মায়ের কথা বলতে গেলেই যেন আমার ভিতরে একটা বাঁধভাঙার মতো অবস্হা হয়। কত কথা যে মনে আসতে থাকে, যেন কথা আর ফুরোবেই না। মায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল মহামায়া। দাদামশাই মাকে সারদেশ্বরী আশ্রমে পাঠিয়ে দেন মানুষ হওয়ার জন্য। সারদেশ্বরী আশ্রমে স্বয়ং গৌরীমার তত্ত্বাবধানে আমার মা বড় হয়েছেন। মায়ের মাথায় একঢল মেঘের মতো ঘণ, কোঁকড়া চুল ছিল, আর তাই আশ্রমে মায়ের নামই হয়ে গিয়েছিল চুলওয়ালা মহামায়া। আশ্রমবাসের ফলে আমার মায়ের আধ্যাত্মিক ভাব ছিল গভীর, আর তেমনি দয়ামায়া। জীবনে মাকে কখনও কারও সঙ্গে গলা তুলে ঝগড়া করতে শুনিনি। রাগ হলে বকাঝকা করতেন বটে, বিশেষ করে আমাকে, তবে তাতে তেমন ঝাঁঝ থাকত না। আমার মা যেমন শান্তপ্রকৃতি ছিলেন তেমনি আমি ছিলাম বেজায় দুষ্টু আর বাঁদর। আমাকে সামলাতে মাকে হিমসিম খেতে হত। আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ এত দুষ্টু ছিল না। আর তাই আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তাও ছিল বেশি। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাড়িতে কোনও ভিখিরিকে খালিহাতে ফেরানো হয় না। যুদ্ধের সময়ে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে তখনও মা এই নিয়মের ব্যাত্যয় করেননি। মাঝেমাঝে ক্ষুধার্ত ভিখিরিকে বাইরে বসিয়ে গরম ভাত ডাল তরকারি খাওয়াতেন। বাসিপচা জিনিষ কখনও খাওয়াতেন না। অথচ আমাদের অবস্হা যে খুব সচ্ছল ছিল তা নয়। আমার সৎপ্রকৃতির বাবা রেলে চাকরি করতেন বটে, কিন্ত ঘুঁষ খেতেন না বলে আমাদের চিরকালই টানাটানির সংসার। ওই সামান্য হিসেব করা পয়সা থেকেই অল্পস্বল্প বাঁচিয়ে মা তাঁর সামান্য দানধ্যান করতেন। যখন আমার তিন কি চার বছর বয়স তখন প্রতি দুপুরে খাওয়ার পর মা আমাকে নিয়ে মাদুর পেতে মেঝেয় শুতেন আর দুষ্টু ছেলেকে শান্ত রাখার জন্য রবি ঠাকুরের কবিতা শোনাতেন। সেই মোহময় কবিতা আমার ভিতরে এক সম্মোহন তৈরি করে দিত, তাই আজও আমি কবিতার পরম অনুরাগী। তখন আমার মা ছিলেন আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মা ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না। কিন্ত বাবার বদলির চাকরি, দেশভাগ ইত্যাদির ফলে আমাকে হস্টেলে চলে যেতে হয়। তাতে মায়ের ওপর টান আরও বেড়েছিল, আর মাও আমার জন্য বড্ড ব্যাকুল থাকতেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে কি যে আদর হত আমার! আজ কত বছর হয়ে গেল মা নেই, তবু আজও মায়ের অভাবে যেন মাঝেমাঝে বুক টনটন করে। একটা মজার কথা বলি। হস্টেল থেকে বাড়ি গেলে আমি সারাক্ষণ মায়ের কাছেকাছে থাকতাম। মা রান্না করতেন আর আমি কাছটিতে বসে গল্প করতাম। আর এইভাবেই মায়ের তোলা উনুনে রান্না করা দেখেদেখেই আমি নিজের অজান্তে পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছি। আমার রান্না খেয়ে অনেকেই আজও প্রশংসা করে।
No comments:
Post a Comment