিদেন দুবেলা খাওয়াও অনেকের জোটে না। তারপর আছে রোগভোগ। আপাতত ফিরে যাই সেই কালীঘাট থেকে উঠে আসা নীতার সঙ্গে দেখা হওয়া প্রসঙ্গে।

কালীঘাট শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার পর যথারীতি আমি নীতাকে চিনতে পারি। বলি, ‘কেমন আছিস মা?’ বেশ গর্বের সঙ্গে সে বলে, ‘খুব ভালো আছি স্যার।’ মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ‘এই আমার মেয়ে, আর ওই উনি হলেন আমার স্বামী।’ ইতিমধ্যে নীতার স্বামী ধাবা থেকে বেরিয়ে আসে। নীতা বলে, ‘ইনি, সেই স্যার, আমাদের কালীঘাটে পাড়াতেন।’ বুঝলাম, ছেলেটি আমার নাম পর্যন্ত জানে। স্বামী হাত মুখ ধুতে গেলে নীতাকে জিজ্ঞেস করি, ‘হ্যাঁ রে, পড়াশোনা কতটা করতে পড়েছিলি?’ নীতা এক গাল হেসে বলে ‘হায়ার সেকেন্ডারি অব্দি কিন্তু তারপর আর হল না। সংসার, মেয়ে সব সামলে আর পড়া হয়নি।’ ক্রমে সে চাপা গলায় শুরু করল তার জীবনবৃন্তান্ত। এই ছেলেটি নাকি ছিল তার মায়ের খদ্দের, প্রায়ই আসত। বয়সে প্রায় পনের বছরের বড়। সে-ই নাকি তার মাকে বুঝিয়ে নীতাকে বিয়ে করে। পাইপের ব্যবসা করে। আজ তার ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে; বোঝা গেল সঙ্গের গাড়িটা দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর মা-র খবর কী?’ নীতা ছলছলে চোখে জানায়,’কঠিন ব্যাধিতে মারা গেছে।’ শেষ বয়সে আমার কাছেই থাকত। আর কটা দিন আগে মাকে নিজের কাছে নিয়ে এলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম।’ এ তো প্রায় হিন্দি ছবির মিলানন্তক কাহিনি। তা হোক, আমায় কেন জানি একটা তৃপ্তির হাওয়া ছুঁয়ে গেল। ওরা পয়সা মিটিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি খনিকক্ষণ স্মৃতির মেঘের মধ্যে যেন ডুবে গেলাম। এই রকম তো আরও ছাত্রছাত্রীরা ছিল। তাদের কী হল? তাদের সঙ্গে কখনও কি দেখা হয়ে যাবে! আজও তার অপেক্ষায়ই আছি।

No comments:

Post a Comment