Saturday, December 25, 2021

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | তৃতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলতেন, ‘প্রত্যেকের তিনটি জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।’ তাঁর স্ত্রী প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যেকার সীমারেখা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার প্রয়াসী ছিলেন, ছেলেদের বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নই।’ তবুও তাঁদের বড় ছেলে, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার রোদ্রিগো গার্সিয়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কলম ধরেছেন। ‘গাবো ও মেরসেদেস: চিরবিদায়’-– এই বইয়ে তিনি তাঁর কিংবদন্তি বাবার জীবন-প্রান্তের সেই সময়টার কথা লিখেছেন, যে সময়ের কথা ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত গাবো লিখে যেতে পারেননি। এই স্মৃতিকথায় তিনি ধরে রেখেছেন স্মৃতিভ্রষ্ট গাবোর অন্তিম লগ্নের অম্লমধুর কিছু মুহূর্ত আর তাঁর পাশে অর্ধ শতাব্দীরও অধিককালের জীবনসঙ্গী মেরসেদেসের প্রত্যয়ী উপস্থিতি। বইটির মূল ভাষা ইংরেজি, নাম: ‘A Farewell to Gabo and Mercedes’, প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই, ২০২১। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সলমন রুশদি জানিয়েছেন: “This is a beautiful farewell to two extraordinary people. It enthralled and moved me, and it will move and enthral anyone who has ever entered the glorious literary world of Gabriel García Márquez.”

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি প্রতিদিন দুপুরবেলায় বাবা-মা ঘুমতেন। প্রায় কখনোই তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মাঝে মধ্যে বাবা আমাদের বলতেন যদি সময় মতো ঘুম না ভাঙে তাহলে তাঁকে ডেকে দিতে। কিন্তু আমি আর আমার ভাই দুজনে সেই ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম যে কাজটা খুবই ঝুঁকির। জাগানোর সময় যদি কেউ তাঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকত বা তাঁর গায়ে হাত দিয়ে ডাকত, সঙ্গে সঙ্গে এমন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন আর এমনভাবে হাত নাড়াতেন যেন কারুর থেকে বা কোনও কিছুর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছেন। তখন খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাসও নিতেন। জাগ্রত বিশ্বে নিজেকে খুঁজে নিতে তাঁর কয়েক লহমা সময় লাগত। তাই আমরা একটা কৌশল আবিষ্কার করেছিলাম: শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খুব আস্তে আস্তে নরম স্বরে তাঁর নাম ধরে একটানা ডেকে যেতাম। তা সত্ত্বেও কখনও কখনও লাফ দিয়ে জেগে উঠতেন, তবে সাধারণত তা করতেন না। আর যেই তিনি ভয় পেয়ে জেগে উঠতেন আমরা এক ছুটে বারান্দায় পালিয়ে যেতাম।

তারপর ভালো করে ঘুম কেটে গেলে এমন করে দু’হাত মুখে বোলাতেন যেন মনে হত ধীরে ধীরে মুখ ধুচ্ছেন। তারপর তাঁর সেই প্রিয় নাম ধরে আমাদের ডাকতেন: ‘পেররো বুররো’১। হাতছানি দিয়ে আমাদের কাছে ডাকতেন ও তাঁকে চুমু খেতে বলতেন। জিজ্ঞাসা করতেন: “নতুন কি খবর আছে? কেমন চলছে সব?” রাতেও প্রায়শই শুনতে পেতাম ঘুমের মধ্যে গোঁ গোঁ শব্দ করছেন আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। মা তখন কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বাবাকে ডেকে তুলতেন। একদিন ওইরকম অশান্ত ভাবে সিয়েস্তা২ থেকে ওঠার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন।

-একটা খুব সুন্দর দিন আর আমি একটা ছোট ডিঙি নৌকায় বসে আছি, কিন্তু সঙ্গে কোনও দাঁড় নেই। একটা তিরতিরে শান্ত নদীর উপর দিয়ে নিঃশব্দে, খুব ধীরে ধীরে ভেসে চলেছি।

-এখানে দুঃস্বপ্নটা কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম।

-আমি জানি না।

কিন্তু আমার ধারণা যে তিনি জানতেন। কারণ তাঁর লেখায় সাংকেতিক কিছু আছে এ কথা তিনি সমানে অস্বীকার করলেও এবং কেতাবি ও বিদ্বজ্জনের সব তত্ত্ব যা তার গল্পের মধ্যে রূপকের সন্ধান করে তার থেকে সব সময় নিজেকে দূরে রাখলেও তিনি জানতেন যে আর সকলের মতো তিনিও অজ্ঞান মনের দাস। জানতেন যে একটা জিনিষ অন্য জিনিষের ভাবার্থ বহন করতে পারে। এবং অন্য অনেক লেখকের মতোই ধ্বংস এবং তার সর্বোচ্চ প্রকাশ মৃত্যু সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মৃত্যু– শৃঙ্খলাপূর্ণ ও শৃঙ্খলাহীন, যৌক্তিক ও যুক্তিহীন, অবধারিত ও অগ্রহণীয়।   

বাবার বয়স যখন সবে সত্তরের কোঠায়, বেশ কয়েকবার কেমোথেরাপির সময়ে এবং পরে, তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন কয়েক খণ্ডে তা প্রকাশ করবেন। প্রথম খণ্ড শুরু হয়েছিল বহু পুরনো স্মৃতির হাত ধরে আর শেষ হল তাঁর সাতাশ বছর বয়সে, যখন সাংবাদিক হিসাবে প্যারিসে গিয়েছেন। কিন্তু তারপর আর কিছু লিখলেন না, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সাফল্যের সময়গুলোর কথাই শুধু লিখলে আর সব বিখ্যাত আত্মজীবনীর মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে যাপনের মহিমা কীর্তন করা হবে। যেমন, অমুক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক রাত কি তমুক চিত্রকরের চিত্রশালা দর্শন বা রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র কি এক প্রতিভাধর বিপ্লবীর সঙ্গে জলযোগ।

-আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটাই আমার ভালো লাগে, বাবা বলেছিলেন, কারণ ওর মধ্যেই আছে আমার লেখক হয়ে ওঠার সময়টার কথা।

একবার একটা অন্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন:

-আট বছর বয়সের পর আর আমার জীবনে আকর্ষণীয় কিছু ঘটেনি।

ওই বয়সেই তিনি দাদু-দিদিমার বাড়ি ছেড়ে, আরাকাতাকা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। ছেড়ে এসেছিলেন সেই জগৎ যা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তাঁর প্রথম দিকের সৃষ্টিকে। তিনি স্বীকারও করেছিলেন যে প্রথম জীবনের লেখাগুলোই ছিল ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’-র জন্য হাত পাকানোর আসর।

স্মৃতিকথা লেখার জন্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাবা তাঁর প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই সেই শৈশবের পর আর দেখা হয়নি বা কোনোরকম কোনও যোগাযোগ ছিল না। কয়েকজনের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন, কারণ বন্ধুটি মারা গিয়েছিলেন। জীবনের এই দীর্ঘ পথ পারি দিতে গিয়ে যে কিছু বন্ধুকে ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছেন, এ আশঙ্কা তাঁর ছিল। কিন্তু কয়েকজনের ক্ষেত্রে যখন শুনলেন যে কিছু সময় মাত্র আগে তাঁরা মারা গেছেন তখন খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। তাঁরা সফল জীবন যাপন করেছেন, মোটামুটি সুখী ও সৃষ্টিশীল জীবন ছিল তাঁদের এবং সত্তরের কোঠায় পৌঁছে মারা গিয়েছেন, যা ছিল মৃত্যুর গড় বয়স। তাই ওই সব বন্ধুদের মৃত্যু কোনও ট্র্যাজিক ঘটনা নয়, বরং জীবনচক্রের স্বাভাবিক পরিণতিই বলা যায়। এই সময়টার পর তিনি বলতে থাকেন ‘আগে মারা যাননি এরকম অনেক মানুষ এখন মারা যাচ্ছেন’ এবং নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতেন।

১০

যদিও স্বভাবগতভাবে তিনি মিশুকে ছিলেন এবং আপাতভাবে মনে হত যে বাইরের জগতের সঙ্গে তিনি ভালোই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন, কিন্তু আমার বাবা আসলে খুবই মুখচোরা মানুষ, তাঁকে অন্তর্মুখী বললেও ভুল বলা হবে না। তাই বলে খ্যাতি উপভোগ করতে পারতেন না, তা নয় বা দীর্ঘ সময় ধরে খ্যাতির শীর্ষে থাকার ফলে নার্সিসিজম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন, এমনটাও বলা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমস্ত সময় খ্যাতি ও সাহিত্যিক সাফল্যকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। আমাদেরকে (এবং নিজেকেও) বারবার মনে করিয়ে দিতেন যে তলস্তয়, প্রুস্ত আর বোর্হেস নোবেল পাননি। যেমন পাননি তাঁর প্রিয় লেখক ভার্জিনিয়া উলফ, হুয়ান রুলফো ও গ্রাহাম গ্রিন। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত যে এই সাফল্য তিনি অর্জন করেননি, তাঁর জীবনে ঘটে গেছে মাত্র। কখনও নিজের প্রকাশিত বই ফিরে পড়তেন না (অবশ্য শেষ বয়সে যখন তাঁর স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল তখন এই কাজটা অনেকবার করেছেন)এই ভয়ে যে অসম্পূর্ণতা খুঁজে পেতে পারেন আর সেটা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে ব্যহত করবে।

১১

দু’দিনের জন্য আমাকে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরতে হল। সেখানে একটা চলচ্চিত্রের এডিটিংয়ের কাজ করছিলাম। গল্পটা হল বাবা আর ছেলের। যে দৃশ্যটা নিয়ে তখন কাজ করছিলাম, একটা দীর্ঘ ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্য, সেখানে একটার পর একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাবা ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে এবং তার জন্য সম্ভবত ছেলেটিও খানিকটা দায়ী। দৃশ্যটি খুবই করুণ, একটা দুর্ঘটনার পর সংঘর্ষ হল, তারপর মৃতদেহ বহন করে আনা হল, তাকে ধোয়া হল, তারপর শেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মৃতদেহটি ধ্বংস হয়ে গেল আর এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে গেল বাবা। যখন নিজের বাবার জীবনের শেষ কয়েকটা মাত্র দিন কি কয়েকটা সপ্তাহ বাকি, তখন এরকম একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে যে ভয়ংকর অনুভূতির সম্মুখীন হতে হবে তা কারুর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবুও ঈশ্বরের পরিহাস হিসাবেই তাকে মেনে নিলাম। কিন্তু সময় যত এগোতে থাকল এই দৃশ্যগুলো নিয়ে আর অনায়াসে কাজ করে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আমি শ্রান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম। এই রকম একটা গল্প লেখার জন্য তখন নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তখন প্রচুর চকোলেট খেতাম আর ভাবতাম যে গল্প আমাদের হাসায় সেটা লেখাই বোধহয় সবথেকে ভালো। আমি নিশ্চিত, পরের বার তাই-ই করব। অথবা হয়তো তা করব না।  

চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে কাজ শুরু করার প্রথম দিকে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন কোন কোন শিল্পীর কাজ আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। আমি বেশ সতর্কতার সঙ্গে নামের একটা তালিকা বলতাম। মোটামুটি একটা নিজস্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করতাম, তবে অনেক নামই ছিল অবধারিত। কিন্তু একটা পর্যায়ে পৌঁছে বুঝতে পারলাম যে আসলে আমি সত্যকথন থেকে বিরত থেকেছি। কোনও পরিচালক, লেখক, কবি, এমনকি কোনও ছবি বা গান আমাকে যা প্রভাবিত করেছে তার থেকে ঢের ঢের বেশি প্রভাবিত হয়েছি আমার বাবা-মায়ের দ্বারা, আমার ভাই, আমার স্ত্রী আর আমার মেয়েদের দ্বারা। জীবনের সমস্ত মূল্যবান শিক্ষা মানুষ মূলত বাড়ি থেকেই  শেখে।

১২

এক সপ্তাহের একটু বেশি হল বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছেন, কিন্তু মেহিকো থেকে ফিরে আসার পর মাকে এর মধ্যেই খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার কি মনে হয় যে সত্যি সত্যিই আরও কয়েকটা মাস বাকি। এমনভাবে প্রশ্নটা করলেন যে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই সময়কে ধারণ করার ক্ষমতা তাঁর নেই। বাবার জন্য বাড়িতে অত্যন্ত সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁকে রাখা হয়েছিল প্রধান শোবার ঘরগুলোর থেকে একটু দূরে, দিনে-রাতে সর্বক্ষণ দেখাশোনার লোক ছিল এবং সর্বোপরি তিনি বেশ শান্তই ছিলেন। বাড়ির বাকি অংশে মনেও হত না যে সেখানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে চলেছে। কিন্তু আমার মায়ের কাছে বাবার ওই ঘরটার ঘড়ির টিকটিক শব্দটাকেও মনে হত বড় দীর্ঘ আর গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো উচ্চকিত।

মাকে বললাম, অত দিন বোধহয় পাব না। তবে সেকথা বলেছিলাম শুধুমাত্র মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। পরের দিন সকালে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাবাকে পরীক্ষা করার পর মত বদলালেন: মনে হয় না আরও কয়েক মাস, বড় জোর আর কয়েক সপ্তাহ। মা চুপচাপ কথাটা শুনলেন সিগারেট খেতে খেতে, সম্ভবত একই সঙ্গে স্বস্তি ও বেদনার বোধ তাঁকে ঘিরে ধরল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বছর চল্লিশের একজন বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ এসে মাকে বোঝাতে লাগলেন শেষের সেই সময়ে কিভাবে যত্ন নিতে হবে। তখনও পর্যন্ত যতজন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে তাঁদের মধ্যে ইনিই সর্বকনিষ্ঠ। ব্যাপারটা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল, কেননা এরকম একজন যুবক বার্ধক্যের সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবেন তা আর কে আশা করে। মা তো তাঁকে প্রায় জেরা করলেন, যেমন সবাইকে করেন। চিকিৎসক আমাদেরকে বললেন যে বাবার একটা লিম্ফ নোড ক্যান্সার হয়েছে যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তখন তাঁকে একেবারে অন্যরকম মনে হল, যেন খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন। তাঁর নিজের থেকে বয়সে অনেক বড় রোগীর মুমূর্ষু অবস্থার সামনে তিনি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে পড়েছেন। বললেন যে সেই মুহূর্তটি যখন আসবে, আমরা চাইলে স্যালাইন খুলে দিয়ে সময়কে ত্বরান্বিত করতে পারি। আমাদের ব্যাখ্যা করে বললেন যে কিছু দেশের নিয়ম অনুযায়ী কোনও অবস্থাতেই রোগীর স্যালাইন খুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না, যেহেতু সেখানে জলের প্রয়োজনকে মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে গণ্য করা হয়। কিন্তু মেহিকোর আইন ভিন্ন আর তাই মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে পরিবারের লোকজন স্যালাইন খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয় আর এটা খুব একটা বিরল ঘটনা নয়। তাছাড়া রোগী তখন ওষুধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, ফলে কষ্ট পায় না। নিঃশব্দে তাঁর সমস্ত কথা শুনলাম, যেন কোনও একটি লেখার এক অদ্ভুত স্বগতোক্তি আমরা শুনছি। কথাগুলো নির্দয় এবং অদ্ভুত। বাস্তববাদী, সহানুভূতিপূর্ণ, হননোদ্যত।

১৩

মা আর আমি একসঙ্গে বসে টিভিতে খবর দেখছি, হঠাৎ আমাকে বললেন: “আমাদের তৈরি থাকতে হবে কেননা একটা সার্কাস হতে চলেছে।” বাবার মৃত্যুর মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যম, পাঠক ও বন্ধুদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হবে মা তার কথাই বলছিলেন। বাবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই অসংখ্য মানুষ ফোন করতে ও চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন। তারপর কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ঘোষণা করল যে তিনি বাড়ি ফিরে গিয়েছেন, জীবনের অন্তিম সময়টুকু যাপনের জন্য। তাঁর ৮৭ বছর বয়স, সুতরাং যে কোনও সময়ে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।

ভায়ের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলাম বাবা মারা যাওয়ার পরেই কয়েকজন সাংবাদিক, যাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে, তাঁদের ফোন করতে হবে। তবে সেটা খুব বেশি নয়: কলোম্বিয়ার দুজন, একজন সে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের আর অন্যজন, বছর কুড়ি বয়সে বাবা যে সংবাদপত্রে প্রথম কাজ শুরু করেন, সেখানকার। আর মেহিকোতে দেশের প্রধান সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম এক মহিলা সাংবাদিক, যিনি রেডিও ও টিভির সংবাদের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া কয়েকজন নিকট বন্ধুদের জানাতে হবে, যাঁরা তাঁদের সুবিধামতো খবরটি প্রচার করবেন। এঁদের মধ্যে অবশ্যই ছিলেন বাবার এজেন্ট ও বান্ধবী, বার্সেলোনার এক দম্পতি এবং এক ভাই, যিনি কলোম্বিয়ায় তাঁর পরিবারের অন্যতম মূল স্তম্ভ। যদিও এঁরা সকলেই এই অন্তিম পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন।

টীকা:

১। পেররো বুররো: পেররো অর্থাৎ কুকুর আর বুররো অর্থাৎ গাধা।

২। সিয়েস্তা: ভাতঘুম


আগের পর্ব

গাবো ও মের্সেদেস: চিরবিদায় | দ্বিতীয় পর্ব | ভাষান্তর: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment